উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব একুশ

এ্যাই জামেরী, দেখ তাে সিঁড়িতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না?
কে?
ঐ যে আমার পিছু পিছু এলাে।
আমি সিঁড়িতে মুখ বাড়িয়ে দেখে দরজা বন্ধ করলাম।
কেউ নেই।

যাক বাঁচা গেলাে। জানিস যখন মনে হলাে তাের এখানে আসবাে তথনই কে যেন আমার পিছু নিলাে। কিছুতেই পিছু ছাড়ছিলাে না।

আমি কিছু বললাম না। আজকে ও বেশ ফিটফাট হয়ে এসেছে চমৎকার দেখাচ্ছে। কিন্তু চেহারার সেই দীপ্তি নেই। ওর আসল মুখটা কেউ চুরি করে নিয়ে ওখানে একটা মাটির মুখ বসিয়ে দিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ঐ ভাবলেশহীন মুখ

আমি চিনতে পারি না।
চা খাওয়া না জামেরী?
বােস।

আমি স্টোভ জ্বালালাম। ও পায়ের ওপর পা তুলে দামি সিগারেট ধরালাে। প্যাকেটটা আমার টেবিলে রাখলাে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে এ্যাসট্রে খুঁজলাে, না। পেয়ে জুতোর তলে দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা চালান করে দিলাে।

জামেরী, ছন্দা এখন আমার জন্যে তৈরি হচ্ছে, না?
হ্যাঁ।
আমার বিয়ের প্রস্তাবটা কিন্তু তােকেই নিয়ে যেতে হবে।
আচ্ছা যাবাে।

তুই বেশ লক্ষ্মী ছেলে হয়েছিস। এমন বন্ধুই আমার ভালাে লাগে। কিন্তু তুই যখন রাগ করিস মনে হয় মরে যাই। আমি ওকে চা দিলাম। ও চায়ে চুমুক দিয়ে আর একটা সিগারেট জ্বালালাে। প্যাকেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলাে।

নে খা।
ঐ সিগারেট আমি খাই না।
তবে কি খাস?
আমি নিজের প্যাকেট বের করলাম।
ফুঃ এ সস্তা সিগারেট খেয়ে ফুসফুসটা ঝাঁঝরা করে ফেলবি নাকি?

আমি হাসলাম। ওর সঙ্গে এখন আর রাগ করা চলে না। যার সঙ্গে রাগ করা যেত সে এখন আর নেই। খাটের নিচে ইঁদুরের চলাচলের শব্দে ও চমকে উঠলাে।

কে দরজায় কড়া নাড়ে?
কেউ না। ইঁদুর।

ও একটুক্ষণ কান পেতে রইলাে। আর কোনাে শব্দ নেই দেখে আশ্বস্ত হালো।
চা ছলকে ওর দামি শার্টে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম, দিলি তো। শার্টটা নষ্ট করে। কি হবে? কাল থেকে এটা আর পরবাে না। জামেরী তুই আর আমি মিলে একটা শার্ট বানাবাে।

তাতে কি হবে?
কেন এক একদিন এক একটা পরবাে।
আমার অত শার্ট ভালাে লাগে না।
তাই নাকি? তাহলে থাক। তাের ভালাে না লাগলে আর বানাবাে না।
তাহলে চল জামেরী আমরা কতগুলাে শাড়ি কিনি।
শাড়ি কেন?
বিয়ের সময় লাগবে না?
কথাটা পাকাপাকি হােক। তারিখ পড়ুক। তারপর কিনবাে।
ঠিক বলেছিস। আগে কিনে লাভ কি?

রায়হান আধ-খাওয়া সিগারেট জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললাে। আমি শুধু ওকেই দেখছিলাম আর হিসেব মেলাচ্ছিলাম।

তাের উপন্যাসটা কতদূর লেখা হলাে রে?
অর্ধেকের বেশি।

জানিস জামেরী, যশােরে একটা দোকানে দেখলাম তাের ‘সরােবরে ঘােলা জল’ বইটা দশ কপি রয়েছে। আমি সবগুলাে কিনে ফেললাম।

অত বই কি করলি?

বন্ধু-বান্ধবদের দিলাম পড়বার জন্য। আর বললাম, এই বইয়ের লেখক আমার ভীষণ ভালো বন্ধু। হ্যাঁ, জামেরী তুই আমাকে বন্ধু মনে করিস তাে?
করবাে না কেন? তুই তাে আমার একমাত্র বন্ধু।
সত্যি? তাহলে চল তােকে আজ চায়নিজ খাওয়াবাে। কাপড় পরেনে। চল বেড়িয়ে পড়ি।
এখন তাে দুপুরের খাবার সময় হয়নি?
হয়নি মানে? বারােটা বাজে। যেতে যেতে হয়ে যাবে।

যাবাে কি যাবাে না দ্বিধায় পড়লাম। রায়হান এখন চমৎকার ভালাে মানুষের মতো কথা বলছে। পরক্ষণে বিগড়ে যাবে। তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। আবার ভাবলাম দুপুরে রান্না করার ঝামেলার চাইতে ওর সঙ্গে যাওয়াই ভালো।

দেরি করছিস কেন জামেরী?
সময় হােক। আস্তে ধীরে যাই।

পটের ভেতর থেকে ভীষণ একটা তেতাে স্বাদ উঠে যেন জিহ্বায় আটকে আছে। রিকশা নিলাম বাসায় ফেরার জন্যে। মেডিক্যালের সামনে মােহনবাঁশি বাজিয়ে এ্যাম্বুলেন্সটি চলে গেলাে। মুকুটের মতাে নীল বাতি মিতুলের নীল বেনারসি হয়ে আমার বুকে আটকে রইলাে।

ঘরে ফিরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রইলাম। জুতাে-জামা খােলারও ইচ্ছে হলাে না। ঠিক করলাম সমস্ত ঘটনাটা মিতুলকে বলবাে। অহেতুক কষ্ট পাওয়ার চাইতে ও জানুক। সবকিছু জেনে বুকটা হালকা করুক। তাতে হয়তাে ওর ভালােই হবে। একটা দিক থেকে ফ্রি হয়ে যাবে। তখুনি দরজায় খুটখুট শব্দ। দরজা খুলতেই মিতুল হুড়মুড়িয়ে ঢুকলাে।

তােমার কি হয়েছে জামী? জানালা দিয়ে দেখলাম তুমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।
চেহারা দেখে মনে হলাে কিছু একটা হয়েছে। কারাে সঙ্গে গণ্ডগােল করােনি তাে?

করেছি।
কার সঙ্গে?
তােমার মা-র সঙ্গে।
আমার মা?

মিতুল কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাে। তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরলাে। চুমু খেলাে। শার্টের বােতাম খুলে দিলাে। আমাকে খাটের ওপর বসিয়ে নিজে নিচে বসে কোলের ওপর মাথা রাখলাে। সেই তেতাে স্বাদটা তখন আমার পেটের ভেতর থেকে বাষ্পের মতাে উড়ে উড়ে আসছে। আমার গলার স্বর কুদ্ধ করে দিতে চাইছে। আমি কি করে মিতুলকে বলবাে? পরক্ষণে নিজেকে শক্ত করলাম। বলতেই হবে। এ খেলা ভালাে লাগে না।

জামী আমার মা-র কথা বলাে।

আমি ওকে হাত ধরে উঠিয়ে পাশে এনে বসালাম। মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম নিজের দিকে। মিতুলের দৃষ্টি এক মুহূর্তে আমার চোখের ওপর থেকে সরতে দেবাে না। আস্তে আস্তে মিতুলকে সব কথা বললাম। একটু বেশি করে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে বললাম। ও নড়লাে না, চড়লাে না, প্রশ্ন করলাে না, কেবল একমনে শুনে গেলাে। শেষ করার পর ভয় পেলাম। মিতুল যেন কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঐ চাউনি আমি চিনি না। হঠাৎ ও শব্দ করে হেসে উঠলাে।

জানাে জামী, বাবা না আজকাল আমাকে ভীষণ আদর করে। কেবল ঘুরে ফিরে জিজ্ঞেস করে, এখানে বিয়ে হলে আমি সুখী হবাে কি না। তুমি বলাে জামী, এসব প্রশ্নের কি উত্তর হয়? তােমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে সুখ কি জানতাম না। এখন জানি। জানি বলেই উত্তর দিতে পারি না। আসলে আমার মনে হয় কি জানাে, বাবা আমাকে প্রশ্ন করার মধ্যে দিয়ে নিজের অন্তরটা হাতড়ে দেখে। তা-ও বােধহয় নয়।

বাবা সব সময় আমাকে আগলে রাখতে চায়। কষ্ট থেকে আগলে রাখা আর কি! বুঝতে দিতে চায় না কিছুই। আসলে সেটাই বাবার ভুল। বাবার উচিত ছিলাে আমার সঙ্গে খােলামেলা হওয়া। বর্তমান মা-ই আমার আপন মা এই পরিচয়ে বাবা আমাকে বড় করেছে। কিন্তু তা-ও কি আমাকে আড়াল করে রাখতে পেরেছে? সে আগুন বাবার অজান্তে আমাকে স্পর্শ করেছে। এখন পুড়িয়ে মারছে।

মিতুল দু’বার ঘরে পায়চারি করলাে। আমি জানালার বাইরে অনির্দিষ্ট শূন্যে

তাকিয়ে রইলাম। আমার প্রিয় আকাশ থেকে অনেকদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। অনেকদিন আমি আমার মতাে করে দিনের এবং রাতের আকাশ দেখিনি। কেমন করে ভুলে গেলাম? কেমন করে ? মিতুল গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালাে । ওকে আমি বুঝতে পারছি না। মাকে নিয়ে ও এখনও একটি কথাও বলেনি । কেবল শুনেছে । তারপর বাবার কথা বলছে। কেমন জানি ঘটলাে ব্যাপারটা । মিতুলের শরীরটা কাঁপছে। ও শক্ত করে দু’হাতে জানালার শিক ধরে আছে। মিতুল কি কাঁদছে? কাছে গিয়ে পিঠে হাত রাখতেই ফুঁপিয়ে উঠলাে। অনেক পরে আস্তে আস্তে বললাে , জামী, তবু আমি একবার মা – র কাছে যাবাে। তুমি নিয়ে চলাে।

যদি দেখা না করে?
ফিরে আসবাে।
তবু যাবে?
হ্যাঁ, যাবাে।

বুকের জ্বালাটাকে চিরদিনের জন্যে শেষ করে দিতে চাই জামী।
তারপর শুধু তুমি আর তুমি। আর কেউ থাকবে না আমার ভাবনায়। আমি ভীষণ ভালাে মেয়ে হয়ে যাবাে। এই তােমাকে ছুঁয়ে বলছি।

বেশ , চলাে । সামনের শুক্রবার যাবাে।
মিতুল আর কিছু না বলে বাথরুমে গেলাে। ও এই মুহূর্তে একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেললো।
রাখতে কি পারবে? ও রাখতে না পারলেও আমাকে চেষ্টা করতে হবে।

নইলে ওকে হারাবাে। একবার ভাবলাম , মিতুলকে শাড়িটা দেখাই। পরক্ষণে মনে হলাে , না থাক। শাড়ি দেখে আর সব দুঃখ ভুলে যাবে তেমন মেয়ে মিতুল নয়।

ভালাে করে হাতমুখ ধুয়ে এসে মিতুল হাসলাে।
মাঝে মাঝে তােমাকে খুব কষ্ট দেই, না জামী?

ওকে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। চোখ জোড়া ফোলা ফোলা। নাকের ডগা লাল আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাসলাম। ভালাে লাগলাে যে মিতুল এখন সম্পূর্ণ আমার আশ্রয়ে ফিরে এসেছে।

হাসছো কেন?
কষ্ট-টষ্ট সব ভুলে যেতে পারি একটা শর্তে।

চক তখুনি খাটের নিচে ইঁদুরটা কি ধরে যেন নাড়া দিলাে। রায়হান দৌড়ে বাথরুমের সামনে চলে গেলাে।

কে এলাে জামেরী?
কেউ না ইদুর শব্দ করেছে।

ইদুর বুঝি অমন কড়া নাড়ার মতাে শব্দ করতে পারে? তাের এখানে আর এক মুহর্ত থাকা যাবে না। কেউ না কেউ কেবল কড়া নাড়তে থাকে। চল যাই। অগত্যা কাপড় পরে ওর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। আমি হাঁটতে চাইলাম। ও রিকশার জন্যে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রইলাে। হাঁটতে ওর ভালাে লাগে না। হঠাৎ মনে হলাে পাশ দিয়ে যে রিকশাটা গেলাে ওটায় সাইকি বসে। আমি একটুও ভুল দেখিনি। মনটা খচ খচ করতে লাগলাে। ওর সঙ্গে বুড়ােমতাে আর একজন মহিলা ছিলাে। সাইকি কি রায়হানকে দেখেনি? নিশ্চয়ই দেখেছে। ও কি ভেবেছে কে জানে। চাইনিজ রেস্তোরার আধাে অন্ধকারে বসে আমি ঘামতে লাগলাম। রায়হানের মুখের দিকেও তাকাতে পারছিলাম না।

তুই হঠাৎ অমন চুপ হয়ে গেলি কেন জামেরী?
একটা কাজের কথা মনে হলাে। এক জায়গায় যেতে হবে।
কখন?
দুটোর মধ্যে।
তাহলে তাড়াতাড়ি খেতে হয়।

রায়হান বেয়ারাকে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে বললাে। বেয়ারা চিকেন কর্ন সুপ দিয়ে গেলাে। এই সুপটা আমার প্রিয়। কিন্তু আজ আমি খেতে পারলাম না। কেমন তেতাে লাগছে। আমার মনে হচ্ছে, বুকের কাছে সবকিছু আটকে যাচ্ছে।

তুই খাচ্ছিস না কেন জামেরী?
খাচ্ছি তাে।
ভালাে লাগছে না খেতে।
বােধহয় বাসী সুপ দিয়েছে।
না না, ঠিক আছে। আমি খাচ্ছি।

ও বেয়ারাকে ডাকতে যাচ্ছিলাে। আমি থামিয়ে দিলাম। রেস্তোরায় বসে ও অযথা হৈ চৈ করুক এটা আমার কাম্য নয়। আমি এখান থেকে চলে যেতে পারলেই

বাচি। সাইকির চোখে আমি চোখ ফেলতে পারিনি। পারলে সেই অবিশ্বাসী ঘৃণাই দেখতে পেতাম। ও নিশ্চয়ই আমাকে খুনী ভাবলাে। ধুত শালা, তুই খাচ্ছিস না আর আমার খাওয়াটাও মাটি করলি। তুই খা না। জানিস তাে আমি এমন অল্পই খাই। রায়হান আমার ওপর বিরক্ত হলাে। আমি তখনাে সাইকির কথা ভাবছি। ভালাে ভালাে যে রায়হান সাইকিকে দেখেনি। দেখলে একটা হুলস্থূল বাধতাে। ওর মাথায় রক্ত উঠতাে। এতক্ষণে মনে হলাে রায়হান সঙ্গে ছিলাে বলেই সাইকি পেছনের পর্দা তুলে আমার দিকে তাকায়নি। সেই ছুরির মতাে ঠাণ্ডা দৃষ্টিটা যেন আমার কলজেয় বিধে আছে।

আমার মতাে রায়হানও অর্ধেক খেয়ে বেরিয়ে এলাে। বেশির ভাগ খাবার পড়েই রইলাে। আমার ওপর বিরক্ত থাকার দরুণই ও বেরিয়ে আমার সঙ্গে কোনাে কথা না বলে রিকশা নিয়ে চলে গেলাে। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম কোথায় যাবাে? রায়হানের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে মিথ্যে কথা বলেছি। মাথার ওপর গ্যালিলিও আকাশে শাণিত রােদ্দুর। প্রচণ্ড প্রতাপে দাপট দেখাচ্ছ। প্রজার ওপর অবিবেচক জমিদারের ক্রুর দৃষ্টি। রাস্তায় পিচ গলছে। ঘরে ফেরার ইচ্ছে নেই এখন। শরাফীর ওখানে যাবাে বলে টিক করলাম। আবার মনে হলাে রেজার ওখানে গেলে মন্দ হয় না। রায়হানের ব্যাপারটা আলাপ করা দরকার। ওর চিকিৎসার প্রয়ােজন।

রেজা আমাকে দেখে ওর স্বভাব অনুযায়ী হৈ চৈ করে উঠলাে। পচা একটা দুর্গন্ধ হালকাভাবে আসছে। সেই সঙ্গে ফিনাইলের তীব্র গন্ধ। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। তবুও ভ্যাপসা গরম। রুমাল বের করে মুখ মুছি।

তাের খবর কি জামেরী? অনেকদিন আসিসনি?

জানি তাে দেখা হলেই এই একটা কথা তুই আগে বলবি। অভিযােগটা আগে করে নেয়া ভালাে। নইলে তুই আবার এক হাত নিবি।
নারে তাের ওপর সব দাবি দাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কোনাে অভিযােগ নেই।
ভালাে হলাে না জামেরী। একটু অভিমান রাখিস সেটা আমার ভালাে লাগবে।

তাের কাজের ডিস্টার্ব করছি না তাে?
ভালাে করে বােস। অত ফর্মাল হতে হবে না।
রেজা আমাকে সিগারেট দিলাে।
জানিস আমার সেই প্যারানয়ার রােগী তােকে একদিন খুঁজছিলাে।
তাই নাকি? এখনাে আছে?
না। অনেকদিন হলাে চলে গেছে।
আমি তখন একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে আস্তে আস্তে রায়হানের সব কথা বললাম।
রেজা কোনাে প্রশ্ন না করে নিবিষ্ট মনে শুনলাে। আমি থামতেই বললাে, কেস অব সিজোফ্রেনিয়া, ভালাে একজন সাইকিয়াট্রিস্ দেখানাে দরকার।

অসুখটা বুঝলাম না?

এই ধরনের রােগী প্রতি মুহূর্তে সন্দেহ করে। কেউ কথা বললে মনে করে ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, নিজে নিজে কথা বললে ভাববে কেউ বুঝি ওর কথা আড়ালে
দাঁড়িয়ে শুনছে। এই ধরনের বিচিত্র ব্যাপার আর কি?
এই মানসিক অবস্থা বেশিদিন চললে পাগল হয়ে যেতে পারে?
হা, তা পারে। তবে ঠিকমতাে চিকিৎসা হলে ভালােও হয়ে যায়। আমার পরিচিত দুজনকে ভালাে হতে দেখেছি। এখন একদম নর্মাল। তবে এ ধরনের
লােককে সব সময় স্বাভাবিকভাবে থাকতে দিতে হয়। যে-কোনাে ধরনের মানসিক প্রেসারে আবার অসুস্থ হতে পারে।

রায়হানের কেসটা কিন্তু জটিল রেজা। যে ওকে স্বাভাবিক রাখতে পারবে সে ওর নাগালের বাইরে।

এ কথাটিই আমি তােকে বলতে চাচ্ছিলাম জামেরী। ওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কি তাের ঠিক হচ্ছে? হাজার হলেও রায়হান খুনী। দেশে আইন-আদালত রয়েছে। কিন্তু ওর যা অবস্থা ওকে আমি তাড়িয়ে দিতে পারি না রেজা। এখন পর্যন্ত ওকে যখন গ্রেফতার করা হয়নি তখন মানসিক হাসপাতালে পৌছে দেয়া আমার কর্তব্য। তারপর দেশের আইন ও বুঝবে। আমি তাে কোনাে অন্যায় করিনি।

আইনের প্যাচ বড় শক্ত জামেরী। কোনখান দিয়ে কিভাবে জড়িয়ে পড়বি বুঝতেও পারবি না। একজন খুনীকে তুই প্রশ্রয় দিচ্ছিস তা ভুলে যাস না। কিন্তু এই মুহূর্তে ও খুনী নয়, রােগী। অসুস্থ। ওকে আশ্রয় দেয়া আমাদে মানবিক দায়িত্ব।

তুই হলে কি করতি? পারতি তাড়িয়ে দিতে?
কি জানি, হয়তাে পারতাম না। কিন্তু আইনের দিকটা ভুললেও চলবে না।
জানিস তাে অনেক সময় একচুল এদিক-ওদিকের জন্যে বিনা অপরাধে কেউ সারাজীবন কারাগারে কাটায়। সত্যি বলতে কি এই সব ব্যাপারগুলােকে আমি ভয় পাই।

অহেতুক জুজুবুড়ির ভয়ে রায়হানকে আমি ফেলে দিতে পারি না। ওকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেই। তারপর ওখান থেকে যদি পুলিশ ওকে ধরে আনে তাহলে আমার দুঃখ থাকবে না।

দেখ যা ভালাে বুঝিস কর।
আর একটা সিগারেট দে।

সিগারেট দিয়ে রেজা চা আনালাে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এমারজেন্সিতে এ্যাম্বুলেন্স এলাে। সেই শব্দ পাচ্ছি। কে যেন এসে রেজাকে ডেকে নিয়ে গেলাে।

মনে হচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়ায় আমি তলিয়ে যাচ্ছি। ভীষণ ধোঁয়া আমার চারপাশে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সেই নীলাভ ধোঁয়ায় রেজা, রায়হান, শরাফী, সাইকি, মিতুল সবাই ঢাকা পড়েছে। আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। একে একে সবাই তলিয়ে গেলাে। কেবল আমি একলা ধোঁয়ার ভেতর সাঁতার কাটছি।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বিশউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বাইশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *