উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তেরো

উপদেশ দিস না জামেরী। উপদেশ শুনতে আসিনি।
কি করবি?

বুলেটের বিনিময়ে ভালােবাসা চাই। ছন্দাকে আমার হতেই হবে। আমার একটা কথা শুনবি রায়হান? না। তাের সামান্য উপদেশে আমার ভেতরে কিছু কাজ হবে না এখন।তােকে খবরটা জানাবার জন্যে এসেছিলাম। তাছাড়া তাের একটা কাজের দায়িত্ব ছিলাে আমার ওপর।
চল আজ সেটা সেরে আসি।
চল।
দু’জনে বেরিয়ে এলাম। রিকশা নিলাম একটা। মাথার ওপর রােদের দাপট। রােদ থেকে যেন ভাপ উঠছে। রােদে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারি না মাথাটা ঝিমিঝিমিয়ে ওঠে। রায়হান চুপচাপ। ও আজ বেশি কথা বলছে না কেন? ওর ভেতরে ভয়ানক একটা আলােড়ন চলছে নিশ্চয়। হেডিসের তিন মাথাঅলা কুকুরের মতাে ওর চারদিকে এখন মাথা গজিয়েছে। ও বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুঁসছে।
উঃ সাইকি তুমি পালাও। অনেক দূরে পালিয়ে যাও।
কিরে বিড়বিড় করছিস কেন?
রায়হান আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতাে দিলাে। একটা হিসেব মেলাতে চাইছি। কিন্তু কিছুতেই মিলছে না। রায়হান শব্দ করে হাসলো। মনে মনে হিসেব মেলানাে যায় না। তার জন্যে চাই এ্যাকশন। তােদের মতাে দুর্বলচিত্তের লেখকরা কি হিসেব মেলাবে বল? রায়হান এখন চিন্তার রকেটে উঠেছে। সে গতির সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সাধ্য আমার নেই। আমি জানি ও আজ অনেক কিছু ভাবছে। ভেবে ভেবে পন্থা বের করবে। সে পন্থায় পিষে মারবে সাইকিকে।

জামেরী দেখ তাে আমাদের ফলাে করে কোনাে রিকশা আসছে কি না?
কি যে বলিস? কে আমাদের ফলাে করবে?
করতে পারে। আমি এখন অনেক কিছু ভাবছি কি না! তুই দেখ না তাকিয়ে?
পেছনে তাে সারি সারি রিকশা আসছে। কোনটা আমাদের ফলাে করছে কেমন করে বুঝবাে?
তুই তাহলে লেখক কেন শালা?
ও আমাকে আবার কনুই দিয়ে গুঁতাে দিলাে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলাে।লেখক কিন্তু ডিটেকটিভ নই শালা। যতসব আজগুবি চিন্তা। আমার মৃদু ধমকে কাজ হলাে। রায়হান আর কোনাে কথা বললাে না। ওর আচরণগুলাে আমার কাছে বেখাপ্পা লাগছে। ওতাে ঠিক এ ধরনের আচরণ করে না। এ পর্যন্ত আমি দেখিনি। কোথাও কিছু একটা গলদ হয়েছে। মনে হচ্ছে ওর ভেতৱের নদী বাঁক বদলাচ্ছে। অথচ একগুঁয়ে জেদি বাছুরের মতাে পাড় ভাঙছে। ভীষণ একটা পরিবর্তন আসছে রায়হানের।

মালিবাগের যে জায়গায় এসে আমরা থাকলাম, তার দু’তিনটে বাড়ি পরেই সেই স্কুলটা। কতকাল আগের কথা। ছােটবেলায় রায়হান এ পাড়ায় থাকতাে। কেবল মিতুলের মা-র নামটা মনে আছে। প্রথমে দারােয়ানকে জিজ্ঞেস করলাে রায়হান।
আয়শা আপা আছেন?
আছেন।
একটু ডাকো তাে, আমার দরকার আছে।
দারােয়ান ভেতরে গেলাে। আমি দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেমন হবে মিতুলের মা? মিতুলের আকাক্ষিত মা! এই মাকে দেখার জন্যে অনেক তৃষ্ণা ওর বুকে। আমি প্রথমে কি কথা বলবাে তার সঙ্গে? একটু পর দারােয়ান ফিরে এলাে। না, উনি নেই। ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন। ওনার বাচ্চার অসুখ।
বাসা কোথায়?
২/১, তাঁতখান লেন।
দারােয়ানের কাছ থেকে ভালাে করে লােকেশনটা চিনে নিয়ে দু’জনে ফিরে এলাম। নির্জন রাস্তা। রায়হান দু’একবার চমকে পিছন ফিরে তাকালাে মনে হচ্ছে, কারা যেন আসছে!
তােকে ঠিক ভূতে ধরেছে। তাের হয়েছে কি বল তাে?
রায়হনি হাসলো।
তুই বুঝবি না জামের ! আমি কেবল একটা নদী পার হয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বড় রাস্তায় এলাম। গলিটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন ছিলাে। দু’পাশের বাড়ির দেয়াল উপচে ডালপালা নেমেছে রাস্তার দিকে। রায়হানকে বললাম ’চল, গলিটায় আর একবার হেটে আসি।
কেন? ও অবাক হলো।
এমনি হাঁটতে বেশ ভালাে লাগছে।
এবার দেখি ভুতে তােকে ধরেছে। আমার অনেক কাজ আছে জামেরী।আমি চললাম। তুই ঐ ঠিকানা খুঁজে মিতুলের মা-র সঙ্গে আলাপ করে নিস।

রায়হান একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলাে। আমি পথে দাঁড়িয়ে গাড়ি দেখলাম, মানুষ দেখলাম। মাথার মধ্যে ঘুরছে ২/১, তাঁতখান লেন।আমাকে এখন ঐ গলিটা খুঁজতে হবে। একটি মুখ বের করতে হবে।আমার মিতুলের জন্যে আমার সামনে এখন কেবল একটা গলি। কিন্তু গলিটাকে এত দূর মনে হচ্ছে কেন? পথের দিকে তাকালে কেবল পাহাড় ভেসে ওঠে। অগণিত পাহাড়। কেমন করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবাে? কি বলে পরিচয় দেবাে? মনে হচ্ছে, এমন কঠিন সমস্যায় আমি আর কোনােদিন পড়িনি। তবু একটা রিকশা ডেকে উঠলাম। কিন্তু মেডিক্যালের সামনে এসে আমার মন ঘুরে গেলাে। মনে মনে ভাবলাম, আজ থাক। আর একদিন যাবাে।
এক মহিলা তার পঁচিশ বছর আগের ইতিহাস ঢেকে রেখেছে সঙ্গোপনে। সে জীবনের প্রতি তার কোনাে আকাক্ষা আছে কি না, আমি জানি না। আর একটি মেয়ে সে ইতিহাসের তৃষ্ণায় ব্যাকুল। শুধু ব্যাকুল নয়, সে তৃষ্ণা তার জীবন-মরণ সমস্যা। আমি এ দুয়ের যােগসাধনের সেতু। আমার আরাে একটু প্রস্তুতি দরকার। আসলে ভয় জোড়া লাগাতে গিয়ে আমি যদি পুরােটাই ভেঙে ফেলি? সে বেদনা মিতুল সইতে পারবে না। তাই আপাতত তাঁতখান লেন মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে রেজার খোঁজে হাসপাতালে ঢুকলাম। সেই বিচিত্র শব্দে নীল বাতির মুকুট মাথায় এম্বুলেন্সটা বেরিয়ে গেলাে আমার পাশ ঘেঁষে। দাঁড়িয়ে সে শব্দ শুনলাম। রেজা আমাকে দেখে হাসলাে।

কি রে, অনেকদিন লাপাত্তা? আমি ভাবলাম, তুই আবার কোন গুহায় গিয়ে ঢুকলি? বেঁচে আছি না মরে গেছি, নিজেও তাে একবার সে খোঁজ নিসনি? কেবল আশা করে থাকিস কখন এসে আমি দেখা দেবাে। সত্যি, জামেরী এত ব্যস্ত যে, দম ফেলার সময় নেই। গত মাসখানেক ধরে কি যে হয়েছে, রােগীর সংখ্যা ভীষণ বেড়ে গেছে। জানিস, রােগের মৌসুম ছাড়াই। কোনাে কোনাে সময় এমন হয়। রােগীর সংখ্যা হঠাৎ করে বাড়তে থাকে।তারপর, কেমন আছিস বল?
আমি ভালাে। মিতুলের জ্বর।
তাহলে তাে তুইও ভালাে নেই দোন্ত।
রেজা আমার পিঠ চাপড়ে হাে হাে করে হাসতে থাকে। আমিও তিন-চারদিন হলাে।
তাের পৃথিবী এখন অন্ধকার, কি বলিস?
একরমক তাই।
মনের গুমােট ভাবটা কেটে যাচ্ছে। এ কয়দিন কে যেন আমাকে ভীষণ অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখেছিলাে। কিছুতেই বেরুতে পারছিলাম না। তুই এখন কি লিখছিস জামেরী?
একটা বড় উপন্যাসে হাত দিয়েছি। পঞ্চাশ পৃষ্ঠার মতাে লিখেছছি।
গুড তুই একটা ভালাে কিছু করবি মনে মনে আমি এটাই চাই। রেজার উচ্ছ্বাসে আমি হাসলাম। ও সবসময় আমাকে এমন ভঙ্গিতে উৎসাহিত করে। ও আমার অকৃত্রিম বন্ধু। ওর মধ্যে কোনাে বিদ্বেষ নেই। ওর ঐ সহজ সরল দ্বিধাহীন আবেদন আমার ভালাে লাগে। যে জন্যে আমি ওর কাছে ছুটে ছুটে আসি।
মনে হয় সাহিত্যিক বন্ধু শরাফীর কাছে আমি যতটা স্বস্তি না পাই, রেজার কাছে তা পাই। রেজা বেয়ারা ডেকে চা আনতে বললাে।
আমি তােকে ডিস্টার্ব করছি না তাে?
মােটেও না। এতক্ষণ কাজের চাপে হিমশিম খাচ্ছিলাম। এখন একটু ফ্রি। তােকে একজন ইন্টারেস্টিং রােগী দেখাবাে।
কেমন?
প্যারানয়ার রােগী।
বুঝিয়ে বল।
প্যারানয়ায় আক্রান্ত রােগীরা সবসময় নিজেকে অনেক বড় ভাবে। নিজে যা নয়, তার চাইতে অনেক বেশি। এই ছেলেটি গত বছর পাস করে বেরিয়েছে। লেখালেখির দিকে ঝোঁক আছে। মাস দুই আগে থেকে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়। এখন বেশ অসুস্থ। ওর মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা চলছিলাে। কিছুদিন আগে জণ্ডিস হয়েছে। এখন আমাদের এখানে। একঘেয়ে অসুখের মাঝে এ ধরনের দু’একজন ব্যতিক্রমী রােগী কিন্তু ভালাে লাগে জামেরী। তুই দেখি কট্টর ডাক্তার হতে পারলি না। এখনাে ভালােমন্দ খুঁজিস। রেজা হাসলাে। বেয়ারা চা দিয়ে গেলাে। চা খেতে খেতে রেজার প্যারানয়া শব্দ আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলাে। আমি গন্ধ শুঁকলাম। আমার নিজস্ব নিয়মের গন্ধ। মনে হলাে, এ ধরনের লােক নিয়ে উপন্যাসের চরিত্র হয়। আসলে আমরা আপাত সুস্থ লােকেরাও প্যারানয়ার রােগী। আমরা কেউ নিজের মূল্যকে সঠিক বিচারে দেখি না। একটু বাড়িয়ে দেখতেই ভালােবাসি। চা খাওয়া হতেই রেজা তাড়া দিলাে চল যাই জামেরী। আবার দশ মিনিট পর ডিউটি আছে। আমরা যখন সতেরাে নম্বর ওয়ার্ডের তিন নম্বর বেডের সামনে এলাম, দেখলাম সেই ছেলেটি চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। জামিল রেজা ডাকলাে। ও চোখ খুললাে না।
মহামান্য সম্রাট জামিল রেজা একটু জোরে ডাকলাে।
বলাে। ও চোখ না খুলেই বললাে।
আজ আপনি কেমন আছেন?
ভালো।
আপনার সঙ্গে একজন অধম দেখা করতে এসেছে।
কি চায়?
কথা বলতে চায়।
ও কি লেখাপড়া জানে?
সামন্য জানে।
আমার মহাকাব্য পড়েছে?
কোনটা?
মূৰ্থ। নামও জানে না।
মহামান্য জামিল, তা নয়। আপনার তাে অনেক মহাকাব্য, কোনটার কথা বলছেন বুঝতে পারিনি।
ইলিয়াড।
জামিল গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলাে। আমি হাসি চাপতে পারলাম না। শব্দ বেরিয়ে গেলাে।
হাসে কে? হুক্কার দিয়ে উঠে বসলাে ও।
মূৰ্থ, মূর্খ। সব মূখ। লেখাপড়া শিখলে কেউ হাসতে পারে। এজন্যে তাে এদের আমি দু চোখে দেখতে পারি না। মহামান্যের দরবারে এসে হাসি? সাহস তাে কম নয়।
জামিল বালিশের ওপর একটা ঘুষি দিলাে।
শুনুন সম্রাট, এ কিন্তু আপনার মহাকাব্য পড়েছে।
রেজা বিনীত ভঙ্গিতে বললাে।
পড়েছে? মূৰ্থ বুঝেছে কিছু?
জামিল চোখ বড় করলাে। আমার মনে হলাে ওর চোখে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি আছে। ঝ্কঝক ধারালাে ছুরির মতাে। এ দৃষ্টি ঔপন্যাসিকের। যে- কোনাে তুচ্ছ জিনিসের ওপর তীব্র আলাে ফেলতে পারে। সে আলােয় বালি থেকে সােনা তুলে আনা যায়। এমন দৃষ্টি তাে দেখার অসাধারণ ক্ষমতা যােগায়। এই মূর্খ আমার উপন্যাস পড়েছে? ওয়ার এন্ড পিস, দ্য ওল্ডম্যান এ্যান্ড দি সী, সিদ্ধার্থ পড়েছে? পড়েছে আমার নাটক? হ্যামলেট, ওথেলাে, পড়েছে?
না সম্রাট, পড়েনি।
গেট আউট। গেট আউট। জামিল উত্তেজিত হয়ে উঠলাে। রেজা আমাকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললাে। আমি বেরিয়ে এলাম। উত্তেজনা হয়তো ওর ক্ষতি করতে পারে। রেজা ওকে ঠাণ্ডা করে বালিশে শুইয়ে দিলাে। ও আবার চোখ বুঁজলাে।

জানিস জামেরী, ও বেশির ভাগ সময় চোখ বুজেই শুয়ে থাকে।
কেন?
এ জায়গাটা ওর থাকবার জন্যে উপযুক্ত নয় বলে। তাছাড়া কোনাে মানুষকে ও মানুষ মনে করে না। ওর চোখে সব গরু, ছাগল, ভেড়া। কেবল ওর মা এলে একটু চুপচাপ থাকে।
স্যাড। অথচ ওর চোখ দেখে মনে হয় সুস্থ থাকলে ও একটা কিছু করতে পারত।
ঠিক বলেছিস। মাঝে মাঝে এ দৃষ্টি দেখে আমিও চমকে যাই। তুই আর একদিন আসিস জামেরী। আজ তাড়া আছে।
ঠিক আছে।

রােজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন রাস্তায় এলাম, তখন দুপুর গড়িয়েছে। ভীষণ খিদে পেয়েছে। বাইরে খাওয়ার মতাে পয়সা নেই পকেটে। সেই কাফে রেস্তোঁরার কথা মনে হলাে। কিছুক্ষণ গিয়ে বসলে মন্দ হতাে না। কিন্তু সাত পাঁচ ভেবে আবার বাসার দিকে রওনা হলাম। ঘরে ফিরে স্টোভে ভাত আর আলু সেদ্ধ বসিয়ে দিলাম। এ কয়দিনের অমনােযােগে ঘরটা নােংরা হয়ে আছে। মিতুল দেখলে বলতাে, তুমি যে কি নােংরা থাকো জামী, আমি হাসলাম। তবু পরিষ্কার করার ইচ্ছে হলাে না। যেমন আছে, তেমনই থাকুক। বর্তমানে জঞ্জালই সঙ্গী। কত ময়লা মনের ওপর জমে, সব কি সাফ করতে পারি? বাথরুমে তাওয়ার ছেড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ঝিরঝিরে জলে সেই তাঁতখান লেন ভাসতে ভাসতে আবার আমার সামনে এলাে। আমি মনে মনে এক মহিলার মুখের ছবি আঁকবার চেষ্টা করলাম। বড় হয়ে মিতুল তাকে কোনােদিন দেখেনি। ও যখন জেনেছে ওর জীবনে একটা ঘটনা আছে তখন থেকে ওর বুকে কষ্ট জমতে শুরু করছে। বরফের মতাে জমা মাঝে মাঝে সে বরফ জল হয়ে নামে। আঃ তখন মিতুল আমার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। মিতুলকে আমি ধরে রাখতে পারি না। মিতুলের জ্বর- ক্লান্ত মুখটা আমার বুকের সঙ্গে এসে মেশে। আমি ভুলে যেতে চাই অন্য সব কিছু আঁকার ব্যাপার-স্যাপার।
দুপুরে খেয়েদেয়ে আমি টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীরে বিশ্রী জড়তা ঘুম পাচ্ছে ভীষণ ঘুম। ঘুমাবার আগে আধাে- চেতনায় টের পেলাম দোয়েলটা ইউক্যালিপটাস গাছের ডালে বসে ডাকছে পাতা নড়ছে। ঝিরঝিরে বাতাস আমার ফুসফুসে ঢেউ তুলছে আমি তলিয়ে যাচ্ছি। একবার মনে হলাে কালাে দোয়েলটা মিতুলের চুল হয়ে আমার বালিশে ছড়িয়ে আছে। আমি সে চুলে মুখ গুঁজেছি। ঘুম যখন ভাঙলাে তখন ঘামে জবজব হিম আমার শরীর। দৃষ্টি গিয়ে শূন্যে ঠেকলাে। সমস্ত মুখটা বিস্বাদে ভরা। তেতাে স্বাদে জিহা আড়ষ্ট আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। সেই স্বপ্নে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। সেই ভীষণ স্বপ্নটা অনেকদিন পর আজ আবার আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে ইউক্যালিপটাসের ডালে এসো দেখলাম দােয়েলটা চুপচাপ বসে নাচানাচি নেই। একটু বিষন্ন যেন। আমি বিছানা নামতেই ফুড়ৎ করে উড়ে গেলাে। জানালার কাছে গিয়ে দেখলাম ওটা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। বাহিরে সন্ধ্যা নামছে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি। মুখ হাত ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলাম অফিসে যাবার জন্যে ।
পরদিন মিতুলের জ্বর আর এলো না। তারপর দিন না । তারপরের দিনও না। মিতুল ভাল হয়ে গেলো। ওকে রুগ্ন ফ্যাকাসে দেখায়। অথচ আমার চোখে মিতুল একদম অন্যরকম। দীপ্তিহীন অথচ আকর্ষণীয়। ওর দৃষ্টিতে আকাশ যেন থমকে যাচ্ছে। মিতুল আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে বললাে,
আমি খুব রােগা হয়ে গেছি, না জামী?
ঐ জন্যেই তাে তােমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে ।
আমি নিচু হয়ে মিতুলের চোখের পাতায় চুমু দিলাম।
জানাে জামী অসুখের সময় আমি কত কি আবােল- তাবােল ভাবতাম।
এখন আর ভেবাে না, কেমন?
ভাবনা যে এসে যায়!
জোর করে তাড়াবে।
পারি না যে!
তাহলে এক কাজ করবে, তখন শুধু আমার কথা ভাববে।
মিতুল হেসে ফেললাে।
হাসছো কেন?
তুমি তাে আমার সব ভাবনার ওপরে জামী।
উঁহু, তা হবে না। আমার কথা ছাড়া তুমি আর কিছু ভাবতে পারবে না। ঠিক আছে, তাই হবে। এখন থেকে তুমি আমার ধ্যান, তুমি আমার জ্ঞান, তুমি আমার প্রার্থনা। হলাে তাে?
হুঁ।
মিতুল আমার হাতটা ধরলাে। ওর মুখের সেই উচ্ছ্বল হাসিটা যেন ফিরে আসছে। অনেকক্ষণ মিতুল আমার হাত আঁকড়ে শুয়ে রইলাে। ড্রইংরুমে মিন্টু উঁচু ভলমে রেকর্ড বাজাচ্ছে। এই ওর এক নেশা। রেকর্ড জোগাড় করবে আর গান শুনবে। ঝরনা আর খালাআম্মা যেন কোথায় গেছে। ঝি আমাকে এক কাপ চা দিয়ে গেলাে। চা শেষ করে বললাম, আমি এখন যাই মিতুল?
না। অসুখের সময় কেবল মনে হতাে, তুমি সারাক্ষণ আমার পাশে থাকো। আমার মনটা ছলকে উঠলাে। ফিসফিসিয়ে বললাম, মিতুল, এবার একটা ব্যবস্থা হবে। তুমি ভালাে সেরে ওঠো। তারপর তােমার বাবার কাছে কথাটা বলবাে। ইদানিং আমারও কেবল মনে হয়, সারাক্ষণ তুমি আমার পাশে থাকো।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বারোউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চৌদ্দ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *