ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তৃতীয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চর্তুথ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। সেলিনা হোসেন ।। মগ্ন চৈতন্য শিস ।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।।সেলিনা হোসেন।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আঠারো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব উনিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব একুশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বাইশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তেইশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চব্বিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব পঁচিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব ছাব্বিশ
ওকে আমি কিছুতেই বােঝাতে পারছি না যে, পাপের সংজ্ঞা বদলেছে। খুনীর সংজ্ঞা বদলেছে। আমাদের বিশ্বাসের প্রচলিত ধারণাগুলাে এখন আর কোনাে বস্তুতে নির্দিষ্ট নেই। উঃ জামেরী, ছন্দার ব্যবহারটা এখন ধীরবিষক্রিয়ার মতাে। আমার রক্তস্রোতকে দূষিত করে তুলেছে। আমার ভালােবাসার বিরাট ফানুসটা যখন সমস্ত আবেগ নিয়ে ফেটে পড়তে চায়, তখন ছন্দা তার নির্লিপ্ততার ছুরি দিয়ে। নির্মমভাবে কাটে। সে ক্ষতের রক্তক্ষরণ কোনাে পদার্থ নয় বলেই ও তা দেখে না। জানিস জামেরী, সে মিষ্টভাষী ছন্দা এখন বড় রূঢ় এবং কঠিন স্বরে কথা বলে। ও কেমন করে এমন বদলে গেলাে, আমি তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না। একদিন আমাকে না দেখলে যার চোখ ছলছলিয়ে উঠতাে, সে এখন আমার মুখের দিকে তাকায় না। চোখে চোখ পেতে কথা বলে না। আমার আঙ্গুল কামড়ে দেয় না। ওর অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছেগুলাে আমার ঘাড়ে চাপায় না। বলে না, রায়হান তুমি পারাে রাত – দুপুরে আমাদের ঐ মাধবী ঝাড়ের নিচে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে? শুধু আমার জন্যে।
আমি দারুণ উৎসাহে বলতাম, পারি, খুব পারি ।
প্রমাণ পাও?
দেবাে আজ রাতে।
থাক লাগবে না। আচ্ছা রায়হান, তুমি পারাে সাত দিন একটানা না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে শুধু আমার জন্যে?
জানিস জামেরী, আমি কোনাে উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে বলতাম, নিজের ওপর তােমার খুব মায়া না ছন্দা?
হ্যা। খুব।
তুই দেখ, জামেরী, ছন্দা এখন নিজের ওপর মায়া করছে না। না কি আমারই ভুল বুঝতে পারছি না। নিজের ওপর অসম্ভব মায়া বলে ছন্দা আমার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। মনে হয় ছন্দা এখন ঠিক সেই নির্জন বাংকারটার মতাে। স্বাধীনতার পর কামালপুরের এক অখ্যাত গ্রামে যা আমরা ফেলে এসেছি। যেখানে ফিরে যাবার আমার আর কোনাে পথ নেই। ঐ বাংকারের মতাে ছন্দা বুঝি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনিংয়ের পর সেই বাংকারটাকে কত আপন মনে হতাে। বাংকারের অন্ধকার আর স্যাতসেঁতে মাটি আমাকে ছন্দার স্পর্শের কথা মনে করিয়ে দিতাে। সে দিনগুলাের ছন্দাকে আমি আর কোথাও খুঁজে পাই না। ছন্দা এখন পাথুরে মাটির মতাে শুকনাে খটখটে। উঃ জামেরী, আমার কি খারাপ লাগছে।
রায়হান টেবিলের ওপর মাথাটা রাখে। আমি নিবিষ্ট মনে এতক্ষণ ওর কথা শুনছিলাম। গল্পের মতাে মনে হচ্ছে। তবে আগেই আমি কোনাে পক্ষ নেবাে না। ছন্দাকে আমি দেখিনি। আগে ওকে দেখা দরকার। হঠাৎ মনে হলাে খুনের অজুহাত দিয়ে ছন্দ রায়হানকে এড়াতে চাইছে না তাে?
নাকি রায়হানের আচরণে ছন্দার সরল বিশ্বাস আহত হয়েছে? হঠাৎ ধাক্কায় ও বিরূপ হয়েছে। রায়হানের প্রতি নমনীয় মনােভাব পােষণ করার আর কোনাে যুক্তি পাচ্ছে না? একটা যুক্তিতে ছন্দকে আসতে হবে। রায়হানকে নিয়ে আমার ভয়। ও কোনাে যুক্তি মানে না। অন্ধ আবেগে তাড়িত হয়ে চলে। আমার চিন্তার ফাঁকে রায়হান মাথা তুললাে । দেখলাম, উত্তেজিত দৃষ্টি শিকারী কুকুরের মতাে বাতাসে গন্ধ নিতে চাইছে। আমার খারাপ লাগলাে। রায়হানের জেদের সামনে আপস বলে শব্দ নেই।
জামেরী?
বল।
তুই যাবি না আমার সঙ্গে?
যাবে।
বাঁচা গেলাে। তুই লেখক জামেরী। আমি জানি, তাের একটা ভিন্ন দৃষ্টি আছে। আমার বিশ্বাস সে দৃষ্টিতে তুই অন্তত ছন্দকে বুঝতে পারবি। আমি যেটা পারছি না, তুই হয়তাে সেটা পারবি জামেরী।
রায়হান নিশ্চিন্তে আমার কাঁধে হাত রেখে, আমার ওপর ভরসা করে সমস্যাটা পার হতে চায়। কিন্তু সুন্দর মনের ওপর কি আমার কোনাে জোর চলবে? ভালােবাসা থেকে যে মেয়ে মুখ ফিরিয়েছে, তৃতীয় ব্যক্তির যুক্তি তার কাছে কতটুকু আবেদন নিয়ে পৌছুবে?
ছন্দাকে আমি বারােটায় আসতে বলেছি জামেরী। চল, বেরিয়ে পড়ি।
যেতে যেতে আমার মনে হলাে, রায়হানকে যদি এড়ানোর ইচ্ছে থাকে, তবে প্রশ্ন আসবে না। কিন্তু রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দেখলাম, আমার ধারণা ভুল। ছন্দা আমাদের আগে এসে নির্ধারিত জায়গায় বসে আছে। সাইকির কথা আমি পড়েছি। তার সৌন্দর্যের বর্ণনায় ঈর্ষান্বিত হয়েছি। কেন কিউপিড় হলাম না, একথা সবসময় মনে হতো। এই মুহূর্তে ছন্দকে দেখে সাইকির কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না আমি। মনে হলাে, আমার বহুদিনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। শুধু আমার জন্যে গ্রিক মিথলজি থেকে ও এখানে উঠে এসেছে। আমাদের দেখে ছন্দার কোনাে প্রতিক্রিয়া হলাে বলে মনে হলাে না। ও যেমনি ছিলাে, তেমনি বসে রইলাে। রায়হান জিজ্ঞেস করলো, কখন এসেছো?
পাঁচ- সাত মিনিট আগে।
কি খাবে বলাে?
ফানটা।
আর কিছু?
না।
জামেরী, তাের জন্যে কি বলবাে?
তোর যা ইচ্ছে।
রায়হান বেয়ারাকে ডেকে একগাদা খাবারের অর্ডার দিলাে। আমি পথে ঠিক করেছিলাম যে ওদের ব্যাপারে খুব একটা কথা বলবাে না। চুপচাপ শুনে যাবাে কেবল। ছন্দার দিক না শুনে একতরফাভাবে রায়হানকে সমর্থন করা উচিত হবে না। তবে ছন্দাকে দেখার পর ওর জন্যে আমার ভয় হলাে। বুঝলাম কোনাে কিছুর বিনিময়ে রায়হান ওকে ছাড়বে না। ছাড়বার কথা নয়। রেস্তোরাঁটা নিরিবিলি ছিলাে। যা দু’একজন খদ্দের ছিলাে, তাদের মনােযােগ অন্যদিকে। তারা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছিলাে। পরিবেশ দেখে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। আমরা কেউ খুব একটা কথা বলছিলাম না। রায়হানের দু’একটা কথার উত্তরে ছন্দ খুব সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাে। বুঝলাম বেশি কথা বলার ইচ্ছে ওর নেই। বেয়ারা খাবার দিয়ে গেলাে। আমরা চুপচাপ খেলাম। কেন জানি রায়হান ছন্দার সঙ্গে আমার কোনাে পরিচয় করায়নি। ছন্দার সঙ্গে আমার কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। আমার মনে হয়েছে ওর সৌন্দর্যের অন্তরালে একটা চাপা বিষন্নতা আছে। যেটা প্রকাশ করতে না চাইলেও বেরিয়ে যায়। খাবারের পর রায়হান কোনাে রকম ভূমিকা না করে বললাে, আমি তােমাকে কেন ডেকেছি, তুমি তা জানাে ছন্দা? জানি। আমার কাজের প্রয়ােজনে আমি যা করেছি, তাকে তুমি আমার ভালােবাসার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেখাে না। ছন্দা খুব শান্ত স্বরে বললাে, যে ভালােবাসার সঙ্গে কাজের যােগ নেই, সেই ভালােবাসায় আমার কোনাে আস্থা নেই। আমি কোনাে কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাইনে। ছন্দা মুখটা নিচু করে ছিলাে। ওর চওড়া সিথিতে আমার দৃষ্টি আটকে গেলাে। মনে হলাে আমার বুকের মাঝেও ও রকম একটা সাদা দাগ পড়েছে। মনে হচ্ছে আফ্রোদিতের ঈর্ষার শিকার হয়ে সাইকি এখন হিংস্র ভেড়ার ললাম আনতে নদীর ধারে যাচ্ছে। সেখানে সাইকির জন্যে নল খাগড়া বুদ্ধিদাতা ছিলাে। কিন্তু ছন্দার কেউ নেই। ও বড় একলা। ছন্দার কথার পিঠে রায়হান একটু বিনীত ভঙ্গিতে বললাে, যে হাতে মানুষ খুন করেছি, তাকে আবার ভালােবাসায় রাঙিয়ে তােমার দিকে প্রসারিত করেছি ছন্দ। হায় না। ছন্দা কত ভারি ও তাপহীন। কেন হয় না? রায়হানের অসহিষ্ণু কণ্ঠ। যেসব কথা সবাই ভুলে গেছে, তাকে নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?
সবাই ভুলতে পারে কিন্তু আমি ভুলিনি।
আমার মনে হলাে ছন্দা যেন এক অলৌকিক স্থান থেকে দেবদূতের বাণী মতাে উচ্চারণ করলাে সে কথা। আমি থমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। বুঝলাম, রায়হান ভুল পথে এগুচ্ছে। ওর কোনাে আশা নেই।
ছন্দা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি?
তুমি তা ভাবতে পারাে। আমার মনে হয় না। সবার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি বলতে পারাে যে তুমি একটা খুনী?
শান্ত স্নিগ্ধ ছন্দার দৃষ্টিতে বারুদ ফেটে পড়ে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলাে যে বলি, আঃ সাইকি তুমি একটু চুপ করে থাকো।
ততক্ষণে রায়হান টেবিলে চাপড়ে বলে ওঠে, আমি যা নই, তা চিক্কার করে প্রতিষ্ঠিত করার কোনাে প্রয়ােজন আমার নেই।
জোর করে অস্বীকার করতে চাইলেই কোনে সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। বারবার তুমি একই কথায় ফিরে যাচ্ছাে ছন্দা। অর্থহীন অবাস্তব কথা। শুধু এটুকু জেনে রেখাে, তুমি যদি এমনিতে রাজি না হও তবে বুলেটের বিনিময়ে আমি আমার ভালোবাসা আদায় করে নেবাে।
পারলে তাই নিও।
ছন্দার নির্লিপ্ত কণ্ঠে রায়হান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তুমি বুঝতে পারছে না আমাকে যে, আমি কত রূঢ় এবং নিষ্ঠুর হতে পারি।
জানি। তুমি তা পারাে।
ছন্দা একদম উদাস হয়ে গেছে। ও যেন জোর করে রায়হানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চাইছে। রায়হান তখন থমথমে জেদী জোরালাে কণ্ঠে বললাে, ছন্দা যে লােককে তুমি বিয়ে করবে তাকে আমি খুন করবাে।
ছন্দা অক্ষুট আর্তনাদ করে। রায়হানের চোখে চোখ রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে। তুমি সব পারাে। সব পারাে।
আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছিলাে, যে তুমি কেঁদো না সাইকি। তুমি কেঁদো। আমি তােমার অশ্রু মিশ্রিত শস্যের কণা বেছে দেবাে। আমি ঈগল হয়ে নির্দয় ঝরনা থেকে পানি এনে দেবাে। তবু তুমি কেঁদো না, দোহাই লাগে কেঁদো না।
আস্তে আস্তে সুন্দর ফোঁপানি থেমে যায়। রেস্তোরায় একজনও খদ্দের নেই। রায়হানের পরিচিত জায়গা বলে বেয়ারারা কেউ এদিকে আসে না। নইলে একটা বিশ্রী ব্যাপার হতাে। হঠাৎ করে ছন্দা টেবিলের ওপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়।
রায়হান থমকে আমার মুখের দিকে তাকায়। আমি বিব্রতভাবে হেসে বললাম, সব ব্যাপারে জোর জবরদস্তি চলে না রায়হান ।