উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চৌদ্দ

কথাটা বলে আমার বুকটা যেমন ভরে উঠলাে, তেমনি মিতুলের মুখেও সুখী হাসি ছড়িয়ে রইলাে।
ও আমার হাতটা গালে ঘসলাে। বালিশের ওপর পড়ে থাকা ওর লম্ব বেণী খুলে দিলাম আমি।

দেখে জামী, একটানা শুয়ে থাকার জন্য চুলগুলাে কেমন জট পাকিয়ে গেছে। মিল, তোমার এই
চুলের অরণা আমার প্রিয় বাসভূমি। ওর চোখে ঝিলিক উঠলাে। মিন্টু রেকর্ডে মুকেশের একটা
জনপ্রিয় গান বাজাচ্ছে। ঐ কণ্ঠ যেন আমারই কথা বলে দিচ্ছে। যে কথাগুলাে বলতে না পারার
জনা অহরহ আমার মনটা গুমরে মরে। আমি মিতুলের চুলে হাত ডুবালাম। মিতুল আমার হাতটা
আঁকড়ে শুয়েই রইলাে। পর পর মুকেশের কয়েকটা গান বাজালাে মিনু আমি আর মিতুল চুপচাপ
শুনলাম। কেউ কোনাে কথা বললাম না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলাে। মনে হলাে খালাআম্মা
আর ঝরনা ফিরেছে। আমি উঠলাম। মিতুল কিছু বললাে না। হাত ছেড়ে দিলাে। আমার দৃষ্টি ওর
ফ্যাকাসে পাতলা ঠোঁটে কেঁপে উঠে থেমে গেলাে। ড্রইংরুমে গিয়ে দাঁড়াতেই ওরা ঘরে ঢুকলাে।
আমাকে দেখেই ঝরনা লাফিয়ে উঠলাে, আপনি কখন এসেছেন জামেরী ভাইয়া? অনেকক্ষণ।
তােমার জন্য অপেক্ষা করে হয়রান হয়ে গেছি ।

ইস! তাই বুঝি?

ঝরনা মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলাে। খালাআম্মা হেসে শােবার ঘরে চলে গেলেন। ঝরনা আমাকে এক
কোণায় ডেকে নিয়ে কানে কানে বললাে, জানেন ভাইয়া, আপু। রের যে রে শুধু আপনার নাম বলতাে?

আমি ওর পিঠে দু’কিল বসালাম।

ডোঁপো হচ্ছো।

ঝরনা হাসতে হাসতে অন্য ঘরে চলে গেলাে। মিন্টুর গান বাজানাে শেষ হয়েছে। ও বসে বসে রেকর্ড
গােছাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলাে, আপনার থার্ড উপন্যাসটা কি বেরিয়ে গেছে জামেরী ভাই?

না।

প্রচ্ছদের জন্যে আটকে আছে।

ছাপা তো হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, মাস দুই আগে।

এতদিনেও প্রচ্ছদ হয়নি?

কি করবাে বলাে, আটিস্ট ঘােরাচ্ছে। আজ নয় কাল, কাল নয় পরও, এই তার

উত্তর।

উঃ আমি হলে সইতাম না। সিওর খুনােখুনি হতাে। তাছাড়া আপনাদেরও দোষ আছে জামেরী ভাই,
শুধু প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর কাছে যান। কেন, নতুন শিল্পী খুঁজে বের করতে পারেন না। নতুনদের অনেরে
হাত কিন্তু চমকার। ঐ খুঁজে বের করার অভাবেই তাে আমরা এগুতে পারছি না। এস্টাব্লিশমেন্টের

বিরুদ্ধে যেতে আমাদের যত ভয়।

একদম ট্রু কনফেশন।

মিন্তু হাসলাে। আমি বেরিয়ে এলাম। সিঁড়িতে পা রাখতেই সেই প্যারানয়ার রােগীর একটা শব্দ খট্ করে
আমার কানে বাজলাে। আমি যে সিড়িতেই পা রাখি, সেখান থেকেই সেই শব্দটা উঠে আসছে। মূর্খ !
আমার শরীরে কাঁপুনি জাগলাে। মনে হলাে, ঐ শব্দটা জীবনের সর্বত্র সত্য। কিছুই জানি না। জানতে
চেষ্টা করার আগেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমি খুব আস্তে আস্পাে ফেলে উঠলাম। মনে হচ্ছে,
পারছি না। উঠতে কষ্ট হচ্ছে। সেই সম্রাট জামিলের অসাধারণ দৃষ্টি গােটা সিঁড়ি আলােকিত করে রেখেছে।
আমি প্রচণ্ড মূর্খ, ভণ্ড, প্রতারক। জীবনের সমস্ত অন্ধকারের তলায় চাপা পড়ে আছি। বেরুবার পথ খুঁজে
পাচ্ছি না। নিঃশ্বাস নিতে বড় কষ্ট। কেবল চাপ চাপ অন্ধকারের দলা প্রতি নিঃশ্বাসে বুকের ভেতর ঢুকে যায়।

আমার দু’চোখ ছাপিয়ে জল আসতে চায়। শেষ সিঁড়িতে উঠে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করতে হবে
জানি না । জানি না পথ কোথায় । ভয় হলাে। এখনে বসেই কি আমার সারাজীবন কেটে যাবে? আমার সামনে
দিয়ে ষােড়শ শতাব্দীর ইতালি হেঁটে গেলাে। কাঠগড়ায় গ্যালিলিওকে দেখলাম। আমার সামনে দাউ দাউ করে
আগুন জ্বলে উঠলাে। দেখলাম, ব্রুনাে পুড়ছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ইদানিং খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতাে
হচ্ছে না। শারীরিক দুর্বলতা হতে পারে। পকেট হাতড়ে চাবি বের করে তালা খুললাম। দক্ষিণের জানালা দিয়ে
একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে চোখেমুখে লাগলাে। এক জগ পানি খেলাম। মাঝে মাঝে এমন হয়। নিজের বিরুদ্ধে
কুদ্ধ আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করি। নিজের বিরুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ। যখন শাসন করি, তখন
নিষ্ঠুরের মতাে করি। যখন ভালােবাসি, সে ভালােবাসার গায়ে কোনাে আঁচড় দেই না। এই মন আমার শত্রু।
আমার বন্ধু। আমার প্রেমিক। যখন নিজের সঙ্গে কথা বলি, তখন বড় অন্তরঙ্গ পরিবেশ গড়ে ওঠে। যখন
রাগারাগি করি, তখন মাথা ঝিমঝিম করে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। নিজের সঙ্গে একতরফা আপস
আর হয়ে ওঠে না।

স্টোভ জ্বালিয়ে এক ফ্লাস্ক চা বানালাম। নিজের ওপর জেদ হলাে। আজ রাতে আমি পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লিখবাে।
গত তিন দিনে দশ পৃষ্ঠা লিখেছিলাম । পুরােটা কেটে ফেললাম। মনে হলাে, কিছু হয়নি। আবার লিখতে শুরু
করলাম। একটা গতি অনুভব করছি। ভরসা পাচ্ছি। হয়তাে ভালাে একটা অংশ দাঁড় করাতে পারছি। পাঠক
নিরাশ হবেন না। একটানা পনেরাে পৃষ্ঠা লেখার পর থামলাম। আর এগুতে পারছি না। জানি আর পারবাে না।
চুল ধরে টানলাম। চা খেলাম। পায়চারি করলাম। আবার চেয়ারে এসে বসলাম। কিন্তু কলম বেঁকে বসেছে।
মাথা শুন্য। বিরক্ত হলাম নিজের ওপর। যারা একটানা লিখে যায় তারা আমার বিস্ময়। তারা

আমার নমস্য। আমি তিরিশ লাইন লিখলে দশ লাহন কাটি। কিছুতেই মন ভরে। না। খুঁতখুঁতি থাকে। এই অতৃপ্তি
আমাকে তাড়িয়ে মারে। অতৃপ্তির যন্ত্রণা বরফ – জলে চুবিয়ে নাকানি – চুবানি খাওয়ায়। আমি তখন কাঁদি।
কাঁদতে আমার ভালাে লাগে।

সেই ভালাে লাগা আঁকড়ে ধরে জীবনের বিমূর্ত ব্যঞ্জনায় আমি দিশেহারা হই। কাগজপত্রগুলাে গুছিয়ে রেখে
ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলাম। বাইরে ঘাের অন্ধকার। আজ অমাবস্যা। রাস্তার দুটো বা নষ্ট হয়ে গেছে। মিটমিটে
আলাে ভিখিরির থালার পাই পয়সার মতাে। থাকা না থাকা সমান। চেষ্টা করেও আমি দূরের কোনাে কিছু স্পষ্ট
দেখতে পাচ্ছি না। আসলে এমনি হয়। মাঝে মাঝে আমরা কোনাে কিছুই পরিস্কার দেখি না। আমার বুকে বেদনা।
আমি জানি না, কেন। আমি তাে জানি, শিল্পের কাছে ফাঁকি নেই। ক্ষমা নেই। শিল্প ফাঁকি সহ্য করে না। এবং
ক্ষমাও দেয় না। শিল্পের গােলকধাঁধায় কখনাে পথ হারাই। তখন বিবেক নামক আরিআনি ওপর থেকে রেশমি
সুতােয় ঝাকায়। আমি বুঝি, শিল্প গােলকধাধা। মিনােটওর মহাকাল। মহাকালকে জয় করতে না পারলে শিল্পের
সাধনা মিথ্যে।

বাতি জ্বেলে বই খুঁজতে বসলাম। আজ রাতে ঘুম আসবে না। বইয়ের গাদা থেকে আবু সায়ীদ আইয়ুবের
‘গালিবের গজল থেকে’ বইটি টেনে বের করলাম। গালিব আমার প্রিয়। এই বই আমি অসংখ্যবার পড়েছি।
প্রতিটি শের আমার মুখস্থ। পড়ে পড়ে আশ মেটে না। যখনই পড়ি, প্রতিবারই নতুন মনে হয়।
‘‘দুঃখের রাগরাগিণীর মূল্য বুঝতে শেখাে, হৃদয় আমার; অস্তিত্বের এই বিচিত্র বীণাটি একদিন নিঃশব্দ হয়ে যাবে।”

সব বীণাই একদিন নিঃশব্দ হয়ে যায়। আমি শুয়ে শুয়ে গালিবের জীবনী। পড়লাম শেষ লাইনটা আমার বুকে গেথে রইলাে,
“এতখানি প্রতিভাধর একটি মানুষের জীবন আর একটু কম যন্ত্রণাময় হলে বিধাতার কি ক্ষতি হতাে?”
আমার মনে হলাে, যন্ত্রণা ছিলাে বলেই তার বেদনায় তীব্রতা ছিলাে। সেখান থেকে তিনি পরিশুদ্ধ আনন্দের ফুল চয়ন
করেছিলেন। সে ফুল শতাব্দীকাল পরও অম্লান থাকে। সৌরভ বিনষ্ট হয় না। আমার মতাে কত অসংখ্য জন সারারাত
গালিব পড়ে কাটিয়ে দিতে পারে। দরিদ্র, হতাশা, নিন্দুকের নিষ্ঠুরতা, বিদ্বেষ ক্ষত – বিক্ষত করেছিলাে গালিবকে। কিন্তু
নিঃশেষ করতে পারেনি তার হৃদয়ের অমৃত। সেই অমৃতের স্পর্শে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন অমরতা।

“হে ঈশ্বর , কাল আমাকে মুছে

ফেলছে কেন?

পৃথিবীর পৃষ্ঠার উপর আমি

বাড়তি হরফ হোে নই।”

এই শেরটি আওড়াতে আওড়াতে আমার চোখ বুঁজে এলাে। বিড়বিড় করলাম, কাল তােকে মুছে ফেলেনি।
তুই কালকে জয় করেছিস। তুই শালা হারামি শিল্পের গোলকধাঁধার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার পথ পেলেছিলি ।
তোকে আর পায় কে? তােকে ঈর্ষা করতে করতে আমার ঘুম পাচ্ছে। আস্তে আস্তে আমার ইন্দ্রিয় বধির হয়ে গেলো।

সকালে চোখ ধাঁধানাে আলােয় যখন ঘুম ভাঙলাে, দেখলাম আমার ওপর আলাে জ্বলছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না।
বইটা গড়িয়ে নিচে পড়েছে। ওটাকে তুলে বালিশের নিচে রাখলাম। পাশ ফিরে শুয়ে আর একটু ঘুমােবাে বলে যেই
ঘুরেছি, দেখলাম দোয়েলটা এসেছে। হঠাৎ মনে হলাে, তাঁতখান লেনে আমার এখনাে যাওয়া হয়নি। ওখানে যেতে
হবে। না গেলে মিতুলের বড় ক্ষতি হবে। ঘুম এলাে। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ইউক্যালিপটাসের ফাঁকে ঝকঝকে
আকাশটা টুকরাে টুকরাে হয়ে আছে।

তখন নিঃশব্দে দরজা ঠেলে রায়হান ঢুকলাে। আমি অবাক হলাম। সারারাত আমি দরজা খােলা রেখেই ঘুমিয়েছি
তাহলে? পরক্ষণে হাসলাম। কিইবা আছে আর নেয়ার মতাে! যা সম্পদ, তা আমার বই। এই দেশে বই কেউ চুরি করে না।

কি রে, হাসছিস যে?

এই সাত সকালে কোথেকে এলি?

হাসলি কেন আগে বল?

এমন কিছু নয় সারারাত দরজা খােলা রেখেই ঘুমিয়েছি। পরক্ষণে ভাবলাম, চোরের নেয়ার মতাে কিছুই নেই ঘরে। কেন,
তুই নিজে আছিস তাে? তুই কি কম মূল্যবান?

কিন্তু এ বস্তু তাে বিক্রি করা যায় না রায়হান। যে জিনিসের বিনিময় মূল্য নেই, তাকে নিয়ে লাভ কি?

তা বটে। এখন চা খাওয়া। হকার কাগজ দিয়ে গেলাে। রায়হান সেটায় চোখ বুলােতে লাগলাে। মনে হলাে, ও সারারাত
জেগে কাটিয়েছে। একটু ঘুমােয়নি। মনের মধ্যে আমার সাইকির খবরের জন্যে ঝড়। কিন্তু নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস
করতে পারলাম না। স্টোভে চা বসিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। ঠাণ্ডা পানিতে হাতমুখ ধুয়েও জ্বালা কমলাে না। আরাে বাড়লাে।
সাইকি আমার বুকের মধ্যে ঝকঝকে রূপালি মাছ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সাইকির জন্যে আমার বুকটা এখন সমুদ্র।

রায়হান এক গ্লাস চা খেয়ে আমার বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাে। আমার ঘুম পাচ্ছে জামেরী।

ঠিক আছে, একটা কড়া ঘুম দিয়ে দে।

আমি নির্বিকার। কোনাে রকম আগ্রহ দেখালাম না। জানি, কথা বলার জন্যে রায়হান এসেছে। ভেতরে ভেতরে ছটফট
করছে। ওর বুকটা কথা বলার জন্যে। ফেটে যেতে চাইছে। আমি খবরের কাগজটা মনােযােগ দিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম, ও উসখুস করছে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তেরোউপন্যাস।। সেলিনা হোসেন ।। মগ্ন চৈতন্য শিস ।। পর্ব পনেরো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *