বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ।। ইলাবৃত ।। কমলেশ রায় ।। অষ্টম পর্ব ।।

অষ্টম পর্ব

জরুরি একটা অস্ত্রোপচার আছে। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডা. অমিয়। ডা. ওশিনের ঘটনাটা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ওরা ক্রমেই আরও বেশি সংঘবদ্ধ হচ্ছে, এই ধারণাটা বরাবরই তাঁর মাথায় ছিল। এত দিনের সেই শঙ্কা সত্য হয়ে সামনে চলে এলে ভেতরটা একটু টলে যাওয়ারই তো কথা। ডা. ওশিনের জন্য একটু মায়া হচ্ছে বৈকি। হাজার হোক এত দিনের সহকর্মী। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই গ্রহের মানবজাতি ভয়াবহ একটা সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।

ঘড়ির দিকে তাকালেন ডা. অমিয়। দু’টো বাজে। সোয়া দু’টোর দিকে অস্ত্রোপচার শুরু করার কথা। পাঁচ মিনিট বাদেই তাকে উঠতে হবে। ওটি প্রস্তুত। সিনিয়র নার্স একটু আগে মেসেজ করে তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। মিনিট তিনেক চোখ বন্ধ করে থাকতে চাইলেন তিনি। মনটা শান্ত করা দরকার, বড্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সবে চোখ বন্ধ করেছে, এমন সময় মেসেজ অ্যালার্ম বেজে উঠল। নতুন মেসেজ এসেছে। তিনি বিরক্ত হলেন। কী মুশকিল, এই সময়ে এই ভর দুপুরে আবার কে মেসেজ পাঠাল? তাকিয়ে তিনি একটু আশ্চর্যই হলেন। সাংবাদিক আশীষ মেসেজ পাঠিয়েছেন। হঠাৎ কী এমন হলো? খারাপ কোনো খবর নয় তো?

ডা. অমিয় ভীষণ শান্ত স্বভাবের মানুষ। মেজাজকে তিনি কখনই চড়তে দেন না। তাকে রাগতে দেখেছেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দায় হবে। কিন্তু আজ কেন যেন মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে তাকে বেগ পেতে হচ্ছে। বিরক্তি আর শঙ্কা নিয়ে মেসেজ পড়তে শুরু করলেন তিনি।
শুরুতে একটা বিয়োগ চিহ্ন। তারপর সাংবাদিক আশীষ লিখেছেন : ‘শপ রেল। ফমশা দেঅ। ধামযে শমে ধসুদ।’
এলোমেলো এসব কী লিখেছেন উনি ? নিশ্চয়ই গোপনীয় ও জরুরি কিছু। তাই উনি এভাবে লিখেছেন। হেঁয়ালির আশ্রয় নিয়েছেন, যাতে অন্য কারও হাতে পড়লেও মেসেজটা বুঝতে না পারেন। কিন্তু কী লিখেছেন ?

এখনই অপারেশন থিয়েটারে যেতে হবে। এমন সময়ে এই জটিল মেসেজ। মাথা ঠিক মতো কাজ করবে তো? খুব ভালো করে মেসেজটা আরেক বার দেখলেন ডা. অমিয়। চোখ বন্ধ করলেন। বিশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে ভাবলেন। তারপর চোখ খুলে আবার পড়লেন মেসেজটা। মাথায় এবার একটা কিছু ঝিলিক দিয়ে গেল। মেসেজটা পাঠানো হয়েছে ঠিক দুটোর সময়ে। মেসেজের শুরুতে বিয়োগ চিহ্ন। তার মানে মেসেজের প্রতিটা অক্ষর থেকে দুই বিয়োগ হবে। দুই বিয়োগ মানে প্রতিটা অক্ষরের জায়গায় তার আগের অক্ষরের আগের অক্ষর বসাতে হবে। যেমন গ লেখা থাকলে তার জায়গায় পড়তে হবে ক। গোমড়টা ধরতে পেরে নিজের মনেই হেসে ফেললেন ডা. অমিয়। সাংবাদিক আশীষ গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করলেও ভালো করতেন। যা হোক অনেক দিন বাদে উনার কারণে ‘বুদ্ধির ব্যায়াম’ হলো।

মেসেজের দিকে তাকাতেই এবার তিনি সবকিছু পরিস্কার বুঝতে পারলেন। এতে লেখা আছে : ‘শপ রেল। ফমশা দেঅ। ধামযে শমে ধসুদ।’
যার অর্থ হলো : ‘সব শেষ। ভরসা নেই। পারলে সরে পড়ুন।’
মাত্র তিনটা বাক্য। কিন্তু ঘাম ছুটিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ডা. অমিয় বুঝতে পারলেন সাংবাদিক আশীষ কী বলতে চেয়েছেন। আর কী ঘটে গেছে এই গ্রহে। না, আর দেরি করা চলে না। তাকে যেতে হবে। অপারেশন থিয়েটারে যেতে হবে। সব শেষ। আর কোনো আশা নেই। তাতে কী ? তিনি কিছুতেই সরে পড়বেন না। এ মুহূর্তে হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যাবেন না। যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রোগীকে অপারেশনের টেবিলে ফেলে রেখে চলে যাওয়া তাঁর পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। প্রকৃত চিকিৎসক সেটা কখনও পারেনও না। অপারেশন থিয়েটারের দিকে পা বাড়ালেন ডা. অমিয়।

অস্ত্রোপচার শেষ হতে ঘন্টা খানেক লাগল। নিজের কক্ষে ফিরেই হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ডা. এলিজাকে ডাকলেন ডা. অমিয়। দুই মিনিটের মধ্যে এলেন তিনি। তারপরও ডা. অমিয়’র মনে হচ্ছিল, ডা. এলিজা আসতে এত দেরি করছেন কেন ? ডা. এলিজা আসার পর তাকে একটা খাম ধরিয়ে দেওয়া হলো। তিনি ঘাবড়ে গেলেন। এটা কিসের খাম? কী আছে এতে? কোনো চিঠি? কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ার মতো কিছু তো তিনি করেননি। আর স্যার তো তার কাজে যথেষ্ট সচেষ্ঠ। তাহলে? তিনি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন স্যারের দিকে।

এত বুঝিয়ে বলার সময় এখন নেই। খামের মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া আছে আমি না থাকলে কী করতে হবে। আপনি এখন আসুন। দ্রুত এই কক্ষ ছেড়ে চলে যান। ডা. অমিয় রূঢ় গলায় গড়গড় করে বললেন কথাগুলো। ডা. এলিজা এই অমিয় স্যারকে চেনেন না। স্যারের আচরণে তিনি অবাক হলেন। তখনও তিনি তাকিয়ে আছেন দেখে ডা. অমিয় হালকা ধমকে উঠলেন, কী ব্যাপার, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? আমার কথা শুনতে পাননি?
ডা. এলিজা মনে অস্বস্তি নিয়ে রুমে ফিরে গেলেন।
মিনিট পাঁচেক বাদেই ডা. অমিয়’র কক্ষের সামনে হাজির হলো অ্যাব সদস্যরা। দরজায় মৃদু আওয়াজ। তিনি এদের অপেক্ষায়ই ছিলেন, বুঝলেন এসে গেছে। আরও দু’জনের দরজায়ও এতক্ষণে নিশ্চয়ই এই বাহিনীর সদস্যরা হাজির হয়েছে। দরজা খুলে ডা. অমিয় বললেন, কী, আমাকে তোমাদের সঙ্গে যেতে হবে ? মহামান্য অধিপতি উতু আমাদেরকে সেই রকমই নির্দেশ দিয়েছেন।
কে এই উতু ? ডা. অমিয় চিনতে পারলেন না। তবে শান্ত গলায় অ্যাব সদস্যদের বললেন, চলো তাহলে, যাওয়া যাক।
ডা. অমিয়কে নিয়ে অ্যাব সদস্যরা যত দ্রুত সম্ভব চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই হাসপাতালের চিকিৎসক ও চাকুরিজীবীদের মধ্যে খরবটা ছড়িয়ে পড়ল। ডা. এলিজা খাম থেকে কাগজটা বের করে মন দিয়ে পড়ছিলেন। তরুণ চিকিৎসক ডা. অর্চি এসে বলল, ‘ম্যাডাম শুনেছেন, অমিয় স্যারকে তো অ্যাব ধরে নিয়ে গেছে।’ কী বলছো ! ডা. এলিজা এবার আরও বেশি অবাক হলেন। সব কিছু মুহূর্তেই তার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে হলো, তাকে শক্ত হতে হবে। কারণ তার ওপর এখন অনেক দায়িত্ব।

Series Navigation<< বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ।। ইলাবৃত ।। কমলেশ রায় ।। সপ্তম পর্ব ।।বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। নবম পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *