ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তৃতীয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চর্তুথ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। সেলিনা হোসেন ।। মগ্ন চৈতন্য শিস ।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।।সেলিনা হোসেন।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব আঠারো
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব উনিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব একুশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব বাইশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব তেইশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব চব্বিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব পঁচিশ
- উপন্যাস।। মগ্ন চৈতন্যে শিস।। সেলিনা হোসেন।। পর্ব ছাব্বিশ
আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না। ও আপন মনেই বলে, বাবাকে আমি বাবার মতাে চাই জামী, মা – র মতাে নয়। এর চাইতে আমার সৎ মা অনেক ভালাে। তাকে নিয়ে আমার কোনাে কষ্ট নেই।আমার জন্যে এটুকুই সান্ত্বনা যে, তিনি। আমার প্রতি কোনাে বিদ্বেষ পােষেণ না। সােজাসুজি ভালােবাসেন, সােজাসুজি রাগ করেন। তাতে কোনাে ঘােরপ্যাচ নেই। সাংঘাতিক রাগারাগি করলেও আমি কিছু মনে করি না। জানি মানুষের মেজাজ সব সময় একতালে চলে না। সেটা লুকোচুরি খেলে। চুপিচুপি ঘরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলবে, তাের কি খুব খারাপ লাগছে মিতু? আমি উত্তর দেই না। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে থাকি। বাবা কিছুতেই বুঝতে চায় না যে, তার এ ধরনের আচরণ আমার পছন্দ নয়। আমি সইতে পারি না। বরং মা – র রাগারাগি সইবার ক্ষমতা আমার অনেক বেশি।
আমার তখন বাবাকে দু’টুকরাে করে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমি চাই বাবা কষ্ট পাক। আরাে কষ্ট পাক। কষ্ট পেতে পেতে মরে যাক। আমি ওকে কাছে টেনে বলি, মিতুল এসব কথা থাক। দেখবে না আমি আজ কি লিখেছি। এই দেখাে, নতুন উপন্যাস শুরু করেছি।
মিতুলের সেদিকে কোনাে খেয়ালই থাকে না। আস্তে আস্তে বলে, তুমি বলতে পারাে জামী, আমার মা কেন বাবাকে ছেড়ে চলে গেলাে? আঃ মিতুল এসব কথা থাক।
মিতুল আমার দিকে একদম তাকায় না। আমি বুঝতে পারি ও এখন আমার বুকের ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। ও শিকারী কুকুরের মতাে দৌড়চ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও আমি এখন ওর নাগাল পাবাে না।
আমি জানি, মা কেন চলে গেছে। আমি ভেবে ভেবে খুঁজে বের করেছি। বাবার এই মেয়েলিপনার জন্যেই মা বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে। বলাে আমি ঠিক বলেছি। কিনা জামী?
ওর এসব কথা শুনলে আমার শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়। ভয় পাই। বুকটা খালি হয়ে যায়। মনে হয় মিতুল আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। আমি একদিন আমার মাকে খুঁজে বের করবাে। জিজ্ঞেস করবাে কেন বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে?
ঠিক আছে আমরা দু’জনে তােমার মাকে খুঁজবাে মিতুল।
সত্যি খুঁজবে?
হ্যাঁ, সত্যি।
তুমি আমাকে বাঁচালে জামী।
মিতুল আবার আমার মধ্যে ফিরে আসে। এই ফিরে আসাতে ওর কোনাে সময় লাগে না। তখন ওর বিশ্বাস ও আমার মধ্যে চারিয়ে দেয়।
আজ কি লিখেছে দেখি?
মিতুল আমার হাত থেকে কাগজপত্র টেনে নেয়। মিতুল যখন আমার ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় তখন আমার জীষণ কষ্ট হয়। আমার ভেতর ওর আজ ধ্যানমগ্ন মূর্তিটি সামনে রেখে স্বস্তিতে দিন কাটাতে পারি। নইলে জ্বালা বাড়ে; তবুও অস্থির খেয়ালি মিতুলকেই আমি পাগলের মতাে ভালােবাসি। আমার মাঝ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ও যখন কষ্ট পেয়ে আবার ফিরে আসে তখনকার সেই শ্যামল স্নিগ্ধ সৌন্দর্য আমাকে অভিভূত করে। আস্তে আস্তে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। মিতুল শান্ত হয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকে। আমি জানালার কাছে এসে দাঁড়াই। তখন কোনাে কিছুই আমার ইন্দ্রিয়ের কাছে গ্রাহ্য হয়। ধীরে ধীরে মাথার ভেতরে উপন্যাসের ছক শঙ্খ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা ভেনাসের মূর্তির মতাে অবয়ব পেতে চায়। আমি টেবিলে গিয়ে বসি। নগ্ন ভেনাসের সৌন্দর্য আমার মস্তিষ্ক আলােকিত করে রাখে। কিন্তু আমি এগুতে পারি না। কাগজের বুকে আঁকিবুকি কাটি। দু’লাইন লিখি। আবার ছিঁড়ে ফেলি। আবার লিখি। আবার ছিঁড়ি। না হচ্ছে না। আমি পারছি না। অথচ নগ্ন ভেনাস তবুও আমার স্নায়ুতে। আলাে তার এতটুকু ম্লান হয়নি। আমি উঠে পানি খাই। গ্লাসে ডালারও ইচ্ছে হয় না। জগের মুখে মুখ রেখে ঢক ঢক করে গিলি। মনে হয় আকণ্ঠ পিপাসা। কিন্তু কিছুতেই তার নিবৃতি হয় না। সারা ঘরে পায়চারি করি। টেবিলে ধারে এসে দাড়াই। চেষ্টা করেও মনের মতাে লিখতে পারি না। মাথার মধ্যে পুরাে জিনিসটা পরিস্কার। অথচ আরম্ভ করতে পারছি না। কি যে যন্ত্রণা। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়। বাথরুম থেকে জগ ভর্তি পানি আনি। আবার খাই। ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে রাস্তায়। আমি তখন ঘুমন্ত মিতুলের পাশে এসে বসি। চুমােয় চুমােয় ভরিয়ে দেই ওকে। মিতুল অবাক হয়েও হয় না। মমতাময়ী মায়ের মতাে আমার মাথাটা বুকের ওপর ধরে রাখে আস্তে আস্তে বলে, তোমার কী হয়েছে জামী।
জানি না। জানি না।
আমি নিশ্চুপ মিতুলের হৃদপিন্ডের ধুকধুক্ শব্দ শুনি। শব্দে আমি উজ্জীবিত হই। আমার ভেতর সেই শক্তি কাজ করে যে আমি প্রােটোপ্লাজমের প্রথম বিন্দু। আমার থেকেই জীবনের শুরু। আমি আবার লেখার টেবিলে ফিরে আসি। আমার লেখনীতে হাজার ঘােড়র গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। মিতুল তখন একান্তই আমার হয়ে শুয়ে শুয়ে পত্রিকার পাতা ওল্টায়।
মিতুল আমাকে সবচেয়ে বেশি বােঝে। আমার যে – কোনাে উত্তেজনার মূহুর্ত ও নিজের করে নিতে পারে। প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও যখন বই ছাপাখার ব্যবস্থা করতে পারি না তখন মিতুলের মুখটা আমার সাধনার কারণ। সংবাদপত্রের কাজ সেরে যখন অনেক রাতে বাড়ি ফিরে আসি তখন মিতুলের ঘরের আলাে আমার ভালাে লাগে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় জানালায় টোকা দিলে ও আলাে নেভায়। ও আমার জন্যে জেগে বসে থাকে। একদিন রাতে বাড়ি ফিরতে পারিনি। রায়হানের সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম ওর মেসে। তারপর সাতদিন মিতুল আমার সঙ্গে কথা বলেনি। পরে অবশ্র অনেক সাধ্যি সাধনায় ব্যাপারটা মিটমাট করেছি। আমি জানি। মিতুলের ভেতর ভালাে মানুষিসুলভ একটা চমৎকার গুণ আছে।
মিতুলকে আমি এখনাে আমার স্বপ্নের কথা বলিনি। যে কষ্টটা আমি একা পাচ্ছি, তার ভাগ আমি আর ওকে দিতে চাই না। স্বপ্নের কথা শুনলে ও হাজার রকম চিন্তা করবে। অজস্র ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণে সারাক্ষণ আমাকে মাতিয়ে রাখবে। তার চেয়ে স্বপ্নটা আমার বুকের ভেতরই থাক। ওটাকে আমি অস্বীকার করবাে। ওটা আমার চেতনায় কোনাে ছায়া ফেলবে না। বাজে একটা ব্যাপার নিয়ে ভেবে ভেবে শক্তি নষ্ট করার মতাে দুর্বল স্নায়ু আমার নয়। আমার একটা নিজস্ব জগৎ আছে। সে জগতের স্রষ্টা আমি। সেখানে আমি অনবরত ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে থাকি। এমন ভুবন ফেলে আমি আর কোথায় গিয়ে ঠাঁই নেবাে? আর কোনাে ঠাঁইয়ে আমার প্রয়ােজন নেই। রায়হান বলে, আমার লেখা নাকি কেউ পড়ে না। আমি জানি, সাহিত্যে ওর কোনাে আগ্রহ নেই। ও কোনাে খোঁজ খবর রাখে না। আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এমন কথা বলে। তবুও মাঝে মাঝে ভাবি, সত্যি কি তেমন কিছু করতে পারিনি। আবার ঝেড়ে ফেলি সব ভাবনা। বিশ্বাস করি সাধনায় নিষ্ঠাবান এবং সৎ থাকলে কেউ আমার পথ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। শিল্পের জগৎ বড় নির্মম। শিল্পীর কাছে থেকে শিল্প সুদে – আসলে মাশুল উঠিয়ে নেয়।
শিল্প হলাে সেই ক্রিট দ্বীপের ক্রুর হৃদয়হীন নিষ্ঠুর বাদশাহ মিনােস। শিল্পীকে সে গােলকধাঁধার ভেতর মিনােটওরের সামনে ঠেলে দেয়। শিংওয়ালা ঘাড়ের মাথা আর মানুষের শরীর নিয়ে সে জন্তু খাবার জন্যে হাঁ করে থাকে। সে এক বিচিত্র জগৎ সে ধাঁধায় ঢুকলে পথ খুঁজে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। শক্তিমানরা পারে মিনােটওরকে হত্যা করতে। আরিআদনির মতাে অনির্বাণ প্রজ্ঞা রেশমি সুতাে হয়ে পথ দেখায় কিন্তু দুর্বলেরা মরে। ব্যর্থতার জ্বালা নিয়ে পথ হাতড়ায়। কোনােদিন সে পথ খুঁজে পায় না। তারপর মিনােটওরের খােরাক হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শিল্পের যে গােলকধাঁধায় আমি নেমেছি, তা আমি অতিক্রম করবােই। অফুরান শক্তির খনি আমার পায়ের নিচে জমে আছে। মিনােটরকে হত্যা করবাে। হৃদয়ের আলাে আরিআদনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রেশমি সুতাে ধরে। আমি বেরিয়ে আসবােই। আমার একটা নির্দিষ্ট আয় আছে। বাড়ি ভাড়া পাই। আমার বাবা অনেক কষ্টে এ বাড়িটা বানিয়েছিলেন। বাস করতে পারেননি। তার আগেই মারা গেলেন। আমার মা বাবার মৃত্যুর পর সাত বছর শােক করেছেন। মা -র শব্দহীন বৈধব্যে আমি প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করেছি দুর্লভ সঙ্গী ছাড়া বেঁচে থাকাটা কঠিন। অন্য অর্থে নির্মম।