কবিতা।। বিমল গুহ।। ফেব্রুয়ারি কবিতা উৎসব সংখ্যা



প্রকৃত কবিতা


আমার কবিতার খাতাগুলি রেখে দিয়েছি প্রান্তরের ধুলোর ভিতর
ধু ধু বালিয়াড়ির পৃষ্ঠা খুলে লাল কাঁকড়ার দল লুকিয়ে থাকে যেভাবে
কবিতাগুলি মাথা গুঁজে বিশ্রামরত-
শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন।
কিছু কবিতা বড়বেশি জেদী
পাণ্ডুলিপির পাতা থেকে বেরিয়ে পড়তে চায় দ্রুত,
আর কিছু পাজি কবিতা স্বীকৃতির মালা গলায় ঝুলিয়ে মর্দষাঁড়ের মতো
সদর রাস্তায় যেতে আগ্রহী
শিং উঁচু করে খড়ের গাদায় গুতো দেয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে চায় এইবেলা!
কিন্তু
প্রকৃত কবিতাগুলি পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাজুড়ে স্থায়ী চিহ্ন এঁকে যেতে
প্রস্তুত হয়ে আছে- দেখো ! …

দীর্ঘশ্বাসগুলি

আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলি প্রান্তরের সীমাচিহ্ন ছুঁয়ে
জেগে আছে বাতাসের শব্দের ভেতর।
শতাব্দীর আত্মত্যাগ কী নিখুঁত লেখা আছে
তরুপল্লবের পাতায় পাতায়
আমার প্রজন্ম-বংশধর দেখো-
সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্ভয়ে দীর্ঘ রাস্তাজুড়ে।
এখনও অশুয়া ঝাপটা কোত্থেকে আসে
বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানির মতো দুর্বিনীত প্রেতাত্মার মুখ!
প্রজন্ম-একাত্তর নির্ভয়ে এগিয়েছে ধৈর্যের সীমানা অবধি।
 প্রেতাত্মা কি জানে
আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলি জেগে আছে অনাদিকাল
তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তঋণ নিয়ে! …



দ্রোহ


চুলের গোড়ালি টেনে তুলে আনি রোজ
পোড়ামাটি ছাইভস্ম
ভাঙা সিন্দুকের আস্তরণ
জংধরা থালাবাটি পড়ে আছে মেঝেয়।
ছুড়ে দিয়ে নষ্ট শিস
উলঙ্গ নেচেছে রাস্তায় একদল নষ্ট বালক।
ঝাঁঝালো রোদ্দুরে অহর্নিশ
টোকা দেয় স্মৃতি
গুমরে গুমরে কাঁদে রাত
 জাগে ক্রোধ মাথার ভেতর।
সারিবদ্ধ যমদূত মার্চপাস্ট করে আজো
মগজের কোষে ধমনিতে
মাটি-ছাইভস্ম থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ
জ্বলে ওঠে অস্থিমূলে দ্রোহের আগুন। …


দরজার খিল

আকাশ বিদ্রুপ করে মানুষের মুখে মাস্ক দেখে
হেসে ওঠে ওপাড়ার ছেলে-ছোকরারা,
বর্ণিল মাস্ক পড়ে গর্বে কারো ফুলে ওঠে বুক
ভোরবেলা চোখে ধাঁধা লাগে!
বাস্তবে কী যে দেখি- দরজা নয়
দরজার মতো দুই বিস্তৃত কপাট দুই প্রান্ত থেকে সজোরে সহসা
আমার চোখের মুখে প্রত্যুষে বন্ধ হয়ে যায়!
কলহাস্যে মেতে ওঠে ঘর-
ঘরময় আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে
অন্ধ বাদুরের মতো ভোরবেলা হা-হুতাশ করি
ত্রিভুবন নৃত্য করে মাথার ভেতর –
কোরাসের সুর বাজে,
আমি একা একাগ্র মনে দেখি আকাশের রং
এত্তসব কাণ্ড দেখে হেসে ওঠে দরজার খিল ! …


লাইফ সাপোর্ট


শুধু বালিয়াড়ি শুধু রাশি রাশি জল- সমুদ্র সমুদ্র
চারিদিকে জলের উল্লাস-
এরকম ঘোরের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে আমার সময়।
শুধু বালিয়াড়ি শুধু জল
ভেতরে শৈশবনৃত্য শুধু কোলাহল !
কোথায় কী হলো আজ- আগুনের মতো
সৈকতে তীর্যক রোদ পড়েছে এক্ষণে,
পাশে নৃত্যরত সমুদ্র
জলের উল্লাস- তবু ভেতরে ভেতরে সব
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে মনে হয়;
আগুনের মতো লেলিহান ছিটকে পড়েছে সবখানে
পুড়ে যাচ্ছে বোধ
সমুদ্রের জলও কি টের পায় কিছু?
শুধু জল- শুধু বালিয়াড়ি- শুধু কোলাহল
এ রকম অনুভূত হয়-
যারা মৃত্যুপূর্ব লাইফসাপোর্ট নিয়ে বাঁচে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *