উপন্যাস

উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব ছাব্বিশ

না থাক, চা খাবাে না।
অল্প একটু?
না, ডাক্তার বারণ করেছে। শরীরটা তালাে যাচ্ছে না।
আপনি হয়তাে বেশি চিন্তা করছেন।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
আমার জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেলাে জামেরী।
আমি চমকে উঠলাম। এ দিকটা কখনাে ভাবিনি। মিতুল তার ফেলে আসা অতীতের একটা যােগসূত্র ছিলাে।মেয়েটাকে আমি কখনাে বুঝতে পারিনি জামেরী। ও ঠিক ওর মা-র মতােই ছিলাে। একটু থেমে আবার বললেন, তুমি কিছু মনে করাে না বাবা। তুমি লেখক
তাে, এ জন্যে এসব কথা বলছি।
আলী আহমদ সাহেব আমাদের সম্পর্কের কথা ভুলে গেছেন। মিতুল সুস্থ থাকলে তিনি কোনােদিন এসব কথা আমার সামনে বলতেন না। সম্পর্কের একটা
নিরাপদ দূরত্ব বাঁচিয়ে চলতেন। মিতুলের অসুস্থতা তাকে আমার অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এখন আমি তার বন্ধুর মতাে।
আমি ভেবেছিলাম, ওর মায়ের স্বভাব থেকে আমি ওকে আড়াল করে রাখতে পারবাে। কিন্তু পারিনি। আমি বুঝতাম ওর জালা কোথায়। আমার কিছু করার
ছিলাে না। যার রক্তে আগুন, তাকে আমি কেমন করে বাঁচাবাে বলাে?
আমি ক্রমাগত বিশ্বয়ের অতলে ডুবে যাচ্ছি। মিতুলের বাবা ওকে এমন গভীরভাবে বুঝতেন, এটা আমরা দুজনের কেউ কোনােদিন টের পাইনি। কোনাটা
আচরণেই তিনি তা প্রকাশ করতেন না। অথবা করতেন। কিন্তু যথাযথ পথে প্রকাশের আবেদন ছিলাে না। ফলে ভুল ব্যাখ্যা হতাে। মিতুল যেটাকে মায়ের
ভালােবাসা বলতে। তার হঠাৎ করে বুড়িয়ে যাওয়া গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গড়িয়েছে। দৃষ্টি ঘােলাটে। ব্যথিত। আমি কোনাে কথাই বলছিলাম না। আমার
ইচ্ছে উনি আজ প্রাণ খুলে কথা বলুন। আমি শুনি। উঠে বাতি জ্বালালে উনি আপত্তি করলেন।
বাতিটা বন্ধই থাক না জামেরী। এই আঁধারটা বেশ লাগছে। আবার বাতি বন্ধ করলাম। দুজনে ঘরে চুপচাপ। মিতুলের মা-রও সুক্ষ্ম মন ছিলাে জামেরী। যেটা ধরতে পারিনি আমি। মিতুলের মা আমাকে কোনােদিন সহ্য করতে পারেনি। সবসময় মনে করতাে আমি তার উপযুক্ত নই। আমার ভেতর নাকি কোনাে শিল্পীমন নেই। বাস্তবটা বড় বেশি বুঝি। আর এসব ছােটখাটো কথায় প্রায় ঝগড়া হতাে। তারপর সে নিজের পথ নিজেই বেছে নিলাে চলে গেলাে আর একজনের সঙ্গে। তাই ওর চলে যাওয়াটা আমার প্রাণে তেমন লাগেনি। মনে হয়েছিলাে, ভালােই হয়েছে। নিরুত্তাপ জীবনের চাইতে এই ভালাে। কিন্তু তাতে কি মুক্তি পেয়েছি। ভুলতে পারলাম কই? মিতুলের
মতাে যদি আমারও সেরেব্রাল করটেক্স অকেজো হয়ে যেত। চমৎকার হতো। প্রতিদিন প্রতারক স্মৃতি আমার হৃদয়ের গর্তে রক্ত বাশি বাজাতাে না। জানাে জামেরী, একটা চিনচিনে অপমানের যন্ত্রণাই বয়ে বেড়ালাম সারাটা জীবন। এগন মনে হয় গ্রহণের ক্ষমতা যদি তীক্ষ্ণ না হয় তাহলে কারাে ভালােবাসাই অকেজো থ্যালমাসের মতাে কোনাে অনুভূতি সারাজীবনের রিলে করে পাঠায় না।

একটানা কথা বলে আলী আহমদ সাহেব চুপ করলেন। ইউক্যালিপটাসের মাথার ফাকে ঝুপকুপিয়ে আঁধার নামছে। প্রগাঢ় হচ্ছে রাত্রির দীর্ঘশ্বাস। আলী আহমদ সাহেবকে বলার মতাে কোনাে কথাই আমার নেই। আমি শুধু শুনতে জানি।
আচ্ছা জামেরী, মেয়েটা এভাবে কতকাল থাকবে?
কেন, যতদিন রাখা যায়।
না না, তা কি করে হয়। আমি সহ্য করতে পারছি না। এ কৃত্রিম জীবন আমার কাছে অসহ্য।
কি বলছেন আপনি?
এভাবে বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ এভাবে বাঁচিয়ে রাখা তাে ধর্মবিরােধীও। আমি কি করবাে বুকতে পারছি না।
আমার সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলাে। কি বলছে ভদ্রলােক। আমি একদৃষ্টে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না যে, কথাগুলাে
মিতুলের স্নেহময় পিতার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে। স্বাস প্রত্যাহার মানেই তাে মৃত্যু।
অসম্ভব। এভাবে যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় ততদিনই বাঁচবে মিতুল। ধর্মের নামে কোনাে বিরুদ্ধ শক্তির কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না।
তুমি তাে জানাে জামেরী, মিতুলের জীবন ফিরে পাবার আর কোনাে আশা নেই।
তবু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের দেখতে হবে। আমার দৃঢ় কণ্ঠে আলী আহমদ সাহেব কিছু বললেন না। অনেকক্ষণ চুপ করে নিঃশব্দে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলেন। আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমি কোনাে কিছুই ভাবছি না। মনে হচ্ছে পায়ে শিকল বাঁধা আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পর্বতের সুউচ্চ চূড়োয়। আমার বুকে অনন্তকালের গােঙানি।

পরদিন কাগজে রায়হানের ছবি বেরুলো। বড় বড় করে খবর ছাপা হলাে। এতদিন পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারেনি। জনৈক লেখক বন্ধুর সহযােগিতায় সে আত্মগােপন করেছিলাে। খবরটা পড়ে আমার সমস্ত অনুভূতি হিম হয়ে গেলাে। বুঝতে পারলাম ভীষণ ষড়যন্ত্রের জাল আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে। সুযােগ পেলেই টেনে তুলবে। যাকগে, সেটার আমি পরােয়া করি না। রায়হান এবং মিতুল দুজনেই খবর হয়েছে। খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় তাদের কথা লােকে আগ্রহের সঙ্গে পড়ে। তিন-চার দিনের মধ্যে মামলা শুরু হবে। রায়হানের ওষুধগুলাে ওর কাছে পৌছে দেয়ার চেষ্ট করতে হবে। আমার ডাক্তার বলেছে, ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। অন্তত এই একটি জায়গায় আমি হেরে যেতে রাজি নই।
রায়হানকে সুস্থ করবােই।
মাঝে মাঝে শরাফী আসে। খুব সাবধানে মিতুলের কথা বলে। পাছে আমি আঘাত পাই। মিটু একদিন অবাক হয়ে জিজ্জেস করেছিলাে, এই খুনী লােকটাকে
আপনি জায়গা দিয়েছিলেন জামেরী ভাই। আমি ওর কথার উত্তর দেইনি। ও ছেলেমানুষ। ওকে কোনাে কিছু বােঝানাের আমার দরকার নেই। ওকে অন্য কথা বলি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভাবি, মিতুল বেঁচে আছে। কিন্তু অর্থপূর্ণ জীবন ফিরে পাবার আশ্বাস নেই। কখনাে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হই। তখন দুশ্চিন্তা নিরাশা হতাশা আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। আমি করকরে বােধ করি। প্রচও কাজ করার তাগিদ অনুভব করি। অফিসের টেবিলে সারারাত কাটিয়ে দেই। একটুও ক্লান্তি ঘায়েল করে না। উপন্যাসটা প্রায় শেষ করেছি। আর কয়েক পৃষ্ঠা লিখলেই হয়। প্রকাশকের সঙ্গে যােগাযােগ করেছি। ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। অন্য আর একটি উপন্যাসের ছক মাথার মধ্যে ঘুরছে। কিছু কিছু নােট করেছি। এটা শেষ হলে ওটা ধরবাে। হাসপাতালের বিছানায় মিতুল ক্রমগত শীর্ণ হচ্ছে। মুখের লাবণ্য নিঃশেষ। মরা চামড়া উঠছে। আমি এখনাে হাসপাতালে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। দেখতে ভালাে লাগে। এ তাে আমার অন্য মিতুল। প্রকৃতির মতাে বদলে যাচ্ছে। মিতুলের জীবনে যুক্ত বদলের খেলা জমেছে। ও
আবার বসন্ত হবে। হ্যা, নিশ্চয় হবে। আমি নিজেকে মিথ্যে শান্তনা শােনাতে শােনাতে বিহরল হই। চোখের কোনা চিকচিকিয়ে ওঠে। তখন রেজা এসে ঘাড়ে হাত রাখে।
চল।
আমিও বিনা প্রতিবাদে ওকে অনুসরণ করি। ওর টেবিলের সামনে বসে থাকি। কোনাে কথা খুঁজে পাই না। চায়ের স্বাদ তেতাে লাগে। সিগারেট বিজবাদ। ধৌয়জ যেন দম আটকানাে। রেজা গালাগাল করে।
শালা, তুই একটা হারামি। তােকে কিছু বােঝানাের সাধ্য কি আমার আছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তােকে ধরে ট্রেনের তলে ফেলে দেই। মরে ভুত হয়ে যা শালা।
আমি হাসি। রেজা আরাে ক্ষেপে যায়। কত অজস্র কথা বলে। আমি শুনি না। রেজা আমাকে ওয়াতে নিয়ে যাবার জন্যে ঢানাটানি করে। আমি যাই না। মনে হয়
এখন আমাকে জীবনের ভিন্ন অর্থ খুঁজতে হবে। যে পথে আমি এতকাল চলে এসেছি সে পথের সামনে এখন বিরাট দেয়াল। ডিস্তোবার কোনাে উপায় নেই। এখন আমার বাঁক বদলের পালা। এতকাল বড় সহজ রাস্তায় এসেছি। সে রাস্তার ধারে মৌসুমী ফুলের বাগান ছিলাে। এখন নামতে হবে পাথুরে পথে।সেখানে কোনাে বাগান নেই। ঝর্ণা নেই। সবুজ ঘাস নেই।

রেজা হঠাৎ করে বলে, জানিস জামেরী, ড, জাকের মাঝে মাঝে মেশিনের সাহায্য ছাড়া মিতুলকে শ্বাস নিতে অভ্যন্ত করাবার চেষ্টা করেন। তার ফলে মিতুল কখনাে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সক্ষম হয়েছে।
তার মানে মিতুল ভালাে হবে?
অত উত্তেজিত হােস না। বােস। এটা একটা পরীক্ষা। ভালাে হবে কিনা, তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই।
তাহলে আর কি!
আমি আবার অন্ধকারে ফিরে আসি। মাথাটা ঝিমঝিম করে। রাগ হয়। অকারণে রাগ। রেজাকে কিছু না বলে চলে আসি। তখন সমস্ত শহরটা সমুদ্র হয় যায়। আমি একটা সবুজ বদ্বীপ খুঁজে ফিরি। শরাফীর মেয়ের কথা মনে হয়। নিউমার্কেটে নেমে একগাদা ফল কিনি। সােজা শরাফীর বাসায় চলে আসি। মেয়েটাকে কাছে ডেকে পাগলের মতাে আদর করি। ও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকায়!
কাকু, তােমার কি হয়েছে?
জানি না তাে কি হয়েছে?
আমি ওকে বুকে চেপে রাখি। কিছুক্ষণ পর ও ছটফটিয়ে ওঠে।
জানাে কাকু, আমার মুরগিটা আজ একটা ডিম পেড়েছে। সেটা আমি তােমাকে দেবাে। মা না আজ আমার লাল মােরগটা জবাই করেছে। কালু যখন ওটাকে ধরার জন্যে দৌড়াদৌড়ি করছিলাে, আমি কত বললাম, পালাও পালাও। মােরগটা পলাতে পরিলাে না। কালু ধরে ফেললাে। আজ আমি মায়ের সঙ্গে আড়ি নিয়েছি।
বেশ করেছে।
আমি এক টুকরাে মাংসও খাইনি। মা অনেক সেধেছিলাে।
ভালাে করেছে।। মায়েরা সব সময় ভীষণ দৃষ্ট হয়। তুমি আমার মা হলে কতই না মজা হতা। তুমি আমার সব কথা শুনতে, না কাকু?
হ্যাঁ। একদম তােমার কথামতাে চলতাম।
জানাে কাকু, আকু না আমাকে খুব আদর করে। আমি যেটা বলি, সেটা শােনে।
তুমি এই ফলগুলাে খাও দেখি মামণি।
আমি ওকে কমলার খােসা ছাড়িয়ে দেই ও খেতে খেতে অজস্র কথা বলে।
শরাফী এক ফাঁকে বলে, রামীন বুঝতে পেরেছে যে, আজ তাের মনে ঝড়। নইলে ঐ মেয়ে কোনােদিন এত কথা বলে না।
সব শিশুরাই বড়দের জন্যে শান্তনার ঠাঁই।
শরাফীর বৌ চা নিয়ে আসে।
কোথায় গিয়েছিলেন?
হাসপাতাল থেকে নিউমার্কেট। তারপর এখানে। প্রায়ই তাে এই একটা কথাই শুনি। আর কি কোথাও যাবার জায়ণা নেই।
আপাতত নেই।
চলুন আমরা সবাই মিলে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি। সময়টা ভালাে। যাবেন?
আপনারা যান।
আচ্ছা জামেরী, তুই কি এমন পাগল হয়েই থাকবি?
তুই কি চাস আমি এখান থেকে চলে যাই? আমি রাগ হয়ে বলি।
না বাপু, বােস।
তােরা বরং তােদের কাজ কর গিয়ে। আমি রামীনের সঙ্গে একটু কথা বলি।
শরাফী আর ওর বৌ দুজনেই চুপ করে যায়। আমি চায়ে চুমুক দেই। রামীন এক কোয়া কমলা মুখে পুরে বলে, কাকু, এবার থেকে তুমি আমাদের বাসায় থাকো।
আমি রােজ তােমার দাঁত ব্রাশ করে দেবাে, জুতাে মুছে দেবাে। তােমার কান থেকে ব্যাঙ বের করে দেবাে।
ব্যাঙ?
হ্যাঁ। জানাে না? মা আমার কান থেকে রােজ ব্যাঙ বের করে আনে। আমার একটা ছােট কাঠি আছে, ওটা দিয়ে তোমার কান থেকেও ব্যাঙ বের করে আনবাে।
আমরা তিনজনে হেসে উঠি। ও একটু বিব্রত হয়। তারপর লজ্জা পায়।
যাঃ হাসছযে কেন? তুমি একটুও ভালাে না কাকু।
না, ঠিক আছে, আর হাসবাে না। এই দেখাে, গঞ্জীর হয়ে গেলাম।
আচ্ছা কাকু, মুরগি ডিম পাড়ে কেন?
শরাফী আর ওর বৌ হেসে ফেলে।
কি জানাে না বুঝি?
না তাে মামণি!
আমি জানি শােনাে। আমরা ছােটরা ডিম খেতে ভালােবালি তো। আর মুরগিও ছোটদের ভালােবাসে। তাই রােজ রােজ ডিম পাড়ে।
ঠিক বলেছে। আর রামীন, তুমি আর কি জানাে?
অনেক কিছু। তােমাকে সব শেখাবাে। তুমি আমাদের বাসায় থাকবে তাে?
হ্যাঁ, থাকবাে।
ঠিক আছে, কাল থেকে তােমাকে শেখাকবাে। যাই খেলি গে।
রামীন লাফাতে লাফাতে চলে গেলাে। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠলাম। শরাফী এক সেমিনারে যাওয়ার জন্যে বললাে। ভালো লাগলাে না। ওর বৌ কি যেন রসিকতা
করলাে, তাও শুনলাম না। ইাটতে হাটতে বাড়ি ফিরলাম। অতটা পথ আমি একটানা অনেকদিন হাটিনি। ঘরে ফিরে ধুলােমাখা জুতােসুদ্ধ বিছানায় শুয়ে
পড়লাম। রােদে ধরেছে। মাথার শিরা দপ দপ করছে। ড্রয়ার ঘেঁটে একটা নােভালজিন পেলাম। সেটা খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। সন্ধ্যায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলাে। মিটু হাসলাে। ঘুমােচ্ছিলেন জামেরী ভাই। আমি আরাে একবার এসে ঘুরে গিয়েছি। তখন আপনি ছিলেন না। একটু পর বাসায় মিলাদ হবে। আপনি আসবেন?
মিন্টু চলে গেলাে। মাথাটা এখন একটু হালকা লাগছে। চোখের জ্বালা কমেছে। হেঁটে না এলেই পারতাম। কেন যেন ইচ্ছে করে নিজের ওপর এ ধরনের অত্যাচার করি বুঝি না। তখন এক ধরনের একরােখা জেদ চাপে। ফলাফল ভাবতে ইচ্ছে করে না। একটু পরে প্রকাশকের কাছ থেকে লােক এসে একগাদা প্রুফ দিয়ে গেলাে।
বইটা দ্রুত ছাপা হচ্ছে। শেষ অধ্যায়টা এখনাে লিখতে পারলাম না। চা খেয়ে প্রুফ নিয়ে বসলাম। নিচ থেকে অনেক লােকের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। আলী আহমদ সাহেবের সেদিনের কথার পর থেকে মনটা আমার বিরূপ হয়ে আছে। তাই যাবাে না বলেই ঠিক করলাম। মিতুল মরে গেছে আর ওরা শােক করছে, সারা বাড়িতে এমন একটা ভাব। ওখানে গেলে আমার দম আটকে আসতে চায়। মাঝে মাঝে ভাবি, আলী
আহমদ সাহবকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলি। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে এই পরিবেশটা আমার কাছে দূষিত হয়ে উঠেছে। আমি যেন এক বিপন্ন বসতির ঘেরাটোপ বাসিন্দা। প্রুফ দেখা শেষ করেছি, তখন দরজায় আবার শব্দ।
জামেরী ভাই, বাবা আপনাকে ডাকছেন।
অগত্যা মিনটুর পিছু পিছু নামতে হলাে। না করার উপায় নেই
মিলাদে এলে না যে বাবা?
একটা জরুরি কাজ ছিলাে।
মিতুলের জন্যে মিলাদ পড়ালাম।
আমি কিছু বললাম না। মনে মনে ভাবলাম, মিতুলের জন্যে আমার নিজস্ব প্রার্থনার ভাষা আছে। ওটা লােক দেখানাে কোনাে ব্যাপার নয়। লােক জড়াে করে
আনুষ্ঠানিকতায় সে প্রার্থনা জোরালাে হয় না। আলী আহমদ সাহেব একটুক্ষণ আমার মুখটা জরিপ করলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঝরনা আমার জন্য এক প্লেট মিষ্টি নিয়ে এলাে।
সব খেতে হবে কিন্তু।
এত মিষ্টি-
এত কৈ? কয়েকটা মাত্র।
এত মিষ্টি খেলে রাতে আমার ঘুম হবে না।
যাঃ, কি যে বলেন!
খাও বাবা, খাও। শরীরটা একদম অর্ধেক হয়ে গেছে। তােমার নিজের স্বাস্থ্যের দিকে একটু নজর দিও। অসুখবিসুখ হলে দেখবার তাে কেউ নেই। আলী আহমদ সাহেব কথাগুলাে কেন বলতেন বুঝতে পারলাম না। অনুগ্রহ না ভান, চতুর কণ্ঠস্বরে তা ধরা পড়ে না। মিতুলের অবর্তমানে এ পরিবারে আমার
কোনাে জোরালাে অধিকার নেই, এ সত্য আমি মর্মে মর্মে অনুভব করি। তখন আমার এখান থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। দু’একটা জিলাপি খেয়ে উঠ
পড়ি। সে কি বাবা, উঠলে যে, আর একটু বসাে না?
জামেরী ভাইয়া এলেই কেবল যাই যাই করেন। আলী আহমদ সাহেবের কথায় নয়, করুণার অনুযােগে আমাকে বসতে হলাো। আমি এ বাড়ির মালিক। ওরা আমার ভাড়াটিয়া। এর বাইরে ওদের সঙ্গে আমার
কোনাে গভীর সম্পর্ক নেই। আলী আহমদ সাহেব আমার কাছে সরে এসে বসলেন। মিতুলের ব্যাপারটা নিয়ে আর কি কিছু ভেবেছে বাবা?
না, ভাবার কি আছে!
আর কতকাল ও এমন করে বাঁচবে? আমি কিছু ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছি না।
আমার কষ্ট হলাে।
আপনি কি এখনই ক্লান্ত হয়ে গেছেন। হান্তির ব্যাপার নয় বাবা, ধর্মেরও একটা প্রশ্ন আছে। আজকে সে রকম
আলােচনাই হলাে। আপনি নিজের মনকে শক্ত করুন। এ ধরনের কোনাে কিছু প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয়। এখন শ্বাস প্রত্যাহার মানে মিতুলের মৃত্যু। সে মৃত্যুর জন্যে আমরা সবাই দায়ী হবাে। আমরা হবাে খুনী।
তুমি একটা আস্ত নাস্তিক।

আলী আহমদ সাহেব রেগে গেলেন।
ঠিক আছে, চলি।
আমি গটগট করে বেরিয়ে আসি। মিতুলের মা-র কণ্ঠস্বরে বারান্দায় একটুক্ষণ খমকে দাঁড়াই। ভদ্রমহিলা জোরে জোরে বলছেন, মিতুলের ব্যাপার নিয়ে ওর সঙ্গে
আলােচনা করার কি আছে? ও মিতুলেের কে? মাথাটা আমার বো করে ওঠে। কোনােমতে পা টেনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসি। আমার জীবনে মিতুলের কোনাে সামাজিক স্বীকৃতি নেই। মিতুল আমার বৌ নয়। চক্রাকারে কথাগুলাে মাথার মধ্যে ঘুরচে। বাতি বন্ধ করে দেই। এখন অন্ধকারই ভালাে। চিৎকার করে উঠলাম, মানি না সমাজ। মিতুলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। হ্যাঁ, মিতুল আমার বৌ। একশবার আমার বৌ। আমি পাগলের মতাে জানালার শিকে মাথা ঠুকি। রাতে আমার ভালাে ঘুম হলাে না। আজেবাজে স্বপ্ন দেখলাম। মাথাটা ভার হয়ে রইলাে। ভােরবেলা জানালার ফাকে রােদ ওঠা দেখলাম। অনেকদিন অন্ধকার-ভােরে মিতুল আমার দরজায় কড়া নেড়ে ঘুম ভাঙিয়ে খুনসুটি করেছে। রাগ করেছে। কখনাে আমার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে অনেক দুরে চলে গেছে। এখন
মিতুলের সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিলে একবারও চোখ তুলে চাইবে না। বলবে না, উঃ জামী, তােমার সঙ্গে আর পারি না। তুমি একটা ইয়ে। মনে পড়লাে আজ দশটায় রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে হবে। অনেক চেষ্টা
করে একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়েছি। রায়হানের ওযুধগুলাে পৌছাতে পারবাে না। কড়া নিষেধ। এটা আমার জানা ছিলাে না। ওর বিচার এখনাে শুরু হয়নি। কেন দেরি হচ্ছে জানি না। বালিশের নিচে থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলাম। দশটার এখনাে তিন ঘণ্টা বাকি। এই দীর্ঘ সময় আমার কিছু করার নেই দেখে খারাপ লাগলাে। ইউক্যালিপটাসের ডালে দোয়েলটা এলে হয়তাে ভালাে লাগতাে। নিচে কোলাহল, গাড়ির হর্ন শুনতে পাচ্ছি। ছকবাঁধা জীবনের শুরু। আপাতদৃষ্টিতে কোথাও কোনাে দ্রুটি নেই। অথচ এর মাঝে কেউ কেউ পিছিয়ে পড়েছে। কারাে চলা থেমে গেছে। আমরা আর কতজনের খোজইবা রাখি? আমি জামেরী জীবনের সবধরনের গতিবেগ বুকের মধ্যে পুষে রেখেও কেমন অথর্ব হয়ে গেছি। চলাটা মাঝে মাঝে বিরক্তিকর মনে হয়। বুঝি এটা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু অবসাদ যখন রাস্তার পিচের মতাে আঁকড়ে ধরে, কিছুতেই নিস্তার পাই না। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে কোথাও, কোনাে শান্তির আশ্রয়ে যা আমার জন্যে স্বস্তির সাদা আলাে জেলে রাখবে। সবকিছুর মধ্যে একটা আনন্দ বইটা দ্রুত ছাপা হচ্ছে। একটু পরে
প্রকাশকের লােক আসবে প্রুফণগুলাে নিয়ে যেতে। নিজেকে ধমকালাম। জমেরী তােমার হয়েছে কি? বয়সের তারুণ্য উপেক্ষা করে তােমাকে কেন বুড়ােমিতে
পেয়েছে? ভালাে নয় জামেরী, বুক টান করে সােজা হয়ে দাঁড়াও দেখি? জীবনের সবটাই ব্যর্থতা আর হতাশা নয়। সেখানে সাদা ছােট জুঁই ফুলও আছে। স্নিগ্ধ গন্ধ
বেঁচে থাকাকে মােহিত করে। তুমি সব বােঝ জামেরী, তবু মাঝে মাঝে পিছিয়ে পড়ে। এই পিছিয়ে পড়াটা তােমাকে অতিক্রম করতে হবে। নিজেকে শাসন করে কিছুটা চাঙা হলাম। হাতমুখ ধুয়ে যখন রাস্তায় বেরুলাম
তখন বেশ সজীব মনে হলাে। মনে হলাে আমি যেন এই জনস্রোতেরই অংশ। আমার হৃদপিন্ডের ধুকধুকানি অগণিত পায়ের শব্দে সঙ্গীতের মতােই বাজে এবং সেই
বাজাকে বেঁচে থাকা বলে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মিতুলের জন্যে গাদা গাদা জিনিস কিনি। একদিন একটা লাল কিউটেক্স কিনেছিলাম। ভালাে হয়ে ও অবাক হয়ে যাবে। জিনিসগুলাে নেড়েচেড়ে দেখতে ভালাে লাগে। বেনারসিটার একটা ভাজও ভাঙ্গেনি। ভাবতে ভাবতে যখন জেল-গেটে এলাম তখনাে দশটা বাজার দশ মিনিট বাকি। রাজ্যের হাঙ্গামা শেষ করে রায়হানের জন্যে অপেক্ষা করতে আমার খারাপ লাগেনি। ও যখন এলাে অবাক হলাম। খোঁজা খোজা দাড়ির মাঝে চোখজোড়া আশ্চর্য জুলজুল করছে। ঠিক সেই আগের রায়হানের মতাে। লাবণ্যের বদলে পৌরুষত্ব। আকম্মিক ঘা খেয়ে রায়হান দ্রুত সুস্থ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম ভেঙে পড়বে। ওকে বুঝি আর ভালাে করতে পারবাে না। দেখলাম হিতে বিপরীত
হয়েছে। আমার জন্যে আনন্দের খবর। রায়হান জেগে উঠেছে। বর্ষায় ডুবে যাওয়া নদীর চরের মতাে। আরাে উর্বর, আরাে ঐশ্বর্যশালী হয়ে। আমি একটু থমকে ওকে
দেখলাম। ও আমাকে দেখে গভীর চাপা গলায় বললাে, তুই কেন এসেছিস জামেরী।
কেন, কি হয়েছে?
বিপদ হতে পারে।
দুর বােগাস। কিছু হবে না। আমি হাসলাম।
না জামেরী, ভালাে করিসনি।
আঃ চুপ কর। তাের একটা দরকারি ওষুধ আনতে চেয়েছিলাম। পারলাম না।
পারবি না সে তাে জানা কথা। তবে জানিস জামেরী, আমি এখন অনেক ভালাে হয়ে গেছি। আগে মনে হতাে আমার মাথার দরজা জানালাগুলাে যেন বন্ধ হয়ে
আছে। বন্ধ ঘর যেমন গুমােট হয়ে থাকে অনেকটা তেমনি। এখন একদম হালকা। সারাজীবন তাের কেনা গােলাম হয়ে থাকবো জামেরী। ভাগ্যিস সময়মতাে চিকিৎসা করিয়েছিলি। তুই ওষুধ না খাওয়ালে আমি বােধহয় পাগল হয়ে যেতাম।
এখন এসব কথা বলতে নেই। তােকে এক বছর ওষুধ খেয়ে যেতে হবে রায়হান।
তােকে দেখে আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে। মনে হয় বহুদিন এমন আনন্দের সঙ্গে আমার কোনাে যােগাযােগ ছিলাে না।
এ জন্যেই তুই আমার প্রাণের বন্ধু।
রায়হান শব্দ করে হাসে।
জানিস জামেরী, আমি একজন খুনের আসামী, তবুও আমার একটুও ভয় করে না। দিব্যি ঘুমােতে পারি।
আমি তাে এটাই চাই। তাের স্নায়ু যেন সব সময় শান্ত থাকে। উত্তেজনা তার জন্যে খারাপ হবে। অসুখ বাড়তে পারে।
আমার জন্যে তাের আর একটুও ভাবতে হবে না রে।
রায়হান গরাদের ফাঁকে হাত দুটো জড়িয়ে ধরে। ও যেন অনেককাল আগে ভুবে যাওয়া টাইটানিকের একমাত্র বেঁচে যাওয়া যাত্রী। ঝকমকে দৃষ্টিতে আশ্চর্য কৃতজ্ঞতা। আমি সেই দৃষ্টিতে অভিভূত হয়ে যাই। আমার মনে হয়, আমি যেন মিতুলের ভালােবাসার স্পর্শ পাচ্ছি। ছন্দাকে আমি আমার করবােই জামেরী। দরকার হলে কিডন্যাপ করে এনে লুকিয়ে রাখবাে।
সেটা তাের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তুই আমাকে এড়াতে চাইছিস?
না।
আমার সিদ্ধান্ত থেকে আমি একটুও নড়িনি।
আমি চুপ করে থাকি। এ কথার উত্তর হয় না। রায়হান এখন খুনের আসামী। বিচারে ওর ফাসি হতে পারে। তবুও ও স্বপ্ন দেখছে। সিদ্ধান্তের কথা সদ্য ঘােষণা
করছে। স্বাভাবিক জীবনের তৃষ্ণা বুকে। ও সেই আগের রায়হান হয়েই আত্মপ্রকাশ করছে।
কি ভাবছিস জামেরী? ভাবছিস খুনের আসামীর মুখে এ কি কথা? না?
রায়হানের চাপা ফিসফিস কণ্ঠে আমি চমকে উঠি। আমার বিচলিত মুখের দিকে তাকিয়ে রায়হান হাসে। হাসির মাঝে সময় ফুরিয়ে যায়।
আবার কবে তাের সঙ্গে দেখা হবে জানি না রায়হান। অনেক ঘােরাঘুরির পর আজকের তারিখটা দিয়েছিলাে ওরা।
না, তুই আর আসিস না। আমি এখন ভালাে আছি রে। চিন্তার কোনাে কারণ নেই। তাছাড়া শিগগিরই বােধহয় বিচার শুরু হবে।
শেষ কথায় রায়হানের মুখে পলকা ছায়া খেলে যায়।আমি কথা বলতে পারি না।
গরাদের ফাঁকে রায়হানের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসি। এখন আর ওর জন্যে কোনাে কিছু করার নেই। বুকে একগাদা আবেগ নিয়ে কিছু করতে না পারার যন্ত্রণাটা বড় মর্মান্তিক।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব পঁচিশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *