উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব উনিশ

আমি ঘর বন্ধ করে বেরুলাম। আকাশ ফাঁকা। বৃষ্টি নেই। মেঘ নেই। ঝকঝকে রােদ লাফাতে লাফাতে এসে গায়ে সুড়সুড়ি দেয়। রাস্তায় বেরিয়ে আমার সাইকির কথা মনে পড়লাে। আঃ সাইকি, তুমি এখন শােকার্ত এ্যান্ড্রোম্যাকি। তােমার স্বামী। হেক্টরের মতাে বীরের মৃত্যু বরণ করেনি। কিন্তু-তখুনি তীব্র বিবমিষায় আমার কথাটা কেমন পাক দিয়ে উঠলাে। মনে হচ্ছে যত রিকশা আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে, সব রিকশায় সাইকি বসে আছে। পেছনের পর্দা তুলে আমাকে দেখছে। চোখে সেই অবিশ্বাসী ঘৃণা। আমার বুকে লু হাওয়া। আমি ফুটপাথের কৃষ্ণচূড়াে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। মগজে একটা শিরশিরে বােধের বিস্তার হচ্ছে। বাড়ছে ক্রমাগত বাড়ছে। কি যে হলাে আমার। এখন আমি প্রাণপণে মিতুলকে ভাবলাম। চকচকে ডানা দোয়েলটাকে ভাবলাম। ভাবতে-ভাবতে আমার প্রেয়সী আকাশটা। বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলাম। আমার নিজস্ব চেতনার ভুবন। তখুনি রিকশা নিয়ে অফিসে এলাম। দু’গ্লাস পানি খাবার পর মনে হলাে, আঃ শান্তি। ডেস্কে অনেক কাজ ছিলাে। সেগুলাে সারতে সারতে অনেক রাত হয়ে গেলাে। প্রায় তিনটে। তাছাড়া বাড়ি ফেরার কোনাে তাগিদ আমি অনুভব করছিলাম না। তাই অত রাতে ঘরে না ফিরে টেবিলের ওপর শুয়ে কাটালাম। সারারাত মশার দল আমাকে গান শুনিয়ে। আরব সাগরের তীরে নিয়ে গেছে। যেতে না চাইলেও জোর করছে। একটুও ঘুমােতে দেয়নি। সকালে টের পেলাম মাথা ধরেছে। চোখ জ্বালা করছে। জিহ্বা তেতাে বিষাদে ভরা। নিশ্চয় লিভার ফাংশন খারাপ যাচ্ছে। ঘরে ফিরে গােসল সেরে একটা কড়া ঘুম দিতে হবে। এই চিন্তা করতে করতে যখন রিকশা থেকে নামলাম দেখলাম সিড়ির মুখে রায়হান বসে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে আছে। নােংরা এলােমেলাে কাপড়-চোপড়। দু-তিন সিড়ি নিচে স্যান্ডেল পড়ে আছে। কোনােদিকে খেয়াল নেই। সিড়িতে আমার পায়ের শব্দ শুনে মাথা তুললাে। একটু চমকে উঠে তড়বড়িয়ে বললাে, আজ কিন্তু তাড়িয়ে দিলেও যাবাে না। আমি কথা না বলে তালা খুললাম। কথা না বললেও যাবাে না। কিছুতেই যাবাে না। বুঝলাম টেনে এসেছে। আমি ঘরে ঢুকলে আমার পিছু পিছু ঢুকলাে। আমি ওকে কিছু বলতে পারছি না। ও স্বাভাবিক নয়। ও চেয়ার টেনে বসলাে। আমার দিকে চেয়ে রইলাে। আমি ওকে পুরাে উপেক্ষা করে লুঙ্গি তােয়ালে নিয়ে বাথরুমে কলাম। আমি ঠাপ্তা পানিতে গা ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোনাে কিছুই ভাবতে ভালাে লাগছে না। এখন গােসলটাই আমার আনন্দ। আমি গান গাইতে গাইতে গোসল সারলাম। অনেকক্ষণ পর বেরিয়ে দেখলাম রায়হান টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমােচ্ছে। আমি ওকে না ডেকে ওর মুখটা দেখলাম। এমন একদৃষ্টে আমি কখনাে ঘুমন্ত মানুষের মুখ দেখিনি। মাথার মধ্যে চড়চড়িয়ে উঠলাে সেই বােধটা, রায়হান খুনী। কিন্তু খুনীর মুখটা তেমন ভয়ংকর নয়। ওর মুখের প্রতিটি শিরায় অপরাধবােধের একটা চিকন সুতাে টাঙানাে আছে। পরক্ষণে সেটা উড়িয়ে দিলাম। অপরাধবােধে আক্রান্ত হওয়ার মতাে দুর্বল স্নায়ু ওর নয়। কিন্তু আমার দৃষ্টি তাে ভুল হতে পারে না। আমি ভূল দেখছি না। মনটা খচ খচ্‌ করছে। রায়হান কি তবে শুভবুদ্ধির কাছে নতজানু হয়েছে? ওর মুখটা সেই কথা বলছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি জানি না। কখনাে খুনীর ঘুমন্ত মুখ দেখিনি। হয়তাে এটা ওর মুখােশ হতে পারে। কিন্তু না, ঘুমের সঙ্গে ছলনা কি সম্ভব? ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষ কিছুতেই প্রতারক হতে পারে না। ভাবতে ভাবতে চা বানালাম। ওকে ডাকলাম ও চমকে ধড়মড়িয়ে উঠলাে-এ্যাঁ, কি হয়েছে? কি?
চা খাবি না?
চা?
ও ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলাে। যা বাথরুম থেকে মুখটা ধুয়ে আয়।
তুই আমাকে চা খেতে বলছিস?
হ্যাঁ, বলছি। যা মুখ ধুয়ে আয়।
রায়হান শিথিল পায়ে বাথরুমে গেলাে। জামার বােতাম অর্ধেক খােলা। বুকটা উদোম। গেঞ্জি পরেনি। চুলে বােধহয় চিরুনি পড়েনি অনেক দিন। মনে হলাে রায়হান নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। অথচ বিজয়ের কোনাে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। রায়হানের জন্যে আমার ভয় হলাে। মায়া হলাে। মৃত্যুর নিশ্চিত সংবাদ বুকে নিয়ে ও একিলিসের মতাে যুদ্ধ করছে। উঃ রায়হান, তুই কার জন্যে কেঁদে মরছিস? সে তাের নাগালের অনেক বাইরে। রায়হান তুই মরবি। বিজয়ের ফল ভােগ করতে হবে না। তুই মরবি। ট্রাজানদের মতাে তুইও বুঝতে পারছিস না যে, কাঠের ঘােড়া নয়-ভীষণ একটা মৃত্যুর ছায়া তুই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিস।

মুখ ধুয়ে, চুল আঁচড়ে, শার্টের বােতাম লাগিয়ে মােটামুটি ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাে রায়হান। আমার একটা কিছু বলা দরকার অথচ ওর সঙ্গে আমি কি কথা বলবাে বুঝতে পারছিলাম না। ও চায়ে চুমুক দিলাে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কোথায় ছিলি। একসময় আমার চোখে চোখ পড়তে জিজ্ঞেস করলাম, এ ক’দিন কোথায় ছিলি? যশোর গিয়েছিলাম।
কবে এসেছিল?
কাল রাতে।
বাসায় যাসনি?
এত কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
রায়হান দৃষ্টিটা সুচালাে করে আমার দিকে তাকালাে। দৃষ্টিতে সন্দেহ। মনে মনে হাসলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম যে ও খুনী। ও এখন মেপে মেপে কথা বলবে। আমাকেও ওর ভয়। কিন্তু রায়হান তাে এম ছিলাে না।ওর সেই দম্ভ কোথায় গেলাে?
নে বিস্কুট খা।
ও কিছু বললাে না। আস্তে আস্তে চা-টা শেষ করলাে। সিগারেট জ্বালালাে। একমুখ ধোয়া ছেড়ে অনেকটা স্বগতের মতাে বললাে, তিন দিন পর আমি ছন্দাদের বাসায় গিয়েছিলাম জামেরী।
বলিস কি? ভাের এত সাহস?
ওরা তাে আমাকে তেমন কেউ চেনে না। তাছাড়া আমার ভেতরটা কেমন ওলট-পালট হয়ে গেলাে। মনে হতাে ছন্দাকে না দেখতে পেয়ে আমি মরে যাবাে। কিন্তু ওখানে গিয়ে আমার সব এলােমেলাে হয়ে যায় জামেরী। মনের মধ্যে যেন প্রচন্ড বােমা ফাটে। সেই বিধ্বস্ত পরিবেশে আমি কিছু খুঁজে পাই না। মনের সুস্থ অবস্থা তাে নয়ই— কোনাে ভালােবাসাও যেন আর নেই।

রায়হান থামলাে। আমার প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। রায়হানের ঘুমন্ত মুখে আমি এই কথাগুলােই পড়েছিলাম। কিন্তু কেমন করে এটা হলাে? যে দৃঢ়তা নিয়ে ও এগিয়েছিলাে, সেখানে ও টিকতে পারলাে না কেন? সব মানুষই কি একবারের জন্যে হলেও বিবেকের কাছে ফিরে আসে?

ছন্দার বাবা আমাকে বসতে দিয়েছিলাে জামেরী। আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিলাে। আমি খুব সােজাভাবে কোনাে উত্তর দেইনি। আমতা আমতা করে ওদের বন্ধু বলে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা কেউ কোনাে কথা বলছিলাম না। সমস্ত বাড়িটা চুপচাপ। আমি খুব সজাগ হয়ে কান খাড়া করে রেখেছিলাম কিছু একটা শুনবাে বলে। কোথাও কোনাে শব্দ নেই কেন? এ কেমন মৃতপুরী? কেউ কি কিছু করতে পারছে না? কেউ যদি কিছু করতে না পারে তাহলে চিৎকার করে কাঁদছে না কেন? আসলে আমি শব্দ চাই। কোলাহল চাই। এমন নিঃশব্দ। সমাহিত ভাব আমার অসহ্য।

হঠাৎ পাশের ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এলাে। প্রথমে আস্তে। তারপর পর আরাে জোরে। ছন্দার বাবা মুখটা ঘুরিয়ে চোখ মুছলেন। আমার মনে হয়েছিলাে ছন্দার ঐ কণ্ঠস্বর আমি চিনি না। কোনােদিন কখনাে ছন্দা আমার সামনে কাঁদেনি। ফোঁপানির শব্দ চুপে চুপে আমার মগজে ঢুকছিলাে। আমি পাগলের মতাে

আমার সব অনুভূতি বধির করে দিতে চাইলাম। পারছিলাম না। ক্ষিপ্ত সাঁওতাল ছেলেটার একগুঁয়ে তীরের মতাে কান্নার ধ্বনি আমার মগজে বিঁধছিলাে। অনবরত বিঁধছিলাে। আমার চেতনার তলদেশে একটা হিম ঠাণ্ডা স্রোত।

আমি উপলব্ধি করছিলাম ছন্দার বাবা একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই স্নেহপ্রবণ বৃদ্ধ ভদ্রলােকের মুখটা আস্তে আস্তে ছােট হতে হতে হঠাৎ বিরাট জন্তুর মতাে হয়ে যাচ্ছে। আমি অস্ফুট আর্তনাদ করি।

কি হলাে আপনার? খুব খারাপ লাগছে বুঝি? মেয়েটার কেন এমন হলাে বলুন তো?

বৃদ্ধ উঠে আমার কাছাকাছি বসলেন। তাঁর মুখে উত্তরের প্রত্যাশা। বৃদ্ধ আমাকে আপন করতে চাইছেন। আমার মধ্যে আশ্রয় খুঁজছেন। কিন্তু আমি তার দিকে তাকাতে পারছি না। ভয় হচ্ছে। বৃদ্ধ যেন ঈশ্বর হয়ে আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইছেন। আজ আমার শেষ বিচারের দিন। বৃদ্ধ আবার একই কথা আওড়ালেন। স্বগতের মতো।

মেয়েটার কেন এমন হলাে বলুন তাে? কপাল কি এতই খারাপ ওর?
আমি জানি না। আমি জানি না।

আমি বিড়বিড় করি। এ সমস্ত কথায় আমার উৎফুল্ল হওয়া উচিত ছিলাে জামেরী। কিন্তু আমি কিছুতেই জোর করেও খুশি হতে পারছিলাম না। মনের সব বাঁধ যেন ভেঙে গেছে। বৃদ্ধ উদাস হয়ে বলেন, জানেন, ওর জন্মের পর আমার ব্যবসায় খুব উন্নতি হয়েছিলাে। একজন ওর জন্মক্ষণ আর রাশি গুণে বলেছিলাে, ও নাকি যার ঘরে যাবে তার ঘর উজ্জ্বল করবে। লক্ষ্মী-ভাগ্যবতী মেয়ে আমার ছন্দা। আমার ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছিলাে যে, ছন্দা যে ঘর উজ্জ্বল করবে তা আমিই তৈরি করে রেখেছি। ভুল জায়গায় পড়লে সে ঘর উজ্জ্বল করা যায় না। কিন্তু আমি বলতে পারিনি জামেরী।

বৃদ্ধ উঠে পাশের ঘরে চলে যান। ছন্দার কান্না থেমে গেছে। আবার সব চুপচাপ। ছােট্ট নির্জন ঘরটা বিরাট জনপদের মতাে খাঁ খাঁ করছে। অনুভব করি আমার বুকটা কেমন শক্ত হয়ে গেছে জামেরী!

আমি পাগলের মতাে আমার ভালােবাসা হাতড়ে বেড়াই। কোথাও কিছু নেই। সব ফাঁকা। কামালপুরের বাংকারে বসে সমগ্র দেশটাকে যেমন বুকের মধ্যে পুরো আকঁতাম, তেমন করে আর কিছুই পারছি না। এতক্ষণে নিজেকে একটা পুরােপুরি খুন মনে হচ্ছে। শুধু ছন্দার নয়, এখন আমার বুকের বাংকারেও পড়ে আছে একটা লাশ। উঃ আমেরী, তোকে আমি বােঝাতে পারবাে না এ যন্ত্রণার কথা।

রায়হান উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি ওর শেষ কথায় চমকে উঠি। এসব কি বলছে ও? যে রায়হানকে এতদিন ধরে আমি চিনতাম তার বিন্দুমাত্র রেশ ওর মধ্যে নেই।

ঔপন্যাসিক আঁদ্রে জিদের কথা আমার মনে পড়লাে। তিনি কোনাে পরিবর্তরনকে স্বীকার করতেন না, সবসময় বলতেন নতুন জন্ম। রায়হানের এ পরিবর্তনকে নতুন জন্ম ছাড়া আমি আর কিছুই ভাবতে পারলাম না। আসলে আনুষ্ঠানিক জন্মটা কোনাে ব্যাপারই নয়। প্রতিমুহূর্তে মানুষ আপন অন্তরে অন্ধকারে কত নাড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। নাড়ি-ছেঁড়ার হিসেব আমরা পাই না বলে আনুষ্ঠানিক জন্মটা আমাদের কাছে প্রাধান্য পায়। সে জন্মের যন্ত্রণা মতো। নিজস্ব নিয়মের খোলস ভাঙার বেদনা সে প্রাণকে স্ফুরিত করে না। তবুও সেটা। আমাদের জন্যে আনন্দের বার্তা। কিন্তু অন্তরের একলা ঘরে বসে দাঁত কেটে নাড়ি-ছেঁড়া সে যে কি ভয়ানক! রায়হান আমাকে তেমন একটা বােধে ঠেলে দিয়েছে। আমি সে জন্মের রাশি রাশি বেদনার সাক্ষী। এ মুহূর্তে আমি ওর পেছনের অংশটা দেখতে পাচ্ছি। ও জানালার দিকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ভেতরটা কাঁপছে। অস্থিরতা ওর স্নায়ুতে। রায়হানের জন্যে আমার ভীষণ মমতা। দাঁড়িপাল্লায় সাইকির দিকটা অনেক কমে এলাে।

দশ বছরের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর হেলেন ম্যানিলাসের কাছে ফিরে গিয়েছিলাে। সাইকি তার সুখে সংসার করেছিলো। দশ বছরের রক্তাক্ত যুদ্ধের ক্ষত, মৃত্যু, ধ্বংস হেলেন বুকে চেপে রেখেছিলাে। তুমি কি তেমন একজন হেলেন হতে পারলে না? জীবনের সবক্ষেত্রে অনেক ফাঁকি থাকে সাইকি। কখনাে কখনাে সেগুলাের সঙ্গে আপস করতে হয়। নইলে বেঁচে থাকা কঠিন। তােমার নিজস্ব নিয়মকে আমি ভুল বুঝিনি সাইকি। তােমার কথাও আমি অনেক ভেবেছি। ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। এখন মনে হয় যদি তুমি হেলেন হতে অন্তত তােমরা তিন জন মানুষ মরতে না। এখন সবাই মিলে মারা যাচ্ছে। যে রায়হান আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আর কেউ নয়— আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে বলিরত ইফেজিনিয়া। ওর বিবেক ওর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছে। ভুল করে ভুলিয়ে এনে ওর গলায় ছুরি দিয়েছে। আমি যেন ওর কণ্ঠে এখন একটাই চিকার শুনতে পাচ্ছি, বা-বা-বাবা বাবা-বাবা।

আমার চিন্তা ধপ্ করে মাটিতে পড়ে গেলাে। আগামেনন নামক প্রবঞ্চক বিবেক এখন আর ওর চিৎকারে পিছু ফিরে তাকায় না। ওর শাস্তি অনিবার্য। আমার মাথাটা কেমন যেন করছে। নড়ে উঠতে চেয়ারে ক্যাঁচ করে শব্দ হলাে। সে শব্দে চমকে মুখ ফেরালো রায়হান।

দরজার কড়া নাড়ে কে, জামেরী?
দরজা নয় চেয়ারে শব্দ হয়েছে।
আমি শুনলাম দরজায় শব্দ। তুই দরজা খুলিস না জামেরী। ওরা বােধহয় আমাকে ধরতে এসেছে।
কারা?

ঐ যে, যারা সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু ফেরে। ওদের তুই বলিস জামেরী, আমি আর কোনােদিনও খুন করবাে না। কোনােদিনও না।

রায়হান মাটিতে বসে আমার হাঁটু চেপে ধরে। কোলের ওপর মুখ রাখে। আমার অন্তরটা শূন্য হয়ে যায়। বুঝলাম নিজের বিচার ও নিজেই করেছে। শাস্তিও দিচ্ছে নিজেকে।
আচ্ছা জামেরী, তুই কি এখনাে আমাকে ঘৃণা করছিস?
একটুও না।

জামেরী, তা হবে না। তুই আমাকে ঘৃণা কর। ভীষণ ঘৃণা। আমি আর ভালােবাসা চাই না। আমি এখন ভালােবাস ছাড়া বাঁচতে চাই। তুই তাে জানিস না। ইলা এখন আমার বুকে লাশ হয়ে শুয়ে আছে।

কাল সারারাত তাের ঘুম হয়নি রায়হান। তুই এখন একটু ঘুমিয়ে নে।
ঠিক বলেছিস। এজন্যে তাে তুই আমার প্রাণের বন্ধু।
রায়হান বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলাে। মুহূর্তে ও আবার ধড়মড় করে উঠে বসলাে।
জামেরী, তুই কি করে জানলি যে, কাল সারারাত আমি ঘুমােইনি।
তাের চেহারা দেখে মনে হয়েছে।
চেহারা দেখে কি সবকিছু বােঝা যায়?
দেখবার মতাে দৃষ্টি থাকলে যায় বৈকি!
আমি যে খুনী, তা কি ওরা আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারবে?

আমি চুপ করে থাকি। রায়হান উত্তেজিত হয়ে ওঠে। খাট থেকে নেমে আমার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে ঝাকুনি দেয়।
কথা বলছিস না কেন জামেরী?
তাের ভয় নেই রায়হান। চেহারা দেখে কোনাে কিছু বুঝে নেবার মতাে দৃষ্টি ওদের নেই।
বাঁচালি। জানিস জামেরী, আমার যেন কি হয়েছে। সারাক্ষণ মনে হয় কেউ বুঝি আমার পিছু পিছু হাঁটছে।
সব তাের মনের ভুল। তুই যা, একটু বিশ্রাম নে।

রায়হান আর কোনাে কথা না বলে সােজা বিছানায় চলে গেলাে। ও আমার দিকে পিঠ রেখে শুয়ে পড়লাে। ওর চওড়া পিঠটা দেখতে বেশ ভালাে লাগছে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আঠারোউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বিশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *