উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব এগারো

এই যে বাবা, আজকে আবার কোথাও বের হওনি তাে?
না।
আমি কোণার সােফায় বসলাম। সেদিনের পত্রিকাটা হাতে নিয়ে চোখ বুলােতে লাগলাম। মনে হলাে, এ বাসায় এখন আমার কোনাে কিছু করার নেই। আমার ভূমিকা নিষ্ক্রিয় দর্শকের। এমন একটা ছবি এখানে চলছে, যেখানে আমি কোনাে যােগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি না। কেবল অবসাদ কেবল হাই তোলা। ঝরনা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। ওদের ভাই মিন্টু মােটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে রেডিওর নব ঘুরাচ্ছে। সেটাও আমার জন্যে বিরক্তিকর। কিছুক্ষণ পর মিতুলের মা এলেন।
চলাে, খাবার দিয়েছি।
আমি আর মিতুল মুখােমুখি বসলাম। দেখলাম, টেবিলের ফ্লাওয়ার ভাসে একগাদা নানা ধরনের ফুল। একটা টকটকে লাল গােলাপও আছে। ফুলের দিকে তাকিয়ে মিতুলের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলাে। ওর ঠোঁটের কোণে খুবই সরু হাসির রেখা। হঠাৎ আলী আহমদ সাহেব বললেন, টেবিলে তাে জায়গা কম, ফ্লাওয়ার ভাসটা অন্য কোথাও রাখাে।
মিতুল আমার পায়ে চাপ দিলাে।
আমি বললাম, থাক না ওটা। বেশ ভালাে লাগছে কিন্তু।
ও তাইতাে, তুমি তাে আবার লেখক। ফুল – টুল একটু বেশি ভালােবাসাে।
আলী আহমেদ সাহেব হাে হাে করে হাসলেন। মিন্টু গম্ভীর মুখে খাচ্ছে।
মিতুলের দৃষ্টি প্লেটে। খালাআম্মা সবাইকে তুলে দিচ্ছেন।
জামেরী ভাইয়া, চিতল মাছের এই কোপ্তাটা কিন্তু আমি করেছি।
সত্যি ভীষণ মজা হয়েছে।
আরাে দুটো দেই?
দাও।
ঝরনার মুখটা আনন্দে ঝলমল করে উঠলাে।
সত্যি ঝরনা মামণি এমন বেঁধেছে না, মনে হচ্ছে এমন খাবার কোনােদিন খাইনি।
আলী আহমদ সাহেবের কথায় সবাই হেসে উঠলাে।
বাঃ সবাই হাসছে কেন? আমি খাবাে না।
বােকা মেয়ে বুঝতে পারছে না যে, আমরা সবাই খুশিতে হাসছি। সত্যি খেতে আমার খুব ভালাে লাগছে।
আমার কথায় ঝরনার উত্তেজনা কমলাে। ও খবারে মনােযােগী হলাে।
তােমার লেখা কেমন চলছে জামেরী?
ভালােই।
চমৎকার হাত তােমার। তবে তােমার প্রথম বইটার চাইতে দ্বিতীয় বইটা আমার বেশি ভালাে লেগেছে।
আমার একটাও ভালাে লাগেনি। মিন্টু গম্ভীর গলায় বললাে। আমি হাসলাম। আমার মনে হয় আপনার লেখা খুব আড়ষ্ট। অযথা পেঁচিয়ে ফেলেন। বুঝে উঠতে কষ্ট হয়। অতটুকু মগজ খাটাতে না হলে লেখা পড়ে আনন্দ নেই মিন্টু। না বাবা, আমি জানি না। আমি চাই স্বচ্ছ লেখা। যেটা এক নিশ্বাসে টেনে নিয়ে যাবে। যার লেখা পাঠকের আসক্তির বদলে বিরক্তি ঘটায়, সে সত্যিকারের শিল্পী নয়। মিন্টু একটা কঠিন রায় দিয়েছে। আমি মিন্টুর কথায় সায় দিয়ে গেলাম। আমি কখনাে কোনাে আলােচনায় নিজের পক্ষ অবলম্বন করি না। সেটা আমার সৌজন্যে বাধে। একটা বই যখন। প্রকাশিত হয় তখন সেটা পাঠকের সম্পত্তি। সে বই নিয়ে যথেচ্ছ নাড়াচাড়া করার অধিকার তার আছে। সেটাকে কেন্দ্র করে সে নিরপেক্ষ বিচারে যা কিছু ভাবতে পারে। তবে দেখতে হবে সেটা যেন উদ্দেশ্যমূলক হয়। কোনাে প্রবল যুক্তি ছাড়া। শত্রুতামূলক একতরফা খারাপ বলা আবার আমি সইতে পারি না। তবে আমার বিশ্বাস লেখায় যদি বস্তু থাকে তবে সেটা তার যােগ্য মর্যাদা পাবেই। সেটা দুদিন আগে হােক বা পরে হােক। আমি কিন্তু বটতলার সস্তা উপন্যাসের কথা বলছি না জামেরী ভাই। আমার বক্তব্য হলাে লেখার প্রথম শর্ত রিডেবিলিটি।
তােমার সঙ্গে আমি একমত নই মিন্টু।
রিডেবিলিটিটাই কিন্তু আসল কথা নয়। যেমন ধরাে সাইফুল বারীর উপন্যাসের কথা। একটানা পড়ে শেষ করে ফেলা যায়। কিন্তু তারপর বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। কেননা পড়ার পর আর কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু জামেরীর লেখা তেমন নয়। পড়ার পরও টেনে রাখে। ঘুরে ফিরে আবার পাতা ওল্টাতে ইচ্ছে করে। বিশেষ বিশেষ জায়গায় চোখ বুলিয়ে যাই। আমি কিন্তু রিডেবিলিটিটাকে প্রথম শর্ত বলেছি বাবা। আলী আহমদ সাহেবের জোরালাে বক্তব্যে মিন্টু তেমন যুক্তি খুঁজে পেলাে না। আমতা আমতা করে বললাে। হ্যাঁ, তুমি সেটা বলতে পারাে। তবে আমার মনে হয় শিল্পকর্ম শুধু কোনাে একটার বাহন নয়। সেটা সমগ্রের পরিপূরক। আমার কথায় আপনি কিছু মনে করেননি তাে জামেরী ভাই? একটুও না। তােমার হৃদয়ে আমি পৌঁছুতে পারিনি সেটা আমার দুঃখ। তবে তোমার সত্য ভাষণের জন্যে আমার কোনাে ক্ষোভ নেই। ভালাে লাগা না লাগার অধিকার তােমার নিশ্চয় আছে।
আমিও তাই মনে করি।
শিল্পকর্ম জটিল ব্যাপার ,না জামেরী ?
পারছি না এবং চেষ্টাও করি না। দু’তিনটে বইয়ের বদৌলতে সভা – সমিতিতে সভাপতির পদ অলংকার করা আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ঐসবে আমার প্রছণ্ড ও ঘৃণা শরাফী। আমি বুঝি কাজ। প্রচণ্ড কাজ। কাজের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিকে এক একটি ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সহৃদয় পাঠক আমার মূল্যায়ন করবে কি করে যদি আমি তাদের সামনে তেমন কাজ দেখাতে না পারি? পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ারও তাে দরকার আছে?
তেমন পরিচয়ে আমি বিশ্বাস করি না শরাফী – যেটা কেবল পরস্পরের পিঠ চুলকানিতে এসে দাঁড়ায়।
তাের কি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না জামেরী? সেটা তুই ভাবতে পারিস। আমি মনে করি না। শিল্পসাহিত্য করতে এসে যারা বিবেককে জলাঞ্জলি দেয়, তাদের কাছে বিনীত হওয়ার মতাে দুর্ভাগ্য আর কিছুতেই নেই শরাফী। সে কাজ মানেই লেখক সত্তার অপমৃত্যু। আমার লেখায় যদি পদার্থ থাকে তবে তার স্বীকৃতি একদিন হবেই।
কিন্তু তুই তাে জানিস জামেরী, অনেক সময় দলাদলি বা ইমেজের খপ্পরে পড়ে অনেক ভালাে বই তার যােগ্য মর্যাদা পায় না।
তার জন্য কোনাে দুঃখ নেই। একজন সহৃদয় বিবেকবান পাঠকের জন্যে আমি শতাব্দীকাল অপেক্ষা করতে রাজি আছি। পাঠক আমার ঈশ্বর। তারা কখনাে ভুল বিচার করে না।
শরাফী চুপ করে থাকে। উত্তেজনায় আমার বুকটা ধপধপ করে। টের পাই উত্তেজিল হলে বুকের ভেতর কি যেন একটা প্রসারিত হতে থাকে। তখন আমার মনে হয় হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দটা গলার কাছে এসে উঠেছে। ওটা যে – কোনাে সময় হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। শরাফী ঠক করে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রাখলো।
তুই অনেক ভালাে ভালাে কথা বললি জামেরী। সবই স্বীকার না করে উপায় নেই।
তবে হৈ – চৈ আচ্ছা আমি একটু পছন্দ করি।
আড্ডা আমারও ভালাে লাগে যদি সেটা সাহিত্যের আড্ডা হয়। তেমন আড্ডায় আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারি।
সেটা আমি জানি। তবে এসব জায়গায় গেলে একটা সুবিধে আছে।
কি?
নানা ধরনের লােক দেখা যায়।
দৃষ্টিটা ঠিকমতাে খােলা রাখতে পারলে তেমন লােক আমাদের আশে – পাশে অজস্র দেখা যায় শরাফী। তার জন্যে বিশেষ জায়গায় যেতে হয় না। দেখাটাই আসল।
বেশ ভালাে! আমাকে নিরীহ শ্রোতা পেয়ে একতরফা নিয়ে যাচ্ছিস। আমার অত সময় নেই।আমি চললাম।
তােদের সভার সভাপতি কে রে?
শামসুল মাহমুদ খান।
শরাফী কোনােমতে উত্তর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে গেলাে। জানে যার নাম ও উচ্চারণ করলাে তাকে আমি স্বীকার করি না। শালা পঞ্চাশ বছরে দুটো উপন্যাস লিখেছে। ঐ ভাঙিয়ে এখনও চলছে। সারাজীবন কেবল ধান্দা আর মতলবের পেছনে ঘুরেছে। সাহিত্যের জন্যে সত্যিকারের মমতা এবং ত্যাগ তার ছিলাে না। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে, এরা কি করে পাটকের সামনে আসে। নিজের সৃষ্টির দীনতায় এদের লজ্জাও হয় না। সভাপতির আসনকে এরা পৈতৃক সম্পত্তির মতাে ব্যবহার করে। অথচ বক্তৃতার সময় বড় বড় কথা। সেখানে কোনাে ত্রুটি নেই।
আমি জানালার সামনে এসে দাঁড়ালাম। শরাফী ক্ষুব্ধ হয়েছে। তাতে আমার কিছু এসে যায় না। বুকটা এখনাে ধুকধুক করছে। এ অবস্থায় আমি কখনাে শুতে পারি না। শুলে ভীষণ হাঁসফাঁস লাগে। জানালার শিকে মাথা রেখে দম নেবার চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে প্রসারিত বােধটা সঙ্কুচিত হচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলাম। বুঝি ডাক্তার দেখানাে দরকার। আলসেমির জন্যে হয়ে ওঠে না। তাছাড়া ভালাে থাকলে অসুখের কথা বেমালুম ভুলে যাই আমি। বাইরে রােদের তাপ কমেছে। প্রুফ বগলদাবা করে বেরুলাম। এগুলাে প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে মার্কেট এলাম। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে দেখলাম সাইকিকে। ওর সঙ্গে আর একটি মেয়ে। আমার চোখে চোখ পড়তে ওর চোখ দপ করে জ্বলে উঠলাে। একঝলক সাদা আগুন। সাইকি মুখটা ঘুরিয়ে নিলাে। আমি কথা বলতে চেয়েছিলাম। ভালাে কথা। সাইকি আমাকে ঘৃণা করলাে। রায়হানের বন্ধু বলেই করলাে। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলাে। অথচ আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। বােকার মতাে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কি যে জাদু! ও পেছনে ফিরে আর এক ঝলক আমার দিকে তাকালাে। কি বুঝলাে কে জানে। দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে অপর দিকে চলে গেলাে। ওর পায়ে ভীত হরিণীর লঘু গদি দেখে আমার কান্না পেলাে। সাইকি আমাকে ভয় পেয়েছে। ও হয়তাে ভেবেছে আমি একটা শিকারী কুকুর। প্রভুর হুকুম তামিল করার জন্যে গন্ধ শুকে বেড়াচ্ছি। হয়তাে এখুনি ওর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে টুটি কামড়ে ধরবাে। আমার বুকটা খা খা করে উঠলাে। আমার হৃদয়ে তখন সন্ধ্যার পেলব আহ্বান। মনে মনে বললা, সাইকি আমি তােমার ভালাে চাই। মঙ্গল চাই। তােমার মঙ্গল চিন্তায় আমার হৃদয় এখন পবিত্র ইলিউম। তুমি আমাকে বিশ্বাস করাে সাইকি। একবারের জন্য বিশ্বাস করাে। তুমি জানতে পারছাে না, তােমার চোখের ঐ অবিশ্বাসী ঘৃণায় আমার হৃদয় চড়চড় করে পুড়ছে। ট্রয়ের মতাে পুড়ছে।
শনিবার আমার অফ ডে। শরীরে অসম্ভব জড়তা। শুয়ে শুয়ে জয়েসের ইউলিসিস পড়ছিলাম। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারলাম না। শরীরের কোথায় যেন বিদ্রোহ।
বইরের সঙ্গে আপস নেই। চোখ জড়িয়ে আসে। অথচ ঠিক ঘুমও পাচ্ছে না। বাইরের একফোঁটা বাতাস নেই। ভ্যাপসা গরম। কি করবাে ভাবতে পারছিলাম না।
সেদিন শরাফীর বাসায় গিয়েছিলাম। ওর মেয়ে রামীন সােজা আমার কোলে উঠে বললাে, কাকু, আজ আমার কি হলাে? ওর কথা বলার ভঙ্গিতে আমি তাে অবাক। এই একরত্তি মেয়েটা বলে কি? বললাম, কি হয়েছে মামণি?
আজ শুধু আমাকে পিপড়ে কামড়াচ্ছে?
আমি হাে হাে করে হেসে উঠলাম।
তুমি নিশ্চয় পিঁপড়ের সঙ্গে আড়ি নিয়েছে। তাই তাে ও ভাব করতে চায়।
হ্যাঁ বয়ে গেছে আমার পিঁপড়ের সঙ্গে আড়ি নিতে।
ও রাগ করে আমার কোল থেকে নেমে গিয়েছিলাে। আমার উত্তরটা ওর মনঃপুত হয়নি। হঠাৎ রামীনের কথা আমার মনে হলাে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আজ আমার কি হলাে?কিন্তু এখানেও কোনাে সদুত্তর দিতে পারলাম না। বইটা বন্ধ করে পাশ ফিরে শুলাম। এমন সময় পিয়ন এলাে। আমাকে কেউ চিঠি লেখে না। মিতুলের চিঠি। এ চিঠির কথা ও আগেই আমাকে বলে রেখেছিলাে। ওর মামা থাকে লন্ডনে। তার কাছে ও লিখেছিলাে ওর মা – র একটা ছবি পাঠাবার জন্যে। নিকট আত্মীয়স্বজন কাছে- ধারে কেউ নেই। ওর মা আর মামা – ই ছিলাে দুই ভাইবােন। নানা – নানীও নেই। সুতরাং কারাে কাছে গিয়ে মন ভােলার কোনাে উপায় নেই মিতুলের। সেটা ওর ভালাে লাগে। আমার সঙ্গেই ওর যত কথা। অন্য কারাে কাছে কোনাে কথা বলে না।চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে দিলাম। একটু পরে মিতুল এলাে।
পিয়ন আসতে দেখলাম জামী?
হ্যাঁ, তােমার চিঠি এসেছে।
চিঠিটা পড়ে ও হতাশ হলাে। ওর মামা লিখেছে ওর মা – র কোনাে ছবি তার কাছে নেই। মিতুল ফিকে হাসলাে। আসলে আমার মাকে বােধহয় কেউ ভালােবাসতাে না জামী।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দশউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *