বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ।। ইলাবৃত ।। কমলেশ রায় ।। পর্ব এগারো

এগারো.

এরকা হলো ইলাবৃতের কেন্দ্রীয় উদ্যান। আগে উদ্যানটি ছিল সবুজ, গাছ-গাছালিতে ভরা। এখন ফাঁকা, একটা গাছও নেই। আগে মাটি ছিল, ঘাস ছিল। এখন মাটি কংক্রিটে ঢাকা। উদ্যানের কোনো বৈশিষ্ট্য আর অবশিষ্ট নেই। তবুও এরকার নামের সঙ্গে উদ্যান শব্দটা রয়ে গেছে। এরকার নাম থেকে উদ্যান শব্দটা মুছে যায়নি, কিংবা মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়নি। এই কংক্রিটের উদ্যানে আয়োজন করা হয়েছে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। অধিপতি উতুকে ঘিরেই এই আনন্দ আয়োজন।

কৃবুসের পক্ষ থেকে তাকে এই সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। যদিও আয়োজক হিসেবে প্রচার করা হয়েছে নাগরিক সমাজের নাম। এরকা এখন বিশাল ফাঁকা পাকা মাঠ। মাঠের পশ্চিম দিকে বিশাল মঞ্চ। সুদৃশ্য, মনোহর এবং ঐতিহ্যমন্ডিত। মঞ্চের ডানদিকে সিংহাসনে বসে আছেন অধিপতি উতু। দুপাশের আসনগুলোতে বসেছেন নতুন মন্ত্রীরা। মঞ্চের বামদিকটায় হবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ। তিল ধারণের জায়গা নেই। কৃবুদের সব স্রোত যেন আজ উদ্যানমুখী। আশপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে সেই ঢেউ। গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে এই অনুষ্ঠান।

সন্ধ্যা হতে খুব বেশি দেরি নেই। ইচ্ছে করেই কারও বক্তব্য দেওয়ার তেমন কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। শুধু অধিপতি উতু সবাইকে স্বাগত জানানো শেষে বললেন, ‘আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। তাই আর কোনো কথা নয়। চলুন, অনুষ্ঠান উপভোগ করা যাক।’

সংগীত বেজে উঠল। নৃত্যশিল্পীরা এলো আলো ঝলমলে মঞ্চে। ছন্দময় নৃত্যশৈলীতে তারা মাতিয়ে তুলল উপস্থিত সবাইকে। নৃত্য চলতে থাকল। মঞ্চে এলো দুই মল্লযোদ্ধা।

বাজনার তালে তালে তারা মল্লযুদ্ধের কলাকৌশল খাটিয়ে একে অন্যকে ধরাশায়ী করতে চাইল। তাদের কৌতুকপূর্ন আচরণ দর্শকদের বেশ আনন্দ দিলো। এরপর মঞ্চে এলো আরও দুই যোদ্ধা। তাদের মাথায় হ্যাট, হাতে বন্দুক। সংগীতের তাল-লয়ে তাল মিলিয়ে উদ্দাম ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো তারা। বন্দুক তাক করল পরস্পরের দিকে। তাদের দেখে ভড়কে গেল দুই মল্লযোদ্ধা। চোখে-মুখে ভয় ফুটিয়ে তারা উড়াল দিলো। উড়ে গেল বেশ খানিকটা। তারপর দুজনে বিশেষ কাদয়ায় প্রায় আকাশ-জোড়া পর্দা টাঙিয়ে দিলো। সমবেতরা হাততালি দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই মঞ্চে এলো অ্যাবের দুই সদস্য।

তারা সংগীত সমঝদারের মতো করে তাদের মাথা দোলাতে থাকল। দুজনই ডান হাতের তর্জনী তাক করল দুজনের দিকে। একই সময়ে দুটো আঙুল থেকে ধেয়ে এলো দুটো রশ্মি। পরস্পরকে আঘাত করে রশ্মি দুটো নিস্ক্রিয় হয়ে গেল। এবার দুই বন্দুকযোদ্ধা ভয় পেয়ে আকাশে উড়াল দিলো। চোখের পলকে তারা চলে গেল পর্দার কাছে। তাদের হাতের বন্দুক যেন পরিনত হলো বড় কলমে। আর সেই কলমের কালি হলো উজ্জ্বল আলো। একজন উজ্জ্বল আলো দিয়ে লিখল : অধিপতি উতু হলেন উৎকৃষ্ট। অন্যজন এরপর লিখল : উৎ হলো অতিশয় উত্তম। এটুকু লিখতে লিখতেই উড়ে এসে হাজির হলো দুই অ্যাব সদস্য। প্রথম অ্যাব সদস্য তর্জনীর ডগা দিয়ে বের হওয়া রশ্মির সাহায্যে লিখল : কৃ হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। দ্বিতীয় অ্যাব সদস্য একই কায়দায় লিখল : ষ্ট হলো আবিষ্ট শব্দের শেষ যুক্ত অক্ষর। মানে, আবিষ্ট ক্ষমতাধর। লেখা শেষে তারা পর্দার আড়ালে চলে গেল।

আকাশ-জোড়া পর্দায় তখন আলোকোজ্জ্বল অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে :

‘অধিপতি উতু হলেন উৎকৃষ্ট।

উৎ হলো অতিশয় উত্তম

কৃ হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন।

ষ্ট হলো আবিষ্ট শব্দের শেষ যুক্ত অক্ষর। মানে, আবিষ্ট ক্ষমতাধর।’

উপস্থিত সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ল। সংগীত ছাপিয়ে যাওয়া বাঁধভাঙা উল্লাস চলল কিছুক্ষণ। এবার অধিপতি উতু সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। উল্লাস হঠাৎই থেমে গেল। শুরু হলো গুরুগম্ভীর সংগীত। নৃত্যশিল্পীরাও নাচতে থাকল ধীরলয়ে। তর্জনী তুলে ধরলেন অধিপতি উতু। আঙুলটির ডগা থেকে রশ্মি ছুটে গেল পর্দার দিকে। গিয়ে থামল আলোকোজ্জ্বল লেখার নিচে। অধিপতি উতু হাওয়ায় আঙুল নাড়িয়ে নিজের নাম সই করলেন। সেই সই পর্দায় জ্বলজ্বল করতে থাকল। আবার উল্লাসে কেঁপে উঠল এরকা উদ্যান।
এরপর ঘটল আরও অভাবনীয় ঘটনা। মঞ্চ থেকে নাচতে নাচতেই নৃত্যশিল্পীরা উড়াল দিলো আকাশে। একটু উপরে উঠতেই তাদের শরীর থেকে বের হতে থাকল রঙিন সব রশ্মি। নৃত্যের তালে তালে এরপর তারা শুরু করল আতশবাজি। রঙিন রশ্মিতে ভরা সন্ধ্যার আকাশ আতশবাজির ঝলকানিতে কেঁপে কেঁপে উঠল। অধিপতি উতু অন্য সবার মতো মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকলেন আতশবাজি ও রঙিন রশ্মির খেলা। শুধু তার মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা খেলে গেল।

সব মানুষের মতো বয়স্ক এক দম্পতিও টিভিটিতে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি দেখছিলেন। বৃদ্ধ ওলন আতশবাজি শুরু হতেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
আতশবাজির রোশনাই এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে। নতুন অধিপতি উতুর সইসহ লেখাটাও স্পষ্ট চোখে পড়ছে। একটু পরে পায়ে পায়ে বৃদ্ধা উষাও বারান্দায় এলেন। উদ্বিগ্ন স্বামীর ডান হাতটা আলতো করে ধরে তিনি জিগ্যেস করলেন, কী বুঝলে?

ওলন ভারি গলায় বললেন, কৌশলে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রাখলেন নতুন অধিপতি। মানুষের জন্য এটা একটা বার্তাও বটে।
কিছু কী বুঝতে পারছো? শেষপর্যন্ত এখানে থাকা যাবে তো?
ওলন এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বাম হাত স্ত্রীর কাঁধে রাখলেন। তারপর তাকে শক্ত করে ধরে তিনি বললেন, এত ভেবো না। দেখা যাক। দেখা যাক …।
নিঃসন্তান এই বৃদ্ধ দম্পতির ধারণাও নেই, সরাসরি সম্প্রচার করা অনুষ্ঠানের প্রতিটি দর্শকের প্রতিক্রিয়া বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে ধারণ করা হয়েছে।
অনেক সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে এই প্রতিক্রিয়ার ওপর।

Series Navigation<< বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব দশবিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব বারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *