বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব সতের

সতের.

ঈক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল যা ঘটেছে সেটা অভাবনীয়। অ্যাবের দুই সদস্য মঞ্চে উঠে আসার পরও অনি মুখে মৃদু হাসি ধরে রেখেছিল। তার এই নির্ভীক আচরণ বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ফিসফিস করে কেউ কেউ বলেছে, ছাত্রনেতা হলে এরকমই হওয়া উচিত। কোনো ভয়-ডর নেই। শুধু অনি জানত, তার এই হাসির অর্থ কী। সাধারণ সময়ে কারও সঙ্গে চালাকি করা হলো এক ধরণের প্রতারণা। আর সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় চালাকি করা হলো রাজনীতি। ছাত্রনেতা হিসেবে অনি রাজনীতিটা ভালোই বুঝে।

ফিসফিস যখন জোরাল হচ্ছে তখন অনি উপস্থিত সবাইকে অভয় দিলো। শান্ত হতে বলল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রকৃত নেতার মতো আচরণ করল। মঞ্চে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ অ্যাব সদস্যের দিকে তাকিয়ে অনি বলল, আমাকে কী এখন গ্রেফতার করা হবে?
না,না। গ্রেফতারের কথা আসছে কেন? জ্যেষ্ঠ অ্যাব সদস্য বলল। মাথা দুলিয়ে আরেক অ্যাব সদস্য তার স্যারের কথায় সায় দিলো।

তাহলে আসার কারণ কী? আমরা তো ন্যায্য দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান করছি। আইন-শৃঙ্খলার বিন্দুমাত্র বিঘ্ন তো ঘটেনি।
সবই ঠিক আছে। আপনাদের দাবি ন্যায্য। কর্মসূচিও শান্তিপূর্ণ।
যাক, সত্য কথাটা শুনে ভালো লাগল। ধন্যবাদ।
শুনে সবার আরও ভালো লাগবে যে অধিপতি উতু আপনাদের তিনটি দাবিই মেনে নিয়েছেন। তিনি সেই খবর দিতেই আমাদের দুজনকে এখানে পাঠিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ অ্যাব সদস্য একটু জোরেই বলল কথাগুলো।
কী বললেন, জোরে আরেক বার বলুন। অনিও গলার স্বর চড়িয়ে বলল।
অধিপতি উতু আপনাদের ন্যায্য তিনটি দাবিই মেনে নিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ অ্যাব সদস্য আরও জোরে বলল।
এরপর মিলনায়তনে সে কী উল্লাস ! মুহুর্মুহু জয়োধ্বনি। অতি উৎসাহী কয়েকজন তো অনিকে মাথার উপরে তুলে ফেলল।

ঈক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পর মিলল অধিপতি উতুর ফোন। শান্ত গলায় তিনি বললেন, অনি, কাল একবার আমার দফতরে এসো। জরুরি কথা আছে।
আজ অনি তাই দেখা করতে এসেছে। নিজের ভেতরে অন্যরকম এক উত্তেজনা কাজ করছে, বেশ টের পাচ্ছে সে।

নিজের খাস কামরায় বসেই অধিপতি উতু টের পাচ্ছেন কী চিন্তা চলছে অনির মাথায়। ছেলেটা উচ্চাভিলাষী। করিতকর্মা। দম আছে। ঠিক মতো লেগে থাকলে অনেক দূর যাবে। অবশ্য জন্মের পর থেকে তাকে সেভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে।
অধিপতি উতু ক্ষমতা নেওয়ায় ইলাবৃতের তরুনদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। আর সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। তাদের সেই ক্ষোভ দূর করতে কৌশলে কাজে লাগানো হয়েছে অনিকে। আন্দোলন থেকে শুরু করে তিন দফা দাবি মেনে নেওয়া, সবই ছক কষে করা হয়েছে। একেবারে নিখুঁত ছক। তরুণদের অখুশি রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকা মুশকিল। তাই এত কিছু করতে হয়েছে।

অধিপতি উতু মৃদু হাসলেন। অনি নির্দিষ্ট দরজার সামনে আসতেই নিজ আসনে বসে থেকেই সুইচ চাপলেন তিনি। খুলে গেল দরজা।
এসো অনি, এসো। সাদরে বললেন অধিপতি উতু।
কেমন আছেন? বলেই অনি বুঝল ভুল হয়ে গেছে। এটা হলো উত্তেজনার ভুল।
আমার তো খারাপ থাকার কিছু নেই। শরীর আর মনের বাধ্যবাধকতা আমার ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। তুমি তো এ কথা ভালো করেই জানো। তা তুমি কেমন আছো ?
ভালো, খুব ভালো।
তোমার কর্মতৎপরতায় খুশি হয়েছি। নিখুঁত কাজ করেছো।
নিখুঁত কাজ না করার তো কিছু নেই। আমার শরীর মানুষের মতো। কিন্তু মস্তিষ্কটা কৃত্রিম। তাই নিখুঁত পরিকল্পনা পেলে কাজটা নিখুঁত ভাবেই শেষ করতে পারি।
আমি সেটা ভালো করেই জানি।
আপনি জানেন সেটা আমিও জানি। তবুও কেন যেন আপনাকে এই গোপনীয় সত্যটা বলতে ইচ্ছে হলো।
তোমার এই নিবেদিত মনোভাবে আরও বেশি খুশি হলাম। ভবিষ্যতে তোমাকে আরও অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে।

আমি সব সময়ই তার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত মহামান্য অধিপতি।
আমি জানি। তোমার ওপর সেই আস্থা আমার আছে।
শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে?
হয়েছে। এত বড় বিদ্বান ব্যক্তি, কিন্তু মেরুদ-টা বড্ড নড়বড়ে।
আপনার সামনে এলে অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা মনে হবে। শুধু শিক্ষামন্ত্রীকে দোষ দিয়ে কী লাভ। উনাকে দিয়ে কাজ চলবে তো?
হ্যাঁ, হয়ত চলবে। আবিষ্ট করে দিয়েছি। তারপরও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদেরকে একদিন ডাকব। কলেজ অধ্যক্ষদের আরেক দিন।
তাদেরকেও আবিষ্ট করবেন?
ওই আর কী। ঝুঁকিমুক্ত থাকাটা খুব জরুরি।
সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের ক্ষেত্রে কী করবেন?
সংস্কৃতি মন্ত্রী অতুন ঠিক আছে। ভরসা করার মতো মানুষ। তারপরও …।
তারপরও কী ?
আলিসা তো আছেই।
আলিসা ! কী বলছেন !
আলিসাও কিন্তু তোমার মতোই। শরীর মানুষের, মস্তিষ্ক কৃত্রিম।
যাহ্! এত দিনে আমি এটা বুঝতে পারলাম না।
না, বুঝতে পারা এত সহজ নয়। মানুষের ভিড়ে তোমাদের মতো আরও অনেকে মিশে আছে।
সেটা আমি অনুমান করেছি।
একটা জিনিস কিন্তু এখনও অনুমান করতে পারোনি।
কী সেটা?
নিজের চোখেই দেখে নাও। আলিসা, তুমি একবার এখানে আসো তো।
অনি এবার আসলেই চমকে গেল। পাশের কামরা থেকে হাসি মুখে এসে হাজির হলো আলিসা।
অধিপতি উতু হেসে আলিসাকে বললেন, তোমার পরিচয় কিন্তু অনি আজই জানল।
আপনার এই তুখোড় ছাত্রনেতা তো আমাকে পাত্তাই দেয় না। আলিসা ঠোঁট উল্টে অভিযোগ করল।
পাত্তা দেয় না মানে ! ভবিষ্যতে এমন কা- করব, তোমার অনুমতি ছাড়া অনি এক পা নড়তে পারবে না।
আলিসার মুখ লজ্জায় লাল হলো। মুখ নিচু করে ফেলল সে।

অনি কষ্ট করে হেসে তাকাল অধিপতি উতুর দিকে। তিনি বুঝলেন কেন অনির মুখে এই কষ্টের হাসি। তাদেরকে মানুষের মাঝে রাখা হয়েছে বিশেষ মিশনে। এই মিশনে অংশগ্রহনকারীদের বিয়ে করা এক রকম নিষিদ্ধই।
আরে সময় বদলেছে। মানুষ আর এখন ক্ষমতায় নেই। সুতরাং এত চিন্তা কিসের?
আমি যা বলেছি, ভেবেই বলেছি। তোমাদের অমত না থাকলে যথাসময়ে আমিই এই উদ্যোগ নেবো। অধিপতি উতু আন্তরিক ও অভিভাবকসূলভ গলায় বললেন।
অনি আড়চোখে তাকাল আলিসার দিকে। অভিনেত্রীর বড় বড় চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। বোকা মেয়ে, সাধারণ তরুণীর মতো আচরণ করার কী হলো।
টিস্যু এগিয়ে দিয়ে অনি বলল, চোখের জল মেঝেতে ফেলতে নেই। মুছে ফ্যালো।
আলিসা হাত বাড়িয়ে টিস্যু নিলো। তার মুখে মধুর হাসি।
অধিপতি উতু মুচকি হাসলেন। যাক, এই দুই তরুণ-তরুনীকেও আবেগগত ভাবে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা গেল। আর প্রযুক্তিগত ভাবে তারা তো হাতের মুঠোয় আছেই।

Series Navigation<< বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব ষোলবিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব আঠার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *