উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব নয়

আজ আমার ছুটি। কাল সারারাত জেগে প্রুফ দেখেছি। ঘুমিয়েছি প্রায় শেষ রাতের দিকে।
মাথাটা টন টন করছিলাে চোখে ব্যথা। ভালাে ঘুম হয়নি। সকালের ঘুম ভেঙে গেলাে। উঠতে
ইচ্ছে করছে না। ইউক্যালিপটাসের পাতার ফাঁক গলিয়ে আলাে এসেছে ঘরে। এই গাছটা আমার
বাবা লাগিয়েছিলেন। ইউক্যালিপটাস তাঁর প্রিয় ছিলাে। তিনি আরাে তিনটে চারা লাগিয়েছিলেন,
সেগুলাে বাঁচেনি। আমার মনে হয় ইউক্যালিপটাসের ঋজু দৃঢ়তা বাবার ভালাে লাগতাে। সেটা
আমারও ভালাে লাগে। মনে মনে হাসলাম। আসলে আমি নিজের ভালাে লাগাটা বাবার ওপর
চাপাতে চাচ্ছি। অনেক সময় এ প্রক্রিয়ায় আমরা নিজেদের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে বেড়াই।
ইউক্যালিপটাসের যে ডালটা জানালার দিকে ঝুঁকে আছে, সেখানে একটা দোয়েল এসে বসলাে।
ক’দিন ধরে দেখছি দোয়েলটা প্রায় এই ডালে এস বসে। বেশ খানিকক্ষণ নাচানাচি করে।
আপন মনেই নাচে। সাদাকালাে এই ছােট্ট পাখিটার আর কোনাে সঙ্গী নেই। কেন যে ও এই
ডালটা পছন্দ করলাে, সেই জানে। তবে আমার জন্যে ও একটা চমৎকার আনন্দ।
দরজায় শব্দ হলাে। আওয়াজে বুঝলাম রায়হান। দরজা খুলতেই হাসলাে।
আজকে জেগেই আছিস দেখছি?
তুই কি আমাকে একটা ঘুমের ডিম ভেবেছিস?
তা নয়। আসলে তুই নিশাচর পাখি কি না। যত কাজ তাের সব রাতে।
আমি হাসলাম। রায়হানের মেজাজটা ভালাে মনে হলাে।আজ চা বানাস নি?
না উঠলামই তাে এইমাত্র। তুই না এলে স্রেফ বারােটা পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে কাটাতাম।
শুয়ে থাকার মতাে আর কিছু আরাম নেই রে!
আমি ঠিক উল্টো। শুয়ে থাকতে বাজে লাগে। সারাক্ষণ কাজ চাই। কাজের শেষে ফুর্তি চাই ব্যস।
রায়হান অকারণে হাে হাে করে হাসলাে। হাত উন্টে গা ঝাঁকালাে শিস বাজালো।
আজ খুব ফুর্তিতে আছিস মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি জামেরী।
কেমন?
বুলেটের বিনিময়ে ভালােবাসা চাই।
কি বলছিস রায়হান?
বােস বােস অত ব্যস্ত হােস না। এখুনি তাে আর কিছু করছি না।
রায়হান পায়ের ওপর পা ওঠালাে। সিগারেট জ্বালালাে একটা। আমাকেও দিলাে আমার হাতের আঙুল কাঁপছিলাে।
ভেতরে উত্তেজনা। সাইকির মুখটা বুকের সঙ্গে লেপ্টে আছে। হঠাৎ বলে ফেললাম,
সাইকি কিন্তু চমৎকার মেয়ে রায়হান।
সাইকি? ও ভুরু কোঁচকালাে।
নিজের ভুল বুঝে লজ্জিত হলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, কি যেন নাম আমি ভুলে গেছি?
ছন্দা।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ছন্দা। ছন্দা কিন্তু—
শােন জামেরী। ও আমাকে থামিয়ে দিলাে। আমি বাজি ধরেছি। নিজের সঙ্গে বাজি।
ছন্দাকে আমার চাই। ছন্দা ছাড়া আমার সব মিথ্যে। অনেকে যে কথা ভুলে গেছে, ছন্দা তা মনে রেখেছে।
ও প্রতিদিন সে কথাগুলাে নিয়ে নাড়াচাড়া করে।হৃদয়ের দোলনায় ঘুম পাড়ায়।
বুকের মধ্যে ভীষণ অসুখ বানিয়ে রাখে। ছন্দা কেন ভুলে যেতে পারে না সব কথা? কি এমন শক্তি ওর মধ্যে কাজ করে ?
এখন ওর বুকের বাংকারে পড়ে আছে একটা লাশ। সে লাশের পচা দুর্গন্ধে আমার ভালােবাসার সৌরভের কোনাে মূল্য নেই।
কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা ছন্দার বুকের বাংকারে শুধু আমি থাকবাে। শুধু আমি।
আর কেউ না। কোনাে লাশ না। ফুলে ফুলে ঢেকে রাখবাে সে লাশের মাংসাশী অস্তিত্ব।
যে জিনিসে আমার লােভ তার থেকে আমি কোনােদিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসিনি। আসবাে না। ছন্দা জানে না,
কি ভীষণ প্রতিজ্ঞা শক্রর পুঁতে রাখা মাইনের মতাে পুঁতে রেখেছি। একটু থেমে রায়হান সিগারেটে জোর টান দিলাে।
এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে আমার ঘরে পায়চারি শুরু করলাে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
সূর্য তখন ইউক্যালিপটাসের মাথার ওপর। দোয়েলটা কখন চলে গেছে টের পাইনি। আমার বুকে চায়ের পিপাসা।
কিন্তু রায়হানের মুখের দিকে তাকিয়ে চলার শক্তির কথা ভুলে। কোনাে কালে হাঁটা – চলা করতে পারতাম কি না সে কথা মনে পড়ে না।
একটা পঙ্গু জীবের মতাে মনে হচ্ছে নিজেকে। নিজের ওপর রাগ হলাে। চেঁচিয়ে বললাম, জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না রায়হান।
বাজে কথা। ঐ পচা কথার বুলি অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে বর্তমানের। আণবিক যুগে আমি আণবিক ভালােবাসা চাই জামেরী?

রায়হান আমার মুখের ওপর ঠা ঠা হাসতে লাগলাে। ওর হাসির একটা নিজস্ব ধরন আছে।
ঐ একই ভঙ্গিতে ও সবসময় হাসে। সে হাসি অনেক সময় আমার কানে ঝিঁঝিঁ ধরিয়ে দেয়।
আসলে সাইকির জন্যে আমার কিছু করার নেই। ওরা দু’জনেই নিশির ডাকে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে।
কে ওদের ঠেকাবে?
আমি জানি জামেরী, তুই সেদিন বুঝেছিস যে ছন্দা আমার হবে না। তােকে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম এজন্যে যে,
হয়তাে তুই ছন্দাকে আমার হয়ে কিছু বােঝাতে পারবি। জানি তুই তাও করবি না।
তােদের মতাে লেখকদের আমি এজন্যে কাপুরুষ বলি। তারা একটা কথাই বুঝিস যে, মনের ওপর জোর চলে না।
যারা দুর্বল তাদের পিছু হটতে হয় বলে ও ধরনের কথা বানায়। কিন্তু আমি অত দুর্বল নই।
নিজের দাবিতে অবিচল থাকাই আমার নীতি। পিছু হটাকে আমি ঘৃণা করি।
ধ্বংসের পথে গৌরব নেই রায়হান।
তােকে উপদেশ দিতে হবে না। তাের ওপর মাঝে মাঝে আমার প্রচণ্ড ঘৃণা হয়। জামেরী তবু তাের সঙ্গ আমি ছাড়তে পারি না।
তার মধ্যে কি যেন একটা আকর্ষণ আছে।
সেটা আমার শুভবুদ্ধি রায়হান।
এজন্য বিকেতাড়িত হয়ে তুই বারবার এখানে ছুটে আসিস।
জানি না, হবে হয়তাে।
রায়হান হতাশ ভঙ্গিতে হাত ওল্টালাে। পরক্ষণেই আমার বিছানার ওপর বসে পড়লাে।
বুঝলাম ওর উত্তেজনা অনেক কমেছে। তবে সেটা বড় ক্ষণিকের।
চা খাবি রায়হান?
না, প্রচুর নাস্তা করে বেরিয়েছি। এক্ষুণি যেতে হবে। অন্যত্র একটা কাজ আছে। রায়হান, তুই মিতুলের মাকে চিনিস?
হঠাৎ এ প্রশ্ন?
আমার কাজ আছে। চিনিস কি না বল?
দেখেছিলাম অনেক আগে। এতদিনে কি আর চেহারা মনে আছে?
কোথায় থাকে জানিস?
না।
ভীষণ মুশকিল। তার ঠিকানাটা আমার দরকার।
তাের মতলব কি বল তাে?
জানিস তাে আমি লেখক। লেখার উপাদান খুঁজে বেড়াই সবসময়।
ভাই বল।
রায়হান হাে হাে করে হাসলাে। আমি রায়হানের কাছে আসল কারণটা চেপে গেলাম।
মিতুলকে ও পছন্দ করে না। মিতুলের বাবা – মার কাছে কিছু লাগালে হয়তাে একটা সাংসারিক অসুবিধা হতে পারে।
বিশেষ করে মিতুলের বর্তমান মা। ব্যাপারটা হয়তাে খুব সুনজরে দেখবে না। মিতুলকে অযথা সন্দেহ করবে।
খিটিমিটি বেধে উঠবে। বুঝতে চাইবে না মিতুলের কষ্ট কোথায়।
ঠিকানা বের করার একটা উপায় আছে জামেরী।
কী?
ভদ্রমহিলা যে স্কুলে চাকরি করতেন, সেখানে গিয়ে খোঁজ করে দেখা যায়।
তুই আমার এ উপকারটা করবি রায়হান?
স্কুলটা আমি চিনি। খোঁজটা এমন কিছু কঠিন কাজ হবে না। চল দু’জনে একদিন গিয়ে খোঁজ করে দেখি।
ঠিক আছে। তাই চল।
আমি আগামীকাল চিটাগাং যাচ্ছি একটা কাজে। সাত দিন পর ফিরে এলে তােকে নিয়ে বেরুবাে। চলি এখন।
রায়হান চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ও এলে আমার ভেতরে উৎকণ্ঠ পাথরের মতাে জমতে থাকে। আমি ওর সামনে ঠিক ততটা সহজ হতে পারি না।
সেদিনের সেই ঘটনা আর সাইকির মুখটা মনে হতে থাকে। কেবলই মনে হয় রায়হান আমার জন্যে একটা দুঃসংবাদ নিয়ে আসবে।
যে কোনােদিন যে কোনাে মুহূর্তে সে ঘটনাটা ঘটাতে পারে। বেলা অনেক হয়েছে। আমি তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম।
ছুটির দিনটা আর শুয়ে শুয়ে নষ্ট করতে চাই না। হাত – মুখ ধুয়ে চা খেয়ে লেখার টেবিলে এলাম। মাথার ভেতরে ঢল নেমেছে।
এখন আমি একটানা কয়েক ঘণ্টা লিখে যেতে পারবাে। ফ্লাস্ক ভর্তি চা নিয়ে বসেছি।
লেখা -পাগল বালজাক সারারাত লিখতেন আর কফি খেতেন। সেই কালাে কফি পরবর্তী জীবনে তার কাল হয়েছিলাে।
আমার অবশ্য সে ধরনের ভয় নেই। বালজাকের মতাে আমি অমন রাতদিন লিখতে পারি না।
আজকে বসার পরই না থেমে আমি একটানা বারাে পৃষ্ঠা লিখে ফেললাম। লিখে আমার মনটা ভীষণ খুশি হয়ে গেলাে।
একটা চমৎকার অংশ লিখতে পেরেছি বলে বিশ্বাস হলাে। মাঝে মাঝে এমন কিছু ভালাে শব্দ লিখি,
যার জন্যে খুশির অন্ত থাকে না। তখন মনে হয় শিল্পের গােলকধাধার পথ চলতে পারছি। গােলক ধাঁধাটা বড় নির্মম।
পাষণ্ডের মতাে আচরণ করে। একটু ক্ষমা নেই। লিখতে লিখতে মেজাজ বিগড়ে গেলাে। লেখাটা এখন আর ঠিকমতাে এগুচ্ছে না।
লেখা থামিয়ে পেছনের দিক থেকে পড়তে শুরু করলাম।তখন মিতুল এলাে দরজা খােলাই ছিলাে।
ও ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাে। আমি মনে মনে তােমাকেই চাইছিলাম মিতুল।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আটউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *