উপন্যাস

উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সতেরো

এ সময় কে আসতে পারে?
শব্দটা আজকে একদম অন্যরকম মনে হচ্ছে। মিতুল নয়তো? কিন্তু মিতুল তাে কখনাে এমন শব্দ করে না?
আরো জোরে শব্দ। অসহিষ্ণু ডাক বোঝা যাচ্ছে। উঠে দরজা খুললাম। রায়হান দাঁত-মুখ খিচিয়ে উঠলাে।
শালা, দরজা খুলিস না কেন?
ও আমাকে জোর করে ঠেলে ঘরে ঢুকলাে।
দরজা বন্ধ করবার সময় আমার হাত কাঁপলাে। মনে হলাে, কোথায় কি যেন একটা হয়েছে।
রায়হান টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড দম্ভে বললাে, কাজটা সেরে এলাম। কোন কাজ?
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। যে কাজটা সারার জন্যে আমার হাত নিসৃপিস্ করছিলাে।

রায়হান হাে হাে করে হাসতে আরম্ভ করলাে। অনেকক্ষণ ধরে হাসলাে। আমার বুকটা রাঢ়ের খাবার মাটি।
একফোঁটা জলের জন্যে হামা দিয়ে ঘুরে মরছি। রায়হান চেয়ারে না বসে আমার লেখার টেবিলটার ওপর
চেপে বসলাে। অনেক চেষ্টার পর সাত দিনের মাথায় সুযােগটা পাই। আমার আসুরিক শক্তিটা নিপুণ
দৈত্যের মতাে কাজ করে। মাত্র দুটো গুলিতে লােকটা রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। লােকজন
জড়াে হওয়ার আগে আমি হাওয়া। আমি জানি,আমাকে ধরার সাধ্যি কারাে নেই। কোনাে সূত্র রেখে
কাজ করি না আমি। যাই একটু হাতমুখে ঠাণ্ডা পানি দেই।

রায়হান বাথরুমে ঢুকলাে। বেশ জোরে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলাে। ওর সব কাজে আমি বিজয়ীর
ঔদ্ধত্য দেখতে পাচ্ছিলাম। বুকটা কেমন ভার-ভার ঠেকছে। ঘরের মেঝেয় বার দুই পায়চারি করলাম।
দরজা-জানালা টানটান করে। খুলে দিলাম। খােলা বাতাস আসুক। এখন আমার বিশুদ্ধ বাতাস দরকার।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে চমকে উঠলাে রায়হান।
কি ব্যাপার, দরজা-জানালা অমন খুলে রেখেছিস কেন?
বাতাস আসুক।
কেউ তাে আমাদের কথা শুনতে পারে?
এখানে কেউ নেই।
আসতে কতক্ষণ।
রায়হান নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিলাে। তােয়ালে নিয়ে মুখ মুছতে ওর করলাে।
আমার ভেতরে প্রচণ্ড রাগ ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
চা খাওয়াবি নাকি জামেরী?
না।
রায়হান থমকে আমার মুখের দিকে তাকালাে।
তুই কি আমাকে সেদিনের মতাে তাড়িয়ে দিবি?

আমি কিছু না বলে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। যুতসই দুটো ঘুষি লাগানাের পর ও আমার হাতটা
ধরে ফেললো। ব্যথা পেলাম। টের পেলাম,কজিতে জোর অনেক। ও শান্ত গলায় বললাে,মারামারি
করলে তুই আমার সঙ্গে পারবি না জামেরী। আমার স্বাস্থ্য তাের চাইতে অনেক ভালাে। মুখে বললেই
পারতিস, আমি চলে যেতাম। অযথা শক্তি ক্ষয় করতে গেলি কেন?

রায়হান দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাে। আমি দরজার মুখে দাঁড়িয়ে একটা খুনীর সিঁড়ি দিয়ে নামা
দেখলাম। না, ওর পা টলছে না। স্বাভাবিকভাবেই নামছে। সমতলভূমিতে ওর হাঁটা দেখলাম।
তাও ঠিক আছে। খুনী রায়হান আমার বন্ধু। আমি একজন খুনীর বন্ধু। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাক্য
দুটো মনের মধ্যে নাড়াচাড়া। করলাম নিজের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশ। চুল ধরে টানলাম।
উঃ কেমন বিচ্ছিরি লাগছে! তীব্র বিবমিষা আমি ছুটে বাথরুমে গেলাম। পানির মতাে কিছু
তেতাে পদার্থ বেরিয়ে গেলাে। ঠাণ্ডা পানির স্পর্শে আমার মনে হলাে আমি যেন নিজেকে
খুঁজে পাচ্ছি।পানির রেখা ধরে আমি নিজের ভেতরে প্রবেশ করেছি। তখন আমার উপন্যাসের
একটা নতুন অধ্যায়ের কথা মনে হলাে।

সকালে মিতুল অফিসে যাওয়ার পথে আমার ঘরে এলাে, ভাের রাতে তােমার দরজায় কড়া নাড়ছিলাে কে জামী?
আমার এক বন্ধু।
উঃ কেমন বন্ধু তােমার? গােটা বাড়ির সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে।
আমি হাসলাম। মিতুলকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। পরনে হালকা হলুদ শাড়ি। কাঁধে ঝােলানাে লম্বা ব্যাগ।
ওর গভীর চোখে সকালের রােদ। মিতুলের শ্যামলা। ছিপছিমে ফিগার আশ্চর্য ধারালাে। আমি সব
ভুলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বিবমিষা কেটে গেছে। ও এগিয়ে এলাে।
কি দেখছাে?
আমি উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। মিতুলের চোখে শাসন।
কি হচ্ছে-অফিস যাবাে না?
না।
যাঃ, কি যে বলাে? দেরি হয়ে যাচ্ছে।
না মিতুল, না। তুমি আজ অফিসে যাবে না। কাল একটা ছুটির দরখাস্ত দিয়ে দিও। একটা জরুরি কাজ আছে।
সব চুলােয় যাক। আজ তুমি আর আমি সারাদিন এ ঘরে কাটাবাে। প্ল্যান করবাে।
কিসের প্ল্যান?
দিনক্ষণ ঠিক করার প্ল্যান। কিভাবে কি হবে সব ঠিক করবাে।
মিতুলের চোখে ঝিলিক। মুখে হাসি।
সত্যি জামী, আমার যেন কি হয়েছে। এখন আমার কেবল তোমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে।
আমি হাে হাে করে হাসলাম। মিতুল অপ্রস্তুত হলাে।
হাসছো কেন?
সব অসুখ এবার ঠিক হয়ে যাবে।
মিতুল তির্যক হেসে ব্যাগটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিলাে। তারপর স্টোভ জ্বালিয়ে চা বসালাে।
দিন দিন তুমি একটা ফাজিল হচ্ছে। লােকে জানে, তুমি ভীষণ গম্ভীর। কথা- টথা কম বলাে। আমি তাে জানি, তুমি কি?
সবার সঙ্গে নিজেকে মিলিও না মিতুল। তুমি কাছে থাকলে আমার প্রাণের উৎস খুলে যায়।
থাক, আর বাড়িয়ে বলতে হবে না। তুমি যে কথা বানাতে জানাে, তা আমি জানি। আমার কাছে গুণ জাহির না করলেও চলবে।
দেখাে, ইনসাল্ট করাে না।
আমি কপট রাগ দেখাই। মিতুল খিলখিলিয়ে হাসে। হাসিতে তরঙ্গ ওঠে। আমি খাটের ওপর চিৎপাত হই।
ও চা বানিয়ে নিয়ে এলাে। কৌটা খুলে বিস্কুট বের করলাে।খাটের ওপর আমার পাশে হাঁটুতে মুখ রেখে বসলাে।

এখন নিজেকে বেশ পাকাপাকি সংসারী মনে হচ্ছে মিতুল। জানাে সংসারের নামে ভীষণ ভয় পেতাম।
মনে হতাে বাজে একটা ঝামেলা। কেবল তেল-নুনের হিসেব।ঐ বস্তু ঘাড়ে একবার চাপালে আর নামতে
পারবাে না। এখন এই যে তুমি ঘুরে ঘুরে কাজ করছো আমার সমস্ত অন্তর তাতে ভরে যাচ্ছে।
আফসােস হচ্ছে। এতদিন অযথা সময় নষ্ট করেছি।

তুমি কি কাব্য করার জন্যে আমার অফিস বন্ধ করলে?

সত্যি, আজ আমার কি যেন হয়েছে মিতুল। সকাল থেকে মনে হচ্ছিলাে আমি কুয়াশায-পড়া দিকভ্রষ্ট
বিরাটাকায় জাহাজ।তুমি যখন এলে, আমি আশ্রয় পেলাম। তুমি আমার ইলিত বন্দর। ব্যস, এবার থামাে।
চা-টা শেষ করে কেবল কথা। মিতুল আমার মুখে হাত চাপা দিলাে। ইউক্যালিপটাসের
ডালে দোয়েলটা কিচ্ কিচ্ করে উঠলাে। মিতুল চমকে ফিরে তাকালাে। আমি অবাক হলাম।

কি হলাে মিতুল?
কিসের শব্দ?
পাগল। ঐ দেখাে দােয়েল।
আমার মনে হলাে কে যেন ডাকছে।
তােমার হয়েছে কি বলাে তাে?

আমার ভেতরে একটা রদবদল হচ্ছে।আমি অনবরত সেটা টের পাই জামী। তুমি তাে আমার কথা মােটেই
বিশ্বাস করাে না। ভাবাে আমি প্রলাপ বকছি।জানাে, কখনাে কখনাে ঘুমের মধ্যে আমার সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড
একটা ঝাকুনি বয়ে যায়। থরথরিয়ে কেঁপে উঠি।

মিতুল কেমন অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালাে। আমার বুকটা কেঁপে গেলাে। এ দৃষ্টি আমি আগে
কখনাে দেখিনি। হঠাৎ মনে হলাে, আজ সকাল থেকে সাইকির কথা আমি একবারও ভাবিনি। সাইকিকে
আমি বেমালুম ভুলে গেছি। অথচ রায়হানের কাছে থেকে খবরটা পাওয়ার পর সাইকির কথা আমার
সবচেয়ে বেশি। মনে পড়া উচিত ছিলাে। আসলে তা নয়। মিতুল সামনে এলে আমি অন্য সবকিছু বেমালুম ভুলে যাই।

বিয়ের আগে আমার একটা শর্ত আছে জামী।
কি?
আমার মাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
ঠিক আছে। সে হবে।
খুব সহজে যে বললে? কেমন করে হবে?
খুব সহজ দায়িত্ব। তােমাকে ভাবতে হবে না।

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাবাকে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু পরে আর ভালাে লাগে। মানুষের জীবনটা কেমন, না জামী?
চলতে চলতে এলােমেলাে হয়ে যায়।মিতুলের দৃষ্টি উদাস হয়ে যায়। ও কিছু একটা ভাবছে। ঘরের ভেতরে ভ্যাপসা
গরম বৃষ্টি হতে পারে। আমরা দুজনে কেউ চা খাইনি। চা জুড়িয়ে ঠাণ্ডা প্রায়ই আমাদের এমন হয়। টুকরাে মেঘের
আড়ালে সূর্য চাপা পড়েছে।আমার মনটা বিষন্ন হয়ে গেলাে। সে বিষন্নতা মিতুল না সাইকির জন্যে, তা বুঝতে পারছি
না। হঠাৎ মিতুল আমার পাশে শুয়ে পড়লাে।

আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে জামী।
ওর মুখটা সাদা হলাে। দৃষ্টি ঘােলাটে।
আমার হাত-পা বুঝি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

আমি ভীষণ ভয় পেলাম। এ ধরনের ঘটনার জন্যে মােটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাড়াতাড়ি চোখে মুখে পানি দিলাম।
মাথায় বাতাস দিলাম। ও কেমন অবসন্নের মতাে শুয়ে আছে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর
মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ জলে ভরে ওঠে। আমার সব আবেগ মিতুলকে কেন্দ্র করে।
আমি জানি না ও এমন করে আমাকে টানে। মনে হয় যুগ যুগ ধরে মিতুলের মমি নিয়ে আমি বসে আছি। মিতুল আর
কোনােদিন নড়বে না, চড়বে না, কথা বলবে না। বুকটা মােচড় দিয়ে উঠলাে। নিজের ওপর রাগ হলাে। ইচ্ছে করলেই
আরাে আগে মিতুলকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারতাম। নিজের খামখেয়ালির জন্যে সেটা হয়নি। আমার কাছে
থাকলে ও এতটা মনােবিকলনের শিকার হতাে না। যে পরিবেশে ও থাকে, তার সঙ্গে ওর হাজার দ্বন্দ্ব। বাবার
ভালােবাসা আনন্দের বদলে ওকে কষ্ট দেয়। এসব কিছু আরাে আগে আমার বােঝা উচিত ছিল। আমি নিজের
দায়িত্ব যথাযথ পালন করিনি। অথচ মিতুলও এমন মেয়ে যে, কোনােদিন নিজের থেকে বিয়ের কথা বলেনি।
ও বললে হয়তাে আমি আরাে আগে বিয়ের ব্যাপারটা ভাবতাম। নিজের চুল টেনে ধরলাম। প্রতি মুহূর্তে
মিতুলকে আমি অসুস্থ করে তুলছি। রায়হানের চাইতে আমি কম খুনী নই।

অনেকক্ষণ পর মিতুল চোখ খুললাে, জামী, আমার ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমোও।
জামী, তােমার কি খুব খারাপ লাগছে?
তুমি ঘুমােও মিতুল।
তুমি কোথাও যাবে না তাে?
আমি তােমার পাশেই আছি।
তুমি গেলে আমার ভয় করবে।
আমি কোথাও যাবাে না।

মিতুল আমার বাম হাতটা নিজের মুঠিতে নিয়ে চোখ বুঁজলাে। ও যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাে,
আমি খাট থেকে নেমে লেখার টেবিলের সামনে এসে বসলাম।ভেবেছিলাম, আমি আর মিতুল
আজ সারাদিন চমৎকার একটা সংসার-সংসার খেলা খেলবাে। দেখবাে কেমন লাগে।তার আগে
মিতুল ঘুমিয়ে গেলাে। মিতুল যেন পাঁচ বছরের মেয়ের মতাে ধুলােবালির রান্নাবাড়া খেলতে খেলতে
মাটিতে ঘুমিয়ে গেছে। জেগে উঠে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু আসলে মিতুল ছেলেমানুষ নয়।
বােঝে অনেক।কিন্তু সে বােঝাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। ঠিক এমনি একটি মেয়ে। চরিত্রই
আমার উপন্যাসের নায়িকা। আসলে মিতুলকে আমি ভেঙে টুকরাে টুকরাে করে বিভিন্নভাবে
দেখবার চেষ্টা করছি। আসলে মিতুলকে আমি ভেঙে টুকরাে টুকরাে করে বিভিন্নভাবে দেখবার
চেষ্টা করছি। যত দেখি, দেখা আর ফুরােয় না। প্রতিবারই নতুন বােধ জন্ম নেয়। মাঝে মাঝে সেই
স্বপ্নের কথা মনে হয়। সেটা যেন এক আদিম যুগের ঘটনা। তারও অনেক আগে থেকে আমি
মিতুলকে দেখছি। কোনােদিন ওকে আমার খারাপ লাগেনি। আমার চোখ বুড়াে হয়নি।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।।সেলিনা হোসেন।। পর্ব ষোলউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আঠারো >>

One thought on “উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সতেরো

  • suraiya Chowdhury

    উপন্যাস টি পড়েছিলাম বহু আগে সম্ভবত কোন এক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়।সেই বয়সে।খুব মন ছুঁয়েছিল উপন্যাসের কাহিনি। আবার নতুন করে পড়বো। অনেক অনেক শুভকামনা
    প্রিয়লেখিকা সেলিনা হোসেন আপা র জন্য।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *