উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ৮ম পর্ব

দুটিও কম বেহায়া নয়। নাদিম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তার ত্রপিত আঁখিতে যেন হাজারো দুষ্ট প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়।

আসিফের ডাকে নাদিম তার অস্তিত্বে ফিরে আসে। নিশার মুখমণ্ডলে ছায়া। নাদিম মাঝে মাঝে নিশার চোখের দিকে তাকায়। দুজনের চোখের মধ্যেই আজ অন্য কিছু পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা, উত্তাপ-স্পর্শের ব্যাকুলতার নীরব দংশন।

নাদিমের ফাইনাল পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতি খুব ভালো করে নিতে পারেনি। এখন কিছু দিন ধরে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে। নাদিমের মায়ের ইচ্ছে পরীক্ষার পরই দীপালীর সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন। নাদিমকে ধরিয়ে দিতে চান একটা অপরূপ সুন্দরী দীপালীকে। তার মায়ের মনেও সংশয়− নাদিমকে বাগে আনতে পারবেন কি না?

একটা অপূর্ব বিকেল। কমলা রঙের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে শহরে। এই বিকেলের রোদে সবুজ পত্র-পল্লব শেষ স্নান করে নিচ্ছে। দীপালী খুব সুন্দর করে সেজেছে আজ। আজ যেন নাদিমের শেষ ইচ্ছাটুকু জেনে নেয়ার সর্বশেষ আয়োজন দীপালীর মনে। পাশাপাশি দুজন। হৃদয়ের টান না থাকুক রক্ত-মাংসের একটা টান তো থাকা চাই অন্তত। কিন্তু সেটাও দীপালী নাদিমের কাছ থেকে পায়নি। সে নাদিমের রুমে ঢুকে জিগ্যেস করল, দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে?

দীপালী অপূর্ব সুন্দরী। সবুজ শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ, কপালে সবুজ টিপ, চোখে কাজল, খয়েরি রঙের লিপস্টিক পাগল করে দেওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু নাদিমের কাছে ভালো লাগেনি মোটেও। সে পাল্টা প্রশ্ন করে চিড়িয়াখানায় যাবি?

ত্যাঁদরামির একটা সীমা থাকা চাই যা নাদিম লঙ্ঘন করেছে।

দীপালী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আমি কি চিড়িয়াখানার প্রাণী? তুমি আমাকে একদম সহ্য করতে পার না। দীপালী কাছে এসে বসে। আচ্ছা ভাইয়া, তুমি কি বলবে তোমার কোনো অ্যাফেয়ার আছে কি না?

তোকে বলতে হবে কেন?

আমাকে বলতে হবে এ জন্য যে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

কী?

হ্যাঁ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব বেশি ভালোবাসি।

আমাকে নাকে দড়ি লাগিয়ে ঘুরানোর জন্য?

না। তোমার নাকের ওপর চন্দন টিপ পরানোর জন্য। বিশ্বাস করো তোমার অবহেলা আমি সহ্য করতে পারি না। দীপালী উঠে দাঁড়ায়। মনে হয় এখনই সে কেঁদে ফেলবে। সে নাদিমের টেবিলের পাশে গিয়ে একটা বইয়ের পাতা উল্টাতে-পাল্টাতে লাগল।

তাহলে কী করতে হবে আমাকে?

দীপালী নাদিমের আরও কাছে এসে মুখোমুখি বসে। দেখো আমার চোখে এক সাগর জলের তৃষ্ণা। আমার চোখে দেখো তুমি ছাড়া আর কিছু নেই।

নাদিম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এমন একটা সুন্দরী মেয়ে নাকের ডগায় ফড়িং-এর মতো লাফালাফি করে অথচ একদিন তাকে ভালো করে দেখেওনি সে। দীপালীর মেদহীন দেহটিতে একজন যুবককে অস্থির করে তোলার মতো উত্তেজনা-শিহরন লুকানো আছে। শাড়ির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে মেদহীন পেট। সুগোল নাভির দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেয় কস্তরির আধার। নাদিমের মাথাটা ঝিম ধরে যায়। গোড়ালির রক্ত যেন উপরে উঠে যাচ্ছে শিড়দাঁড়া বেয়ে। একটা হিম ভাব পায়ের নিচ থেকে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আর নেমে যাচ্ছে ক্রমাগত।

দীপালীর ঠোঁটের দিকে তাকায় নাদিম। প্রদীপের শিখার মতো লিকলিক করছে যন্ত্রণায়, পুড়ে ভস্ম করে দিতে চাচ্ছে নাদিমের চোখ দুটি।

দীপালী হাসে। শব্দহীন হাসিতে যেন নক্ষত্রের আলো উপচে পড়ছে। নাদিম মনে মনে বলে দীপালী তোমাকে এমন করে আগে তো দেখিনি কখনো। তোমার এত মাধুর্য কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে? কিন্তু এখন আমাকে হাত ধরে টেনে তুলে আনবে কে? আমি যে কঠিন দায়ে আবদ্ধ হয়ে গেছি।

দীপালী আবেগ ভরা কণ্ঠে বলল, তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি যখন থেকে বুঝি তখন থেকেই তোমাকে আমার ভেবেছি। আমি তোমাকে যে কত বিচিত্রভাবে সাজিয়ে রেখেছি তা তুমি বুঝবে না। কিন্তু এত দিনেও যখন তোমার সাড়া পাচ্ছি না আমি এখন পাগলপ্রায়।

নাদিম কী বলবে বুঝতে পারছে না। এ যে মিনতি− এ মিনতিকে ফেরাতে পারে এমন পাষাণ কজনই বা পৃথিবীতে জন্ম নেয়।

দীপালী আবার বলল, তুমি হয়তো জানো, খালামণি আমাকে যখন এখানে নিয়ে এসেছে তখন আম্মুকে বলেছিল আমাকে আর যেতে দেবে না। আমি আশার সোনালি পাথরে বুক বেঁধেছি, আমার বুক ভেঙে দিও না।

দীপালী তুই এখন যা। আমার পরীক্ষা সামনে। এখন আমাকে বিরক্ত করা মানেই রেজাল্ট খারাপ করা। আমি তো আর চলে যাচ্ছি না কোথাও।

তুমি চলে যাচ্ছো না ঠিকই। কিন্তু তোমাকে আমি ধরেও রাখতে পারছি না। তোমাকে ক’বছরে আমি একটু বুঝতে পারিনি। আজও পারছি না।

বেশি কিছু চাইবি না। বেশি কিছু চাইলে কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কাই অধিক।

তুমি শেষ কথাটা বলে দিলেই পারো। আমি হয়তো কষ্ট পাব না।

শেষ কথা বলতে যা বোঝায় তাহলো আমার জন্য তোর অপেক্ষা না করাই ভালো।

দীপালী চলে যায়। কিন্তু তার চোখে অনন্ত জিজ্ঞাসা। কিছুক্ষণ পর নাদিম শুনতে পায় দীপালী ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

দীপালী খুব সহজেই নাদিমকে ছেড়ে দিতে পারে। তার কোনো অনুযোগ অভিযোগ না থাকতে পারে কিন্তু ওর মা তো সহজে নাদিমকে ছেড়ে দেবার কথা নয়। মায়ের অধিকার আছে, আছে অনুশাসনের অধিকার এবং সর্বশেষে মাতৃত্বের অমোঘ দাবি।

খারাপ ব্যবহার করেছে। তা না হলে কাঁদবে কেন? না! এভাবে হবে না। মা মনে মনে বলেলন, একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। ব্যাপারটাকে তাহলে বুঝে নিতে হবে।

নাদিম।

জি মা।

দীপালীকে নিয়ে বেড়িয়ে আয়।

আমার যে পরীক্ষা।

আমি কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। যা বলছি তাই কর। যা, ও যেখানে যেতে চায় সেখানেই নিয়ে যাবি। আশ্চর্য! কয় বছর হলো মেয়েটি এল আর একটা দিন তাকে কোথাও নিয়ে গেলি না? ওর আর কে আছে এখানে? যা এক্ষুনি তৈরি হয়ে নে।

নাদিমের মা দীপালীকেও বললেন নাদিমের সঙ্গে বেড়িয়ে আসার জন্য। দীপালী প্রথমে রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত রাজি না হয়ে আর উপায় ছিল না। এ বাড়িতে নাদিমের মা যা বলেন তাই হয়। হতে হয়। এর বাইরে যাবার কারও উপায় নেই।

নাদিমের হাতে পাঁচশ টাকার দুইটা নোট দিলেন তার মা। দীপালী যা। তোরা ইচ্ছেমতো বেড়াবি আজ। নাদিমের মা আদেশের সুরে বললেন।

নাদিম আর দীপালী বাসা থেকে বের হল। তারা রাস্তায় নেমে একটু দাঁড়াল। নাদিমের মুখ পাথরের মত ভার। দীপালী জানে নাদিম মায়ের ধমক খেয়ে এসেছে তার সঙ্গে। এ বেড়ানোর মধ্যে কোনো আন্তরিকতা নেই, কোনো আকর্ষণ নেই বরং আছে বিরক্তি। নাদিম জিজ্ঞেস করল, কোন দিকে যাবি?

আমি জানি না।

নিমিষের মধ্যে নাদিম পড়লো কঠিন দায়ভারে। কোথায় নিয়ে যাবে? কোথায় গিয়ে কি কথা বলবে – সে ভেবে পাচ্ছে না।

দূরে কোথাও না কাছে কোথাও?

জানি না। অভিমানে ভরা দীপালীর কণ্ঠ।

কতক্ষণ ঘুরবি?

জানি না?

তাহলে বের হয়েছিস ক্যান? বাসাতেই থাকতে।

আমি তো আসতে চাইনি। খালামণি…

রাখ খালামণি।

দেখ ধমকাধমকি করবে না। তুমি যেমন মায়ের ধমক এড়াতে এসেছো আমিও তেমনি এসেছি। এ বেড়ানোর মধ্যে তোমার যেমন আন্তরিকতা নেই আমারও তেমন আন্তরিকতা নেই। কৃত্রিমতায় ভরা আমাদের এ বের হওয়া।

তাহলে চল।

রাস্তায় নেমে নাদিম রিকশা ডাকল। রিকশাওয়ালাকে বুঝিয়ে বলে তার যেদিকে যেতে ইচ্ছে করে যাবে। যখন ইচ্ছে হয় এখানে আবার এসে নামিয়ে দেবে। ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া চুকিয়ে নিল ওরা। রিকশাওয়ালাকে নাদিমের ঘড়িটা দেখিয়ে বলল, দেখো কটা বাজে। রিকশাওয়ালা হাসল। আমি ঘড়ি চিনি না। আফনেই ঠিক কইর্যা দেইক্যা লন।

নাদিম ঘড়িটা দেখে নিল। ওরা চলে। নাদিম রিকশাওয়ালাকে বলল, যে দিকে যেতে চান সেদিকেই যাবেন।

রিকশাওয়ালা মনের আনন্দে ফাঁকা রাস্তাগুলোতে চালাতে লাগল। তার জীবনে মনে হয় এমন মজার কোনো খ্যাপ পায়নি। ইচ্ছেমতই ঘুরছে।

এক সময় রিকশাটি আসতে আসতে ধানমন্ডি সাত নম্বর সড়কে উঠে এল। নাদিমের সেদিকে খেয়াল নেই। এই সড়কেই নাবিলাদের বাড়ি।

নাবিলা তার দুই বান্ধবীকে নিয়ে ইভিনিংওয়াকে বেড়িয়েছে। নাবিলা থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ নাদিমই তো।

নাবিলা মনে মনে বলল, ইতর ভদ্রলোক, ভণ্ড, প্রতারক।

নাবিলার এক বান্ধবী আরও কনফার্ম করে নাদিম তাহলে তোকে বিট্রে করেছে? অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুরছে।

নাবিলা রাগে যন্ত্রণায় কাঁপতে থাকে, নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে। নাবিলা বুঝতে পারে নাদিম কেন ওকে এভয়েড করছে। দীপালীর সাথে ওর সম্পর্ক রয়েছে সেটা আগে বলে দিলেই পারত।

নাদিম এমন কিছু করবে নাবিলা বিশ্বাস করতে পারে না। রিকশা দিয়ে এদিকেই বা আসবে কেন? সে নিশ্চয়ই আমাকে দেখাতে এসেছিল। নাবিলা দ্রুত বাসায় ফিরে গেল সেদিন। ইভিনিংওয়াক আর হলো না। উত্তেজনায়, যন্ত্রণায় তার শরীর কাঁপছে।

হাজারো স্মৃতির মন্থন শুরু হল। কেটে দেয়া লতাগুল্ম যেমন সতেজতা হারিয়ে ঝিমিয়ে পড়ে নাবিলাও ঠিক তেমনি ঝিমিয়ে পড়েছে মুহূর্তের মধ্যে।

রিকশা এক সময় একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থেমে গেল। চালক মনে হলো খুব রসিক। স্যার আমিও একটু জিরাই আর আফনেরাও কিছু খানাপিনা কইর্যা আন।

রিকশাওয়ালার কথা শুনে নাদিম হাসল। তুমি এখানে থামলে কেন?

স্যার আফনে তো কইলেন আমার ইচ্ছে মতো চালাইতে। এবার কিছু খানা খাইয়্যা লন। আমিও একটু জিরাই।

রিকশা চালালেও সে চিনে নগরের মানুষকে। রিকশাওয়ালা সাহসীও বটে। সে নাদিমকে বলল, স্যার রিকশা ছালাইলেও মানুষের মনের ডিমিট বুঝতে ফারি। ডিমান্ডকে সে বলল ডিমিট।

নাদিম মুচকি হেসে দীপালীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে গেল।

ঢাকায় রিকশা চালকরা ঠিকই জানে চাইনিজ খাওয়ার মধ্যে একটা আলাদা আমেজ আছে। যারা প্রেমটেম করে তারা এসব রেস্টুরেন্টে আসে, খায়-দায়, কথা বলে, সময় কাটায়। নিরিবিলি কথা বলার জন্য এখানে আছে সুব্যবস্থা।

নাদিম আর বাড়াবাড়ি করে না। দীপালীকে ডেকে নিয়ে রেস্তোরায় ঢুকে একটা এক কোনায় একটা টেবিল পছন্দ করে সেখানে গিয়েই বসল।

সবুজাভ বাতির আলো ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। একটা স্বপ্নিল পরিবেশ। নাদিম ভাবে দীপালী শত হলেও খালাতো বোন। বধূ না হয়ে বন্ধু তো হতে পারে। তাকে ব্যাপারটা খুলে বললে অসুবিধা কী? অন্তত পৃথিবীতে একটি মানুষ জানুক আমি কেন এমন হয়ে গেলাম। আমি কতটা আগুন বুকে ধারণ করে আছি। আমি কতটা পরাজিত মানুষ।

দীপালীর মনে হয় চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। জোর করে মনের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চায় না সে। নাদিম যেমন বাকহীন পথ চলেছে দীপালীও তেমন।

নাদিম ডাকে ‘দীপালী’।

দীপালীর কথা বলার এতটুকু আগ্রহ নেই। সে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।

নাদিম রসিকতা করে বলল, মূক-বধির স্কুলে ভর্তি করতে হবে বলে মনে হয়।

দীপালীর মুখে স্মিত হাসির ছটা। তবে কোনো ব্যাকুলতা নেই।

বয় এসে মেনুবুকটা মেলে ধরে দীপালীর কাছে। দীপালী মেনুবুকটা নাদিমের দিকে ঠেলে দিল। বয়গুলোও ইতরের হাড্ডি। ওরা মেয়েদের কাছেই মেনুলিস্ট দিয়ে মজা পায়। নাদিম বুঝতে পারছে দীপালী কথা বলবে না। রেস্তোরায় তার সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করাটা দৃষ্টিকটু দেখাবে ভেবে নিজেই অর্ডার দিয়ে দিল।

খেতে খেতে নাদিম বলল, দীপালী তুই আমার খালাত বোন। আমি জানতাম না তুই আমার প্রতি দুর্বলতা আছে, একটা আশায় বুক বেঁধে আছিস এবং তাও জানতাম না মা তোকে ঢাকায় ভর্তি করিয়েছে আর যেতে দেবে না এমন একটা চিন্তা করে। খালাম্মাও হয়তো নিশ্চিত হয়ে বসে আছে যে, দীপালীর বিয়ের ব্যাপারে আর ভাবতে হবে না। সবগুলো বিষয় আজ আমার কাছে এক কঠিন সমস্যা যা আমার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে আজ তোকে কয়েকটি সত্য কথা বলব। খুব মনোযোগ দিয়ে শোন। এই কথাগুলো খুবই জরুরি। হয়ত আমার কঠিন সন্ধিক্ষণে তুইও আমাকে সাহায্য করতে পারবি। আমি একটা অগ্নিগর্ভে আছি হয়তো আমাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করতে পারবি।

তুই যখন বাসায় এসেছিস তখন আমি তোকে দেখে অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলাম। সেই ছোটকালে তোর সাথে আমার দেখা। পরে অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এই বয়সে তুই এত সুন্দরী হয়েছিস যে একাবার তাকালে চোখ ফিরানো যায় না। মেয়েদের ব্যাপারে আমার পছন্দের বিষয় হলো অন্তরের গুণাবলি। তোর তো কোনো দিকেই কোনো কিছুর ঘাটতি নেই। তুই যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি তোর সাদা অন্তর। তোকে চিনি ছোট থেকে তাই একটি কথাও তোকে তোষামোদ করার জন্য বলছি না।

তুই যখন বাসায় এলি আমি তখন নাবিলা নামের আমার এক সহপাঠিনীর সাথে  জড়িয়ে পড়েছি। সেও খুব ভালো মেয়ে। আমি পার্টির কাজে যখন এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে আমার লেখাপড়া উচ্ছনে যেতে লাগল তখন নাবিলা আমাকে বলতে গেলে ঘাড় ধরে টেনে তুলে আনে পার্টির কাজ থেকে, লাইব্রেরিতে বসায়। বলতে গেলে সেও সারাক্ষণ আমার পাশে বসে থাকত শুধু আমার লেখাপড়ার জন্য। অনার্সে আমার এত ভালো রেজাল্টের পেছনে নাবিলার অবদান কৃতজ্ঞাতার সাথে স্বীকার না করলে বেঈমানি হবে। তখন নাবিলা ছাড়া আমি আর কিছুই বুঝতাম না।

মনে মনে সহস্রবার বলেছিও দীপালী সত্যি অপূর্ব। এও ভেবেছি দীপালীর সাথে কেন যে আগে দেখা হলো না? কিন্তু নাবিলার বন্ধন ছিল এতই নিবিড় যে তার কাছ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া একটা মেয়ের সাথে প্রতারণা করারও ইচ্ছে ছিল না আমার। তার প্রাপ্য সম্মান আমি দিয়ে এসেছিলাম এবং বাকি জীবনেও দেওয়ার জন্য আমি কমিটেড ছিলাম।

নাদিম থেমে গেল। তার মুখ থেকে কথা সরছে না। চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে।

দীপালী জিগ্যেস করল, তারপর? থামলে কেন? বলো।

নাদিম আবার বলতে শুরু করল, নাবিলাকে এখনো আমি ভালোবাসি। কিন্তু …নাদিম আবার থেমে গেল। চোখের পলক পড়ছে খুব দ্রুত।

দীপালীর জানার আগ্রহটা দমাতে পারেনি। তারপর… দীপালী আবার জানতে চাইল। নাবিলা এখন কোথায়?

নাবিলা আছে। আমিও আছি। কিন্তু মাঝখানে ঘটে গেছে অনেক কিছু যা আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো মানুষ জানে না। নাদিম থেমে গেল। আড়ষ্ট গলা। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাদিম চোখ মুছে। দীপালীর চোখও আয়াতনে বাড়ে। সে ঘনিষ্ঠ হয়ে নাদিমের হাতের ওপর হাত রেখে বলল, বলো, থেমে যাও কেন?

নাদিম আবার শুরু করল, আসিফের দুর্ঘটনার পর আমি মানসিকভাবে এত বেশি ভেঙে পড়ি যে এখন ভাবতে পারছি না আমি কী করব? সত্যি কথা কী জানিস, আসিফের দুর্ঘটনার জন্য আমিই দায়ী। বন্ধুত্বের অকৃত্রিম টান দেখাতে গিয়ে তার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম। আমি ভাবতে পারি না দীপালী…। চোখে মুছে বলল, আমি আসিফের জীবনটাকে নষ্ট করে দিলাম।

অকাট্য স্তব্ধতায় ঢেকে যায় চাইনিজ রেস্তোরা। নাদিম আবার বলল, এখন আমার জীবন আবর্তিত হচ্ছে আসিফদের পরিবারকে কেন্দ্র করে। দীপালী কথাগুলো বললাম তোকে খুব বেশি আপন ভেবে। তুই আর কাউকে বলবি না, এই অনুরোধটুকু রাখিস।

নাদিম বলল, আমি আজ বড় অসহায় হয়ে পড়েছি। বিবেকের কাছে দারুণভাবে হেরে গেছি। হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। আমার জীবনের কোনো লোভ বা অন্য কিছু কখনোই ছিল না বা এখনো নেই বরং জীবনের সুন্দর কিছু কিছু পাওয়া থেকে আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই বঞ্চিত হচ্ছি। আসিফের দুর্ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে তা আজ তোকে বলি। তাহলে তুই আমার কষ্টটা বুঝতে পারবি।

আমি যখন অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলাম তখন আনন্দে দিশেহারা হয়ে যাই। কারণ ফার্স্ট হওয়ার কথা ছিল জাহানের। রেজাল্ট পাওয়ার পর প্রথমেই নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। তারপর ভাবলাম আসিফকে খবর দিয়ে এনে আমার রেজাল্টের খবরটা তাকে দেব এবং আমরা কয়েকজন মিলে সেলিব্রেট করব। সবাই মিলে আনন্দ করব। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম আমরা কয়েক জন দূরে কোথাও বেড়াতে যাব। নাদিম থেমে যায়। তার চোখ দুটি ভিজে গেছে। নাদিম চোখ মুছে। গলায় যেন সব কথা আটকে গেছে।

দীপালী বলল, তারপর? তারপর কী হলো?

নাদিম বলল, আমাদের বাসার সামনের রাস্তাটির একেবারে পশ্চিম পাশে একটা টেলিফোনের দোকান আছে যেটা একজন মহিলা চালায়, তুই হয়তো দেখে থাকবি। দেখেছিস?

হ্যাঁ আছে। আসমা দূরালাপনী। ওই মহিলার নামও আসমা।

আমি ঐ মহিলাকে বললাম, আপনি আসিফের মায়ের খুব অসুখ এ কথা বলে আসিফকে একটা ফোন করুন। আপনি বলবেন, আমি আসিফের বোন নিশা। আসিফের নতুন চাকরি, আবার কনস্ট্রাকশনের কাজ রেখে ছুটি দেবে না ভেবেই এ রকম চালাকি করে টেলিফোনটা করাই। ফোনটি আসিফের ম্যানেজার ধরবে এটা আমি জানতাম। কারণ যে সময় ফোনটা করিয়েছিলাম সে সময় আসিফ সাইটে থাকে। সেই টেলিফোন পেয়েই আসিফ একটি লোকাল বাসে ঢাকায় আসার জন্য রওনা হয় এবং অ্যাকসিডেন্ট করে তার চোখ হারায়।

নাদিমের চোখ ভিজে যায়। সে যেন আর কথা বলতে পারছে না। সে মাথা নিচু করে রুমাল দিয়ে চোখমুখ ঢেকে রাখে। এক সময় দীপালীর চোখ থেকে দরদরিয়ে পানি পড়তে থাকে। কয়েক ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে টেবিলের ওপরের সাদা কাপড়ে।

অনেকক্ষণ নাদিম কথা বলতে পারেনি। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নাদিম আবার বলতে শুরু করে, আসিফ আজও খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে কে মিথ্যা ফোনটা করেছিল। কারণ হাসপাতালেই আসিফ জেনে গেছে নিশা তাকে ফোন করেনি। এই যন্ত্রণা আমি কী করে মেনে নেব? কিভাবে ভুলে থাকব? তুই-ই বল দীপালী? আসিফ আবার থামল। আবার চোখ মুছল। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল।

নৈঃশব্দ্যে ভরে যায় ঘরটা। তারপর আবার নাদিম শুরু করল, এখন আমি ভাবছি আসিফদের পরিবারের সঙ্গে মিশে যেতে। যদি আসিফের জন্য কিছু করতে পারি। সোজা কথা ওদের দায়িত্ব আমি নিতে চাই।

তুই এমনই একটি সময়ে এলি যখন আমার জীবনের চাওয়া-পাওযার দফারফা শেষের দিকে। তোকে আমি অবহেলা করি না। তোকে আমি ভালোবাসি। আমাকে তুই ভালোবাসিস তাও বুঝি। তোর ভালোবাসার প্রতি আমার প্রচণ্ড শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু পাছে আরও বেশি তালগোল পেকে যায় তাই তোর সাথে আমি দুর্ব্যবহার করেছি। এ জন্য আমি অনুতপ্ত। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।

দীপালীর খাওয়া থেমে যায়। বার কয়েক পানি গিলেছে। এক সময় প্লেটটা সামনের দিকে ঠেলে দিল।

নাদিম আবার বলল, তুই হয়তো নিজের সম্পর্কে জানিস না তুই কত ভালো একটি মেয়ে। জীবনে যে অবস্থাই থাকিস, যেভাবেই থাকিস একটা কথা বিশ্বাস করবি যে তোর ভালোবাসার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ ছিল এবং আছে।

একটা অনুরোধ করলে রাখবি দীপালী?

তোমার যে কোন কথা আমি রাখব।

দীপালীর কণ্ঠে আড়ষ্টতা। নাদিমের মতো একটা অসামান্য ভালো মানুষ দীপালীর হাতছাড়া হয়ে যাবে এমন অধিকার ত্যাগ করে কেই বা বাঁচতে পারে? কেই-বা পারে সহজভাবে মেনে নিতে? তার একটা চাওয়া পূরণ করব না আমি? দীপালী মনে মনে বলল।

আমি আজ যে কথাগুলো বললাম সেগুলো আর কাউকে বলিস না। আর কষ্ট পাবি না এই ভেবে যে আমি তোকে কখনো অবহেলা করিনি। দৈবাৎ কোনো ঘটনার জন্য আমি ছিটকে পড়ে গেছি আমার স্বপ্নের ভুবন থেকে। এটি নিছক দুর্ঘটনা।

কথা দিলাম কাউকে বলবো না। কিন্তু যদি আমার শরীর কেটে হলেও তোমার কষ্টটা ভাগাভাগি করতে পারতাম তাহলে তাই করতাম আজ। আজকে বুঝতে পারলাম তুমি কেন এমন অস্থিরতায় থাকতে। দীপালী শাড়ির আঁচল দিয়ে তার চোখ ঢেকে দিল। বাষ্পরুদ্ধ গলায় জিগ্যেস করল, তাহলে তোমার কী ইচ্ছা যে, তুমি আসিফের বোন নিশাকে বিয়ে করবে?

আমি এমনই ভাবছি। সরাসরি ওদেরকে কোনোভাবে সাহায্য করা যাবে না। তাই আমিও ওদের পরিবারের একজন হয়ে যেতে চাই। যদিও নিশা কী করবে বা রাজি হবে কি না আমি এখনো জানি না।

তোমার বিবেক যদি বলে তাই করবে। নাবিলাকে কী বলবে?

তাকে আমি এভয়েড করছি। তাকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করছি।

জীবন কী এভাবে চলবে?

জানি না। জানেন অন্তর্যামী। তিনি যেভাবে চালান। তবে ধরে নেব আমার জীবনেও আসিফের মত দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে যেভাবে বাস্তবতাকে মেনে নেবে আমিও হেরে যাওয়া মানুষের মতো বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করব।

অনেকক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল। মনে হল কারও কোনো কথাই নেই। একবার দীপালী বলল, তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

হ্যাঁ। রাখব।

আমার কাছ থেকে তুমি একটা কিছু চেয়ে নেবে যা থেকে তুমি আমাকে মনে রাখতে পারবে আর আমি তোমাকে মনে রাখতে পারব চিরদিন। এটা হবে আমাদের দুজনের জীবনের একমাত্র স্মৃতি।

নাদিম বুঝতে পারছে এটা ভাবাবেগ ছাড়া কিছুই না। একটা বয়সে এমন হয়। মানুষের মনে বেঁচে থাকার জন্য কত কিছু করতে চায়। বাস্তবতা হলো মানুষের যতই বয়স হয় না কেন অতীত থেকে নিজেকে পৃথক হতে পারে না। অতীতের সব ঘটনাই কোনোভাবে মনে আসে, চোখে ভাসে। অতীত মানুষের মুদ্রিত গ্রন্থ, স্মৃতিতে থাকে, সময় সময় সেসব বইয়ের পাতা যেন বাতাসে উল্টে দিয়ে যায়, মনে পড়ে সব কথা। মন্দ কাজের জন্য মানুষ আক্ষেপ করে, ভালো কাজের জন্য সুখবোধ করে। নাদিম সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র। তারপক্ষে এমন বিশ্লেষণ হতেই পারে। সে দীপালীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, কিন্তু তোমার ছেলেমানুষী ভাবাবেগকে দমিয়ে দেব না; মন সায় দেয় না। নাদিম দীপালীর দিকে তাকিয়ে বলল, এ যে খুব কঠিন সমস্যায় ফেলে দিলি দীপালী। আমি কী চাইতে পারি তোর কাছে? তুই ইচ্ছে করে দে যা তোর মন চায়। আমি তো এম্নিই তোকে মনে রাখব। তাছাড়া তুই আমার খালাত বোন। আমাদের মনে রাখা না রাখার ব্যাপার তো এখানে কিছু নেই।

না, তুমি একটা কিছু চেয়ে নাও আমার কাছ থেকে।

আজ না হলে চলবে না?

চলবে। তবে দেরি করো না।

না, কালই বলব। কাল রাতে। তুই আমার কাছ থেকে কিছু চেয়ে নিবি না?

আমার ইচ্ছের পুনরাবৃত্তি তোমার ভিতর ঘটুক সেটা চাই না। বরং তুমি নিজে থেকে দিও। তোমার যা ইচ্ছে হয় আমাকে দিও।

রাতে দুজন বাসায়

Series Navigation<< উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। সাত পর্বউপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ৯ম পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *