উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আঠারো

মিতুল প্রকৃতির মতাে খােলস বদলিয়ে নতুন হয়ে ওঠে। আর তাতেই আমার আনন্দ,
আমার বিশ্বাস, আমার বেঁচে থাকা। আসলে মিতুল সেই আর আপনি –
আমার প্রজ্ঞা এবং বিবেক অনির্বাণ হয়ে জ্বলে।

সংসার সংসার খেলা জমেনি বলে আমার খারাপ লাগছে না। হাঁড়িকুড়ির মধ্যে মিতুল
কেবল আমার রাঙা বৌ নয়। তা আমি হতেও দেবাে না। মিতুলের সেই সৌড়ে
পালানাে আবেগটা আমার চাই। তার সঙ্গে আমার কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা। মিতুল
নিজেও জানে না ওর ভেতরের বাইরের শরীর থেকে আমি কেমন ননী চুরি করে।
ঘুমের ঘােরে ও যেন কি বললাে। তারপর পাশ ফিরলাে। আমি এখন ওর পিঠ
দেখতে পাচ্ছি। চুল দেখছি। ওর ব্লাউজের একটা হুক খােলা। আঁচলটা ঘাড়ের কাছে
জড়ো হয়ে আছে। দেখতে দেখতে আমার সময় কেটে যায়। টেবিল থেকে একটা বই
টেনে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। পারি না। মিতুলের পিঠে দৃষ্টি আটকে যায়। বাইরে মেঘ
গুমােট ভাব কেটে গিয়েছে। হঠাৎ করে ঘনকালাে মেঘ করেছে। ঝলক ঝলক ঠাণ্ডা
বাতাসের লুটোপুটি। জানালার সামনে এসে দাড়াই। রাস্তায় ব্যস্ততা। বাতাসে ধুলাে,
ছেড়া কাগজ উড়ছে। জোর বাতাস শুরু হয়েছে। এখুনি হয়তাে বৃষ্টি নামবে। মন্দ হয়
না। বৃষ্টি নামলেই এখন আমি সবচেয়ে খুশি হই। চারদিকে অন্ধকার করে ঝমঝম বৃষ্টি
পড়ুক। এলােও তাই। আমাকে খুশি করার জন্যেই আকাশের সব আয়ােজন। বড়
বড় ফোঁটার পর মুষলধারে বৃষ্টি এলাে। আমি জানালা বন্ধ করে কাচের ওপর মুখ রেখে
বৃষ্টি দেখি। ছিটকিনির ওপর এক ফোটা পানি টলমল করছে। বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যায়।
আবার একফোটা জমে। আমি অনেকক্ষণ খেলাটা দেখি। কতক্ষণ কেটে যায় টের পাই না।

মিতুল আমার পিঠের ওপর হাত রাখে।
উঠেছে কেন?
এমন বেশ লাগছে।
কোনাে অসুবিধে নেই তাে?
না।
মাথাটা ঝরঝরে মনে হচ্ছে। কিন্তু জানাে জামী, মাথাটা মাঝে মাঝে হঠাৎ নেন যেন
হয়ে যায়।

মিতুল আমার বুকের কাছাকাছি দাঁড়ালাে। জানালায় মুখ রাখলাে। বৃষ্টির তােড়ে
সব কেমন ধোঁয়াটে দেখাচ্ছে। ভিজে ভিজে গাড়ি চলে যাচ্ছে সাঁই করে। বস্তায়
মানুষ নেই। দোকান বন্ধ। মিতুলের ফুল থেকে চমকার গন্ধ আসছে। ওর মাথাটা
আমার নাকের কাছে। সেই সুগন্ধী থেকে আমার কাকার কথা মনে হলাে। জানি
না কেন। কাফকা মরণােত্তর খ্যাতি পেয়েছিলেন।

আমি তা চাই না। মৃত্যুর পর যে খ্যাতি তাতে আমার সুখ কোথায়? যে খ্যাতি
আমার আনন্দ, তা আমার কাম্য। কাফকা প্রেমের যন্ত্রণায় অবিবাহিত ছিলেন।

আমি তা চাই না। না, আমার মিতুল আছে। তখুনি আমি ওকে হাত ধরে টেনে
 নিয়ে। বিছানায় নিয়ে এলাম। ও অবাক হলাে।

কি ব্যাপার?
বসাে। প্ল্যানটা করে ফেলি।
আচ্ছা লােক তুমি। যেমন হাতকড়া দিয়ে নিয়ে এলে। ভাবলাম অপরাধ করেছি
বুঝি?
অপরাধ তাে করেছে বটেই।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম।
কি অপরাধ?
এই যে আমাকে ভালােবেসেছে।
যাঃ!
মিতুল খিলখিলিয়ে হাসলাে।
আচ্ছা মিতুল, আগে দিনটা ঠিক করি?
দিন? একটা বিশেষ দিন?
হ্যাঁ, ঠিক করো।
এটা অক্টোবর মাস। সামনের নভেম্বরের দশ তারিখ আমার জন্মদিন।
সে দিনটি কেমন হয়?
মুরুব্বীরা বলে, জমাসে বিয়ে হয় না।

তুমি দেখছি একটা কুসংস্কারের ডিপাে। আমি ওসব মানি না। কথায় বলে না, জন্ম,
মৃত্যু, বিবাহ। আমি ঐ তিনটে ব্যাপারকে একদিনে বাঁধতে চাই। তিনটে কেমন করে
বাঁধবে? মৃত্যুর কথা তাে তুমি বলতে পারাে না?

পারি। ঐ নভেম্বরের দশ তারিখেই আমার মৃত্যু হবে। ইচ্ছে থাকলে মানুষ সব পারে।
সতসব আজগুবি!

কিছুই আজগুবি নয়। জানাে, জাপানি ঔপন্যাসিক এবং ছােটগল্পকার ওসামু
সাজাই-র আত্মহত্যা ভীষণ প্রিয় ছিলাে। তিনি তিন-তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
ব্যর্থ হয়ে চতুর্থবার সফল হয়েছিলেন। তিনি শিল্পের বস্তু হবার জন্যে নিজেকে ধ্বংস
করেছিলেন।

তুমি কি সে রকম করবে নাকি?
মিতুল চোখ বিস্ফারিত করলাে।
পাগল। আত্মহত্যায় আমার ভীষণ ঘৃণা।

লেখকদের আমার ভয় করে জামী। লেখকরা নাকি অন্যরকম হয়। সবাই তাই বলে।
মিতুলের ভীতুকণ্ঠে আমার হাসি পেলাে। হাসতে হাসতে আমি বিষম…
ও রােগে গেলাে।

তোমার এ ধরনের হাসির কোনাে অর্থ বুঝি না আমি। ওসামু দাজাই-র কথা─
বলে তুমি কিসের ইঙ্গিত করলে, সে আমি কি করে বুঝবো?
মিতুলের গলা ধরে এলাে। হয়তাে এখুনি কাঁদবে।
আমি ওকে কাছে টানলাম।
নিজেকে ধ্বংস করে আমি শিল্পের বন্ধু হবাে না মিতুল।আমি শিল্পকে ভালোবাসি।
তোমার লেখকরা শিল্পের জন্যে অনেক কিছু করতে পারাে। তখন তােমাদের
প্রিয় মনের কথা মনে থাকে না।

গলগলে ধোঁয়ার মতাে কথাগুলাে মিতুলের মুখ থেকে বেরিয়ে এলাে। আমি
নিজের ভেতর হোঁচট খেলাম। কথাটা কি মিতুল ভুল বলেছে? ও মুখটা নিচু করে
লাতে নখ কাটছে। ও এখন ভীষণ সিরিয়াস। ব্যাপারটা এত সিরিয়াস হয়ে যাবে।
আমি নিজেও ভাবিনি।

কি, চুপ করে আছাে যে? কথাটা বুকে লেগেছে, না?
মিতুল বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকালাে। আমি হাসলাম।
তুমি যা বলাে তাই আমার বুকে লাগে মিতুল। সেটা কি আমি পায়ে লাগাতে পারি?
ইস! আমার ঠাকুর।
দেখাে, আমার কিন্তু আসল কথা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি।
তারিখটায়। তুমি রাজি আছে তাে?
হুঁ।
আচ্ছা মিতুল, তােমার জন্যে আমার কি কি কিনতে হবে?
আমি জানি না।
এক শিশি আলতা, রেশমি চুড়ি, মেঘডুম্বুর শাড়ি-
ফাজলামি হচ্ছে?

আমি ওর বেণী ধরে টান দিলাম। মিতুল হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাে। দেখাে
জামী, জিনিসের প্রয়ােজন তাদের হয়, যারা সাজানাে-গােছানাে বিয়ে করে।
আমাদের কি তেমন কিছুর দরকার আছে?

আমার আছে। একদিনের জন্যেই আমি তােমাকে অন্যরকম দেখতে চাই। লাল
বেনারসি, জড়োয়া গয়না, চন্দনের ফোটা সারা মুখে-তুমি চোখ বুঁজে আছো– আঃ
তাতে আমি উত্তেজিত হচ্ছি।

এখন একটু থামবে? নইলে আমার কিন্তু মাথা ধরবে।

আমি মাঝে জানালার ধারে গেলাম। বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে। এখন টিপটিপেয়ে
পড়ছে। মিতুল হাঁটতে মুখ গুঁজে বসে আছে। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায়
বৃষ্টির ছাঁট আসছে। তবু জানালাটা আমি খুলেই রাখলাম। ভালােই লাগছে।
বাইরের সবকিছু এখন আমার ভালাে লাগার মধ্যে। আজকালের মধ্যেই কথাটা
মিতুলের বাবার কাছে বলতে হবে। আগে মিন্টুকে বলবাে। ওরাও জানে আমার
কেউ গার্জিয়ান নেই। কাজেই নিজে নিজেই সব করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে।
ফেললে সেটা কার্যকরী করার জন্যে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তখন আর দেরি সয়
না মনটা আবার একটু খারাপ হলাে। তার আগে আমাকে একবার তাঁতখান লেনে
যেতে হবে। মিতুল তাে জানে না তার আকাক্ষিত বস্তুর খোঁজ আমি পেয়েছি।
কিন্তু প্রাচীর ডিঙিয়ে তার কাছে পৌছুতে পারিনি। মিতুল তেমনি মুখ বুঁজে বসে
আছে। আমি গিয়ে ওর মুখটা নিজের দিকে ঘােরাতেই দেখলাম চোখে জল।

কি হয়েছে মিতুল?
ও কথা বললাে না। তেমনি শক্ত হয়ে বসে রইলাে।
মিতুল, লক্ষ্মীটি কি হয়েছে?

ও কিছু না বলে খাট থেকে নামলাে। আঁচলে চোখ মুছলাে। তারপর দরজার খুলে
বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলাে। আমি ডাকলাম না। জানি লাভ নেই। মিতুল এখন
আমার আশ্রয়ে আর নেই। জানি না বিয়ের কথায় ওর হয়তাে অনেক ঘটনা মনে
পড়েছে। ওরা শৈশব, কিশােরে ওকে বড় কষ্ট দেয়। হঠাৎ মনে হলাে কষ্ট পেতে
পেতে মিতুল হয়তাে একদিন টুপ করে মরে যাবে। কেউ জানবে না ওর কি হয়েছে।
শুধু আমি বুঝবাে কেন মরলাে মিতুল।

পরের দিন মিন্টুকে ডেকে সব কথা বললাম। ও খুশিতে লাফিয়ে উঠলাে। আমরা
তাে আপনার এই একটি কথার জন্যেই অপেক্ষা করেছিলাম জামেরী ভাই।

কনগ্রাচুলেশন।

তারিখটাও জানিয়ে দিলাম ওকে। সেই তারিখ অনুযায়ী এখনাে এক মাস চার দিন বাকি।
মিন্টু চলে যাবার পর নিজেকে খুব হালকা লাগলাে। দোয়েলটার মতাে। এখন
ইউক্যালিপটাসের উচু ডালে গিয়ে বসতে পারি। অনায়াসে আকাশ ছুঁতে পারি। মেঘ হতে
পারি। তখুনি লাফাতে লাফাতে ঝরনা এলাে।

আমেরী ভাইয়া মিষ্টি চাই।
কেন, কিসের মিষ্টি?
বাঃ, কিছুই যেন জানেন না?
অত সহজে মিষ্টি নেই ঝরনামণি। আগে আপুকে এই হাতের মুঠিতে দাও,
তারপরে মিষ্টি?
বাব্বাঃ আপনি কি সাংঘাতিক লােক!

মােটেই না। তোমার ক’হাঁড়ি মিষ্টি চাই বলাে? তবু সাংঘাতিক হতে রাজি নই। ঠিক আছে,
মিষ্টি আমার চাই না। বিয়ের দিন শােধ তুলবাে। তখন টের পাবেন। নাকের জল, চোখের
জল এক হবে। শোনা, শোনো ঝরনা- আগে দুলাভাই হয়ে নিন তারপর শুনবাে। ও যেই
ভঙ্গিতে এসেছিলাে ঠিক সেই ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে চলে গেলাে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সতেরোউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব উনিশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *