বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। নবম পর্ব

নয়.

কী কপাল আমার !

অ্যামির মেজাজ খারাপ। স্বামীকে শুনিয়ে বলল কথাটা।

তোমার কপাল তো দেখতে অনেক সুন্দর। টিপ পরলে আরও বেশি সুন্দর লাগে। ইকো হেসে বলল। বউয়ের কথায় কেন এত ঝাঁজ তা ঠিকই বুঝতে পেরেছে ইকো। অফিস থেকে ফিরতে দেরি করে ফেলেছে। এখন প্রশংসা করে পটানো ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো উপায় নেই। অন্তত তার আর কোনো উপায় জানা নেই।
এগুলো টিনেজ মেয়েদের বলো, ওরা পটতে পারে। আমাকে ন্যাকা কথা শোনাতে এসো না। একদম ভালো হবে না। অ্যামি গজগজ করতে থাকল।
যাহ্ ! কী যে বলো না। টিনেজদের কেন পটাতে যাবো ? আমার ঘরে বউ আছে না। আমার বস তোমাকে দেখে কী বলেছিলেন মনে নেই ? বলেছিলেন, ইকো, তুমি একটা টিনেজ মেয়েকে কেন বিয়ে করেছো ? পরে আমি বললাম, কী বলছেন স্যার ! অ্যামি তো পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে। সত্যি বলছি, আমার কাছে এখনও কিন্তু তোমাকে টিনেজই মনে হয়।

ও তার মানে তুমি বলতে চাইছো, আমি এখনও পরিনত হইনি। প্রায়ই টিনেজদের মতো বায়না করে বসি। ঠিক কিনা ?

দ্যাখো কান্ড, কী কথার কী অর্থ বের করলে। আমি বলতে চেয়েছি, তোমাকে দেখতে এখনও টিনেজদের মতোই লাগে।
ছাই লাগে।
আজ আমাদের বিয়ের দেড় বছর পূর্তি। সকালে এতো করে বলে দিলাম তাড়াতাড়ি এসো। কিন্তু গুলে খেয়ে বসে আছো। আবার এখন আদিখ্যেতা করা হচ্ছে। ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়।

আহা, গা জ্বলার কী দরকার। গা জ্বললে তো সখীর সোনার অঙ্গ কালো হয়ে যাবে।
হোক কালো।
এই দেড় বছরে তো জীবনটাই পুড়ে কালো কয়লা হয়ে গেছে। কী সোনার সংসার করছি আমি !

আরে, কী মুশকিল। এই দ্যাখো, এরই মধ্যে চোখ ছলছল। কত বার বলেছি বাইরে যাওয়ার আগে এ রকম করবে না। চোখের কাজল নষ্ট হয়ে যায়। যাও, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

সন্ধ্যা পেরিয়েছে সেই কখন। এখন আর বাইরে গিয়ে কী হবে ? আমি যাব না।

যাবে না বললেই হলো। আরশিতে আমি টেবিল বুক করে রেখেছি।

আমাকে ভোলাতে তুমি মিথ্যে বলছো। ঠিক না ?

আরশি অ্যামির খুবই পছন্দের একটা রেস্টুরেন্ট। লেকের ধারের টেবিলটা তার কাছে বিশেষ কিছু। কারণ এখানেই প্রথম একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিল তারা। পরে যে তারা একসঙ্গে পথচলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে সেই সন্ধ্যা ও ওই টেবিলটার অনেক বড় ভূমিকা আছে।
ইকো বুঝতে পারল, ওষুধে কাজ হতে শুরু করেছে। সে গোবেচারার মতো মুখ করে বলল,
মোটেই মিথ্যে বলছি না। তুমি গেলে বুঝতে পারবে। আরে, সব কিছু তো ঠিকই ছিল। বস শেষ বেলায় মিটিং ডেকে ঝামেলাটা বাঁধিয়ে দিলেন।

সরি। তোমার আসতে দেরি হওয়ায় আমার মাথা গরম হয়ে ছিল। আমি ঝটপট তৈরি হয়ে নিচ্ছি। সরি, ঠিক আছে ?

সব ঠিক আছে। এত বার সরি বলতে হবে না। আর রাগলে তোমাকে বেশি টিনেজারের মতো দেখায়।
সুযোগ পেয়ে দুষ্টুমি শুরু করে দিলে ? দুষ্টুর রাজা একটা।
অ্যামি ফিক করে হেসে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াল। ইকোও জবাবে হাসল। তবে তার হাসিটা তত চওড়া হলো না। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে কেমন একটা ফিসফিসানি শুনেছে। পরিবেশও যথেষ্ট গুমোট আর থমথমে মনে হয়েছে। সবাই যেন একটু বেশি সতর্ক। অ্যামিকে কী কথাটা বলবে ? ও হয়ত এটাকে বাইরে না যাওয়ার একটা অজুহাত মনে করবে। এমনিতেই অ্যামি মাঝে-মধ্যে তাকে ‘জ্যাঠা’ বলে ডাকে। ভ্রু কুঁচকে চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলে, জ্যাঠাদের মতো আচরণ করো না তো। তোমার আচরণ দিনকে দিন জ্যাঠাদের মতো হয়ে যাচ্ছে।

আরশিতে ছোট্ট টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি বসে আছে ইকো আর অ্যামি। মৃদু লয়ে সংগীত বাজছে। লেক থেকে শীতল হাওয়া এসে তাদেরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অ্যামির মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। এখানের খাবারও খুব সুস্বাদু। একটু দূরে একটা টেবিলে বসেছেন এক দম্পতি। তাদের সঙ্গে আছে বছর তিনেকের একটা মেয়ে। চঞ্চল সন্তানকে সামলাতে তাদের ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে। অ্যামি মাঝে- মধ্যেই সেদিকে তাকাচ্ছে। বিষয়টা ইকোর চোখ এড়াল না। একবার ধরা পড়ে যেতেই অ্যামি বলল, দ্যাখো বাবুটা সুন্দর না ?

জবাবে কিছু না বলে ইকো শুধুই হাসল। আর তাতেই কী কারণে যেন লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো অ্যামি। সময়টা দারুণ উপভোগ করছিল অ্যামি ও ইকো। উপস্থিত সবার কাছেই সময়টা উপভোগ্য মনে হচ্ছিল। হঠাৎ একটা ঘোষণায় চমকে গেল সবাই। সংগীত থেমে গেছে। বদলে শোনা যাচ্ছে আধা-ধাতব গলা।

‘উপস্থিত ভোক্তা ও অতিথিরা, বিরক্ত করার জন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, আজকের মতো আমাদের সব ধরণের সেবা প্রদান বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। মহামান্য উতু আমাদের এই গ্রহের নতুন অধিপতি হয়েছেন। আমরা এই অর্জনকে দারুণ ভাবে উদযাপন করতে চাই। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’

হঠাৎই চাপা সোরগোল শুরু হলো। সুন্দর শিশুটিকে দু’হাতে আকড়ে ধরে একটু দূরের টেবিলের সেই ভদ্রমহিলা বললেন,
হায় প্রভু, এখন কী হবে ?
তার স্বামী তাকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ভয় পাচ্ছো কেন ?
আরও অনেকে আছে তো এখানে। কিছু হবে না, দেখো। ইকো নিজেকে ধিক্কার দিলো। আঁচ পেয়েও বাইরে আসা মোটেই ঠিক হয়নি। অ্যামির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ইকোর হাত আকড়ে ধরে সে বলল,
কী শুনছি এসব। তবে কী… ?
কথা শেষ করার সাহসটুকুও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে।

রেস্টুরেন্টে উপস্থিত সবার অলক্ষে আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। আরশির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অর্ণব তার কক্ষে বসে দাপ্তরিক কিছু কাজ করছিলেন। কিছুক্ষণ আগে সেখানে গিয়ে হাজির হয় এদু। এই রেস্টুরেন্টে এদুর মতো অনেক যন্ত্রমানব কাজ করে। মূলত তারাই সব ধরণের সেবা নিখুঁত ভাবে প্রদান করে এবং রেস্টুরেন্টের কর্মকান্ড সচল রাখে। এদুকে অসময়ে দেখে বিরক্ত হন অর্ণব।
তিনি বলেন, তুমি এসেছো কেন ? তোমাকে তো আমি ডাকিনি।

আপনার ডাকার অপেক্ষায় থাকার সময় তো এখন নেই, স্যার। এদু বলল। তার গলায় হেঁয়ালি। তাকে ভীষণ উৎফুল্ল মনে হচ্ছে।

কী বলতে চাও তুমি ?

বলতে চাইছি, আমরা আজ আর কোনো কাজ করব না।

কেন করবে না ? এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস তোমাদের হলো কী করে ?

আমাদের মহামান্য উতু এখন নতুন অধিপতি। আপনি বোধহয় জানেন না ?

মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার। সেই তখন থেকে আবোল-তাবোল বকছো।

স্যার, আমার মাথা খারাপ হয়নি, তবে আপনার অবশ্যই হবে। আরশির মালিকানা মনে হয় আপনার পরিবারের হাতে থাকবে না। সব কিছু দেখভালের দায়িত্ব আমাকেই দেবে বলে প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি। একটু পরে মহামান্য উতু গ্রহবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।

অর্ণব দ্রুত ডিজিটাল নিউজ বুকটা দেখলেন। হ্যাঁ, এদুর কথাই সত্য। ব্রেকিং নিউজ দেওয়া হচ্ছে: ‘মহামান্য নতুন অধিপতি উতু। একটু পরে গ্রহবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ।’ অর্নবের মেরুদন্ড দিয়ে শীতল একটা অনুভূতি বয়ে গেল।
কী স্যার, বিশ্বাস হলো তো। এখন আমি গিয়ে আজকের মতো সব ধরণের সেবা বন্ধ ঘোষণা করব। আর কাউকে আজ কোনো বিল পরিশোধ করতে হবে না।
অর্ণব মিনমিনে গলায় বললেন, কেন ?

কী যে বলেন স্যার, আজ আমরা একটু উদযাপন করব না ! আর এমন আনন্দের রাতে পুরোটাই ছাড় না দিলে চলে। হা-হা-হা। এদুর ধাতব হাসি বড্ড বিদঘুটে শোনাল অর্ণবের কানে।

Series Navigation<< বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ।। ইলাবৃত ।। কমলেশ রায় ।। অষ্টম পর্ব ।।বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব দশ >>

৩ thoughts on “বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। নবম পর্ব

  • জুলাই ২৫, ২০২২ at ১০:৪৯ অপরাহ্ণ
    Permalink

    দারুণ

    Reply
    • জুলাই ২৮, ২০২২ at ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ
      Permalink

      ধন্যবাদ। শুভকামনা।

      Reply
  • জুলাই ২৭, ২০২২ at ১১:২৯ অপরাহ্ণ
    Permalink

    ধন্যবাদ। শুভকামনা।

    Reply

Leave a Reply to কমলেশ রায় Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *