ছোটগল্প।। পৃথিবীতে কে কাহার।। মোহিত কামাল

‘হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহু বিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভেতর প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ি কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।’ লাইনগুলো পড়ে চমকে উঠলেন মজনু শাহ। কষ্টে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কষ্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল মিডিয়ার তাড়া। তাড়া দূর হয়নি। কষ্টও উবে যায়নি। শক্ত পেরেকের মতো এখনো কষ্ট ঠুকে রয়েছে বুকে, মনে, চোখে। 

এ মুহূর্তে ‘পোস্টমাস্টার গল্প’র শেষাংশটুকু পড়ার পর হালকা হতে লাগল বুকের চাপ। অন্য রকম অনুভবে নাড়া খেল মন। বই পড়ার মধ্যদিয়ে চোখের ভেতর আটকে থাকা বীভৎস দৃশ্যটাও পেয়ে গেল পথ খুঁড়ে বেরিয়ে আসার নতুন গলি। বন্ধু ফরহাদকে ধন্যবাদ দিলেন মনে মনে। গতকাল গল্পগুচ্ছ বইটি দিয়ে গেছে সে। আজ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে চোখ আটকে গেছে লাইনগুলোতে। ওষুধের মতো কাজ দিয়েছে প্রতিটা শব্দ, প্রতিটি বাক্য। গভীর মনোযোগের সঙ্গে অনুভব করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বকথা―আবেগে আক্রান্ত মানবমনকে বুদ্ধিহীন বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। নেতিবাচক অতি আবেগের ঘোরে ডুবে থাকলে ভুল কাটবে না মানুষের। মিথ্যা আশায় ভর করে, মিথ্যার পক্ষে শক্ত প্রমাণকেও তুচ্ছ ভেবে উড়িয়ে সত্য বলে আঁকড়ে ধরে এগোতে চায় মানুষ। মজনু শাহও মিথ্যার পক্ষে প্রমাণ খুঁজছিলেন। নওরীন নেই, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। নওরীন আত্মহত্যা করেছে, মন মানে না। মন বলছে সে আছে। চারপাশে আছে। ওর ঘরে আছে। ঘরের আসবাব, কাপড়-চোপড়, টেবিল-চেয়ার, বই-খাতা সবকিছুতেই মিশে আছে নওরীন, আদরের কন্যা নওরীন। অথচ নওরীন নেই―নাড়ি কেটে, হৃদয়ের রক্ত শুষে সে চলে গেছে মহানৈঃশব্দ্যের জগতে। এ জগত থেকে ফেরার আর উপায় নেই। চোখ খুলে গেল মজনু শাহ’র―চেতন মনে নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটল। নিজেকে আবার দেখতে পেলেন। ভ্রান্তি কেটে যেতে লাগল। 

রবীন্দ্রনাথের এসব কথা আবার পড়লেন সাহিত্যিক মজনু শাহ। কয়েকটা শব্দ আলোড়িত করল তাকে। শব্দগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলেন―বুদ্ধি, আবেগ, আশা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, চেতন মনের চিন্তা-উপলব্ধি―এসব বিজ্ঞানের ভাষা। বিজ্ঞানের কলকব্জা স্বভাবগতভাবে ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ কি তবে সৃজন করেছেন সাহিত্য? নাকি তাঁর জীবন-ঘনিষ্ঠ সাহিত্য-সম্ভার থেকেই  জেগে উঠেছে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো?

‘সাহিত্য সৃজনধর্মী, দর্শন-বিজ্ঞান প্রভৃতি নির্মাণধর্মী।’ রবীন্দ্রনাথের মতে ‘সৃষ্টির উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না, নির্মাণের উদ্দেশ্য পাওয়া যায়।’ তাঁর মতে যে-কোন সৃষ্টিই উদ্দেশ্যহীন―অথবা উদ্দেশ্য যদি কিছু থাকে তা আনন্দ।

আনন্দ ছাড়া সাহিত্য থেকে অন্য কিছু ফল লাভ প্রত্যাশা করা যায় বলে তিনি মনে করেননি। কথাগুলো মনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আবারও নাড়া খেলেন মজনু শাহ। পোস্টমাস্টার গল্পের জগতের ক্রোড়বিচ্যুত রতনের জন্য কষ্ট পেয়েছেন তিনি। পোস্ট্অফিস গৃহের চারদিকে ঘূর্ণায়মান অশ্রুজলে সিক্ত রতনের অশ্রু নিজের চোখের জলে পরিণত হয়েছিল। 

এ কষ্টে আনন্দ কোথায়? 

আনন্দ খুঁজে নিলেন বর্তমানের চেতন মন থেকে। ভেঙে গেছে নওরীনের জন্য জমাট বাঁধতে থাকা  কষ্টের চাক। কষ্ট কমে এসেছে। কষ্ট কমার অর্থ হলো চাপমুক্ত হওয়া। নিজেকে নির্ভার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে রবীন্দ্রসাহিত্য কমিয়ে দিতে পারে পাঠকের কষ্ট। সৃষ্টির এর চেয়ে বড় সফলতা আর কী হতে পারে? 

‘পৃথিবীতে কে কাহার’―সৃজনের মাধ্যমে কি দর্শন উপহার দেননি রবীন্দ্রনাথ? বিজ্ঞান উপহার দেননি? সৃজনের মধ্যেও তাহলে ঢুকে যেতে পারে দর্শন-বিজ্ঞান? এসব প্রশ্ন নতুন ভাবনার উদয় ঘটাল মজনু শাহ’র মস্তিষ্কে। এ কারণে নওরীনের চলে যাওয়ার কষ্ট হালকা হতে লাগল। বুঝতে পারলেন, চরম সত্য মেনে নিতে হবে, মেনে নেওয়ার নামই জীবন। মেনে নেওয়ার গোপন শক্তি ঢুকে গেল মনে। এ শক্তিতে নাড়া খেয়ে ঢুকলেন স্ত্রী নাঈমা জান্নাতের ঘরে। নাঈমা স্তব্ধ-নির্বাক। ঘুম নেই চোখে। খাওয়া নেই। নাঈমার পাশে এখন কেউ নেই। একা। নাঈমার ঘরটাকে মনে হলো শ্মশান। শ্মশান-ঘরের খাঁখাঁ শূন্যতা সহসা কমবে বলে মনে হচ্ছে না। নাঈমার সাহিত্যপ্রীতি নেই। কাব্যপ্রীতি নেই। ভিন্ন রকমের নাঈমা তার জগতে তার মতো। একা। একমাত্র ছেলে জাফর শাহ, কাছে নেই। নিউজিল্যাণ্ডে বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালো আছে সে। ছেলের জগতে ছেলে। পরিবারসহ সেখানে থাকলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। একমাত্র কন্যাও চলে গেছে অন্য কোনো জগতে। নিজেকেও বড্ড একা মনে হচ্ছে। বাইরে একা। ঘরে একা, সর্বত্র একাকী জীবনের পথ চলা। 

‘পৃথিবীতে কে কাহার’ কথাটার যথার্থতা আবারও বুঝতে পারলেন মজনু শাহ। সাহিত্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি না-হলেও এর যে কোন ফল নেই, সে-কথা স্বীকার করেননি রবীন্দ্রনাথ। ফল প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। হাতে হাতে এর ফল প্রমাণ করিয়ে দেওয়া সম্ভব না-হলেও সাহিত্য-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ মুহূর্তে মনোযাতনা কিছুটা কমে আসার কারণে নাঈমার পাশে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে মজনু শাহ বললেন, ওঠো। এসো, এক সঙ্গে খেতে বসি। 

স্বামীর কণ্ঠের জোর নাড়া দিল নাঈমাকে। শোক-সাগরে হঠাৎ যেন ভেসে এসেছে ডিঙি নৌকা। সাগর থেকে উদ্ধার পাওয়ার তাড়না না থাকলেও চোখ খুলে নাঈমা তাকালেন স্বামীর মুখের দিকে। স্বামীকে শোকাচ্ছন্ন মনে হলো না। মনে হলো সাহসী স্বামী পাশে দাঁড়িয়েছেন কষ্টের সময়। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্র-সাহিত্যতত্ত্ব আবার ঢুকে গেল মনে―‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে…’ কথাটা মুখে উচ্চারণ না-করে বললেন, কেঁদে ফল কী, দোয়া করো মেয়ের জন্য। দোয়া করা এখন তোমার নৈতিক দায়িত্ব। সাহিত্যের বদলে ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করলেন স্ত্রীকে। নিজে জীবনছোঁয়া ফলবান সাহিত্যের আলোয় আলোকিত হলেও ধর্মপ্রাণ স্ত্রীকে জাগিয়ে তুলতে চাইলেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেঁদে উঠলেন নাঈমা। স্ত্রীর কান্না ছোঁয়াচে রোগের মতো ছুঁয়ে গেল শক্ত হয়ে ওঠা মজনু শাহ’র মনও। তার চোখ বেয়েও নেমে এল লোনাজল। মিথ্যা আশাকে আবার বুকের ভেতর প্রাণ-পণে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা জেগে উঠল―নওরীন মরেনি, মরতে পারে না। ভ্রান্তির গিঁট খাওয়া দড়িতে আবার টান লাগল। এই টানে বুকের ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় হৃৎপিণ্ড। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না শুরু করেন। অব্যক্ত মর্মব্যথার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে মেতে লাগল বিশ্ব চরাচরে।

॥ দুই ॥

ডোরবেল বাজার পরও টেবিল ছেড়ে উঠলেন না মজনু শাহ। টেবিলে খোলা আছে হীরেন চট্টোপাধ্যায়-এর ‘সাহিত্যতত্ত্ব : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ বইটি। কঠিন বিষয়। মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়। মেয়ের নির্মম আত্মহত্যার দৃশ্য চোখ থেকে সরানোর আর কোনও উপায় খুঁজে পেলেন না তিনি। কঠিন বইয়ে ডুব দিয়ে ভুলে থাকতে পারেন চারপাশ; বীভৎস দৃশ্যটার ইমেজ তখন আর চোখে ভেসে ওঠে না। ফ্যানের সঙ্গে মেয়ের ঝুলে থাকার ছবিটা বারবার আক্রমণ করে চোখ। পুরোদৃশ্য জীবন্ত হয়ে সামনে দাঁড়ায়। মজনু শাহ’র কাছে এ যন্ত্রণার ক্ষত মোছার উপায় হচ্ছে বইয়ের ভেতর ডুব দেওয়া। অন্যদিকে মনোযোগ সরানোর সহজ কৌশল জানা নেই তার। এখনো ডুবেছিলেন। তাই ডোরবেলের শব্দেও টনক নড়ল না তার। 

দরজা খুলেছে গৃহকর্মী ,সুবর্ণা। 

বাসায় ঢুকেছেন কবি ফরহাদ খান, মজনু শাহ’র কাছের বন্ধু। ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তিনি।

সুবর্ণা বলল, মামা পড়বার ঘরে বই পইড়ছেন।

বসার ঘরে না-গিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকে ফরহাদ খান দেখলেন গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন মজনু শাহ। কিছুদিন আগে কন্যা সুইসাইড করেছে―এ মুহূর্তে বাবাকে দেখে তার প্রমাণ মেলে না। মগ্ন একাকিত্বে মজনুকে এখন সাধারণ কোনো পাঠক মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে বিদ্বৎসমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত একজন গুণী লেখক ডুবে আছেন ভাবজগতে, তাঁর সামনে কোনো সিঁড়ি নেই, পথ নেই। পথের শেষে অচিন সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাচ্ছেন তিনি সুদূর আকাশপানে।

পেছন থেকে মজনুর ঘাড়ে হাত রেখে ফরহাদ খান বললেন, কেমন আছ, মজনু?

স্পর্শ পেয়ে, শব্দ শুনে মোটেও চমকে উঠলেন না মজনু শাহ। যেন অনেক আগেই এসেছেন ফরহাদ খান। যেন দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেছেন দুই বন্ধু। ফরহাদ খানের প্রশ্নের উত্তর না-দিয়ে মজনু শাহ প্রশ্ন করলেন, তুমি কি জানো রিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম কী? ফিউচারিজম, হিউম্যানিজম, সেন্টিমেন্টালিজম বলতে কী বোঝায়, পড়া আছে তোমার? 

প্রশ্নের ধরন দেখে চমকে গেলেন ফরহাদ খান। মনে হলো ধূসর ধোঁয়ার স্তর আড়াল করে রেখেছে মজনুর আসল মন। ওই মন থেকে উদগীরণ ঘটছে অগ্নিলাভার। লাভার ওপরের স্তরে জলতে থাকা ধোঁয়ার স্তর থেকে প্রশ্ন করছে সে। ভেতরের অগ্ন্যুৎপাত দেখতে পাচ্ছে না। বন্ধুর প্রশ্নের দাপট উপেক্ষা না-করে পরাজয় স্বীকার করে ফরহাদ খান বললেন, না। পড়া হয়নি। তবে বিভিন্ন সাহিত্য-আসরে আলোচনা শুনেছিলাম, শোনা কথা কিছুই মনে নেই এখন। 

শোনো ফরহাদ, এসব যদি না-জানো বিভিন্ন মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ক্যাটাগরিক্যাল সাহিত্যের গভীর স্তর ছুঁতে পারবে না তুমি। সব ভালোভাবে জেনেশুনে লেখাঝোকা কোরো, বুঝলে? 

এ কথার মধ্যেও আসল মজনুকে খুঁজে পেলেন না ফরহাদ খান। মনে হলো অনেকখানি বদলে গেছে প্রিয় বন্ধু, মজনু। সে সব সময় নিজের ভেতর থেকে জেগে ওঠা স্বভাবজাত কাব্যভাবনাকে মূল্য দিত । এখন বিভিন্ন মতবাদের কথা বলে নিজের অস্তিত্বকেই তুচ্ছ ভাবছে।

ফরহাদ খানকে মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে চুপ থাকতে দেখে মজনু শাহ লেকচার দেওয়ার মতো করে বলতে শুরু করলেন, শোনো, ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফরাসী দেশে সাহিত্যে রিয়ালিজম বা বাস্তবতাবাদী আন্দোলন প্রবর্তন করেছিলেন মাদাম বোভারীর লেখক গুস্তাভ ফ্লবেয়র। এ মতবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চরিত্র ও ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করা যাবে না, আদর্শায়িত করা যাবে না। মূল ঘটনা ও চরিত্রকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে হবে। ভাববাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভব ঘটেছিল রিয়ালিজমের।

মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে মুখ খুললেন না ফরহাদ খান। কেবল মাথা দোলালেন কয়েকবার। 

মজনু শাহ’র ভেতর থেকে কথা বেরোতে লাগল গড়গড়িয়ে। নিজেকে থামানোর চেষ্টা করছেন না। এসব কথার কোনো প্রাসঙ্গিকতা এ মুহূর্তে না-থাকলেও যেন সামনে উপস্থিত ছাত্রকে পড়াতে চাচ্ছেন―এ তাড়নায় ছেদ পড়ছে না। আবার বলতে শুরু করলেন, সুররিয়ালিজম হচ্ছে অধিবাস্তববাদ। আমাদের প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এর প্রতিফলন রয়েছে। তবে এ মতবাদের মূলে তিন খ্যাতিমানের ভাবনার সমাহার দেখা যায়। মনোবিদ ফ্রয়েডের সংজ্ঞান ও অবচেতন মনের স্তরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একক সমগ্রতা বা অভিন্নতা, হেগেলের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের সংস্কার আর মার্কস থেকে গ্রহণ করা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আবেগ।

এবার মজনুকে থামিয়ে দিয়ে ফরহাদ খান বললেন, এতসব কঠিন কথা মাথায় ঢুকছে না। এসব বাদ দাও এখন। 

বলো কি ফরহাদ! তুমিই তো বইগুলো দিয়েছ আমাকে। তুমিই উৎসাহ দিয়েছে এসব পড়তে! মনে হলো এসব তত্ত্ব ভালো করে না-জানলে সাহিত্যের ভালোমন্দ বুঝব না, রস পাব না সাহিত্যের ভেতর থেকে।

মজনুর আলাপের ধরনটাকে অস্বাভাবিক লাগছে। এ মুহূর্তে জটিল আলোচনা করতে ইচ্ছা করছে না। তাই ফরহাদ খান বললেন, ভাবী কোথায়? তোমরা কেমন আছ?

শোনো ফরহাদ, একসঙ্গে দুটো প্রশ্ন করেছ তুমি। একসঙ্গে দুটো প্রশ্ন করা ঠিক নয়। একটা একটা করে প্রশ্ন করা উচিত ছিল। তবু দুটো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি―তোমার ভাবী নিশ্চয় কোনো এক রুমে আছে। একা। ও এখন একা থাকতে পছন্দ করে। আমি আছি রিডিংরুমে। তুমি পাশে থাকলেও আমিও একা আছি এখন। একা থাকতে পছন্দ করি। তুমিও এখন একা। মূলত তোমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। যখন রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরবে, তখনও তুমি থাকবে একা। হয়ত রাস্তায় অনেক মানুষ থাকবে। থাকুক। জনারণ্যেও তুমি একা। একাকীত্বকে তাড়াবে কীভাবে হে বন্ধু! এজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে কে কাহার’ বুঝেছ? 

বুলেট ট্রেনের মতো ছুটছে মজনু শাহ’র মুখের কথা। স্পীড বেড়ে গেছে কথার। উত্তরও দিচ্ছে ঠিক-ঠাক। উত্তর ঠিক দিলেও টেনে আনছে রিলেটেড নানা প্রসঙ্গ। 

মজনু শাহ’র কথার ধরন দেখে ঘাবড়ে গেলেও সহজ কণ্ঠে ফরহাদ খান প্রশ্ন করলেন, রাতে ঘুমিয়েছিলে মজনু?

ভুরু কুঁচকে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন মজনু শাহ, ঘুমিয়েছিলাম? কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থেকে বললেন, মনে হয় ঘুমোইনি। ঘুমালে এত পড়া শেষ করব কীভাবে? ঠিক আছে। ঘুমাব। তুমি কি ঘুমানোর পরামর্শ দিচ্ছ? ঠিক আছে, বন্ধু। আই শ্যাল গো টু দি বেড। আই শেল টেক স্লিপ। রাইট? প্রশ্ন ছুড়ে উত্তরের আশা না-করে আবার বই খুলে বসলেন মজনু শাহ। দাঁড়িয়ে আছেন ফরহাদ খান, বেমালুম ভুলে গেলেন সেকথা। 

পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ফরহাদ খান। বেরোনোর পথে দেখলেন এক মনে রুমের দিকে তাকিয়ে আছে সুবর্ণা। এ মুহূর্তে সুবর্ণাকে দেখে ‘পোস্টমাস্টার গল্প’র রতনের কথা মনে পড়ল―‘যখন অন্ধকার দাওয়ায় একলা বসিয়া গাছের কম্পন দেখিলে কবিহৃদয়েও ঈষৎ হৃৎকম্প উপস্থিত হইত, তখন ঘরের কোণে একটি ক্ষীণশিখা প্রদীপ জ্বালিয়া পোস্টমাস্টার ডাকিতেন―“রতন”। রতন দ্বারে বসিয়া এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত কিন্তু এক ডাকেই ঘরে আসিত না; বলিত, কি গা বাবু, কেন ডাকছ।’

সুবর্ণা কি মজনু শাহ’র ডাক শোনার জন্য উদ্বেলিত হৃদয়ে দরজার বাইরে রতনের মতো অপেক্ষা করে থাকে? মেয়েটির জন্য মায়া জাগল মনে। আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, সুবর্ণা, তোমার মামা কি ঠিক মতো প্রেশারের ওষুধ খায় তো? ঘুমায়? 

কী কমু আফনারে, মামা । দুই জনেরে লইয়া বড় বিফদে আছি। খানা খায় না। ওষুধ খায় না। মামাজান খালি পড়ে আর পড়ে, ঘুমায় না। পড়ার রুমথন বাইরই অয় না। মামী খালি কুরআন শরীফ লইয়া বইয়া থাকে। পড়ে না। খালি কাঁন্দে। বলতে বলতে কেঁদে ফেলে সুবর্ণাও।

সুবর্ণার কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন ফরহাদ খান। মনে হলো বিষণ্ন গৃহের শীতলশ্বাসে ভারি হয়ে উঠেছে সুবর্ণার মন। কচিমন সামাল দিতে পারছে না বড় পরিবর্তন। বদলে যাওয়া বাড়ির পরিবেশে দিশাহারা হয়ে গেছে সে। কিছুক্ষণ কাঁদতে দিলেন তিনি সুবর্ণাকে। কেঁদে-কেটে হালকা হয়ে সুবর্ণাই প্রশ্ন করল, কী করমু আমি?

তোমার মামা-মামী কি ঠিক মতো ওষুধ খায়?

খাইতে চায় না। আমিই দিয়া আসি ওষুধ। খায় কিনা জানি না।

ওষুধ চেনো? কখন কোনটা খেতে হবে, জানো?

চিনি। সময় মতোই দিয়া আসি আমি।

কীভাবে চেনো? তুমি পড়তে পারো?

হ। পড়তে পারি। নওরীন আফা পড়াশোনা শিখাইছে আমারে। বলতে বলতে আবারও ছলছল করে উঠল সুবর্ণার চোখ।

নওরীন প্রসঙ্গ চাপা রেখে বর্তমান ঘটনার দিকে নজর দিলেন ফরহাদ খান। 

শোনো, এখন থেকে তুমিই ওষুধ খাইয়ে দেবে। ওষুধ না-গেলা পর্যন্ত সামনে থেকে সরবে না। বুঝেছ?

হ। বুঝছি।

তোমার মামীর সঙ্গে দেখা করব। ভেতরে যাব? 

আহেন। ভিতরে আহেন। বলতে বলতে এগিয়ে গেল সুবর্ণা। তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে ফরহাদ খান বুঝলেন, মেয়েটি কেবল গৃহকর্মী নয়, এ বাড়ির বৈঠা এখন তার হাতে। এও বুঝলেন, নওরীন দারুণভাবে প্রভাবিত করে গেছে সুবর্ণাকে। শোকে স্তব্ধ সুবর্ণা এখন ব্যস্ত মামা-মামীকে সামলানোর কাজে। এ বাড়ির একমাত্র ছেলে নিউজিল্যান্ড থাকে। সংসারের বড় বিপদেও দেশে আসেনি। অথচ মায়ার সংসারে কোনো না কোনোভাবে মায়ার ঢেউ লেগেছে। শোকে স্তব্ধ বাড়িতে মায়ার ঢেউ উঠছে সুবর্ণার কারণে। কেউ টের না-পেলেও টের পেলেন ফরহাদ খান। বন্ধু হিসেবে নিজেও জড়িয়ে গেছেন পরিবারটির সঙ্গে। বিপদে ওকেও থাকতে হবে পাশে। সহমর্মিতার অনুভবে নিজেও জেগে উঠেছেন এ মুহূর্তে। ভেতরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম জানালেন ভাবীর উদ্দেশে।

আচমকা কেঁপে উঠলেন নাঈমা জান্নাত। সালামের জবাব না-দিয়ে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে থাকলেন ফরহাদ খানের দিকে। নীল বেদনার বিষে ভরে গেছে দেহের প্রতিটা কোষ। এ শুধু হৃদয়মথিত জ্বালা আর জীবনযন্ত্রণা নয়। ভাবীকে দেখে ফরহাদ খানের মনে হলো নওরীন ভুল কাজ করে গেছে। আত্মহত্যা করে কেবল পৃথিবী থেকে নিজেকেই সরিয়ে নেয়নি, একই সঙ্গে বিষাক্ত বটির কোপ বসিয়ে দিয়ে গেছে বাবা-মায়ের বুকে। এ ক্ষত মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে মা-বাবাকে। এ শাস্তি পাওয়ার কথা ছিল না এমন সফল দম্পতির। অথচ মেয়ের ভুলে বাকী জীবন শাস্তি পেতে হবে তাঁদের।

ফরহাদ খান জিজ্ঞেস করলেন, সকালের নাশতা খেয়েছেন? ওষুধ খেয়েছেন? 

প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে কিছুটা সময় নীরব থেকে নাঈমা জান্নাত বললেন, আমি ভালো আছি।

না। আপনি ভালো নেই। ভালো থাকবেন, আশাও করি না। তবে ঠিক মতো ওষুধ খেতে হবে। খাবার খেতে হবে। সুবর্ণার কথা শুনতে হবে। যখন আমি আসব, আমার কথাও শুনতে হবে।

এবার মুখে হাসির রেখা টেনে নাঈমা জান্নাত বললেন, আপনি বিশ্বাস করুন ভালো আছি আমি। আমার তো কোনো অভাব নেই। অতৃপ্তি নেই। চাহিদার অপূর্ণতা নেই। আমার মেয়ে নওরীন তো ছেড়ে যায়নি আমাকে। রোদ হয়ে আলো দেয়, মেঘ হয়ে বৃষ্টি দেয়, গাছ হয়ে ছায়া দেয়। কথাও বলে আমার সঙ্গে। আমি ভালো থাকব না কেন? অবশ্যই ভালো আছি।

নাঈমা জান্নাতের কথার সঙ্গে মিল আছে মুখের হাসির। তবে বর্ণনার ধরনের সঙ্গে পরিস্থিতির অসামঞ্জস্যতা ব্যাপকভাবে কাঁপিয়ে দিল ফরহাদ খানকে। শোক-সাগরে ডুবে মন কি তবে পুড়ে গেল স্বামী-স্ত্রীর? দুজনেই এমন অগোছাল কথা-বার্তা বলছে কেন?

দরজার সামনে থেকে সরে এলেন ফরহাদ খান। কথা বাড়ানোর ইচ্ছা থেমে গেল। বসার ঘরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। সুবর্ণাও এল পিছু পিছু। মামীর কথা শুনে অনাথ বালিকা সুবর্ণাও ভয় পেয়ে গেছে। ভীত গলায় বলল, মামা, আজ একটা কাগজ পাইছি আমি। নওরীন আফার বই গোছানোর সময় পাইছি। কাউকে দিই নাই। আফনি কি পড়বেন কাগজডা? আফার লেখা।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে ফরহাদ খান বললেন, নিয়ে এসো। 

নওরীনের ঘরে ছুটে গেছে সুবর্ণা। ফিরে এসে একটা খাতা এগিয়ে দিল। খাতার ভেতর নওরীনের লেখা ভাঁজ করা একটা কাগজ। লাশ নেওয়ার সময় অস্বাভাবিক মৃত্যুর আলামত পাওয়া যায় কিনা বোঝার জন্য তন্নতন্ন করে সব খুঁজেছিল পুলিশ। নওরীনের ঘর থেকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত লাশ নামিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আত্মহত্যা বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহ ছিল না তাদের। খবর পেয়ে ফরহাদ খানও ওইদিন ছুটে এসেছিলেন। নির্বাক বন্ধু ও ভাবীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ফরহাদ খানের পুরোপরিবার। পুলিশী ভয়ে কোনো আত্মীয়স্বজন তখন এ বাড়িমুখো হয়নি। তখন কোনো কাগজ-পত্র খুঁজে পায়নি পুলিশ। 

খাতাসহ কাগজটা সুবর্ণা তুলে দিল ফরহাদ খানের হাতে।

দ্রুত পড়া শেষ করলেন এটা। স্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে গেলেন ফরহাদ খান। এ মুহূর্তে তার দায়িত্ব কী হওয়া উচিত বুঝতে পারলেন না।

অবুঝের মতো ফ্যালফ্যাল করে সুবর্ণা তাকিয়ে আছে ফরহাদ খানের দিকে। নির্বাক ফরহাদ খানের মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। তবে দেখল, ফরহাদ খানের কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। চোখের নড়া-চড়া থেমে গেছে। কপালে ঘামও জমে গেছে। ঘাম দেখে সুইচ অন করে রুমের ফ্যান ছেড়ে দিল সে।

সুবর্ণার উদ্দেশে কিছুই বললেন না ফরহাদ খান। কাগজটা হাতে নিয়ে আবার ঢোকার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন পড়ার ঘরে। উদ্দেশ্য মজনু শাহ’র সঙ্গে বিষয়টা আলাপ করা। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ভাবনা এল মাথায়– এ মুহূর্তে ঘটনার লিখিত আলামতের বিষয়ে মজনু’র সঙ্গে আলাপ করা ঠিক হবে না। বরঞ্চ পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলা উচিত। আবার ফিরে এসে সুবর্ণাকে বললেন, নওরীনের বাংলা হাতের লেখায় কোনো খাতা আছে ওর টেবিলে?

সুবর্ণা জবাব দিল, আছে।

নিয়ে এসো।

আবার ছুট দিল সুবর্ণা। খাতা খুঁজতে গিয়ে ও একটু কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ পূর্বে বলা মামীর কথা মনে পড়ল:

‘আমার মেয়ে নওরীন তো ছেড়ে যায়নি আমাকে… কথাও বলে আমার সঙ্গে।’ 

মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে লাগল সুবর্ণা। ঘামতে শুরু করল। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। পুলিশ লাশ নেওয়ার পরও অনেকবার এ ঘরে ঢুকেছে, ভয় পায়নি। কিছুক্ষণ আগেও এসেছে, ভয়ের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ফরহাদ মামার কপালের ঘাম আর দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখে ভয় পেয়েছে। দ্রুত একটা খাতা নিয়ে ফিরে এল। খাতা খুলে ফরহাদ খান দেখলেন, খাতাটাতে বাংলা লেখা নেই। ইংরেজি লেখা। ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, বাংলা লেখা খাতা নিয়ে এসো। এটাতে ইংরেজি লেখা। 

এবার ওই ঘরের দিকে যেতে ভয় পেল সুবর্ণা। কাঁপতে লাগল। সুবর্ণার কাঁপুনি দেখে বললেন, এমন কাঁপছ কেন?

ভয় করছে মামা!

ভয় কীসের?

ওই ঘরে ঢোকার পর মনে অইল, আফা আছে ওইহানে। নওরীন আফার কথা শুইনতে পাইছে মামী! মনে অইল আফার রুহু আছে ওইহানে! হেই বোধ অয় কাগজ খান রাইখ্যা দিছে। আগে তো পুলিশ বহুত খোঁজাখুঁজি কইরাও কুনু কাগজ পায় নাই। আফনারেও দেখলাম কাগজখান হাতে পাইয়া ভয় পাইছেন!

সুবর্ণার ভীত এক্সপ্রেশন দেখে নিজের বর্তমান অভিব্যক্তিই টের পেলেন ফরহাদ খান। নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য হাসলেন। ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, এসব তোমার মনের ভয়। নওরীনের দাফন হয়ে গেছে। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে সে। কোনোভাবেই আর ফিরে আসার সুযোগ নেই তার। এ মুহূর্তে রুহু আসার ধারণা ভুল, বুঝেছ। মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললেন, চলো আমি সহ যাই। 

ফরহাদ খানের সঙ্গে এবার রুমে ঢুকল সুবর্ণা। এখন ভয় পাচ্ছে না সে। সাবলীলভাবে নওরীনের টেবিলের খাতা উল্টিয়ে পেল একটা বাংলা খাতা। ফরহাদ খানের হাতে তুলে দিয়ে বলল, নেন, এইডাতে বাংলা লেখা আছে।

কাগজের লেখা আর খাতার লেখা মিলে গেছে। কোনো পার্থক্য নেই। বুঝতে অসুবিধে হলো না এটা নওরীনের লেখা কাগজ―আত্মহত্যার নোট বা এভিডেন্স। নিশ্চিত হয়ে মজনু’র ঘরে ঢুকলেন আবার। ঢোকার পর ভাবলেন বই পড়ায় নিমগ্ন মজনুকে এ মুহূর্তে কাগজটা দেখানো ঠিক হবে না। পেছনে ঘুরে দেখলেন সুবর্ণা নেই, এ ঘরে ঢোকেনি। সুবর্ণার এ ঘরে ঢোকার ব্যাপারে কি নিষেধ আছে? মেয়েটি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন! মনে প্রশ্ন দোলা দিলেও উপেক্ষা করলেন ভাবনাটা। কাগজটা পকেটে চালান করে দিয়ে দাঁড়ালেন মজনু’র পাশে।

অন্য রকম ঘোরের মধ্যে থেকেও এবার মজনু শাহ টের পেলেন বন্ধুর উপস্থিতি। মাথা না-ঘুরিয়ে ‘পাশ্চাত্য দার্শনিকদের বিবিধ সাহিত্য-মতবাদ’ বিষয়ের ওপর আঙুল দেখিয়ে বললেন, দেখো, সেন্টিমেন্টালিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আবেগ―আদর্শ ও নৈতিকবোধ নিয়ে মাত্রারিক্ত আতিশয্য ও আবেগ-প্রবণতা; বুদ্ধির পরিবর্তে হৃদয়ধর্মের ওপর আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে এ মতবাদে। 

বন্ধুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা অযৌক্তিকভাবে কঠিন বিষয়ে ডুবে থাকার বিষয়টা এখন মানতে পারছেন না ফরহাদ খান। অসহায় বোধ করলেন। কিছুটা ধৈর্যচ্যুতিও ঘটল। মজনু শাহ আবার বলা শুরু করলেন, ন্যাচারালিজম ও রেশানালিজম বা অ্যান্টি-রেশানালিজমও বেশ ইন্টারেস্টিং… এবার বন্ধুকে থামিয়ে দিলেন ফরহাদ খান। নিজ হাতে বইটি বন্ধ করে বললেন, সকাল প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। শুনলাম এখনো নাশতা খাওনি। ওষুধও খাওনি। ওঠো। খেতে হবে। গলার স্বরের মধ্যে ধমক আছে। শাসন আছে। 

বন্ধুর কথা শুনে চট করে উঠে দাঁড়ালেন মজনু শাহ। সুবোধ বালকের মতো রাজি হয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। 

সুবর্ণা ছুটে গেল কিচেনে। নাশতা রেডি ছিল। টেবিল সাজিয়ে ঢুকল মামীর ঘরে। ফরহাদ খানকে কাছে পেয়ে উদ্বেগমুক্ত সুবর্ণা মামীর কাছে গিয়ে বলল, আহেন। মামা টেবিলে বইছে, নাশতা খাবে। আফনিও আহেন।

মুখ তুলে কিশোরী সুবর্ণার উচ্ছল মুখের দিকে তাকালেন নাঈমা জান্নাত। হঠাৎ মনে হলো মেয়েটির মুখের উচ্ছল ঢেউয়ের মধ্যে ভেসে উঠেছে নওরীনের মুখ। খপ করে তিনি ধরে ফেললেন সুবর্ণাকে। মুহূর্তে আদুরে হাত বুলিয়ে দিলেন ওর মুখে। আদর দিয়েই ছেড়ে দিলেন। উঠে রওনা দিলেন খাবার ঘরে স্পেসের দিকে। আচমকা আদরে নার্ভাস হয়ে গেলেও ছাড়ার পর আবার সহজ হয়ে গেল সুবর্ণা। খুশি মনে মামীর পেছনে এল ডাইনিং স্পেসে।

সবাই নাশতা খাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে এ বাড়ির একটি মেয়ে সুইসাইড করেছে। এ মুহূর্তে দেখে বোঝার উপায় নেই। মামা-মামীকে স্বাভাবিক হতে দেখে খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল সুবর্ণা। ফরহাদ খানও  ওদের সঙ্গে নাশতায় অংশ নিলেন সানন্দে।

॥ তিন ॥

থানার তদন্ত কর্মকর্তা, আজিজ পাশার সামনে বসে আছেন ফরহাদ খান। সঙ্গে আছেন জুবায়ের আলম, নওরীনের মামা। নওরীনের সুইসাইড-নোট নিয়ে আলাপ করতে উভয়ে এসেছেন থানায়। জুবায়ের আলম কথা বলেছেন নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত ভাগ্নে জাফর শাহ’র সঙ্গে। নওরীনের বাবা-মাকে না-জানালেও পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন থানায়। 

জাফর বলেছে, মামা এ প্ররোচিত আত্মহত্যার বিচার হতে হবে। সুষ্ঠু বিচারের জন্য যা যা লাগে, করুন। আমি আসতে না পারলেও টাকা পাঠাব।

মামা জুবায়ের আলম আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। ভাগ্নের উদ্দেশে বলেছেন, এ মুহূর্তে তোমার দেশে আসা জরুরি। বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো উচিত। টাকার কথা ভাবতে হবে না।

জাফর শাহ বলেছে, মামা ,সরি। আসতে পারব না এখন। মামলার ব্যাপারে এগিয়ে যাও তোমরা। সময় বের করে আসতে চেষ্টা করব আমি। 

ভাগ্নের অনুমতি থাকার কারণে জুবায়ের আলম ও ফরহাদ খান থানায় এসেছেন। সুইসাইড-নোট পেয়ে স্বস্তি পেলেন তদন্ত অফিসার। পড়ে বললেন, হ্যাঁ নওরীনের আত্মহত্যা ব্যাপারে সন্দেহ নেই আমাদের। তবে এটা যে প্ররোচিত আত্মহত্যা, বুঝতে অসুবিধে হয়নি। আত্মহত্যার পূর্বে নওরীন অন্তত দশবার কল করেছে তপুকে। কল ধরেনি তপু। এর পূর্বে টানা আধাঘন্টা কথা বলেছে তারা। কল লিস্ট চলে এসেছে আমাদের হাতে। তদন্ত কর্মকর্তা ‘সুইসাইড-নোট’টা পড়ছেন আর মাঝে মাঝে কথা বলছেন, আমি আগেই ধারণা করেছিলাম নওরীন প্রেগনেন্ট। আশা করি ময়না তদন্তে সেটা ধরা পড়বে। তবে সে যে তপুকে বিয়ে করেছে, বিয়ের কথা গোপন রেখেছে, সেটা বুঝতে পারিনি। নোটের বিষয়-বস্তুর প্রতি মনোযোগ দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আজিজ পাশা আবার বললেন, বিয়ের প্রমাণপত্র হিসেবে প্রয়োজন রেজিস্ট্রিকৃত নিকাহনামা। বিয়ে করেছে তপু, তবে কৌশলী হয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেনি। প্রেগনেন্ট হওয়ার পর চাপ দিচ্ছিল নওরীন। রেজিস্ট্রেশনের জন্য বহুবার বলেছে, পাত্তা দেয়নি তপু। উল্টো সম্পর্কচ্ছেদের হুমকি দিয়েছিল। এ হুমকি ও লোকলজ্জার ভয় তাকে প্ররোচিত করেছে আত্মহত্যায়। তপু কিছুতেই এড়াতে পারবে না এ দায়। নোটটা পেয়ে সুবিধা হলো আমাদের। 

নওরীনের মামা জুবায়ের আলম বললেন, আমার ভাগ্নি তো অবৈধ মাতৃত্ব ধারণ করেনি। নৈতিকভাবে বিয়ে করেছে। নৈতিকভাবে গর্ভবতী হয়েছে।

হ্যাঁ। সেটা বোঝা যাচ্ছে। লোকলজ্জার কিছু ছিল না। কিন্তু কচি বয়সে এত চাপ সইতে পারেনি সে, যৌক্তিক চিন্তা করতে পারেনি। তপুর অপমানের বোঝাও সামাল দিতে পারেনি। শেষ পরিণতি হচ্ছে এ সুইসাইড। এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে সমাজে। অথচ মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে ‘মুসলিম বিয়ে ও তালাক আইন ১৯৭৪’ অনুযায়ী প্রতিটি বিয়ের রেজিস্ট্রেশন জরুরি―যেদিন বিয়ে সম্পাদিত হবে সেদিনই নিকাহ-রেজিস্ট্রার দ্বারা বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করা  প্রয়োজন। অবস্থা সেদিন প্রতিকূলে থাকলে বিয়ের তিন সপ্তাহের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। বিষয়টা জানত নওরীন। এজন্য প্রেগনেন্ট হওয়ার পর তপুকে চাপ দিচ্ছিল। তপুও ছলেবলে-কৌশলে ওকে অবজ্ঞা করেছে, এড়িয়ে গেছে।

বিয়ের কোনো প্রমাণপত্র তো আমাদের হাতে নেই। বললেন জুবায়ের আলম। 

না-থাকলেও অসুবিধা নেই। এ কাগজই যথেষ্ট। মুসলিম আইনে বিয়ে হচ্ছে ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত এক দেওয়ানী-চুক্তি। খ্রীস্টান ধর্মেও বিয়ে একটি চুক্তি বিশেষ, গির্জায় পুরোহিতের নিকট থেকে যথার্থ নিয়ম পালন করে ম্যারেজ সার্টিফিকেট বা নিকাহনামা সংগ্রহ করতে হয়। নওরীন-তপুর বিয়ে-চুক্তি তো হয়েছে। 

রেজিস্ট্রেশন না-হলে কি মূল্য আছে এ চুক্তির? প্রশ্ন করলেন ফরহাদ খান।

দেখুন, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ে বিয়ে হয় পারিবারিক নিয়মে, রেজিস্ট্রেশন করার কোনো নিয়ম নেই। হিন্দু সমাজে বিয়ে কোনো চুক্তি বিশেষ নয়, এটি পবিত্র ধর্মীয় নির্দেশ। ১৯৫৫ সালের আইন অনুযায়ী অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বন্ধন স্থাপিত হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। চুক্তি না-হলেও বিয়ে-সম্পর্ক জটিলতা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আর মুসলিম আইনেও এ অবস্থায় তপু পার পাবে না, পার পাওয়ার সুযোগ নেই। রিমাণ্ডে নিলে সব স্বীকার করবে, প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র, বিয়ের স্বাক্ষী-সাবুদ সব পেয়ে যাব আমরা। নিশ্চিত হোন আপনারা।

বিচার চাইতে গিয়ে কি সামাজিক লজ্জা-সংকটে পড়তে পারি আমরা? প্রশ্ন করলেন জুবায়ের আলম।

প্রশ্ন শুনে কিছুটা থমকে আবারও জোর দিয়ে আজিজ পাশা বললেন, আপনাদের মেয়ে অবৈধ মাতৃত্ব ধারণ করেনি। লজ্জায় পড়বেন কেন? গোপনে বিয়ে করেছে, এটা নিয়ে ভয় পেলে চলবে না। আবারও বলছি, গোপনে বিয়ে করে প্রেগনেন্ট হওয়া অশ্লীল কোনো ঘটনা নয়।

আজিজ পাশার কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলেও উদ্বেগ কাটেনি নওরীনের মামার। বললেন, মিডিয়া তো বিষয়টা লুফে নেবে। নওরীনের পরিবার কি হ্যারাসমেন্টের স্বীকার হবে না? 

মিডিয়া যদি লুফেও নেয়, হ্যারাসমেন্ট হবে কেন নওরীনের পরিবার? সমস্যা হবে তপুদের। সামাজিক হ্যারাসমেন্ট হওয়াও তো এক ধরনের শাস্তি। তপুকে সেই শাস্তি পেতেই হবে। তাই না?

কথাটা মনে ধরেছে ফরহাদ খানের। জুবায়ের আলমও স্বস্তি পেলেন। থানা থেকে বেরিয়ে বাসায় এলেন তারা।

॥ চার ॥

বাসায় এসে আত্মমগ্ন হয়ে থাকলেন জুবায়ের আলম। মনের মধ্যে নানা চিন্তার উদয় হতে লাগল। ভাগ্নির সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তার। অথচ বিপদে কারও কাছে মুখ খোলেনি অবুঝ মেয়েটি। মনে মনে নওরীনের উদ্দেশে বললেন, ভালো কাজ করোনি তুমি, নওরীন। তোমার উচিত ছিল অন্তত তোমার মামার কাছে সব খুলে বলা। আলোচনা করা। তুমি তো অশ্লীল কিছু করোনি। অনৈতিক কাজ করোনি। বেঁচে থেকেই ফাইট দেওয়া উচিত ছিল। আমরা থাকতাম তোমার পাশে। তপুর পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে চলে গেলে আমাদের ছেড়ে। তপুর মতো ফ্রডদের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য তেজস্বিনী হতে পারলে না তুমি? সেই গুণ তো ছিল তোমার। ভুল করেছ―নিজেকে খুন করেছ, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনকেও খুন করে গেছ। তোমাকে ক্ষমা করতে পারছি না… ভাবতে ভাবতে চোখ গড়িয়ে অশ্রু নেমে এল। টের পেয়ে চোখের পানি মোছলেন। 

বড় বোন নাঈমা জান্নাত আর দুলাভাই মজনু শাহ’র দিকে তাকিয়ে বুঝলেন ছোট্ট দুই অবুঝ শিশু রক্তাক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে… এ ক্ষত কি মুছবে তাদের জীবন থেকে? 

প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছেন খোলা আকাশের দিকে… শূন্য আকাশটা আরও বেশি শূন্য মনে হচ্ছে। অসীম শূন্যের শেষ নেই। জীবনেরই শেষ আছে কেবল। 

পুনশ্চ:

মামলা চলছে। তপু ধরা পড়েছে। বিয়ের প্রমাণাদি হাতে পাওয়া গেছে। সাক্ষীও পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিন পেয়েছে তপু। পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হচ্ছে নিউজ। মামলা কতদিন চলবে, জানেন না মজনু শাহ। এখন অনেক শক্ত তিনি, ঠিক করেছেন মৃত্যু পর্যন্ত মামলা লড়ে যাবেন। কিছুতেই ছাড় দেবেন না। কিছুতেই পেছন ফিরবেন না। স্বামীর সঙ্গে আছেন নাঈমা জান্নাত, তিনিও অনেক শক্ত এখন। নিউজিল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছে জাফর শাহ, নওরীনের ভাই। সেও আছে লড়াইয়ের ময়দানে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় দিচ্ছে। প্রথমে মনে হয়েছিল ছেলে পর হয়ে গেছে। খোঁজ-খবর রাখছে না বাবা-মায়ের। এখন মনে হচ্ছে পর হয়নি, মমতার বন্ধন ছিন্ন হয়নি, মমতার শেকড়ের টানে ফিরে এসেছে দেশে।

আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্র-ভাবনা আবার উদয় হলো মজনু শাহ’র মনে―‘পৃথিবীতে কে কাহার’। মনে মনে উত্তর পাঠালেন রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে―পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। আবার সবাই সবার। প্রিয় কবি, আপনি আমার। আমিও আপনার। কারণ আমি গুণমুগ্ধ পাঠক। আপনার সৃষ্ট প্রতিটি শব্দ আলোড়িত করে আমাকে। আপনি পর ভাবতে পারবেন আমাকে? পর ভাবা উচিত? আমার আদরের মানিক নওরীন, চলে গেছে পরপারে। সে কি পর হয়ে গেছে আমার? হয়নি। জেগে আছে বুকের মধ্যিখানে। মায়ার আলো জ্বেলে বসে থাকে রাত-দিন। কীভাবে পর হবে সে, কবি?

৩ thoughts on “ছোটগল্প।। পৃথিবীতে কে কাহার।। মোহিত কামাল

  • আগস্ট ১০, ২০২১ at ৬:৫১ অপরাহ্ণ
    Permalink

    চমৎকার হয়েছে। দারুণ লাগলো।

    Reply
  • আগস্ট ১১, ২০২১ at ২:১৭ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    চমৎকার হয়েছে স্যার

    Reply
  • আগস্ট ১২, ২০২১ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    চমৎকার গল্প। পরিশেষে যে বক্তব্য, সেটাই আসল; পৃথিবীতে কেউ কারও পর হয় না। ধন্যবাদ লেখককে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *