ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তৃতীয়

মা- র মৃত্যুর পর এখন আমার আর কেও নেই। আরো এক ভাই এক বােন ছিলাে। দু’জনেই ছােট বেলায় মারা যায়। ফলে এখন আমি দায়িত্বমুক্ত এবং বন্ধনমুক্ত। সে কারণেই শিল্পের গােলকধাঁধায় আমার অনন্তকালের যাত্রা। কোনাে পিছুটানে পথচলা থমকে যাবে না। রায়হান এ নিয়ে মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে। ওর মতে আমার সবকিছুই পাগলামি। শিল্পের সঙ্গে ওর কোনাে খাতির নেই। এসব প্যানপ্যানানি নাকি জীবনকে গুরুভার করে তােলে। এসব অনুভূতি- টুতি জীবন থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় করা দরকার। ও সােজা সরল পথ বােঝে। টাকা উপার্জন এবং ফুর্তি করা ছাড়া আর কিছু ওর ভালাে লাগে না। তবে ও খুব জেদি ছেলে। কোনাে কিছু মনে উঠলে সেটা করে ছাড়ে। দরকার হলে তার জন্যে নিজের সমস্ত শক্তি নিয়ােগ করতে রাজি। তখন ও ডানে- বামে তাকায় না। মাঝে মাঝে ওর এ ধরনের আচরণে আমি ভয় পাই। তবে আমার ওকে ভালােই লাগে। যদিও মিতুল ওর ওপর ভয়ানক খাপ্পা। রায়হানও মিতুলকে পছন্দ করে না। আমার চরিত্রের বিপরীতধর্মী লােকজন আমার সবসময় ভালাে লাগে। আমি ওদের মধ্যে লেখার উপাদান খুঁজে পাই। সেজন্যে অনেক বিরুদ্ধ পরিবেশেও আমি ওদের সঙ্গ ত্যাগ করি না। রায়হান আমার সে ধরনের বন্ধু। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। এখন পর্যন্ত কোনাে কারণে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বে পাটল ধরেনি। যদিও মিতুলকে ও সহ্য করতে পারে না। ওর মতে মিতুলের চরিত্রে অনেক খামখেয়ালিপনা আছে। সেসবের কোনাে মানে হয় না। আমিও রায়হানকে কখনাে বােঝাতে চেষ্টা করিনি যে, মিতুলের সবকিছু মিলিয়েই মিতুল আমার কাছে অসাধারণ। রায়হানকে বােঝানাের দরকারই বা কি!

একদিন মাঝরাতে সেই স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেলাে। হিংস্র ঈগলটা আমার কলজে টেনে বের করেছে। ঘুম ভেঙে যাবার পর কোনাে ভয় বা অবসাদ আমাকে আচ্ছন্ন করলাে না। মনে হলাে বিরাট একটা সমুদ্র আমার মাথার মধ্যে গর্জন করে বয়ে যাচ্ছে। প্রােটোপ্লাজমের বিন্দুটি একা একা ভাসছে। ভেসে যাচ্ছে। ওর গায়ে এখন আমার আলট্রা ভায়ােলেট রশি স্পর্শ করানাে প্রয়ােজন। ভেতরে ভীষণ আলােড়ন। আমি উঠে জানালার কাছে দাঁড়ালাম। ঘুরে এসে আলাে জ্বালালাম। আমি তাে সেই অমিত তেজের অধিকারী। আলাের রশ্মি ছুঁড়ে ফেলতে হবে। উত্তেজনা আমাকে পাগল করে তোলে। আমি টেবিলের ধারে এসে দাড়াই। এ তিনটে মাস হাজার কষ্ট করেও যে উপন্যাসটা আমি শুরু করতে পারছিলাম না, সেটা এখন একদম তৈরি বলে মনে হচ্ছে। আমার মাথায় হাজার জলপ্রপাতের শব্দ।

সেদিন অনেক রাতে সংবাদপত্র অফিসের কাজ সেরে বাড়ি ফিরলাম। দেখলাম মিতুলের ঘরে আলাে নেই। এমনটি হবার কথা নয়। হয়তাে ক্লান্ত ছিলাে, ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তো কম হয়নি। এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিতে চাইলাম। তবু খুঁতখুঁতি কাটলাে না। ঘরে ঢুকে মেজাজ আরাে খারাপ হয়ে গেলাে। সমস্ত ঘরটা এলােমেলাে। এতক্ষণ ইঁদুরেরা অবাধ রাজত্ব চালাচ্ছিলাে। আমার সাড়া পেয়ে পালালাে। দুপুরবেলার এঁটো বাসন তেমনি রয়েছে। স্টোভের ওপর ভাতের হাঁড়ি উল্টে আছে। জগে পানি নেই। মেঝের ওপর আলু, ডিমের খােসা ছড়ানাে। বিরক্তির মাঝেও হাসি পেলাে। বুঝলাম ইঁদুরের কাণ্ড। আমার ঘরটা স্টেডিয়াম বানিয়ে ওরা হয়তাে ডিমের খােসা দিয়ে ফুটবল খেলছিলাে। ওদের আর দােষ কি! সুযােগ পেলে আমরা সবাই বেশ একটা রামরাজত্ব গড়ে তুলতে চাই।

বাথরুমে ঢুকে বেশ করে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। ক্লান্তি ঝরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মেদ কমে গেলে শরীর যেমন হালকা লাগে, তেমন লাগছে নিজেকে। আসার পথে পাউরুটি, মাখন কিনে এনেছিলাম। তাই খেলাম। বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ার পরও আমার মনে হলাে শরীরে কোনাে অবসাদ নেই। আমি এখনাে অনেক কাজ করতে পারি। ঝিরঝির বাতাস ঢুকছে জানালা দিয়ে। মশারি কাঁপছে। মিতুলের ওপর থেকে রাগ পড়ে যাচ্ছে। মিতুলের ওপর রাগ করে থাকা খুব কষ্টের। পায়ের দিকে জানালার কাছে ইউক্যালিপটাস গাছের আড়ালে চাঁদটা ঢাকা পড়েছে। দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে ইচ্ছে করছে না। মাঝে মাঝে না দেখে কেবল উপলব্ধিতেই আলাে পাই। বিজ্ঞানীরা বলেন পৃথিবীর জন্মের পর চাঁদের দূরত্ব ছিলাে আট হাজার মাইল। তারপর কয়েকশ’ কোটি বছরে চাঁদ পৃথিবীর কাছ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে গেছে। এখনকার দূরত্ব প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল। আসলে এমনি হয়। একটু একটু করে আকর্ষণ কমতে থাকে। তখন অনেক দূরে সরে যায় মানুষও। জীবনের আরম্ভটা যেমন, শেষটা তেমন নয়। তবে চাঁদের দূরে সরে যাবার একটা সীমানা আছে, সে পর্যন্ত পৌঁছে আবার সে কাছে আসতে শুরু করবে। আবার টানবে পৃথিবীকে, পৃথিবীকে টানবে চাঁদকে। আমার মনে হয় এটাই সত্য। দূরে সরে যাবার সীমানা না থাকলে জীবনের প্রাপ্তি ফুরিয়ে যেত। ঐ নতুন করে আবার কাছে আসার নিয়ম আছে বলেই তাে আমরা আছি। টানাটানির মধ্যে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দুইধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চর্তুথ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *