জয় বাংলা শিশুসাহিত্য উৎসব।। মা।। রণজিৎ সরকার

চার দিকে গুলির শব্দ। আশপাশের গ্রামের কোন বাড়িতে আগুন জ্বলছে। তালুকদার বাড়ির সবাই বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটা ধরেছে। মায়ের কোলে মাথা গুঁজে আছে এক বছরের কন্যা শিশু রতনা। হাঁটতে হাঁটতে সারাদিন সবাই ক্রান্ত। মায়ের কোলে রতনা কান্নাকাটি করছে। পেটে ক্ষুধা। পাঁচ বছরের মানিক বাবার হাঁট ধরে হাঁটছে। কিছুদূর গিয়ে একটা জঙ্গলের ভেতর গিয়ে বসল সবাই।

মা সবিতা রতনাকে বুকের দুধ খাওয়াল। তারপর রতনা একটু চুপ করল। মানিকেরও ক্ষুধা লেগেছে। ব্যাগের ভেতর চিড়া ছিল। চিড়া আর গুড় খেয়ে জল ওরা। এই জঙ্গলের ভেতর গেরিলাবাহিনি এল। তারা এসে সবাইকে সাবধানে ও সতর্ক থাকতে বললেন।

কেউ কোন শব্দ যেন না করে। ছোট মানিকের খুব ভয় করছে। কোন কথা বলা যাবে না। মানিক যেন ভয়ে বোবা হয়ে রইল।

আশপাশের অনেক বাড়িঘর আগুনে পড়ে দিচ্ছে। এবং গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। ভয় আর আতঙ্কে সবাই। যদি কোন ভাবে রাতে রাজাকার আর পাকিস্তানিবাহিনী টের পেয়ে যায় তাহলে তো সবাইকে শেষ করে ফেলবে। খুব করে রতনার কান্না থামানোর চেষ্টা করে। যখনই কান্না করে তখনই মা তার বুকের দুধ খাওয়ান। কিন্তু কান্না থাকে না।

কান্নার করার কোন কারণ তো খুঁজে পায় না কেউ। সবাই মনে মনে ভাবে ভয়ে আতঙ্কে কান্নাকাটি করছে।

এই জঙ্গলে এসে বসে গেরিলাবাহিনী পরিকল্পনা করছে। কারা কোন এলাকায় পাকিস্তানী ঘাঁটিতে হামলা করবে। মুক্তিবাহিনীর সবাই এসে ছোট শিশুর রতনাকে আদর করে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা মা এসে বললেন, ‘আপনার ছেলে ও মেয়ের দুর্ভাগ্যও বলতে পারেন। আর সৌভাগ্যও বলছেন পারেন।’
রতনার মা বললেন, ‘কেন?’
তিনি বললেন, ‘যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। রতনাকে নিরাপদে
রাখবেন। ওর জন্য যেন কোন ক্ষতি না হয়।’
’কোন মা কি কখনো সন্তানের ক্ষতি চায় বলেন। চায় না। আমিও চাইব না। আমি
মা হিসেবে নিজের কোলে নিরাপদেই রাখব। আপনি দেশের জন্য যুদ্ধ করছেন। করেন আপনার প্রতি আমার আশির্বাদ রইল।’

অন্য একজন গেরিলাবাহিনীর সদস্য এসে উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘মনে রাখবেন, রতনার জন্য আমাদের কোন ক্ষতি না হয়।’

’রতনার দ্বারা আবার কি ক্ষতি হবে। ও তো কথাও বলতে পারে না। হাঁটতেও পারে না। আপনারদের কোনো ক্ষতি করবে না।’
’তা ঠিক বলেছেন। কিন্তু রতনা একটা জিনিস করতে পারে। তা অনেক সময় ধরে শুনতে পারছি।’
‘কি সেটা?’
’ও কান্না করছে। ওর কান্নার শব্দ শুনেই পাকিস্তানবাহিনী আর রাজাকারেরা আমাদের এই জঙ্গলে এসে হামলা করবে। তখন আর আমাদের রক্ষা নেই।’
’ঠিক আছে। আমি রতনার কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। আপনারা টেনশন মুক্ত থাকুন।’
ছোট মানিক বোনকে কোলে নেওয়ার জন্য দুই হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা,
রতনাকে আমার কোলে দাও। আমি ওকে একটু আদর করি। তাহলেই হয়তো কান্না থেমে যাবে।’
মানিক চাওয়ার সাথে সাথে মা রতনাকে কোলে তুলে দিলেন। দাদার আদর পেয়ে
একটু চুপ করে তাকিয়ে রইল মানিকের দিকে রতনা। মানিক মাথা নাড়িয়ে বোনকে ইশারায় অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল। তবুও একটু পর আবারও কান্না করতে লাগল।
মানিক বলল, ‘বাবা, এবার বুনুকে তুমি একটু কোলে নাও। মনে হয় তোমার কোলে যাবে। সেজন্য কান্না করছে।’
মানিকের কথা মতো রতনাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল বাবা। রতনা বাবার
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর কিছু সময়। তারপর আবার কান্নাকাটি শুরু
করে। রতনার কান্না নিয়ে বেশ উদ্বেগ আর টেনশনে পড়ে যায়। কি করে মেয়ের কান্না থামাবে। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় আসে সবাই। হঠাৎ পাকিস্তানি একটা গাড়ি কিছু দূরে থামল। তারপর কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি আর কয়েকজন রাজাকার সাথে করে ওই জঙ্গলের পাশ দিয়ে একটার রাস্তা গিয়েছে। সেই রাস্তার দিকে আসতে লাগল। ওরা আসা দেখতে লাগল গেরিলাবাহিনী।
গেরিলাবাহিনীর প্রধান সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘কেউ কোনো কথা বলবে না। সবাই চুপচাপ থাকবে। এই যে রতনার মা, রতনার কান্না থামান। ওর কান্না শব্দে কানে গেলে আমাদের বিপদ হতে পারে। আমরা কেউ বাঁচতে পারব না। প্লিজ যেমন করে হোক রতনার কান্না থামান।’

রতনার মা ভীষণ টেনশনে পড়ে গেলেন। তিনি করি করবেন। কিছুতেই রতনার কান্না থামাতে পারছেন না। এবার তিনি বুদ্ধি করে বুকের দুধ মুখের ভেতর দিয়ে কান্না থামিয়ের রাখার চেষ্টা করলেন।

মানিক তার বাবার হাত ধরে চুপচাপ করে বসে আছে। ভয়ে কোনো কিছু বলার ও নড়াচড়ার সাহস পাচ্ছে না। পাকিস্তানী আর্মি ওই জঙ্গলকে লক্ষ করে গুলি ছাড়ল।

পাকিস্তানি আর্মি অনেক। জঙ্গলের ভেতর যে কয়েকজন গেরিলা আছে। তারা ওদের সাথে পারবে না। তাই গেরিলার চুপচাপ করে রইল। কোন আক্রামনে গেলেন না।

পাকিস্তানি আর্মিরা ওদের প্রায় কাছকাছি এলো। এর মাধ্যে রতনা মায়ের বুকের দুধ খাওয়া বাদ দিয়ে কান্না করতে শুরু করল। সাথে সাথে মা সবিতা আবারও বুকের দুধ রতনার মুখে ভেতর দিয়ে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রাখল। যেন কোনো ভাবে রতনার মুখ দিয়ে কান্নার কোন শব্দ বের না হয়।

একটু পর দেখে রতনা নড়াচোরা করে না। আর কোনো কান্নাকাটি নেই। পাশে থেকে মানিক ধীরে ধীরে বলল, ‘মা, রতনা তো নড়াচোরা করছে না। ওকে ঘুমিয়ে গেছে। যাক এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে গেল খুবই ভালো।’

রতনার মা এতে সময় বুঝে গেছে রতনা আর এই পৃথিবীতে নেই। রতনার কান্নার শব্দ পাকিস্তানি আর্মিরা টের পেলে আমাদের সবার মৃত্যু হতো। তাই একজনের বিনিময় যদি বিশ জনের প্রাণ বাঁচিয়ে দেশের জন্য কিছু করা যায় তাহলে একজন মা হিসেবে গর্ববোধ করা যায়। রতনা এখন স্বর্গবাসী হয়েছে।

মা প্রথমে মানিকের কাছে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল, ‘অনেক কান্নাকাটি করেছে তো তাই এখন ও ঘুমিয়ে গেছে। তুমি চুপ করে বসে থাক।’
মায়ের কথায় বিশ্বাস করে মানিক চুপকারে রইল। আর কোন কিছু বলল না।
মানিকের বাবা বললেন, ‘রতনাকে আমার কোলে দাও। তুমি অনেক সময় ধরে কষ্ট করছ। ওকে আমার কোলে একটুঘুমপাড়ায়।’
’না না তুমি এখন কথা বলো না।’
’এখন কথা বললে। আর কোনো সমস্যা হবে না। আর্মিরা চলে গেছে।’
’তবুও থাক। যদি তারা আবার ফিরে আসে তাহলে আবার বিপদ। তার চেয়ে রতনা আমার কোলে থাক।’
রতনার বাবা জোর করে কোলে নিতেই দেখে। রতনা আর বেঁচে নেই। ও মারা গেছে। মানিক জানা মাত্র হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করল। পাশের সবাই তখন কাছে এসে দেখেন রতনাকে সত্যি মারা গেছে।

মানিক কান্না করতে করতে বলল, ‘মা তুমি একি করলে। রতনাকে মেরে ফেললে!’
মা বুকে পাথর চাপা দেওয়া দুঃখ নিয়ে বলল, ‘রতনাকে হারিয়ে আমি অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছি।’
সবাই অবাক।
তখন মানিক বুঝতে পারল মায়ের দুঃখের কথা আর দেশ প্রেমের কথা। মানিক শেষ বাবার মতো রতনার শরীরে আদর করে দেখতে লাগল। হঠাৎ পায়ের দিকে হাত পড়ে গিয়ে দেখে মুজা পরা ছিল। সে মুজাটা অনেক টাইট হয়ে নরম পায়ের ভেতর বসে গেছে। দাগ পরে গেছে। মানিক তখন মাকে বলল,
 ‘মা, এই দেখ বুনুর পাযের ভেতর মুজার দাগ হয়ে গেছে। এই জন্যই বুনু কানাকাটি করেছিল। মুজাটা খুল রাখলে বুবু কান্নাকাটি করত না।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা মানিকের কথা শোনা মাত্র মানিককে জড়িয়ে ধরে বলল,
’সব দোষ আমারে বাবা। আমি এই মুজাটা পরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার কারণেই আজ মেয়েটার এমন অবস্থা হলো।’
মা চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘সব দোষ আমার।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল,
‘রতনা শহীদ হয়েছে। তোমরা আর কোন চিন্তা করো না। ওরা জন্য দোয়া কর সবাই। এক রতনা আমাদের অনেকের জীবন বাঁচিয়ে গেল। দেশ স্বাধীন হলে রতনার নামে আমরা এখনে একটা ভাস্কর্য তৈরি করব। রতনাকে আমরা আজীবন মনে রাখব, রাখতে হবে সবাইকে।’

গেরিলবাহিনীর একজন বলল, ‘রতনা লাশ নিয়ে এতো বসে থাকলে চলবে না। ওর লাশটা সৎকার করে ফেলতে হবে না।’
বাবা বললেন, ‘এখানে তো শ্মশান নেই। কোথায় সৎকার করব।’
’শ্মশানে তো নেই। আর এই জঙ্গলের ভেতর পরানো যাবে না। পড়াতে গেলেই পাকিস্তানী আর্মি টের পেয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে এখানে কবর দিতে হবে। ভবিষ্যতে এইখানে ওর একটা ভাস্কর্য তৈরি করব।’

মানিক বলল, ‘আমার বোনকে কোলে নিয়ে আমি সাথে সাথে ঘুরব।’
অন্য একজন গেরিল বলল, ‘নানা বাবা। মরা মানুষ নিয়ে ঘোরা যাবে না। আরো বিপদ হতে পারে।’
বাবা বললেন, ‘না বাবা মানিক। তুমি শোনো নাই। মানুষ মরলে বাঘ হয়। আর বাঘ মরলে মানুষ হয়। তুমি ভয় পাবে। বুনুকে আমরা এখানে রেখে যাই। দেশ স্বাধীন হলে আমরা এসে এখানে বুনুর নামে ভাস্কর্য করব।’

মানিক বলল, ‘বাবা, এই যুদ্ধের সময় কার কখন কোন বিপদ হবে কেউ তো তা বলতে পারবে না। তাই বলছি, বুনুর জন্য হলোও আমাদের সতর্ক থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এবং দেশের জন্যও কাজ করতে হবে।’
ওদের মা কোনো কথা বলছেন না। অন্যেরা বলছে এখন থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে। কারণ এখানে থাকলে যে কোন সময় বিপদ হতে পারে। তাই তারা কোন ভাবে এখানে নিরাপদ মনে করছে না। রতনাকে কবর দেওয়া হলো। তারপর ওর হেঁটে যেতে লাগল। কিছু দূর যাওয়ার পর মানিক একটা ফুল ছিড়ে নিয়ে এসে রতনার কবর দিয়ে গেলে। তারপর আবার ওরা হাঁটতে লাগল।

মানিক বলল, ‘বাবা, আমরা আর কত দূর যাব?’
’বাঁচতে হলে সতর্ক থেকে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতেই হবে। কত দূর যেতে হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না।’
’যুদ্ধ শেষ হবে। আমরা স্বাধীন দেশ দেখতে পারব তো বাবা।’
’বাঁচার জন্যই তো এগিয়ে যাচ্ছি।’
বাবার কথা শুনে মানিক বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে। নতুন একটা দেশের জন্ম হওয়া হবে। সেই দেশের স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। এমন স্বপ্ন দেখে এগিয়ে যেতে লাগল বাবা মায়ের সাথে। কিন্তু বাবা মা জানেন না এ যুদ্ধের শেষ কবে হবে। কোথায় গিয়ে তাদের পথ শেষ হবে। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা শিশু কান্নার শব্দ পেল। মানিকের মা এগিয়ে গেল। গিয়ে দেখে শিশুটির একা কান্না কাটি করছে। পাশে রক্তাত অবস্থায় তার মায়ের মৃতদেহ পড়ে আছে। তখন আর ওদের বোঝার বাকি রইল না। শিশুরটির মাকে কারা এমন নির্যাতন করে হত্যা করেছে।

শিশুটি কোলে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরল মানিকের মা সবিতা। মুহূর্তে শিশুরটির কান্না থেমে গেল। সবিতা মনে মনে ভাবল, আমি কি রতনাকে ফিরে পেলাম। রতনাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিল ওরা। কয়েকদিন পর ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বিজয়ের লাল সবুজের পতাকা উড়াতে লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *