বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব চৌদ্দ

চৌদ্দ.

ডা. অমিয়কে হাসপাতালে নয়, বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছে ওরা। এই ওরা হলো অ্যাব সদস্যরা। কামরায় ঢুকেই পদস্থ একজন অ্যাব কর্মকর্তা বলল, স্যার, চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। তার সঙ্গে অধঃস্তন আরেকজন এসেছিল পেছন পেছন, কিছু না বলে সে কেবল মাথা নেড়ে তাল দিলো। তাতেই তার বক্তব্য পরিস্কার হয়ে গেল। হ্যাঁ, চলুন স্যার, নামিয়ে দিয়ে আসি।

ওদের যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা ওরা করবেই। বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই।

তাছাড়া অসম্মতি জানানোরও কোনো কারণ ছিল না। বড় জোর বলা যেত, নামিয়ে দিয়ে আসার কোনো দরকার নেই। একাই যেতে পারব। কিন্তু সেটা কি ওরা মেনে নিতো? না, কিছুতেই না। ডা. অমিয় সেটা ভালো করেই জানেন।
কামরা থেকে বের হলে বাম দিকেই লিফট। তবে লিফটে উঠে নিচতলায় নয়, ডা অমিয়কে নিয়ে যাওয়া হলো ছাদে। সেখানে বায়ুগাড়ি নিয়ে চালক তৈরিই ছিল।
আকাশ পথে উড়ে এসে গাড়িটি নামল তার বাসার ছাদে। অ্যাবের দুই সদস্য একদম বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর বিদায় নিয়েছে।

বাসায় ফিরে একলা বোধ করতে থাকলেন ডা. অমিয়। সাধারনত তিনি গভীর রাতে বাসায় ফেরেন। ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েন। সকাল হতেই চলে যান হাসপাতালে। এরপর ভীষণ ব্যস্ততায় কাটে গোটা দিন, সন্ধ্যা এবং রাতের একাংশ। দিনে বাসায় থাকা হয় না বললেই চলে। আজ ফুরসত মেলায় একাকীত্ব যেন তাকে ঘিরে ধরল।

ইতিকার কথা মনে পড়ছে তাঁর। তিনি ছোট্ট করে ডাকতেন ইতি। তাঁর স্ত্রী ইতি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সোচ্চার ছিলেন মানুষের নায্য অধিকার আদায়ে, প্রকৃতিকে রক্ষায়। কংক্রিট আর ধাতব এই বসতি ছেড়ে ইতি সপ্তবটী বনে চলে গেছেন বছর দশেক আগেই। একমাত্র ছেলে অরিত্র, আদরের অরিও গেছে মায়ের সঙ্গে। এখানে সিলিকন সিটিতে কাজ করত। তরুণ প্রোগ্রামার হিসেবে তার বেশ সুনাম আছে। সব কিছু ছেড়ে চলে গেল। তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, তাই বাধা দেননি ডা. অমিয়। কর্তব্যের তাগিদে নিজে যেতে পারেননি।

হঠাৎ তাঁর মনে হলো, ডা. এলিজার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। হাসপাতাল কেমন চলছে কে জানে? সবকিছু ঠিক মতোই চলার কথা। ডা. এলিজা যথেষ্ট যোগ্য ও দায়িত্বশীল চিকিৎসক। তারপরও একবার কথা বলা দরকার। একেই কী বলে ট্যালিপ্যাথি?
ডা. অমিয়ের আগেই, ঠিক তখনই যোগযোগ করলেন ডা. এলিজা।
স্যার, আপনি কি বাসায় ফিরেছেন?
হ্যাঁ। আপনি কিভাবে জানলেন?
ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আমি কেন সবাই জানে আপনি এখন বাসায়।
তাই নাকি। এটা তো দেখছি বিখ্যাত হওয়ার লক্ষণ।
স্যার, বিখ্যাতদের নিয়েই বেশি ব্রেকিং নিউজ হয়। সাধারণদের নিয়ে সাধারণত হয় সাধারণ খবর।
হয়ত তাই। বিষয়টা নিয়ে কখনও তেমন করে ভেবে দেখিনি।
হয়ত না স্যার, এটাই সত্য।
তা হাসপাতাল কেমন চলছে?
প্রসঙ্গটা তুলে ভালোই করলেন স্যার।
কেন কী হয়েছে?
মহাপরিচালক পদে একজন কৃবু প্রতিনিধিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব
বুঝে নিয়ে ওই প্রতিনিধি অফিসও শুরু করে দিয়েছেন।
তিনি ওই পদের যোগ্য তো?
না হওয়ার কী আছে। সব কিছু তো মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েই তাকে হাসপাতালে
পাঠানো হয়েছে।
কী নাম তার?
ডা. নিষ্ঠব্রত।
বাহ্ ! নামটা তো দারুণ রেখেছে।
হ্যাঁ, বেজায় নিষ্ঠা তার। বাসায় যাওয়ার তো বালাই নেই। চব্বিশ ঘন্টা হয়ত হাসপাতালেই পড়ে থাকেন।
বাহ্ ! এটাও তো খুব ভালো।
আপনি তো স্যার সব কিছুতেই ভালো দেখেন।
মানুষের কল্যাণ হলেই হলো। সুচিকিৎসা প্রাপ্তিই রোগীর জন্য মুখ্য। সেটা নিশ্চিত হলেই হয়।
আপনি খুব বেশি ভালো, স্যার। হিসাবটা কিন্তু অনেক জটিল।
জানি। জীবনটাই তো জটিল একটা বিষয়। এই বসতিতে সেটা আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে।
সাবধানে থাকবেন স্যার।
সাবধানে থেকেও কী খুব বেশি লাভ হবে?

ডা. এলিজার হঠাৎ মনে হলো, অমিয় স্যার তো ঠিকই বলছেন। সাবধানে থেকেও খুব বেশি লাভ হবে না। কৃবুস-শ্রেষ্ঠ উতু ছক সাজিয়ে রেখেছেন। সেই ছকের বাইরে যাওয়া সহজ কাজ নয়, সহজ সাধ্যও নয়। তাই তিনি আন্তরিক গলায় বললেন,
ভালো থাকবেন স্যার। আজ রাখি।
আপনারাও ভালো থাকবেন।

সংযোগটা এরপর কেটে দিলেন ডা. এলিজা। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন ডা. অমিয়। মাথায় মনে হচ্ছে জট পাকিয়ে আছে। মাথাটা পরিস্কার করা দরকার। নতুন কর্মকৌশল নিয়ে আরও পরে ভাবতে হবে।

মাথা পরিস্কার হওয়ার পর ধীরে-সুস্থে। ডিজিটাল মিডিয়ায় একটু উঁকি দিলে কেমন হয়? হাজার হোক নিজেকে নিয়ে ব্রেকিং নিউজ, একবার অন্তত দেখা দরকার। ডা. অমিয় ত্রিমাত্রিক ভিজুয়াল টিউবের রিমোট হাতে নিলেন। লাল বোতাম টিপে শক্তি সঞ্চালনের ব্যবস্থা করলেন। সবুজ বোতামে চাপ দিতেই সামনের দেয়ালে বড় একটা পর্দা হাজির হলো। রিমোটে এক চাপতেই অধিপতি নিয়ন্ত্রিত গ্রহীয় চ্যানেল ইত্তেলা। ব্যক্তি উদ্যোগের প্রচার মাধ্যমগুলো একের পর থেকে শুরু। ডা. অমিয় গ্রহীয় চ্যানেল দেখারই সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সময়ে অন্য প্রচার মাধ্যমগুলোও বাড়তি কিছু দেখাতে সাহস করবে বলে মনে হয় না। কিংবা সেই সাহস দেখানোর সুযোগটুকুও রাখা হয়নি। হ্যাঁ, তাকে নিয়ে সত্যিই ব্রেকিং নিউজ দেওয়া হচ্ছে। একটা লাইন প্রাচীন আমলের রেলগড়ির মতো ছুটছে :

‘অপহৃত প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. অমিয় আজ দুপুরে সুস্থ শরীরে নিজ বাসায় ফিরেছেন।’
পর্দা জুড়ে এতক্ষণ অধিপতি উতুর বিভিন্ন কর্মকা- দেখানো হচ্ছিল। হঠাৎ করেই দেখা গেল বিজ্ঞানী ঈশানের চেহারা। গলা ভারি করে তিনি বলছেন,
‘অধিপতি উতুকে আমি তৈরি করেছি। এই মুহূর্তে বুদ্ধি-বিবেচনা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা সব দিক দিয়েই অধিপতি উতুই এই গ্রহের সেরা। মানবিক গুণাবলী তার মধ্যে পুরো মাত্রায় থাকলেও মানুষের মতো ভুল করার প্রবনতা তার ভেতরে নেই। তিনি নিখুঁত এবং সর্বোত্তম…।’

এইটুকু শোনার পরই ডা. অমিয় রিমোটে চাপ দিলেন। পর্দা মুহূর্তেই উবে গেল। বিজ্ঞানী ঈশানকে আর সহ্য হচ্ছিল না। নরকের কীট মনে হচ্ছিল তাকে। মানুষ হয়ে মানুষের এত বড় সর্বনাশ মানবজাতির ইতিহাসে আর কেউ করেছে বলে তাঁর জানা নেই।
অচেনা এবং অদ্ভুত একটা নম্বর থেকে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। ডা. অমিয় কী সাড়া দেবেন? হ্যাঁ, কেন নয়। সিদ্ধান্ত নিতে একটুও সময় নিলেন না তিনি।
তাঁর আর হারানোর তেমন কী আছে? তাহলে কিসের এত সতর্কতা? বরং দেখা যাক কে কী কারণে যোগাযোগ করতে চাইছে।

হ্যালো বাবা…। ছেলে অরির গলা।
ডা. অমিয় একটু কেঁপে উঠলেন। কত দিন বাদে কথা বলছে তাঁর ছেলে। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, হ্যাঁ, বলো।
কেমন আছো?
ভালো আছি।
না, তুমি মোটেই ভালো নেই।
কে বলল তোমাকে এ কথা?
ওই বসতির সব খবর আমি রাখি।
তোমার মা কেমন আছে?
ভালো আছে। মুখে কিছু বলে না, তবে তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে।
আরে এত চিন্তার কিছু নেই। তুমি তোমার মাকে বুঝিয়ে বলো।
আমি চেষ্টা করব। শোনো, যে কোনো সময় হয়ত সংযোগ কেটে যাবে।

কেন, কী হয়েছে?

নতুন অধিপতি ক্ষমতার বসার পর বাইরের সঙ্গে তোমাদের ওখানের সব ধরনের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সিল করে দেওয়া হয়েছে। আমি বিশেষ প্রযুক্তিতে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কথা বলার খুব বেশি সময় হয়ত আর পাবো না।
তাই নাকি! কী বলছো এসব!
ঠিকই বলছি। অনেক তো হলো, এবার চলে এসো বাবা।
আসব, অবশ্যই আসব।
কবে আসবে?

ডা. অমিয় বলতে চাইছিলেন, দেখি, হয়ত তাড়াতাড়িই আসব। কিন্তু তিনি সেটা বলার আগেই সংযোগ কেটে গেল। তাঁর মনটা কেমন যেন করছে। হু হু করা একটা ব্যাপার ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে। চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। উঠুক।
ইচ্ছে করেই সেটা মুছলেন না ডা. অমিয়।

Series Navigation<< বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব তেরবিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব পনের >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *