উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। দুই

আসিফ আর কথা বাড়াতে চায় না। এরপর কিছু বলা মানে সীমা লঙ্ঘন করা। সীমা লঙ্ঘন করা ঠিক না। এক শুক্রবার বিকেলে ভাবি রোজীকে বাসায় নিমন্ত্রণ দেয়। ড্রয়িংরুমে আসিফকে রোজীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আজকে তাদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। ভাবি বলল, সেদিন তো ভালোভাবে কথা হয়নি। আজকে ভালোভাবে কথাবার্তা বলো।

রোজী ভাবির দিকে তাকায়।

ওদের পরিচয় থাকলেও আজকের দিনটা প্রেম-পাতানো-দিন বলা যায়। রোজী একটা দুষ্ট হাসি যুগল ঠোঁটের মাঝখানে ছড়িয়ে দিয়ে মনে মনে বলল, তোমার কথার অর্থ বুঝিনি সুন্দরী ভাবি। ভাবির চোখ দুটি মেলে দিল, হাসল, যেন বুঝিয়ে দিল−মনের কথা বলো। রোজীর গালে আলতো মেয়েলি চিমটি কেটে ভাবি আবার বলল, তোমরা গল্প করো আমি চা নিয়ে আসছি।

রুমটি যেন জমাট নৈঃশব্দ্যে একাকার হয়ে গেছে। বাইরে কোমল রোদ। জানালা দিয়ে বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাসের আনাগোনা। উপজেলা ক্যাম্পাসের পশ্চিম পাশের এই বাসার প্রাঙ্গণ জনশূন্য। আসিফের বন্ধুও বাসায় নেই। আড়িখলা গ্রামে একটা ঘোড়া নাকি কয়েক দিন যাবৎ কিছু খায় না, সেটির চিকিৎসা করতে গিয়েছে। জীবনের বাসার সঙ্গে মিশে আছে ভোগেনভিলা গাছের কয়েকটি ডাল। দেয়াললাগোয়া লাল ফুলগুলো মোরগের ঝুটির মতো পাপড়ি মেলেছে। দুষ্ট বাতাস মাঝে মাঝে পাপড়িগুচ্ছকে নাড়িয়ে দিয়ে যেন পালায়। কোনো গন্ধ নেই। আরও একটু উত্তর পাশে হাসনাহেনার একটি গাছ। গাছটিতে এখনো ফুল ফোটেনি। আসিফই গাছটি লাগিয়েছে কয়েক দিন আগে। ফুল গাছের প্রতি ওর বিশেষ টান। বাড়িতে ফুল গাছ না থাকলে বাড়িকে পাথরের গুহা মনে হয়।

কিছুটা সময় কেটে যায় নীরবতায়। তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। বার কয়েক দুজনের মুখোমুখি চোখাচোখি হলো। দুজনের দেহ মনে বৈদ্যুতিক শিহরন। দুর্নিবার আকর্ষণ যেন একজনকে আর একজন টেনে নিচ্ছে ঘনিষ্ঠতার বন্ধনে। কারও মুখে কোনো রা নেই, শব্দ নেই, রাত্রির ঘন স্তব্ধতায় পাতা ঝরার শব্দটুকুও হারিয়ে গেছে যেন। কে আগে কথা বলবে, কোন কথা দিয়ে শুরু করবে−দুজনের কেউ-ই বুঝতে পারছে না। কথা না বলাও ভালো। আসিফ ভাবছে যে কথা বলা হবে তার মানে হয়তো হবে একটাই। কিন্তু নীরবতার সুতো দিয়ে কত কথার জাল বুনন হচ্ছে তার কি শেষ আছে? শব্দহীন মুখ যেন হাজারো কথার কথিকা। হয়তো তাই ভালো−তাহলে কথা না বলাই ভালো যে-কথার গভীরতা অন্তহীন।

রোজী নিজের মধ্যে এক প্রকার আকর্ষণ অনুভব করলে ও আবার সমান তালে লজ্জাও অনুভব করছে। এভাবে একটি পুরুষের সামনে বসে থাকা যায়? শত হলেও তো সে কাদার মূর্তি নয়। বুকের ভেতরে অসংখ্য প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। মনের ভেতরে চাপা থাকা হাসিটি বের হয়ে আসতে চায়; কিন্তু কীসের সংকোচের জন্য বের হতেও পারছে না। মাঝে মাঝে ভাবছে এখনই জোরে হেসে ফেলবে। দুজন মানুষ এত কাছাকাছি বসে আছি, মনের গভীরে তোলপাড় শুরু হয়েছে অথচ কিছুই বলতে পারছি না। সময়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে। রোজীই শুরু করল এভাবে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যে যেমন ভালো লাগা আছে তেমনি যন্ত্রণা এবং অপমানও আছে−কথা বলুন।

আসিফ খরগোশের মত কান দুটি আরও সর্তক করে। রোজী তোমার কথা যেন সেতারের সুর, মনে মনে বলল। এক সময় সে রোজীর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। কি জানি বলতে গিয়েও থেমে যায়। কিছুক্ষণ পরে আসিফ বলল, মানুষ শোকে এবং সুখে পাথর হয়ে যায় মাঝে মাঝে। আমি অনেকটা পাথর হয়ে গেছি।

শোকে না সুখে?

সুখে।

এত সুখ আবার কীসে?

আসিফ ভেবেছিল রোজীর কোনো প্রতিক্রিয়া থাকবে না। এই যে তোমাকে… মানে এত কাছাকাছি …

আমি কি সুখের আড়ত? রোজী চুড়ির শব্দের মতো হাসে। রিনিঝিনি সুর।

                হ্যাঁ। অনেকটা তাই।

                ভাবাবেগ থাকা ভালো কিন্তু এত বেশি থাকা ভালো না।

                আসিফ অবাক হয়ে রোজীর কথা শুনে। খুব গুছিয়ে কথা বলে তো! আসিফ রোজীর দিকে গভীর চোখে তাকায়। রোজীও তাকায় তার দিকে। এভাবে তাকাতে পারলে মনে হয় একজন অন্যজনের। এভাবেই মনের অজান্তে আসিফের একটা হাত চলে আসতে পারে রোজীর হাতের কাছে। তবে তা আসেনি। আসিফ নিজেকে সংযত করে। রোজীর সঙ্গে বেয়াদবি করা যাবে না।

                ভাবি এতক্ষণ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুজনের জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারছে না দেখে ভাবি আসিফের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে। আসিফ রোজীর দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে তার অন্যদিকে তাকানোর অবকাশ নেই। দরজার আড়ালে ভাবি দাঁত কটমট করছে।

আসিফ বলল, না বলেও তো কোনো কোনো কথা বলা হয়ে যায়, তাই না?

হ্যাঁ।

আমার যে কী বলার তা তো তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?

না, বুঝিনি।

                রোজী দুষ্টুমির হাসি ছড়িয়ে দিল আবার। আসিফ বুঝতে পেরেছে রোজীর হাসিতে মনের কথার সোনালি ধান মনের উঠোনে ছড়িয়ে দিয়েছে।

আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চাও না?

চাই। তবে…

তবে কী?

এই তো আস্তে আস্তে জানা হবে। আজই তো আমাদের সব শেষ হয়ে যাচ্ছে না বা এমন তো নয় যে আর দেখা হবে না।

এভাবে তো আর দেখা নাও হতে পারে। তুমি যদি আর না আসো।

                আমাকে আসতে হবে না। তবু দেখা হবে। আপনি তো পুকুরে প্রতিদিনই যান। আপনি পুকুরে কেন গোসল করতে যান আমি জানি।

                কেন? কী জানো?

                আমি আপনার চোখের ভাষা পড়তে পারি।

                তাহলে কথা বলার প্রয়োজন কী? আমি তোমার সামনে বসে থাকি, তুমি আমাকে পাঠ করো।

                ভূমিকাটা পাঠ করা হয়েছে। আর পাঠ করতে চাই না। এখন শুনতে চাই।

কিন্তু …

কিন্তু আবার কী? আমার চোখে কি আপনি কিছু দেখেননি?

                দেখি। আমি দেখি তুমি আকাশের উড়ন্ত পাখি। ধরা না দেওয়ার মতো চঞ্চল প্রজাপতি।

কাব্য রাখেন। আমি এসব কাব্য বুঝি না। গদ্যে বলুন। রোজী হাসে। 

সহজ হও। আমাকে আরও কাছে টানো। একেবারে সরলরেখার মতো।

সময় হলে তো। আমি জ্যামিতি বুঝি না। আপনি সরল রেখা, ত্রিভুজ, চতুষ্কোণ, ইট-পাথর আর লোহা লক্করের ভাষা যোভাবে বুঝেন আমি তা বুঝি না।

তুমি কী ভাষা বোঝো তাহলে?  

জীবনের কথা। নদী ও জলের কথা। আকাশের কথা। পাখি ও ফুলের কথা। অরণ্য ও অন্ধকারের কথা।

তুমি জানো না এক ঘুমিয়ে থাকা গভীর অরণ্যে তুমি তুমুল ঝড় উঠিয়েছো। আরও কথা বলো। এমন কাব্যময় কথা শোনার ভাগ্য কয়জন মানুষের আছে।

বলব, সময় হলে। 

কখন সময় হবে?

                রোজী মুখ লুকোয় ওড়নার ফাঁকে। সে জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে ধীরস্থির চোখে। দূরে, অনেক দূরে তাকিয়ে থেকে একবার আস্তে আস্তে বলল, আসলে কীভাবে আমাদের কথা শুরু হবে কিংবা কীভাবে শেষ হবে তা কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আসিফ কান পেতে শোনে। সে রোজীর দিকে তাকিয়ে বলল, দূর থেকে যখন তোমাকে দেখি মনে হয় একবার সামনে পেলে অনেক কথা বলব। কিন্তু এখন কোনো কথা বলতে পারছি না। তবে আজ একটি কথা তোমাকে সাহস করে জিগ্যেস করতে চাই। আমাকে তোমার পছন্দ হয়?

                এই কথা তো এমনিতেই বোঝা যায়। আপনি যখন আমার দিকে তাকান তখনই আমি বুঝি। তা জিগ্যেস করতে হয় কেন? অন্য কথা বলুন। স্বপ্নময় কথা।

                স্বপ্নময় কথা তো স্বপ্নেই হারিয়ে যায়। সে কথা কেন বলব?

                স্বপ্নময় কথা দিয়েই শুরু করতে হয়। তারপর…

                আমি তো তোমাকে বুঝি।

                মিথ্যে কথা। রোজী হাসে। আমাকে আপনি বুঝবেন কীভাবে? কদিনই দেখা হল। আমি তো আপনাকে কোনো কিছু বলিনি। না কি বলেছি?

                তুমি না বললেও কিন্তু আমি বুঝি।

                কচু বোঝেন।

                আচ্ছা যাকগে ওসব। আমি একটি কথা সরাসরি বলতে চাই। আমি একবার গিয়ে মাকে নিয়ে আসব। আমাদের বিয়ের ব্যাপারে মা-ই কথা বলবেন যদি তোমার আপত্তি না থাকে। বলো তোমার কোনো আপত্তি আছে কি না?

                রোজী কথা বলেনি। সে জানালা দিয়ে দূরে তাকায়। মনের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। আসিফকে একবার লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করে। আসিফ এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যে তার লুকিয়ে দেখার সাধটুকু আর পূরণ হয়নি। কিছুক্ষণ পর আসিফের চোখে চোখ পড়ল। দুজনেই চোখে চোখে স্থির হয়ে গেল। দুজনেই ঠোঁট লুকিয়ে চাপা হাসি হাসল। 

                আসিফ বলল, তোমার সম্মতি কিংবা অসম্মতি কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কটা কিছু বলো রোজী। আমি কি মাকে নিয়ে আসবো?

                রোজী আবার আসিফের দিকে তাকায়। আস্তে আস্তে বলল, সম্মতি কি অসম্মতি তা কি বুঝতে পারেন না?

                না, পারি না।

                না পারলে আমি কিছু বলতে পারব না। একটু আগে না বললেন, আমাকে বুঝতে পারেন। আপনি এমন স্ববিরোধী কেন?

                ঠিক আছে, আমি বুঝে গেছি।

                শুধু বুঝে গেলেই হবে না। আমিই তো সব নই। আমার অনেকেই আছে। তাদের মতামতেরও প্রয়োজন আছে। 

                ভাবি টেবিলে ট্রে রাখতে রাখতে বলল, দীর্ঘ বিরহে প্রেম ধ্বংস হয়। রোজী ভাবির দিকে তাকিয়ে বলল, প্রেম হল কিনা ভেবে দেখতে হবে আগে। তারপর তো বিরহের কথা আসবে।

                আসিফ হাসল। হাসলে আসিফকে বড্ড সুন্দর দেখায়। খুব সুন্দর।  

                ভাবি বলল, বেশি ভাবতে গেলে প্রেম হয় না। এটা ঘটাঘট করে ফেলতে হয়। ঘটাঘট না করে ঘটা করতে গেলে কখনও প্রেম হয় না। শুধু মাকড়সার জালে আটকে যেতে হয়। ভালো লাগলে আর কোনো কথা নয়-প্রেমে ডুবে যাওয়া। ভালো না লাগে স্লালামুলাইকুম। 

                ওরা হাসে।

                রোজী বলল, ভেবে চিন্তে প্রেম করলে সেটা টিকে। প্রেমের ব্যাপারে ডেসপারেট হওয়াটা ঠিক না। সেসব প্রেম ভেঙে যায়। ফুসফুসের থলিতে জমা থাকে দীর্ঘশ্বাসের সঞ্চিত বাতাস। 

                ভাবি বলল, তত্ত¡ কথা। প্রেমের ক্ষেত্রে এত তত্ত¡ খাটে না। 

                ভাবির যেন একটু দেরিও সয় না। মালা দুটি নিয়ে আসব কিনা সেটাই বলো? তারপর রাতে বাসর সাজাব, আমিই। রোজী কিছু বলো? আমার দেবর তো দুপায়েই দাঁড়া।

                রোজী বলল, তাই তো দেখছি। দুপায়েই দাঁড়িয়ে আছে। এক পায়ে দাঁড়া থাকলে একটা কথা ছিল।

                ওরা হাসে।

                ভাবি উঠে গিয়ে বাগান থেকে কয়েকটি ফুল তুলে নিয়ে এল। চায়ের ট্রের পাশে রেখেই আবার চলে গেল। যেন অদৃশ্য স্পর্শে হাতে হাত রেখে যাওয়ার ব্যস্ততা। আসিফ সুযোগটি হাতছাড়া করেনি। একটা ফুল নিয়ে রোজীর হাতে তুলে দিল। রোজীর টোল পড়া গাল লাল হয়ে ওঠল। আসিফের ইচ্ছে হচ্ছিল চুলের বেণীতে গুঁজে দেয় একটা ফুল। কিন্তু পারেনি। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে আবার অংকুরেই বিনষ্ট হতে পারে ভবিষ্যতের প্রেমের চারাগাছটি। প্রচন্ড অস্থিরতাকে ধৈর্যের পাথরে চাপা দিয়ে রাখে আসিফ।

                আসিফ যে কাজটি করতে পারেনি ভাবি সেটা করে দিল। সন্ধ্যার সময় রোজী যখন ভাবির বাসা ছেড়ে যায় তখন তার চুলের বেণীর গোড়ায় শোভা পাচ্ছিল দুতিনটি লাল টকটকে গোলাপ আর আসিফ দরজায় দাঁড়িয়ে যেন রোজী আর বেণীর ফুলগুলোর সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল।

                একবার দেখার তৃষ্ণায় এবং দৃষ্টি বিনিময় করে চোখের ভাষায় কথা বলার উদ্দেশ্যে রাতেও রোজীদের বাসার সামনে দিয়ে পায়চারী করে আসিফ। সে অন্ধকারে কিংবা জ্যোৎস্নায় ছায়াপথের কোনো নক্ষত্রের মতো রাতের পথ বেয়ে চলে। পথে যদি কেউ সারাদিন হাঁটে তাকে কি অভিযুক্ত করা যাবে? আসিফ পথে হাঁটে−যে পথে সে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে। রোজী তো সে পথের পাশের বাড়িতেই। আড়চোখে তাকালে রোজীকে চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে পায়চারি করার সময় সে রোজীকে খুঁজে বেড়ায়। কখনো কখনো রোজীর ছায়া দেখা যায়। সে হেঁটে বেড়ায় মধ্যরাত অব্দি। রোজীও মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে ওকে অভিবাদন জানায়। যদিও হেয়াঁলি তাদের দুজনের মধ্যে তবু অজানা দুনির্বার আকর্ষণে সে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। একজন একটি বাসার বারান্দার খোঁপা খোলা রানী আর অন্যজন রাস্তার রাজা। চুরির রিনিঝিনি শব্দ হয়। এই শব্দ বুকের ভেতরে প্রেম-বিরহের সুর। ভাবজগৎ কখনো হয়ে ওঠে সুফলা আবার কখনো হয় নিষ্ফলা। ভালোবাসার আগে এই সব আনুষঙ্গিক শব্দও যেন প্রাণে উজ্জীবনের সুর তুলে। মানবজীবন বড়ই রহস্যময়। 

                রাতে আসিফ মায়ের কাছে চিঠি লিখে। চিঠিতে সে বোঝাতে চেয়েছে কনস্ট্রাকশনের কাজে সময়ের কোনো মা-বাপ নেই। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে ছুটি পাবে কিনা জানে না। এখানে রোজী নামে একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। রোজীকে ওর খুব ভালো লেগেছে। তুমি যদি পারো তবে চলে আসো, মেয়েটিকে দেখে যেতে পারবে। খুব ভালো মেয়ে। এখানে আসা খুব সোজা। চিটাগাং-এর যে কোনো বাসে উঠলেই চলবে।

                চিঠিটি লিখে সে বালিশের নিচে রেখে দেয়। মনে মনে ভাবে কাল পোস্ট করবে। তিন-চার দিন লেগে যাবে চিঠিটি পৌঁছাতে।

                বর্ষার পানির মতো আসিফের মন যেমন টলমলে ঠিক তেমনই রোজীর মনও। একটু সুযোগ পেলেই ভাবির বাসায় এসে যায়। কোনো কোনো সন্ধ্যায় বোন-দুলা ভাইকে ফাঁকি দিয়ে (এমনও হতে পারে যে, বোন-দুলাভাই বিষয়টি জেনেও এড়িয়ে যায়।) আসিফের সঙ্গে দেখা করে। পুকুরপার থেকে দূরে ফাঁকা জায়গায় সড়কের পাশে সাধারণ পথচারির মতো হাঁটতে যায়। তখন ওরা জীবনের কথা বলে।

                 সেদিন সন্ধ্যায় পথে বের হয়ে ওরা হাঁটছিল আর কথা বলছিল। আসিফ বলল, তোমাকে নিয়ে একদিন সীতাকুন্ড যাব। সেখানে দুজন মিলে পাহাড়ে উঠব।

                আমি পাহাড়ে উঠব না। আমার ভয় হয়।

                জীবনকে উপভোগ করতে হলে ভয় পেলে চলে না। চ্যালেঞ্জ ছাড়া জীবনকে উপভোগ করা যায় না।

                আমি কোনো চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে চাই না। যা শান্ত তাই আমার ভালো লাগে।  যদি পড়ে যাই!

                ভয় কীসের? আমি তো পাশেই থাকব। তোমাকে পড়তে দেব কেন?

                তাহলে ভালোই হয়, দুজনের জীবনের খেলা সাঙ্গ হবে। অন্য কোথাও চলো না। পাহাড়ে কেন?

                বুঝতে পারো না? ওখানে নিরিবিলি জায়গা আছে। কথা বলা যাবে।

                আচ্ছা দেখা যাক।

                সকালের হিমেল বাতাসে হালকা কুয়াশার আবেশ ও স্নিগ্ধতা শরীর মন জুড়িয়ে এক স্বপ্নাতুর আবেশের সৃষ্টি করেছে। স্নান করতে গিয়ে আসিফ পুকুরের পাকা ঘাটে বসে চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পুকুরে আসার সময় রোজীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, চোখের ভাষায় কথা হয়েছে। একটা ঘোরের মধ্যে বসে থাকে অনেক্ষণ। ভাবতে ভালো লাগে রোজীকে। ভাবতে ভালো লাগে প্রেমের সূক্ষ সূক্ষ অনুভূতিগুলোকে। প্রেম মানুষকে কাছে টানে, প্রেম মানুষকে নির্বোধ করে, করে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। প্রেম মানুষকে যেমন প্রাণ দিতে পারে আবার ঠিক তেমনি প্রাণ কেড়েও নিতে পারে। শরীরবৃত্তীয় প্রেম মানুষকে টেনে নেয় মনোবৃত্তীয় প্রেমের দিকে। শরীর ও মনের রসায়নেরই খাঁটি। লালন ঠিক কথাই বলেছেন, ‘কী বলিব প্রেমের কথা, কাম হলো প্রেমের লতা।’ দুটির একটি বাদ দিলে সে প্রেম একদিন ঘুণে ধরে, জর্জরিত হয়−বিনাশ হয়। বিসর্জন ছাড়া প্রেমের অমিয় প্রশান্তি ও নিখাঁদ নির্যাস উপভোগ করা অসম্ভব। নর-নারীর প্রেম কী? দুজনে মিলে জীবনের একটি নদী পাড়ি দেওয়া। যদি শরীর বাদ দেওয়া হয় তাহলে জীবন-নদী পাড়ি দিতে হবে একাকী। তাহলে এ প্রেম কী খন্ডিত নয়? হঠাৎ আসিফের মনে হয় অফিসের সময় হয়ে গেছে, দ্রুত পুকুরে নেমেই দুটি ডুব দিয়ে উঠে আসে। 

                রোজীকে ভালো লাগার অনুসর্গ-উপসর্গ অনেক। উপমা-উৎপ্রেক্ষায় তাকে অনেকভাবেই কাব্যময় করে তোলা যায়। আসিফই বা কম কীসে? তাই রোজীর বোনের কানে কথাটি গেলেও সেও অপেক্ষা করছে, দেখা যাক কত দূর গড়ায় এই প্রকৌশলীর প্রেমের স্রোত। যখন রোজী বারান্দায় আসে তখন তার বোন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষা করে, বুঝতে চেষ্টা করে আসিফের গতিবিধি।

                ভাবি পারে তো ‘ধর তক্তা মার পেরেক’−এমনই অস্থির।

                শুক্রবারে সকাল সকালই তৈরি হয়ে গেছে। পাহাড়ি নদী বেয়ে আজ সারা দিনের সফর। জীবন, ভাবি, রোজী আর আসিফ। অনেক দূরে যাবে। নৌকা ভ্রমণ। দুপুরের খাবারের জন্য নিয়েছে ভুনাখিচুরি, মুরগির ঝাল রেজেলা, কমলা ইত্যাদি।

                নৌকা এগিয়ে চলল। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে স্রোতহীন সরু নদীর টলটলে জলে ধীরে বয়ে চলেছে নৌকা, দুপাশ পাহাড়, হিমেলে আবেশ, সকালের সতেজ বাতাসে ভেসে যেতে মন ভরে যায়। আকাশের নীল ছায়া পড়ে জলে, পাহাড়ের সবুজ গাছ-গাছালি, পুঞ্জ পুঞ্জ বীথিকা, পাহারি বুনো ফুলের ঝুমকা, পাখির কিচির-মিচির শব্দ সব মিলিয়ে মনে হলো এক অভাবনীয় সুখের রাজ্যে প্রবেশ করেছে ওরা। তন্ময় হয়ে ভাবতে ভালো লাগে। চোখ জুড়িয়ে আসে নিসর্গের এই অপরূপ রূপ দেখে। মহুয়ার মাতাল সুবাস মন উথাল-পাতাল করে তোলে। এক সময় দূরে এক পাহারের আড়ালে তারা নেমে পড়ে। ওরা চারজনেই জানে আজকের এই ভ্রমণের মর্মকথা। তাই কোনো গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই তারা দুইভাগে ভাগ হয়ে একটু দূরে সটকে পরে।

                আসিফ আর রোজী একটা ছাতিম গাছের নিচে গিয়ে বসে।

                আসিফ রোজীর চুলে গুঁজে দেয় ছাতিমের ফুল। পাহাড়ি এক অপ্সরার মত লাগছে রোজীকে। আসিফ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে রোজীর দিকে। অনেকক্ষণ। হঠাৎ রোজী দেখে আসিফ তাকিয়ে আছে। রোজী লজ্জা পেয়ে স্মিত হাসি ছড়িয়ে বলল, এভাবে তাকিয়ে থাকতে আছে বুঝি? নজর লাগবে যে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব একউপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তিন >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *