ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চার

গতকাল অনেক সময় কাটিয়েছে সে ছেলের সঙ্গে। বোঝতে চেষ্টা করেছে। কয়েকটা চমৎকার মিথ্যে বলেছে। মার খুব অসুখ, মা এ বিয়ে ছেলেবেলায় ঠিক করে রেখেছিল, এসব। ছেলে সব শুনে, মিটিমিটি হাসে, কিছু বলে না। একতরফা কতক্ষণ কথা চালানো যায়? অন্য কেউ হলে রুম্পা ঠিক উঠে আসতে। কিন্তু সে ঠিক জানে, এ ছেলেকে নরম করতে না পারলে সময়মত ঠিক বাগড়া দেবে। কিন্তু তাই কি হতে দেওয়া যায়! অসম্ভব, তার বহুদিনের ইচ্ছে বিদেশে সেটেলড্ হবে। হ্যাঁ মাঝে মাঝে আসবে বটে দেশে। তবে সে আসা হবে নিছক বেড়াতে আসা।
কিন্তু ছোকড়া দড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে তো আগেই। রুম্পা বলছিল—আশ্চর্য, তুমিও এ যুগে ছেলে হয়ে সামান্য কয়েকদিনের সম্পর্কে বিয়ে পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চাও। অ্যাবসার্ড, তোমাকে তা মোটেই মানায় না।’ ছেলে বলেছিল — ‘কই, চাই না তো।’ ‘তবে?’ —রুম্পা জানতে চেয়েছিল। ‘তবে কি?’ —ছেলের পাল্টা প্রশ্ন। রুম্পা বলেছিল —-তবে আমার জিনিসগুলো দিয়ে দাও না।’ জিনিস বলতে বেশ কয়েকটা চিঠি। রুম্পার এই এক স্বভাব, চিঠি না লিখে থাকতে পারে না। মুখে বলা যায় না, কিন্তু চিঠিতে লেখা যায় অনেক কিছু, বানিয়ে বানিয়েও— এ ব্যাপারটা বেশ লাগে তার। আর আছে দু’তিনটে ফটো, একটা একটু খোলামেলাই। সেটাই বড় অসুবিধে। একটা সাধারণ অ্যাফেয়ারকে দীর্ঘদিনের প্রবাসী ঐ ছেলেটা নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবে না, কিন্তু ছবিটা বিপত্তি ঘটাতে পারে।
রুম্মা তার জিনিসগুলো ফেরত চাইলে ছোকড়া বলে— ওগুলো ফেরত নিয়ে কি করবে, থাক না আমার কাছে।’ ‘তুমি ও গুলো রেখে কি করবে, —রুম্পা জানতে চায়। ‘স্মৃতিচিহ্ন’— ছোকড়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। স্রেফ ইয়ার্কি মারছে, রুম্পা বোঝে। স্মৃতিচিহ্ন ফিহ্ন কোনো ব্যাপার না। আর ছোকড়াকে কোনো দিন দীর্ঘশ্বাসও ফেলতে দেখেনি সে। তবুও সে হাল ছেড়ে দেয়নি— ‘ধ্যাৎ, তোমার মতো ছেলের মুখে স্মৃতিচিহ্ন কথাটা একদম মানায় না।’ ছোকড়া হাসে—‘তাই বুঝি? তা তুমিই বা এগুলো নিয়ে কি করবে রুম্পা, তোমারইবা ওগুলো কেন দরকার, বল?’
কি বলে রুম্পা? এমন ফ্যাসাদ! সে ব’সে ব’সে দাঁতে নোখ খোটে। কতক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে আবারও আরম্ভ করে। একটু শরীর ঠেকিয়েও বসেছে সে। ছোকড়ার চুলে আদর ক’রে হাতও বুলিয়েছে। কিন্তু এসব এবং কয়েকটি চুম্বনও কোনো কাজে দেয়নি। ছোকড়ার কোনো দূর্বল জায়গাও আগে অবজার্ভ করে রাখা হয়নি। এখন কোনো চাহিদাও দেখতে পাচ্ছে না তার। ছোকড়া সে রকম কোনো আভাস দিলে, সে না হয় বিনিময় মূল্য দেওয়ার কথা ভেবে দেখতো।
শেষে সে ওঠে, বলে,— ‘যাচ্ছি জামান, তুমি আজ আমার সঙ্গে খারাপ বিহেভ করলে….. কাল আসবো, প্লিজ তুমি ওগুলো দিয়ে দিও, তোমার মতো ছেলের এরকম করা মানাচ্ছে না…..।’
‘ব্যস ব্যস’— জামান হাত ওঠায়—-‘কান পচে গেল ঐ এক কথা শুনে। তা তোমার কথা ভেবে দেখবো। কাল ক’টায় আসছো?’
সময় শুনে জামান মাথা ঝাঁকায়— ‘ওয়েল, সকালের দিকেই এসো। কিন্তু এক অসুবিধে কি জান, কাল এক জায়গায় যাওয়ার কথা। কিছু টাকা পেতাম। হাত একদম খালি।’
স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড ছেলেটা এভাবে ঘুরিয়ে কেন কথা বলে রুম্পা ভেবে পায় না সে হেসে জিজ্ঞেস করে ‘তোমার কত টাকা দরকার?’
‘পাঁচ হাজার। নো মোর নো লেস।’
এক ধাক্কায় হাজার পাঁচেক নেমে যাবে। কিন্তু রুম্পা তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না। ‘ঠিক আছে, কাল আমিই না হয় তোমাকে দেব টাকা, অ্যাজ এ ফ্রেন্ড’ —

এই বলে সে বেরিয়ে আসার আগে জামান তাকে থামায়। একটু বসে জামান, বলে— ‘আর শোন, মেন্টালি একটু প্রিপেয়ার্ড হ’য়ে এসো। আমি মেয়েদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই না । সুতরাং ইচ্ছেটা শরীরে বা মনে সঙ্গে ক’রে নিয়েই এসো। অলরাইট? আমি কি বলছি, বুঝতে পারছো, তাে?’
সারারাত ঘুম হয় না রুম্পার। ঘুমের অসুবিধে নেই , দিব্যি সাউণ্ড স্লিপ তার। কিন্তু, সারারাত তার কাটে বিছানায়। এপাশ ওপাশ করে।
সে ভেবেছিল জামানের কাছ থেকে জিনিসগুলাে হাতিয়ে এনে আরাম – আয়েশে কাটাবে বাকি দিন ক’টা। কিন্তু তা আর হলাে কই। রাতে সে কি করবে তারও একটা প্লান করে রেখেছিল। চমৎকার প্লান, খুব মজা হবে, তার ধারণা ছিল।
এতদিনকার এত অসংখ্য প্রেমিকের কারে চিঠি বা ফটোই সে নষ্ট করেনি। কেন করবে। অবসরে ও গুলাে পড়তে তাে ভালাে লাগে, দারুণ কাটে সময়। সে ভেবেছিল জামানের কাছ থেকে ফিরে এসে রাতে ঐ চিঠিগুলাে নিয়ে বসবে। একটা একটা ক’রে পড়বে, একটা একটা করে চুম্বনের পর ফেলে দেবে ওয়েস্ট – পেপার বাস্কেটে। ফটোগুলাের ভাগ্যও সে এভাবেই ঠিক করে রেখেছিল । ভেবেছিল পরদিন সকালে আগুনে সব পুড়িয়ে ফেলে সে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
জামানের কাছ থেকে ফিরে এসে ওসব আর ধ’রে দেখতে ইচ্ছে করে না। থাক, ওগুলাে যেমন আছে থাক। ওসব, দিন দুই পরে করলেও কিছু এসে যাবে না। জামানকে নরম না করা পর্যন্ত বরং অনেক কিছু এসে যায়।
বাড়ি ফিরে সে ব্যাঙ্কের হিসেবপত্র নেড়ে – চেড়ে দেখেছে। হাজার তিনেক টাকা তােলা যাবে। বাকী দু’হাজার বাবার কাছ থেকে ম্যানেজ করতে হবে। সেটা সমস্যা না। শুধু নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে তিন হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে এই তার দুঃখ। ট্রাপে পড়ে কোনাে ছেলের জন্যে নিজের টাকা ভাঙ্গতে হচ্ছে, এতদিন তাে উল্টোটাই ঘটেছে — এ ব্যাপারটা তাকে বড় জ্বালায়।
টাকা না হয় গেল? কিন্তু তার পরের ব্যাপারটা? জামান আরাে কিছু চেয়েছে। সে এমন কোনাে বিরাট ব্যাপার নয় তার কাছে। জামান যা চেয়েছে , দেবে সে, আগেও পছন্দসই দু’তিনজনকে দিয়েছে বার কয়েক। কিন্তু জামান এখানেই স্যাটিসফায়েড হবে তাের? এখন লজ্জায় – ঘেন্নায় তার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। মন খুলে সে, লুচ্চা, বদমায়েশ; হারামজাদা আমাকে ব্লাকমেইল করতে চায়’ বলে গালি গালাজ করে। কিন্তু সে সুস্থির হয় না। সব চাহিদা পুরণের পরও যদি জামান জিনিসগুলাে ফেরত না দেয়— এই চিন্তায় সে ছটফট করে।
রাতে ঘুম হয় না । তাই সকাল থেকেই মেজাজটা তার খচে থাকে। রােজ ভােরবেলা উঠে সূর্যের আলাের সঙ্গে শরীর মিলিয়ে দুতিনটে ফ্রি হ্যাণ্ড এক্সারসাইজ সারে সে। নইলে শরীর ঠিক থাকে না, অপ্রয়ােজনীয় মাংস জমে। তারপর মৃদু গরম পানিতে প্রায় আধ – ঘন্টার একটা গােছল। এসবে বিন্দুমাত্র আলস্য নেই তার। কি আজ ওসবের কিছুই হয় না।
সকালে বিছানায় উঠে বসে কতক্ষণ ঘাড় গোঁজ করে থাকে। নড়তে- চড়তে শরীরের আড়মােড়া ভাঙতেও ইচ্ছে করে না। শেষে ওঠে সে। মুখ ধুয়ে পাঁচ মিনিটের গোসল সেরে নেয়। ব্রেকফাস্টের টেবিলে বাবার কাছে টাকা চাওয়া ছাড়া আর একটি কথাও বলে না সে কারও সঙ্গে। তৈরি হ’তে দেরি হয় না। পােশাক পাল্টে ব্যাংকের চেক বই ব্যাগে পােরে। বাবার কাছ থেকে টাকাটা নেয়। বাড়ির কাছেই ব্যাংক। টাকা তুলে সে এগােয়। জামান নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করবে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। তৃতীয় পর্বধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পাঁচ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *