ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সাত

উপদেশ দিস না জামেরী। জানিস, ছন্দা চলে যাবার পর আমার মনে হলো বুলেটের একটা গুলি অন্ধকারে ছুটে গেছে। সাঁই সাঁই করে কোথায় গিয়ে লাগলো, আমি তা ঠাহর করতে পারলাম। কিন্তু আমি জানি, আমার হাতের নিশানা কখনো মিস হয় না।

তোকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় এগোতে হবে রায়হান। আঃ জামেরী, তুই কেবল গুগম্ভীর মুরব্বীর মতো উপদেশ দিতে শুরু করলি।

আমি জানতে চাই, ছন্দাকে দেখে তোর কি মনে হলাে?
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম, ছন্দা ভালাে মেয়ে।
ধুত্! বােকাস! রায়হান আমার ওপর রেগে গেলাে। দেখ জামারী অামি সােজা সােজা কথা বুঝি। ভেতরে আবেগ আছে ভোলােবাসি। কিন্তু ভালােবাসার তত্বকথা বুঝি না। কথার মারপ্যাচ আমার ধাতে সয় না। এ জন্যে লেখক জাতটাকে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। চলি, আমার কাজ আছে।

বায়হান আমাকে একরকম উপেক্ষা করেই বেরিয়ে গেলাে। সে জন্য আমার কোনাে দুঃখ নেই। কারণ রায়হানকে সত্যি কথাটা আমি বলতে পারিনি। আমি বুঝেছি, ছন্দা কোনােদিনই ওর হবে না। ছন্দার বুকের ভেতর সাদা আগুনের শিখা জ্বলছে। সে আগুন দেখা যায় না কিন্তু পুড়িয়ে মারে। কিন্তু ছন্দার মুখটা আমি ভুলতে পারলাম না। সেই নরম দীপ্তি সৌন্দর্য আমার স্নায়ুকে মাতাল করে রাখলাে। ওর জন্যে আমার দুঃখ হলাে। সাইক তুমি ভুল জায়গায় পড়েছ। রায়হানের হৃদয়টা নরকের চেয়ে বেশি ভয়ানক। ও সবসময় আগুন পােষে। হ্যা, বিশ্বাস করাে, আদুরে খরগােশের বাচ্চার মতাে আগুন পােষে। তাকে যত্ন করে, খেতে দেয়, কোলে নিয়ে চুমু দেয়। তারপর দরকার মতাে সে আগুনে যে কাউকে পুড়িয়ে মারে।
সাইকি আমি বুঝতে পারছি তুমি বাঁচতে পারবে না। তুমি স্বর্গীয় মেয়ে, স্বচ্ছতােয়া সরােবরে তােমার অবগাহন। আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি করে ভুল করলে? সাইকি বড় দুর্গম পথে এসে পড়েছ।
স্যার, যাবেন না?
বেয়ারার ডাকে আমার ধ্যান ভাঙে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে আসি। বাইরে ঠা ঠা দুপুর। মাথার ওপর ঝকঝকে রােদ। একটা বড় উপন্যাসে হাত দিয়েছি। মাথার ভেতর সেই ছকটা কাজ করছে। পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, হর্ণ বাজছে। প্রশস্ত রাজপথে আমি নির্বিকার দাঁড়িয়ে। যাবার জায়গা ঠিক নেই। দূরে গাছের মাথায় রায়হানের দৃষ্টির মতাে ঝকঝকে রােদ। কার দিকে যেন রােষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বড় লাল বাড়িটার মাথায় দুটো কাকা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বসে। পায়ের নিচে গরমের ঝিঁঝিঁট বাজছে। এসব দৃশ্যের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছি না বলে বিরক্তি ধরছিলাে। অথচ ঝকঝকে রােদ আমার ভালাে লাগে।

একতরফা পক্ষপাতিত্বের ভালাে লাগা আর কি! সবকিছুর মধ্যেও উপন্যাসের ছকটা আমার মাথার ভেতর ট্রেনের মতাে ছুটছে লেখার কোনাে একটা ছক যখন আমি গ্রহণ করি , তখন সেটা সারাক্ষণ আমার মাথার ভেতর শীতল পাটির মতাে বুনট হতে থাকে। খাবার সময়, বাথরুমে, কারাে সঙ্গে কথা বলতে থাকলেও একটি উপমা, একটি শব্দ, একটি বিশেষ লাইন ঠিক আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাবে। উপন্যাসটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার রেহাই নেই। অন্য কিছু আর ভাবতে পারি না। অথচ দ্রুত লিখে যে শেষ করব, তাও হয় না। একটু একটু করে আমাকে লিখতে হয়। একসঙ্গে একটানা লেখা আমার ধাতে নেই। হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্তানের সামনে এলাম। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মিতুল ফল কিনছিলাে। আমি ওকে দেখে ভীষণ খুশি হলাম। এতক্ষণ বড় একঘেয়ে লাগছিলাে। আমি চুপচাপ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও তখনাে আমাকে দেখেনি। ফল কিনে এগুতেই বেণীতে মৃদু টান দিলাম। বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে আমাকে দেখেই ওর মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলাে।

উঃ জামী, তুমি! আমি মনে মনে তােমাকেই খুঁজছিলাম ।
কেন?
জানাে, অফিসে একটু ভালাে লাগছিলাে না, তাই ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে বেরিয়ে মনে হলাে, তুমি যদি কাছে থাকতে, কি যে ভালাে লাগতাে! মনে মনে বললাম, এজন্যেই তাে তুমি আমার মিতুল। তােমাকে আমার শ্রাবণের বর্ষণমুখর রাত্রির মতাে ভালাে লাগে। তােমাকে সারারাত বুকের মধ্যে রেখে আমি বৃষ্টির গান শুনি।

জামী, তুমি কোথায় যাবে?
তােমার সঙ্গে।
চলাে, আমরা একটা রেস্তোরায় বসি।

ঘুরে ফিরে আমি আবার কাফে রেস্তোরাঁয় এলাম। রেস্তোরাটা আমার ভালাে লেগেছিলাে। নির্জন পরিবেশ মিতুলেরও উপযােগী। রায়হানকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। রেস্তোরাঁরাটার খবর আমার জানা ছিলাে না। ছিমছাম পরিবেশে মিতুল খুশি হলো।

জায়গাটা বেশ ভালাে জামী।
তােমার জন্যেই তাে খুঁজে রেখেছি।
মনে মনে ভাবলাম, এখানে ঘণ্টা দুয়েক আগে একটা নাটক হয়ে গেছে। সাইকি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে। সে নাটকের শেষ পরিণতি এখনাে মঞ্চায়নের অপেক্ষায়।
কি ভাবছাে জামী?

কিছু না।
আমি ওর চোখে চোখ রেখে হাসলাম। মিতুলকে আজ খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলাে। ও কথায় কথায় হাসছিলাে। আমার খুব ভালাে লাগছিলাে। মনে হলাে ভেতরের সব একঘেয়ে ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। ‘মস্কো মাই লাভ’ ছবির জাপানি নায়িকার কথা আমার মনে হলাে। ঠিক সেই উচ্ছল ইউরেকোর মতাে লাগছিলাে মিতুলকে। আমি আর মিতুল দু’জনেই কয়েকবার সে ছবিটা দেখেছি। ছবির শেষে ইউরেকার মৃত্যু মিতুল সহ্য করতে পারতাে না। ওর চোখে জল চিকচিক করতাে। আমি এই মুহূর্তে ওকে বলতে যাচ্ছিলাম ইউরেকার কথা। পরক্ষণে চেপে গেলাম। ইউরেকার কথায় মিতুলের মত খারাপ হয়ে যায়। আমি একবার ওকে ইউরেকার সঙ্গে তুলনা করেছিলাম। তখন ওর কালাে চকচকে চোখে আঁধার ঘনিয়েছিলাে। বলেছিলাে, ইউরেকা মারা গেছে জামী। আমিও কি মারা যাবাে? সেদিন আমি ভীষণ অনুতপ্ত হয়েছিলাম। আর কখনাে ওকে একথা বলিনি।

জানাে জামী, অফিসে বসে কিছুক্ষণ আগেও সমস্ত একঘেয়েমির বিরুদ্ধে মনটা বিদ্রোহ করেছিলাে। এখন তােমাকে দেখে আমার সব ক্লান্তি উঠে গেছে। তুমি কি করে জানলে জামী যে, আমি মনে -প্রাণে তােমাকে চাইছিলাম?
আমি ওর হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললাম, মিতুল, তুমি নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের কথা কি ভুলে গেছাে? ঐ যে বস্তুর প্রতিটি কণা অপর প্রতিটি কণাকে আকর্ষণ করে।
পৃথিবীই শুধু গাছের আপেলকে আকর্ষণ করে না, আপেলও পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। এই ক্ষেত্রে তুমি হলে পৃথিবী আর আমি আপেল। কেননা তােমার আকর্ষণ ছিলাে প্রবল। সেজন্যে আমি বৃন্তচ্যুত হয়ে ছুটে পড়েছি।

যাঃ ফাজিল!
মিতুল আমার হাতটা টেনে গিয়ে গালে ঘষে। মিতুল তুমি যেখন থেকেই আমাকে ভালাে না কেন টেলিপ্যাথির মাধ্যমে সে খবর আমার ইন্দ্রিয়ের কাছে এসে পৌঁছুয়।
সব বানিয়ে বানিয়ে বলছাে?
পাগল! তােমার কাছে বানিয়ে বলা মানেই তাে নিজেকে ফাঁকি দেয়া। সে কি আমি পারি? আচ্ছা মিতুল, বলাে তাে তােমাকে আমার এত ভালাে লাগে কেন?
জানি না।
মিতুল চোখ নিচু করে। এই মুহূর্তে ও সম্পূর্ণভাবে আমার আশ্রয়ে। এখন ওর আর অন্য কোনাে মন নেই। মিতুল হঠাৎ অকারণে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলাে। জানাে জামী, এই দুপুরে তােমাকে না পেলে আমি ঠিক চন্দনার ওখানে যেতাম।
গিয়ে কি করতে?

কি আর খানিকক্ষণ বকব্ক করতাম। ওর বকবকানি শুনতাম। নয়তো ক্যারাম খেলতাম।
বেয়ারা খাবার দিয়ে গেল। মিতুল ওর অর্ধেকটা আমাকে উঠিয়ে দিলো। আমি গালে হাত রেখে ওর দিকে শাসনের দৃষিটতে তাকালাম। ও জানে, খাবার নিয়ে ওর সঙ্গে আমার প্রায়ই রাগারাগি হয়। ও হেসে বলে, সত্যি বলছি জামী ,আজ আমার একটু খিদে নেই।
কোনদিন থাকে?
রোজই থাকে। ও জোর করে হাসলো।
আজ যদি তুমি পরোটা না খাও, তবে আমি খাবো না।
প্লিজ জামী, জোর করো না।
খাবোই না।
মিতুল আমার থেকে ওর অংশটা নিজের প্লেটে উঠিয়ে নিলো।
এবার খুশি তো?
একদম।
তোমার মতো লোক আমি দুটো দেখেনি।
তার মানে? কতজনের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে?
যাঃ!
মিতুলের মুখে বিব্রতের হাসি। আমিও জোরে জোরে হাসলাম।

ওকে ঘাবড়ে দিতে মাঝে মাঝে আমার ভালো লাগে। ওর সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে আমি ছেলেমানুষিভরা আবদার দেখতে পাই। শসনও নয়, অনুযোগও নয় এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রেস্তোরায় অনেকক্ষণ কাটিয়ে আমরা যখন বেরিয়ে এলাম, তখন পড়ন্ত বিকেল। ফুটপাট ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালো। আমার হাত আঁকড়ে ধরলো। দেখলাম, ওর ঠোট কাঁপছে। আমি অবাক।
কি হয়েছে মিতুল?
ঐ ভদ্রমহিলাকে দেখো!
ঐ যে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলা কিনছেন? পরনে সবুজ শিফন শাড়ি। হাতে সাদা ব্যাগ।
হ্যাঁ, দেখছি তো। কিন্তু চিনতে পারছি না।
আমার মনে হচ্ছে কী জামী, ঠিক আমার মা। হয়তো আমার মা এ রকমই
ছিলেন।
বুকটা আমার ভার হয়ে এলো। একটা কথা বলতে পারলাম না।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব ছয়ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আট >>

One thought on “ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সাত

  • নভেম্বর ১১, ২০২০ at ১২:১৭ অপরাহ্ণ
    Permalink

    সাতটি পর্বই পড়লাম। খুব ভালো লাগছে পড়তে। অপেক্ষায় থাকব।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *