ছোটগল্প।। অনিন্দিতা।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

গোধূলির আলো এসে তার মুখে পড়েছে। সোনারঙ মুখখানি সবুজের দিকে মেলে ধরে আছে সে। তার চোখদুটি সুনীল প্রশান্ত সাগরের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সফেদ জাহাজগুলোর মতো আকাশে ভেসে থাকা দূরের ধবল মেঘ দেখছে। আমি জানি, ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ তার খুব ভালো লাগে। তাকে দেখতে দিই, আর নিভৃত-নীরবে আমি দেখি তার মুখ। জীবনানন্দ যেমন বলেছেন বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই… তেমনি আমিও বলি, তার মুখ আমি দেখিয়াছি আর কারো মুখ…

আমার জীবনে আর কিছু দেখার নেই। কত কত নারী আমার সামনে এসেছে, তাদের অবয়বে কত না ঢঙ আর ঠোঁটে দেখেছি কত রঙ। আমি দেখেছি তাদের, কিন্তু আবেগে তাকাই নি। আমি জীবনভর দেখেছি একটাই মুখ, একজোড়া চোখ আর একটাই নারীর অবয়ব। আমার সামনে এখন যে মুখ আমি সে মুখের পানে তাকিয়েই কাটিয়েছি পঁচিশ বছর। তবু দেখার সাধ আমার কখনো মেটে নি, মেটে না। আমি তারে বারবার দেখি, সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যাবেলা, সারাবেলায় সে কথা সে জানে। আমাদের এখন শেষের বেলা। ইদানিং মনে হয়, আমার নিজের আলো নিভে যাবার আগে আরো একটু আলো দুচোখ ভরে দেখে নিতে হবে। তা না হলে মরণের পর আত্মা অতৃপ্ত রয়ে যাবে।

শেষবেলার আলোর মতো সে রেখেছে আমার জীবন আলোকিত করে। আজ খুব মনে পড়ে, খুব সাধ ছিল আমার কোনো এক নারী এসে একদিন বলবে আমাকে, চিনতে পারছ না, আমি তোমার অনিন্দিতা। আমি খুব অবাক হবো, বিস্ময়ভরা চোখে তার দিকে তাকাব। মনে হবে, কত না বিস্ময়ভরা এ জীবন। আমি যা চেয়েছি তা পাই নি তখন। প্রেমের জন্য আমার মন তৃষ্ণাকাতর ছিল চাতকের মতো। অত অত কুমারী আমার চারপাশে ছিল, তারা রিনিঝিনি হাসির জল ছিটিয়ে চলে গেছে ঝরনার মতো। তারা পাখি হয়ে আর কারো হাত ধরে ডালে গিয়ে বসেছে। নাটকের নায়িকার মতো তাদের কারো কারো অভিনয় দর্শক হয়ে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।

কিন্তু আমাকে দেবে সামান্য পিপাসার জল এমন কাউকে পাই নি খুঁজে। অবশেষে একদিন যাকে তার পিতামাতা সপে দিয়েছিলেন আমার হাতে, আমানতের মতো আমি তাকে গ্রহণ করেছিলাম হৃষ্টচিত্তে। আমি তারে আগে দেখি নি। সেও আমাকে দেখে নি। আমাদের দুজনার প্রথম দেখা হয়েছিল মধুরাতে। আমি তার ঘরে ঢুকে অচেনা এক সুবাস পেয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। সে অচেনা সুবাস যে আমার নববধূর সেটা আন্দাজ করেছিলাম। আমি খুব করে নাকে সুবাস নিতে থাকি এবং সে সুবাসে বিমোহিত হয়েছিলাম।

তবে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল আমার ঐ সুবাস চিনতে। হঠাৎ মনে হয়েছিল, তাহলে এ সুবাস কি আমারই দেয়া শিশি থেকে নেয়া?

তুমি কি শুঁকছো?

সুবাস। অচেনা একটা সুগন্ধ পাচ্ছি। সে হেসেছিল।

আমি অচেনা, তুমি চেনা গন্ধ কী করে পাবে?

আরও যোগ কিরেছিল, তুমি আমাকে চেন না, মাত্র তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো, আর তাতেই তুমি আমার সুবাস পেয়ে গেলে! তুমি কি গন্ধবিশারদ? অচেনা সুবাস নাকে বেশি লাগে সেটা জানতে না বুঝি?

তাই নাকি? জানতাম না তো! তাহলে চেনাজানা শুরু হোক।

তাই হোক।

কী নামে ডাকব তোমায়?

সমর্পিতা।

আমি বলেছিলাম, এ কেমন নাম! অর্পিতা কোনো ভালো নাম নয়।

তাহলে তুমিই বলো। কী নাম দেবে আমায়।

আমি ভেবে বলি, অনিন্দিতা। অনিন্দিতা! তুমি চন্দন ব্যবহার করো?

না।

সেই ভালো। অনিন্দিতার চন্দন দরকার পড়ে না।

এ কথা কেন বলছ?

অনিন্দিতা নিজেই সুগন্ধী, সুবাস ছড়ায়।

তোমার নাকে সমস্যা আছে, বুঝলাম। কিন্তু চোখেও কি সমস্যা আছে নাকি?

এতদিন তো জেনে এসেছি, নেই। এখন থেকে সমস্যা হতে পারে।

মানে?

মানে আমি তো চোখ ফেরাতে পারছি না। চাঁদের আলোর দিকেও অপলক আর সবসময় তাকিয়ে থাকলে চোখে সমস্যা হয়, সে কথা জানতে না বুঝি?

তুমি তো বেশ কথা বলতে পার। আর ক’জন মেয়ের সঙ্গে এমন করে বলতে? এরকম কথা শুনলে তো অনেক মেয়েরই পটে যাবার কথা।

আর কেউ পটার দরকার নেই, তোমাকে পটাতে পারলেই জীবন সার্থক হবে।

কেন, তুমি কাউকে আগে ভালো বাসো নি?

চেয়েছিলাম, কিন্তু অভাগার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকায় নি। খুঁজে পাই নি।

কাকে খুঁজেছিলে?

যে হবে আমার বোধের অংশীদার।

পাও নি, সেই ভালো হয়েছে।

কেন?

তাহলে তো আমার আর তোমাকে পাওয়ার সুযোগ হতো না।

তুমি আগে কাউকে ভালোবাস নি?

এ অভাগীর দিকেও কেউ তাকায় নি।

আমাকে বিশ্বাস করতে বলছ?

বিশ্বাস অবিশ্বাস আসলে ব্যক্তিগত। বিশ্বাস কোনো যুক্তি মেনে চলে না।

যেমন?

মানুষ কি ভূতে বিশ্বাস করে যুক্তি দিয়ে?

না। তা নয়।

তুমি আমার অতীত জানো না, আমিও জানি না তোমার অতীত। তেমনি আমরা আমাদের ভবিষ্যতও জানি না। কেবল ভবিষ্যতের পথে পরষ্পর হাত ধরে হেঁটে যেতে পারি, এর বেশি কিছু নয়। এ পথচলায় আমরা কতটা কাছে থাকব, পাশে থাকব সেটাই হচ্ছে দাম্পত্য সম্পর্ক।

আমি কিন্তু তোমার সাথে একমত নই। আমার কাছে বর্তমানের মূল্য অসীম। আমি এর বাইরে ভাবতে চাই না।

কেন?

এক মুহুর্ত আগে যা বর্তমান ছিল তা এখন অতীত। আবার এক পল পরের সময়টা বর্তমান হয়ে ধরা দিয়ে অতীতে মিলিয়ে যাবে। তাই বর্তমানকে যথা সম্ভব উপভোগ করতে চাই। আমরা আমাদের জীবনটাকে বর্তমান আর উপভোগ্য করে রাখতে চাই।

আমি একমত। কিন্তু আমরা কি পারব?

কেন পারব না?

আমাদের অন্তর-বাইরের বৈরিতা আমাকে বা তোমাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তখন তোমার কাছে আমি অথবা আমার কাছে তুমি অতীত হয়ে যেতে পার। আসো, আমরা চলি কেবল বর্তমানের হাত ধরে, মেঘের মতো মতো হাওয়ায় পাল তুলি, অথবা জোড়শালিকের মতো একসাথে ডানা মেলি।

তবে তাই হোক।

আমাদের জীবন শুরু হোক। উহু। কেবল জীবন নয়। জীবন তো সকলেই যাপন করে।

তাহলে কী? আর কোন জীবন? ভালোবাসা, দাম্পত্য প্রেমের জীবন। যা আমাদের দু’জনের কেউ আগে পাই নি। অনিন্দিতা আর আমি এভাবেই আমরা জীবন শুরু করেছিলাম। আমরা আজো আছি জোড়শালিকের মতোই। চলেছি পথ একসাথে আমাদের চলার পথ যদিও ছিল না মসৃণ সবসময়। কখনো শ্রাবণ কখনো চৈত্রের খরা শুষ্করুক্ষ, কখনো ফুল ফুটেছে কখনো মাঘের সন্যাসীর মতো কাটিয়েছি আমরা সুখেদুখে। আমরা ছিলাম দুজন, আমাদের সংসারে এসেছে নতুন মুখ, ওদের নিয়ে গড়েছি নতুন জীবন, তারা বড় হয়েছে, জগতের রীতি অনুযায়ী ওরাও গড়েছে আমাদেরই মতো নতুন জীবন। জোড়শালিকের মতো ওরা ওদের বেঁধেছে নতুন বাসা। আমরা আছি আমাদের মতো।

কত বছর হলো?

বছর!

 তাহলে কি দিন?

দিন মানে!

তাহলে ক্ষণ বলবো?

কেন?

তুমি কি ক্লান্ত?

কেন?

কিসে?

আমাকে নিয়ে?

কেন বলছ?

তুমি জান না, বর্তমান ছাড়া আমাদের আর কোনো কাল নেই?

জানি। আমাদের অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। অনিন্দিতা আজও আগের মতোই আমার হাতে হাত রাখে, নগ্ন নির্জন হাত। আমরা আছি আগের মতোই। কেবল দু’জন দু’জনার হয়েই। আমাদের জীবন আজো আমাদের। আমাদের চেনা অচেনা জগত নিয়ে আমরা আছি আমাদের মাঝে আমাদের হয়ে। আমাদের সামনে কাশফুল, মাথায় সাদাচুল। অনিন্দিতা দেখছে সাদা মেঘ, আমি দেখছি দুটো শালিক বসে আছে একটা গাছের শাখে। আমরা বসে আছি পাশাপাশি, আছি কাছাকাছি জোড়শালিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *