হাছিনা মমতাজ ডলি’র কবিতা

একটা বিকেল

তুমি দেবে কি একটা বিকেল আমায়!
স্মৃতিগুলো একটু গুছিয়ে নেবো শুধু
তারপর সযত্নে রাখবো তুলে মনের আলমিরায়।

তোমাকে দিতেই হবে একটু সময়
কতটা সময় কেটেছে তোমারই তো হাত ধরে
এই জারুল বিছানো পথে!
টিএসসির খোলা সবুজ উদ্যানে
চায়ের দোকানে রং চায়ে চুমুক দিতে দিতে!
তুমি তো জানতে দিনগুলো ছিলো ভীষণ রঙিন!

মনে পড়ে সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায়,শ্রাবণজলে মন ডুবে,
কতটা সাহসী যুগলবন্দী ছিলাম,
স্বাধীনতার চত্বরে!
কিংবা নিয়ন আলোর আলোআঁধারিতে,
সেই প্রাচীন বৃক্ষের কথা মনে আছে?
যে আমাদের গল্পের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও!
সেই টংঘর, চায়ের সাথে জলজমা বৃষ্টির!
আহারে কত যে প্রিয় সুখ আমাদের!
জানো আজো ছুঁতে ইচ্ছে করে ফুটপাতে বিছানো রেশমি চুড়ি!
বেলোয়ারি সুখের পসরা জানি আজো আছে সবি!
নাকি পোড়ামাটির ফলকে লেখা হয়ে
সব ইতিহাসে মমি হয়ে গেছে!

বড্ড অচেনা অসুখ মনে, স্মৃতির অনুরণন!
কী করে ভুলে যাই বিদগ্ধ নগরের সেইসব হৃদয়ের কোলাহল!
হঠাৎ ঘাঁই দিয়ে উঠে অন্তর, স্মৃতি পোড়ানো ধোঁয়ায়।

একটা বিকেলে না হয় বসবে সাথে,
টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো গেঁথে নেবো মায়াবী সুতোয়
কৃষ্ণচূড়ার রঙের মন,বড্ড দাম দিয়ে কিনেছিলো সে একজীবন!
কেবলই এখন তা ধূসর বিষণ্ণ বিকেল যেন।

ঘুমন্ত এই শহর

এখনও এই শহরে রাতের গল্প লেখে নিশ্চুপ সময়
মুখোমুখি বসে স্মৃতির আয়নায়—
সেই গুমোট ঠাস বুনটে গাঁথা জীবন,
যেন এই ঘুমন্ত শহরে বিলি কাটে বিবশ মন।

ছিলো তো সোনার কাঁঠি রূপোর কাঁঠি ছোঁয়ানো জীবন,
এখন সব ধুলো উড়া স্মৃতির নির্যাস,
সুখের কোটরে অ-সুখের বাস, যেন আদ্যিকালের ঘুণপোকা!
থেমে থেমে বাজে মধ্যরাতে হুতোম প্যাঁচার বিলাপ!
নিদ্রাহীন আমি অশরীরীর মতন পলেস্তারা খসা প্রাসাদে
কবেকার ধূপগন্ধী সুখ হাতড়ে বেড়াই।

সন্মুখে কানাগলির রোয়াকে ঘুমায় নৈঃশব্দ্য
অহেতুক ডানা ঝাপটায় রাতজাগা পাখি!
ইচ্ছে করে অনুভূতিহীন নিয়ন আলোতে ঝুলিয়ে দেই
আগামী সকাল—
কফির মগে ঠোঁট ডুবিয়ে মুছে দেই উপোবাসী রাত
ভোরের ঘ্রাণে মিলিয়ে যাক পোড়া নিকোটিনের স্বাদ
নিদ্রাহীন মন ঘুমন্ত শহরে রাত জেগে জেগে
শুধুই বিষণ্নতার পদাবলি লেখে।

কোথাও কেউ নেই

চারিদিকে দিনের শেষ আলোটুকু নিভে যায় যখন,
সন্ধ্যারাগের রক্তিম লালিমা আকাশ রাঙিয়ে দেয়
অলৌকিক ছায়ার মতো,
নিজেকে বড়ো বেশী একা লাগে!
শূন্য চরাচরে কোথায় কেউ নেই অপেক্ষায়!
নিজেকে লাগে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকা নক্ষত্রের মতো!
যে শুধু ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের মতো আলো বিলিয়ে যায়
শূন্যতা বসতি করে আছে যেনো এই বিবর্ণবেলায়।

কোথাও কেউ নেই!

বিষাদের কালবেলায় নিঃসঙ্গ যে সুখ
ইশারায় শীষ দিয়ে যায় সন্ধ্যাতারার সাথে,
আমিও ডুবে যাই ক্রমশ সেই আঁধারের অসুখে।

অতঃপর আমি আকাশের ঠিকানায় স্বপ্নের দিপালী জ্বালি,
মনের ক্যানভাসে আঁকি আপন বিভোরে
বিমূর্ত কোনো আনন্দলোকের ছবি।
সেই ছবিতে রঙের দীপ জ্বেলে যে নদী বয়ে যায়,
অসীমের পানে,
চাঁদ যেনো ডুবে যেতে চায়,আগুন রাঙা ঐ অতল জলে।

বেলাশেষে চারিদিকে মুছে যায় জীবনের চালচিত্র
অনাহুত অন্ধকার ঘিরে থাকে আমাকে,
কবে, কখন পাখীদের আলাপনে সকাল হবে,
সেই অপেক্ষায়!
ঢেউ গুনে গুনে সাথী হই, নিরবধি বয়ে যাওয়া নদীর
নির্জনতার অখন্ড বিরহীকথনের।

ভয়ংকর এই সুন্দরেরও শেষ আছে!
হয়তো কোনো একদিন
জীবন নদীর স্রোতে ভেসে যাবে সব মৃত ইচ্ছেরা,
জীবন হবে আবার কোলাহলময়, নীরবতার বিউগল যাবে থেমে।
আমি সেই অস্তরাগের অপেক্ষায়!

এক বিকেলের গল্প

পিছনে পড়ে থাক নিভে যাবার ভয়
জীবনের দীপশিখা,
অবরুদ্ধ পৃথিবী, অচেনা জীবাণুর সংক্রমণে,
ঘেরাটোপে বাসস্থান আশংকায়,
লকডাউন প্রেম!
সকাল -সন্ধ্যার আটপৌরে সময়, কী করে কাটবে!
বিবশতা ধূসর মননে
তবুও ইচ্ছেরা বিবাগী হতে চায়
তোমার হাতটি ধরে!
চলো না নিশ্চুপে দলছুট হই জীবন থেকে
দূরের মায়াবতী কোনো এক জলাশয় ধারে,
যেখানে নিত্য ডুবসাঁতার দেয় পানকৌড়ি
ভোরের কুয়াশায়!
অনিমেষ চেয়ে থাকা রঙধনু রঙের মাছরাঙাটি
কেবলই ভাবে কখন জলের বুকে কাঁপন লাগাবে
রুপালি মাছটি!
জলের ছায়ায় কাঁপন লাগে আমাদেরও
না বলা কথার সুরধ্বনি!
তবুও মৌনতায় মাতি নৈঃশব্দের মায়াজালে ডুবি।

এখানেই যেন ভালোবাসা চাষ হয়
এখানেই বৃক্ষের ছায়ায় স্বপ্নরা ঘুমায়!
এই নীলাভ জলে পড়ুক যুগলছায়া
স্বর্গসুখে ভুলে যাই মর্ত্যের মায়া!

অন্তত কিছু খুঁচরো গল্প জমা থাক
আমাদের মনের ঘুলঘুলিতে,
চড়ুই যেমন বাসা বাঁধে জানালার খুপরিতে!
চলে গেলেও জীবন, শেষের কাব্য লিখে
দীপ্তি ছড়াবে একটি বিকেল,এপিটাফে দ্যুতি জ্বালিয়ে।

ঘুমের মাঝেই জেগে ওঠে দ্বীপ

ঘুমের আঁচলে মুখ লুকিয়ে যেতেই
এক অচেনা সত্তার মুখোমুখি হই,
আমাকে জড়িয়ে দিয়ে আটপৌরে ঘুমে
হুটহাট দুয়ার খুলে প্রজাপতির ডানায়
উড়ে যায়, সে কী আমিই নাকি অন্য কেউ!
পিছনে পড়ে থাকে তার সাদামাটা সুখ,
অপরিমিত কর্তব্যের ছককাটা ভাবনা!
বিষণ্ন সময়ের কান্নায় ভরা বুক।

আর সেই সত্তা অনিন্দ্য দ্বীপের বালুকাবেলায়
আনমনে সমুদ্র জলে ঝিনুক কুড়ায়,
নৈঃশব্দের দোলনায় শুয়ে আকাশের নীল ছোঁয়,
চারপাশের আঁধার যেন তার
গাঙচিলের ডানার রোদ্দুর মুছে দেয়।

কেউ কোথাও নেই—
শুধু উত্তাল জলরাশি মনের ঝড়ো হাওয়ার সাথে কোরাস গায়
জীবন দোলে সাম্পান হয়ে—
একাকীত্বের জলজ ঘ্রাণে।
যতদূর হেঁটে যায় সে গহিনে—
আমারই স্বপ্নরা সাথী হয়ে রয়!

কি যেন নিরন্তর খুঁজে ফেরে তার মন—
যার হাহাকার ইশারায় শীষ দেয় অবচেতনে,
নিভৃতে ঘুমের মাঝে যায় অচেনা দ্বীপের পথে।

আমার এ দ্বৈত বোধ যাকে আমি নিজেই চিনি না,
হঠাৎই তাকে দেখি নিঃসঙ্গ বেলাভূমিতে,
অস্তাচলের আবীর ছুঁয়ে
জীবন রাঙায়, সমুদ্রজলের নীলে ভেসে ভেসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *