উপন্যাস

উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।।সেলিনা হোসেন।। পর্ব ষোল

অবশেষে আমার তৃতীয় উপন্যাসটা বেরুলাে। প্রকাশকের কাছ থেকে প্যাকেটটা এসেছে গতদিন। এখনাে খুলিনি। মিতুল এলে খুলবো। নইলে ও রাগারাগি করে। এই আশা হওয়ার আগ পর্যন্ত ভীষণ টেনশনে থাকি। বেরিয়ে গেলে কেমন একটা নিরাশক্তি পেয়ে বসে আমাকে। লাফালাফি করে খুলে দেখার খুব একটা ইচ্ছেও নিজের মধ্যে নেই। বসে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলাম – তখনি মিতুল এলাে। সকালে বই বেরুনাের খবরটা ওকে দিয়েছিলাম। দুপুরে ও এলাে। আমি কিছু বলার আগেই বইয়ের প্যাকেটটা টেবিলের ওপর থেকে টেনে নিয়ে চটপট খুলে ফেললাে। বড় বড় শ্বাস টেনে নতুন বইয়ের গন্ধ নিলাে। আমার হাসি পেলাে। হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষেপে গেলাে।

হাসছো যে?

তােমার কাজ দেখে না হেসে উপায় আছে।

ভালাে হবে না বলছি।

ঠিক আছে বাবা এই মুখে আঙুল দিয়ে বসলাম।

থাক আর ভেজা বেড়ালের মতাে ভাব করতে হবে না।

আচ্ছা জামী, বই বেরুলে তােমার কেমন লাগে?

ভালাে লাগে। এই তােমাকে ভালােবেসে যেমন সুখ পাই তেমন।

ঠিক বলেছে?

মিতুল আমার গলা জড়িয়ে ধরে। আমার ঘাড়ে নাকটা ঘষতে ঘষতে বলে, হ্যাঁ, ঠিক সেই রকম একটা গন্ধ বেরুচ্ছে।

কি রকম?

ঐ নতুন বইয়ের মতাে। মনে হচ্ছে তােমার পুরাে শরীরটা একটা চমৎকার নতুন বই। মুহূর্তে আমার অনুভূতি পাল্টে গেলাে। আঃ এ জন্যেই তুমি আমার নিঃশ্বাস মিতুল। ঠিক মুহূর্তে মনের কথাটি বলতে পারাে। আর কেউ আমাকে এমন করে বলতে পারে না। তুমি বােঝ আমি কি চাই। এ জন্যেই তােমার সঙ্গে আমার এত ভাবের খেলা। এ খেলা না থাকলে আমি হয়তাে অনেক আগে ঝিমিয়ে যেতাম। জীবনের অর্থ যেত বদলে। আমার প্রথম বইটা যখন বের হয় তখন মিতুলের সঙ্গে পরিচয় ছিলাে না। দ্বিতীয় বইটা যখন বের হয় তখন কেবল পরিচয়ের সূত্রপাত।

তৃতীয় বইটা প্রকাশের সময় মিতুল সম্পূর্ণ আমার। এখন ভালােবাসা বলতে আমি বুঝি মিতুল। ও যেন আমার নতুন বইয়ের মতাে আনন্দ এবং উত্তেজনা। অন্য অর্থে গর্ব।

ওঃ জমী, তােমাকে বলতে ভুলে গেছি, আজ আমার জন্মদিন।

সত্যি? আমার ভীষণ খুশি লাগছে। বলাে এখন কি করবাে?

কি আর করবে। আর খুশিরই বা কি আছে?

মিতুল উঠে জানালার ধারে গেলাে। ছটফট করলাে। কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে আবার আমার কাছে এসে দাঁড়ালাে।

জানাে জামী, বাবা আজ সকালে আমার মাথার কাছে একগাদা ফুল দিয়েছিলো।

তাহলে ফুলের গন্ধে তোমার ঘুম ভেঙেছে?

হ্যাঁ।

আমার ভাৰতেই খুব ভালাে লাগছে।

কিন্তু আমার একটুও ভালাে লাগেনি।

কেন?

জানি না।

মিতুল আর কথা বললাে না। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর দৃষ্টি পাল্টে যাচ্ছে। বাবা – সম্পর্কিত কোনাে কথায় সবসময় ওর দৃষ্টি পাল্টে যায়। ও তখন অন্য মানুষ। অসুখের সময় দেখতাম, বাবা প্রায়ই রাত জেগে আমার মাথার কাছে বসে আছে। আমার ভীষণ বাজে লাগতাে। কান্না পেতাে। বাবার প্রতি তুমি বড় অবিচার করাে মিতুল?

কক্ষনো না।

মিতুলের চোখ ছলছলিয়ে উঠলাে।

মা-র ভালােবাসা আমি মা-র কাছ থেকেই পেতে চাই জামী। আঃ আজ যদি আমার মা কাছে থাকতাে! জন্মদিনে মা না থাকাটা খুব কষ্টের। জন্মের সঙ্গে বাবার কোনাে প্রত্যক্ষ যােগ থাকে না জামী। যে যােগ মায়ের।

আমার বুকটা ধক করে উঠলাে। তাঁতখান লেনের ঘটনাটা মিতুলকে বলা হয়নি। ইচ্ছে করেই বলিনি। ওকে কি বলবাে? শুধু মা-র সঙ্গে দেখা হয়েছে বললে ও খুশি হবে না। একগাদা প্রশ্ন করবে, অথচ ওর জন্যে আমি তেমন কোনাে খবর। আনতে পারিনি, যে খবরে মিতুলের কষ্ট কমবে।

তােমাকে আমি একটা কাজ দিয়েছিলাম জামী, তুমি সেটা করোনি?

কোনটা?

তুমি আমার মাকে খুঁজৰে কথা দিয়েছিলো?

ও একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাে। আমার ঠোঁট কাঁপলাে। হঠাৎ করে কি বলবাে বুঝে উঠতে পারলাম না।

মিতুলের কাছে মিথ্যে বলতে আমার বাধে। তবুও আজ বলতে হলো। আমি তাে খুঁজছি মিতুল।

এখনোে – খোঁজাখুঁজিই সার হবে। জানি, পাবে না। হারিয়ে যাওয়া জিনিস সহজে পাওয়া যায় না।

আমি ঠিকই পাবাে। তুমি আর ক’টা দিন সবুর করাে। কোনাে কিছুতেই সবুর এখন আর সয় না জামী। অসুখের পর থেকে শরীরটা কেমন যেন হয়ে গেছে। মনে হয় ভেতরে ভেতরে ভীষণ একটা রদবদল চলছে। যতসব বাজে ভাবনা।

বাজে নয় জামী। এ রকম একটা ব্যাপার যে, আমি কাউকে বােঝাতে পারবাে না।

ঠিক আছে, তােমার সব ব্যাপার তাে আমারও। আমরা দু’জনেই বুঝবাে। আমি ওকে উৎফুল্প করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। মিতুলের ক্লান্ত মুখটা। আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেলাে। একবার ইচ্ছে করলাে মা – সম্পর্কিত ধারণায় মিতুলের ভুলটা ভেঙে দেই। কিন্তু ওকে আঘাত দিতে সাহস হলাে না। মিতুল আমার কাছ থেকে উঠে চলে গেলাে। হাত দিয়ে এলাে খোঁপা বাঁধলাে। তােমার ঘরে আমি একটা ছবি ছিড়েছিলাম, সেটা দাও জামী?

বের করে দিলাম।

জানাে, বাবা একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাে, আমি তাঁর পুরােনাে ডায়রিটা ধরেছি

কি না?

আমি সােজা বলে দিয়েছি, না।

তারপর?

বাবা আর কিছু বলেননি।

ঐ টুকরােগুলাে কি করবে?

যেখান থেকে পেয়েছি সেখানে রেখে দেবাে।

মিতুল খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাে।

মাঝে মাঝে বড় জানতে ইচ্ছে করে যে, মা সম্পর্কে বাবা কি ভাবে? বাবা বােধহয় মাকে ভীষণ ঘৃণা করে।

মিতুল আরাে জোরে হাসলাে।

আমি বললাম, কিছু কিছু ঘৃণা থাকে, যেটা ভালােবাসার মতাে।

সত্যি?

মিতুল চোখ বড় করলাে।

তাহলে তুমি আমাকে তেমন ঘৃণায় ভরিয়ে দাও জামী।

ও এসে আমার পাশে বসলাে। কাঁধে মুখ ঘষলাে। আমার তখন সাইকির কথা মনে হচ্ছিলাে। মনে হচ্ছিলাে, সাইকি আমার পাশে বসে আছে। আমার শরীর সাইকিতে আত্নস্থ হচ্ছে।

কথা বলছো না কেন জামী?

আঃ মিতুল, তুমি কি এসব ভাবনা ছাড়বে?

আমি ওকে জোর করে চুমু খেলাম। মিতুল এক ঝটকায় আমার হাত ছাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলাে। তখন মিতুলের এলাে খোঁপা খুলে গেছে। একরাশ চুল বিষ দোয়ের মতাে পিঠের ওপর নিথর।

টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। উপন্যাসটা আমার মধ্যে ধোঁয়ার মতাে নীলাভ হয়ে উঠছে। ইউরেকা! ইউরেকা! পেয়ে গেছি! নাম রাখবাে ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ নাম নিয়ে ভীষণ ঝামেলায় পড়তে হয় আমাকে। কিছুতেই মন – মতাে নাম ঠিক করতে পারি না। আশি পৃষ্ঠার মতাে লেখা হয়েছে। মগজ যেমন জলপিঁপির ডাক ছাড়ছে, তাতে এখুনি বসলে কয়েক পৃষ্ঠা একটানা লেখা যাবে। উঠবাে উঠবাে করছি, শরাফী এলাে। দরজা খােলাই ছিলাে।

যেভাবে শুয়ে শুয়ে পা নাচিয়ে চিন্তা করছিস, মনে হলাে ডিস্টার্ব করলাম?

একটুও না। চিন্তাটা একবার মনের মধ্যে ঢুকে গেলেই হলাে। তারপর যত গগুগােলই হােক না কেন, যে – কোনাে মুহূর্তে আমি আবার এই মাথার কাছে ফিরে যেতে পারি। তারপর, তাের খবর কি বল শরাফী?

খবর আবার কি! তাের খোঁজ নিতে এলাম। দিন দিন যে একদম ঘরকুনাে হয়ে যাচ্ছিস?

যাবার জায়গা কোথায় বল? কোথাও গিয়ে তাে খাপ খাওয়াতে পারি না। তার চেয়ে এই জগৎটা অনেক ভালাে শরাফী। নিজের মনে কাজ করে যাওয়া কেবল। হুঁ, বুঝেছি, জমতে জমতে মুক্তোই হয়ে উঠবি তুই। ঠিক আছে, সেই ঝিনুকের প্রত্যাশাতেই থাকবাে আমরা।

ওর কথায় হাে হাে করে হাসলাম। শরাফী মাঝে মাঝে এমনি দু’একটি কথা তুই আজ অফিসে যাসনি শরাফী?

না।

কেন? শরীর খারাপ?

আরে না। সকালে বাথরুমে বসে একটা গল্পের প্লট মনে এলাে। বারােটা পর্যন্ত। একটানা লিখে শেষ করেছি। তারপর খেয়ে – দেয়ে ঘুম। ঘুম এ থেকে উঠে তোর এখানে এলাম।

বেশ করছিস। বোস, চা বানাই।

শরীফা আমার ‘সরােবরে ঘােলা জল’ বইটা টেবিল থেকে নিয়ে চেঁচিয়ে।

উঠলো, কি রে এতক্ষণ যে চেপে ছিলি খবরটা?

চাপিনি দোস্ত, মনে ছিলো না। কালকেই দিয়ে গেছে।

হুঁ, তোর অভ্যাসই এই মুখ খুলতে চাস না।

সবার কাছে মুখ খুলি না ঠিক। তাই বলে তােকে বলবাে না, এটা হয় নাকি? তুই বল শরাফী, লেখার মধ্যে যদি জিনিস থাকে, লােকে খুঁজে নিয়ে পড়বে, আমি কেন জনে – জনে বলতে যাবাে?

হয়েছে, আর সাফাই গাইতে হবে না।

তুই রাগ করিস না দোস্ত। তােকে কি আমি কোনাে কথা না বলে থাকি। একটু আগে মিতুল এসেছিলাে, এ জন্যে বইয়ের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি।

শরাফী হাে হাে করে হেসে উঠলাে। এতক্ষণ ওর মনের গুমােট ভাবটা কাটলাে। আসলে প্রচণ্ড অভিমানী ও। আমি ওকে এক কপি বই দিলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করলাে, আচ্ছা জামেরী, তুই যখন লিখিস, তখন মিতুল তাের মাথা আচ্ছন্ন করে রাখে না?

হ্যাঁ, কখনাে কখনাে রাখে। তখন লেখা বন্ধ করে রাখি। তারপর মিতুল বিদায় নিলে আবার শুরু করি।

কতক্ষণে বিদায় নেয়?

তার কি ঠিক আছে? কখনাে চট করে। কখনাে অনেক পরে। কখনাে হয়তাে

নেয়ই না।

বেশ আছিস।

শরাফী শব্দ করে চায়ে চুমুক দিলাে।

তাের বইয়ের একটা রিভিউ লিখবাে।

সে তাের ইচ্ছে।

আমি সিগারেট জ্বালালাম। শরাফী বলে আমার গল্গ করে কথা বলতে ইচ্ছে করে।

আমরা দু’বন্ধু অনেক গল্প করতে পারি। ক্লান্তিহীন বিরতিহীন সে গল্প। আজো শরাফী সন্ধে পর্যন্ত আমার এখানে কাটালাে। তারপর দু’জন খানিকক্ষণ রাস্তায়। রাস্তায় এলােমেলাে ঘােরাঘুরি করে আমি অফিসে গেলাম। বেশ রাতে ফিরলাম। তখনাে দেখি মিতুলের ঘরে আলাে জ্বলছে। আমি জানালায় টোকা দিলাম। বিছানায় শােয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম এলাে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলাে। তাকিয়ে দেখি, তখনাে ঠিকমতাে ভাের হয়নি। ফিকে আঁধার গুঁড়াে ঝরছে। বিরক্তি লাগলাে। হঠাৎ শব্দে বুকটা ধক ধক করছে। আবার শব্দ। চোখ বুজলাম।

Series Navigation<< উপন্যাস।। সেলিনা হোসেন ।। মগ্ন চৈতন্য শিস ।। পর্ব পনেরোউপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সতেরো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *