বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ।। ইলাবৃত ।। কমলেশ রায় ।। পঞ্চম পর্ব

পঞ্চম পর্ব
একটা বদ্ধ কক্ষে বসে আছেন ডা. ওশিন। কক্ষটা খুবই ছোট। তার বুঝতে মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না তাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতিটা মুহূর্তে তার প্রতিটা তৎপরতা লক্ষ্য করা হচ্ছে। কক্ষটাকে আরেক বার ভালো করে দেখলেন ডা. ওশিন। তারপর চোখ বন্ধ করে নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কবি ইরেশের বাসা থেকে ডা. ওশিন সরাসরি হাসপাতালে যান। ছাদে আগে থেকেই ছোট্ট এয়ার অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষা করছিল, সেটাতেই ফিরেছেন। অমিয় স্যার ডেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উনার চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার যথেষ্ট ছাপ ছিল। হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের সময় আজ বার বার আনমনা হয়ে যাচ্ছিলেন ডা. ওশিন। একটা চিন্তা থেকে নিজেকে কিছুতেই মুক্ত করতে পারছিলেন না।

বড় একটা ঝুঁকি নিয়েই কবি ইরেশের বাসায় গেছেন ডা. ওশিন। ভালো করেই জানতেন শেষ পর্যন্ত বিষয়টা গোপন থাকবে না। আর বিষয়টা প্রকাশ পেলে তাকে যথেষ্ট মাশুল দিতে হবে সেটাও মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন। তাই বলে সেটা এত তাড়াতাড়ি ? কর্মঘন্টা শেষে পার্কিং জোনে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ডা. ওশিন। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসছিল। ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনা। হঠাৎ তার দুপাশে এসে দাঁড়াল দু’জন। একবার তাকিয়েই ডা. ওশিন বুঝতে পারলেন এরা কারা। অ্যাব* নামের বিশেষ বাহিনীর সদস্য এরা। যারা কথা কম বলতে এবং কাজ বেশি করতে অভ্যস্ত। এদের মস্তিষ্কের নকশা করা হয়েছে সেভাবেই। একটা গাড়ি সাঁ করে এসে সামনে থামল। ডা. ওশিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, অনেকটা যান্ত্রিক গলায় পাশ থেকে একজন বলে উঠল, এখন কোনো কথা নয়। কথা বলার যথেষ্ট সময় পাবেন। দয়া করে গাড়িতে উঠুন।
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই গাড়িতে উঠে বসলেন ডা. ওশিন। দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করল গাড়ি। জানালা দিয়ে ডা. ওশিন দেখতে পেলেন, তার গাড়িটিও ততক্ষণে জায়গা মতো চলে এসেছে। ড্রাইভার তাকে খুঁজে না পেয়ে একই সঙ্গে বিরক্ত ও হতাশ হবে। কিছুক্ষণ পরেই তার জায়গা হলো এই বদ্ধ কক্ষে। এরপর নিশ্চয়ই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এমন কিছুর জন্য নিজের ভেতরে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন ডা. ওশিন। কী এত ভাবছো ? কক্ষটায় একটা ভরাট গলা গমগম করে উঠল। গলাটাই কেবল শোনা গেল। ব্যক্তিকে দেখা গেল না। আর তার দেখা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তেমন কিছু না। ডা. ওশিন বললেন।
কিছু একটা তো অবশ্যই ভাবছিলে, শুধু মুখে স্বীকার করছো না। তা কী ভাবছিলে ?
কী ভাবছিলাম সেটা তো আপনি ভালো করেই জানেন। তারপরও কেন জিগ্যেস করছেন ?
তোমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো ?
হ্যাঁ, ধারণা করতে পারছি।
সবকিছু জানার পরও তুমি এমনটা কেন করলে ?
সত্যি কথা বলব ?
তুমি সত্যি না মিথ্যা বলছো সেটা আমি সহজেই বুঝতে পারব। ওই ক্ষমতাটুকু আমার আছে।
আমি সেটা জানি।
তাহলে কথা বাড়াচ্ছো কেন ? বলো, কেন এমনটা করলে ?
আমি একজন চিকিৎসক বলে।
মাথামোটার মতো কথা বলো না। তুমি শুধু চিকিৎসক নও, আরও বেশি কিছু, সেটা ভুলে গেলে ?
না, মোটেই ভুলিনি।
ভুলে গেলে কতটা বছর ধরে তিলে তিলে তোমাকে গড়ে তোলা হয়েছে ?
ভুলিনি তো। বত্রিশ বছর বয়স আমার।
বত্রিশ তো তোমার নিজের বেলায়। আমাদের কিন্তু আরও বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। নবজাতকের পর্যায় থেকে তোমাকে তৈরি করা হয়েছে। তারপর তোমাকে তুলে দেওয়া হয়েছে নিঃসন্তান দম্পতির হাতে। তুমি বড় হয়েছো সাধারণ একজন শিশুর মতো করে। তুমি স্কুলে গেছো, কলেজে গেছো। কৃতিত্বের সঙ্গে পাসের পর পাস করেছো। সফল চিকিৎসক হয়েছো। অথচ হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অন্য কেউ জানে না তুমি কে ? আমাদের অনেক গবেষণার ফসল তুমি। মানুষের চেহারা নিয়ে তুমি মানুষের মাঝে মিশে গেছো, অথচ তুমি মানুষ নও।
আমি সেটা জানি। আমার শরীর মানুষের মতো। শুধু মস্তিষ্কটা কৃত্রিম। আমাকে চাইলেই আপনারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
আর কেউ তো তোমার মতো অবাধ্য হয়নি। শুধু তুমিই সিদ্ধান্ত অমান্য করেছো।
আর কেউ মানে ? তার মানে আমার মতো আরও অনেকে আছে ?
হ্যাঁ, এখন তোমাকে সত্যটা বলাই যায়। আছে, তোমার মতো আরও অনেকে আছে। প্রতিটি পেশায় আছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এক বা একাধিক জন আছে। আমাদের প্রজেক্ট বিশাল। আমাদের স্বপ্নও অনেক বড়।
জানি। এবার আপনি আমাকে একটা সত্য কথা বলবেন ?
বলো, আগে শুনি। এখন তোমার কোনো ইচ্ছে আমি অপূর্ণ রাখব না।
লোকে জানে লিফট দুর্ঘটনায় আমার মা-বাবা মারা গেছেন। কিন্তু আমার ধারণা তাদেরকে কৌশলে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার ধারণা কি ঠিক ? ঠিক, তোমার ধারণা একদম ঠিক। তোমার কথিত মা-বাবার আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল না। বরং তারা বেঁচে থাকলে আমাদের ঝুঁকি বাড়ত। আর পাঁচটা মা-বাবার মতো তারাও তোমার বিয়ে দেওয়া নিয়ে উঠে-পড়ে লেগেছিল। তুমি রাজি হচ্ছিলে না। তোমার গতিবিধির ওপর তারা বেশি করে নজর রাখছিল। তোমাকে তারা সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। বিষয়টা আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হতো না। দু’টো জীবনকে এভাবে শেষ করে দেওয়া ঠিক হয়নি। আপনারা বললে ঝগড়া করে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতাম। তাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতাম না। তাদেরকে এভাবে মেরে ফেলা ঠিক হয়নি।

তোমার মধ্যে দেখছি মানবিক গুণাবলী প্রবল হয়ে উঠেছে। এটাই তোমার মস্ত ভুল। তোমার প্রধান কাজ ছিল আমাদের মিশনকে সহয়তা করা। সিদ্ধান্ত অমান্য করা নয়। আমাদের ধারণাকে তুমি খানিকটা হলেও ভুল প্রমাণ করেছো। নতুন করে আবার ভাবতে হচ্ছে। কাজটা করার আগে তুমি একবারও ভাবলে না ?
কে বলল আপনাকে ভাবিনি ? ভেবেছি। অনেক ভেবেছি।
ভেবেছো, কী বলছো !

আপনি অযথাই বিস্মিত হওয়ার ভান করছেন। আমার মস্তিষ্কের কোনো তথ্যই তো আপনার অজানা থাকার কথা নয়। একজন চিকিৎসক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করার আগে রোগীসেবার যে শপথ নিয়েছি, আমি সেটাই পালন করেছি মাত্র। তুমি অবাধ্যের মতো আরেকটা কাজ করেছো। প্রায় দেড় ঘন্টা তোমার মস্তিষ্কের সঙ্গে ‘ডাটা সেন্টারের’ যোগাযোগ তুমি বিচ্ছিন্ন রেখেছিলে। কেন করেছো এরকম হটকারিতা ?
সজ্ঞানে ইচ্ছে করেই করেছি। তা না হলে কবি ইরেশের অপারেশনটা আমি করতে পারতাম না। আপনারা কিছুতেই আমাকে সেটা করতে দিতেন না।
তোমার এই স্বীকারোক্তির সাজা তুমি জানো ?
জানি। আর আপনি তো এতক্ষণ ধরে এই স্বীকারোক্তিটাই আদায় করতে চাইছিলেন।
অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য !! হতাশা মেশানো গলায় একই শব্দ দুইবার উচ্চারণের পর ভরাট গলাটা আর শোনা গেল না।
কিছুক্ষণের জন্য মাথাটা একবারে ফাঁকা হয়ে গেল ডা. ওশিনের। খানিক বাদে মস্তিষ্ক আবার কাজ করতে শুরু করল। হঠাৎ কবি ইরেশের কথা মনে পড়ল তার। লোকটা ভারি অদ্ভুত। বয়সে তার পালিত বাবার চেয়েও বছর পাঁচেক বড় হবে। তারপরও স্বভাবে-আচরণে একদম তরুণদের মতো। কবি ইরেশ তাকে তার হাত ধরতে বলেছিলেন। চোখে খেলা করছিল কী অদ্ভুত স্নেহ। বাবার চোখে যেটা সব সময় উপচে পড়ত। তখন ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। অস্ত্রোপচারটা ঠিক মতো শেষ করতে পারবে কিনা সেটাই সেই মুহূর্তে মাথায় জুড়ে বসেছিল। ইশ ! আবার যদি কখনও দেখা হয়, কবি ইরেশের হাত অবশ্যই ধরবেন। তবে সেই সুযোগ আর পাবেন বলে মনে হচ্ছে না ডা. ওশিনের।
*অ্যাব : আর্টিফিসিয়াল অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্নদের তৈরি করা বিশেষ প্রশিক্ষিত বাহিনী।

Series Navigation<< বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ।। ইলাবৃত ।। কমলেশ রায় ।। ষষ্ঠ পর্ববিজ্ঞান কল্পকাহিনি ।। ইলাবৃত ।। কমলেশ রায় ।। চতুর্থ পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *