উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পঞ্চম পর্ব

আসিফ খুব ব্যাকুল হয়ে উঠল। পেয়েছিস? দেখি, দেখি বলে আসিফ বিছানায় উঠে বসে। নাদিমের হাত থেকে লুফে নেয় ছবিটা। জড়িয়ে যাওয়া গলায় বলল, আমি কি আর রোজীকে দেখতে পারব না? তার কথায় মনে হয় সমস্ত হাসপাতালে নেমে এল নিস্তব্ধতা। পাশের সিটের এক রোগী তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। একজন নার্স পাশ দিয়ে যাচ্ছিল সেও একটু সময় দাঁড়িয়ে আসিফের হাতে রাখা ছবিটার দিকে তাকাল। মুহূর্তে সেও গম্ভীর হয়ে গেল। তার বুকের ভেতরটাও যেন নড়ে ওঠল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, অ্যাকসিডেন্টে কত মানুষের জীবনে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। আহা বেচারা! নাদিমও চোখ মুছে খুব সাবধানে।

ছবিটা বিছানার উপর রাখল আসিফ। ছবির ওপর হাত বুলিয়ে বলল, এখানে রোজীর চোখ। তাই না রে নাদিম? এখানে ভ্রু। একটা লাল টিপ ঠিক এখানেই। এটা কপাল। কপালে একগুচ্ছ চুল। এখানে একটা তিল। সৌন্দর্য তিলক। দ্যাখ নাদিম এটা কানের রিং। নাদিম তাকিয়ে থাকে স্থির দৃষ্টিতে যা যা বলছে সব ঠিক। একটুও এদিক সেদিক হচ্ছে না। নাদিম দ্যাখ ঠোঁট দুটি অসম্ভব সুন্দর, কোমল শিশির ভেজা।

কোনো কোনো কষ্ট আছে যে কষ্ট থেকে হাসি উৎসারিত হয়।

নাদিম হেসে বলল, থামত এবার।

সে আর কথা বলতে পারল না। তার কণ্ঠ জড়িয়ে গেল আস্তে আস্তে।

আসিফ আবার বলল, জানিস, সব মেয়ের চোখ কিন্তু কথা বলে না। যেমন সব নদী পলি দিতে জানে না ঠিক তেমনি সব মেয়ের চোখ কথা বলতে জানে না। যাদের চোখ কথা বলে না তারা কোনো আবেদনও সৃষ্টি করতে পারে না। মেয়েদের চোখই হলো অক্ষরহীন কাব্য। আসিফ থামল।

বুক ফাটা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় নাদিম। আমার তো এখন চোখই নেই। রোজীকে আমি আর কোনো দিন দেখব না। ওর সাথে আমার আর কোনো কথাও হবে না। নাদিম আসিফের দিকে শুধু তাকিয়ে থেকে তার কথাগুলো শুনে। আস্তে আস্তে ওর কথাগুলো হারিয়ে গেল বাতাসের ঢেউয়ে।

কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল। একবার আসিফ বলল, মীরেরসরাইয়ে একটি চিঠি লিখে দে ভাবিকে। ভাবি একবার এলে আমার ভালো লাগবে। জীবন কি খবরটা জানে?

হ্যাঁ। কুমিল্লা হাসপাতালে এসেছিল। রোজীকে আসতে বলব?

আসিফ বলল, চিঠি লিখে দে— ভাবি আর জীবন তো আসবে। রোজী কী আর আসবে? কয়েক দিনের প্রেম! তার তো অনেক বাধা। রোজীর ভাবাবেগ থাকলেও তার সমাজ, পরিবারের বাধা ডিঙিয়ে আসা সম্ভব হবে কি?

আসিফ একটু চিন্তিত হয়ে বলল, সব মেঘ তো আর বৃষ্টি হয়ে পড়তে পারে না। অনেক মেঘকে বাতাসে ভাসিয়ে নেয়— তাই না?

নাদিম আসিফের কথার কোনো উত্তর দিল না। নির্বাক চেয়ে রইল আসিফের মুখের দিকে।

নাদিম জীবনকে চিঠি না লিখে ফোন করে দিল রাতেই। পরদিন দুপুরের পরেই জীবন আর ওর স্ত্রী আসিফকে দেখতে এলো। নাদিম তখন আসিফকে কমলা খাওয়াচ্ছিল। নিশা পাশে বসা।

ভাবি অবাক হয়ে গেল আসিফকে দেখে। এমন তরতাজা প্রাণোচ্ছল হাসি-খুশি এক যুবক এই কয় দিনে কীভাবে মিইয়ে গেল— ভেবে পাচ্ছে না জীবনের স্ত্রী। মানুষের জীবন কেন এমন হয়?

ভাবি আসিফের পাশে বসল। নির্বাক। ওদের মুখে সান্ত্বনার কোনো ভাষা নেই। হাসপাতালের পরিবেশটা কেমন যেন ভারি হয়ে উঠল। ডেটলের গন্ধটা মেঝ ফেটে যেন ভুরভুর করে বের হচ্ছে। পঙ্গু হাসপাতালে বাড়তি আর একটা গন্ধও আছে। এ-রকম গন্ধ অন্য হাসপাতালে পাওয়া যায় না। কেমন পচা গন্ধ। হয়তো রোগীদের অ্যাটেন্ডেন্ট রাতে কয়েল জ্বালায় ওয়ার্ডটি এ-রকম গন্ধে ভুরভুর করছে।

আসিফ নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। সে নিরেট নীরবতা ভেঙে এক সময় তার জীবনের স্ত্রীকে জিগ্যেস করল, রোজী কী একসিডেন্টের কথা শুনেছে ভাবি?

ভাবি বলল, হু, শুনেছে।

আবার নীরবতা নেমে এল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। জীবন বিভিন্ন কথা বলতে চাইল কিন্তু গলায় আটকে গেল সব কথা। নিশার মনও ভারি হয়ে গেল। মুখে পড়েছে একটা কালো ছাপ। এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করল না ওর। এখানে থাকলেই যেন বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসবে। কান্নাটা গলার কাছাকাছি এসে আটকে গেছে। সে বলল, আমি এখন আসি। ভাবি আপনারা নাদিম ভাইকে নিয়ে বাসায় আসবেন। আপনারা আসলে মা খুশি হবে। নিশা রুম থেকে বেরিয়ে ওড়না দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে দিল।

নাদিম বলল, খালাম্মাকে একবার দেখে আসলে ভালো হয়। উনি খুশি হবেন।

ভাবি বলল, না, আজকে যাব না। অন্য একদিন যাব। আসিফ বাসায় গেলে একদিন আসব।

জীবন নাদিমকে বলল, চল চা খেয়ে আসি। ওরা রাস্তার পাশে টিস্টলের একটা বেঞ্চিতে বসে চায়ের অর্ডার দিল।

জীবন জিগ্যেস করল, আসিফের চোখ কি আর ভালো হবে না?

নাদিম বলল, ভালো হবার সম্ভাবনা খুব কম। তবে বিদেশে চিকিৎসা করালে হয়তো ভালো হতে পারে, ডাক্তার তাই বলল। ফিফটি ফিফটি চান্স। কিন্তু বিদেশে চিকিৎসা করানোর মতো টাকা তো নেই।

জীবন রগচটা মানুষ হলেও মন খুব কোমল। বিদেশের চিকিৎসার কথা শুনে ওর মাথাটা তন্দুর রুটির উনুনের মত জ্বলে ওঠে। আমাদের দেশের ডাক্তাররা কী ঘোড়ার ঘাস কাটে? কোনো জটিল রোগের কথা বললেই শোনা যায় বিদেশে চিকিৎসা করাতে হবে−এর কারণ কী? প্যারাসিটামল মার্কা চিকিৎসা কবে দূর হবে রে নাদিম? জীবন রাগে-ক্ষোভে যেন কাঁপতে থাকে। কিছুটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, প্রতিটি প্রফেশনে নোংরা পলিটিক্স ঢুকে পড়াতেই দেশে প্রফেশনালিজম ডেভেলপ করছে না। না হয় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্ডিয়ার মানুষ কি স্বর্গ থেকে নেমে আসে? ওসব দেশে চিকিৎসা হলে এদেশে কেন হয় না? রাগে-দুঃখে গজগজ করতে করতে বলল, হবে কীভাবে? নেতাদের সর্দি হলেই তো মাউন্ট এলিজাবেথে গিয়ে শুয়ে পড়ে, বাপের টাকা তো নয়! যদি এদেশে চিকিৎসা বাধ্যতামূলক হতো তাহলেই ভালো হাসপাতালও হতো।

নাদিম বলল, থাক, এসব নীতিবাক্য। নীতিবাক্য ঝেড়ে লাভ নেই। তুই তো ডাক্তার। তুই না-হয় পশুসম্পদ ডাক্তার। তোর প্রফেশনের জন্য কী করছিস তা তুইও ভালো জানিস। এসব বাদ দে।

জীবনের আঁতে ঘা পড়াতে একটু শান্ত হলো। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমরা কেমন বন্ধু হলাম যে ওকে টাকা দিয়েও সাহায্য করতে পারছি না।

নাদিম বলল, টাকা তো বানানো যায় না। কী করবি বল?

জীবন ভাবনায় পড়ে গেল। এক সময় বলল, পত্রিকার মাধ্যমে একটা বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয়? একজন গরিব ইঞ্জিনিয়ারের জন্য তো মানুষ সাহায্য করতেও পারে।

নাদিম বলল, আমি আসিফকে বলেছিলাম একদিন। কথাটা শুনে সে খুব রাগ করেছে। এই কথা তাকে আর দ্বিতীয়বার বলা যাবে না।

জীবনের উৎসাহটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তাই তো আসিফের মত ছেলে মানুষের সাহায্য নেবে— তা কী করে সম্ভব?

জীবন বলল, ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কিছু করা যাবে না।

নাদিম বলল, এই সবই ভাগ্যের খেলা।

জীবন জিগ্যেস করল, আচ্ছা টেলিফোনটা কে করেছিল তার কোনো খোঁজ পেয়েছিস?

নাদিম কথা বলে না। তার সব কথা গলায় আটকে যায়। প্রসঙ্গ পাল্টে কথা বলল। রোজীকে জানিয়েছিস ব্যাপারটা?

হ্যাঁ।

সে তোদের সঙ্গে আসতে পারত। আসতে চায়নি?

আসলে তো রোজীর সঙ্গে কেবল আলাপচারিতা হচ্ছিল। প্রেমের প্রাথমিক অবস্থা। ওর পরিবার আছে। কীভাবে আসবে? তবে মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। খুব ভেঙে পড়েছে।

নাদিম বলল, আসিফ প্রায়ই রোজীর কথা বলে। একবার যদি আসত তাহলে হয়তো ওর সাহস অনেক বেড়ে যেত।

জীবন বলল, দেখি কোনো সময় নিয়ে আসা যায় কি না? ওরা খুব বড়লোক মানুষ। ওদের সমাজ-টমাজই তো আলাদা। বাবা চট্টগ্রামের বিরাট ব্যবসায়ী।

জীবন সিগারেট জ্বালায়।

নাদিম বলল, আমাকেও একটা সিগারেট দে। জীবন জানে নাদিম সিগারেট টানে না। আজকে যখন টানতে চাইছে তাকে সে বাধা দেয়নি। সবকিছু হচ্ছে মনের অস্থিরতা আর অশান্তি থেকে তা বুঝতে পারছে নাদিম। নাদিমের হাতে একটা সিগারেট তুলে দিল।

আসিফের সিটের পাশে একটা ফাইবারের নীল রঙের চেয়ারে বসে আছে ভাবি। একটা লোক পাটের তৈরি বিশালকার মপ দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করছে। একবার মপের কিছু অংশ ভাবির রাঙা পা ভিজিয়ে দিল। ভাবি লোকটার দিকে চোখ বড়ো করে তাকাল। এতে এই লোকের কিছু যায় আসে না। সে সরকারি চাকরি করে। এসব ভিজিটর তার কাছে নস্যি। লোকটি নিজ মনে মেঝের একপাশে থেকে শুরু করে আরেক পাশ মুছে দিল ঝটিকা বেগে। ভাবির দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় আসিফ। এক সময় আসিফ জিগ্যেস করল, ভাবি, রোজী কি চট্টগ্রাম চলে গেছে?

ভাবি বলল, না।

আসিফের একবার জানতে ইচ্ছে করে রোজীর রেজাল্টের কথা। মুখ থেকে প্রায় বের হয়ে আসলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। না, থাক। রেজাল্টের কথা জেনে কী হবে? সে থাক তার মতো। তাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। সে ভালোবেসেছিল এক তরতাজা বুদ্ধিদীপ্ত ইঞ্জিনিয়ারকে। সে ভালোবাসেনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কোনো ইঞ্জিনিয়ারকে। রোজীর জীবনের অশান্তি ডেকে আনার কোনো অধিকার আমার নেই।

ভাবি জিগ্যেস করল, রেজাল্টের কথা জানতে ইচ্ছে করে না?

না, থাক। ওর মতো ও থাক। যত ভাবব তত কষ্ট বাড়বে।

হাসপাতালের এই রুমের বাতাসকে ভারি মনে হয়। নাকের মধ্যে তীব্র নাড়া দেয় ঝাঁঝালো ডেটলের গন্ধ। সে গন্ধের মধ্যে ডুবে যেতে চায় আসিফ। রোগীর আর্ত-চিৎকারের মধ্যে ডুবে যেতে চায় আসিফ। রোজীর সেই রিনিঝিনি শব্দ বুকের ভেতর থেকে উতলে উঠলেও সেগুলোকে সে চাপা দিতে চায় ডেটলের গন্ধে। আসিফ আর কোনো কথা বলে না। অন্ধ দৃষ্টি ফেলে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আজ হরতাল। ছাত্ররা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় দেখা গেল টোকাইদের একটি মিছিল টিএসসি ক্রস করে দোয়েল চত্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভীরু ছাত্রছাত্রী সে মিছিলটির দিকে চেয়ে আছে। স্বৈরাচার এরশাদের পতন হলেই এদেরই বা কী হবে? এদের জীবনের পরিবর্তনের জন্য কে বা কারা কথা বলে? এমন কেউ কি আছে?

প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ছাত্রছাত্রীরা এসে জড়ো হয়েছে টিএসসির কাছে। শত শত ছাত্রছাত্রী —স্লোগানে —স্লোগানে ক্যাম্পাসকে আন্দোলিত করে তুলছে। এটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিল। মিছিলের অপ্রতিরোধ্য স্রোতকে সামাল দিতে পুলিশ বাহিনী টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করেছে। টোকাইদের মিছিলটিও পাশপাশি। টিয়ার শেলের ফলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। একেকটি শেল আসে আর টোকাইরা ক্রিকেট বলের মতো ক্যাচ নিয়ে আবার পুলিশের দিকে ছুড়ে মারল। পুলিশকে হটাতে বা সামলাতে মনে হয় টোকাইরাই যথেষ্ট। এমন বিপ্লবী ওরা!

রোকেয়া হলের গেটে মেয়েরা বালতি ভর্তি করে পানি এনে রেখেছে। যারা টিয়ার গ্যাসের জন্য চোখে দেখতে পাচ্ছে না তাদের চোখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ রুমাল ভিজিয়ে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছাত্ররা চোখে হাত দিয়ে এগিয়ে এলেই ভেজা রুমালটি দিয়ে চোখ চেপে ধরে। মিছিলটি একবার ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পুলিশও বেসামাল হয়ে পড়েছে। যাকে যেখানে পাচ্ছে সেখানেই বেধড়ক পিটাচ্ছে। একবার মেয়েদের হলে ঢুকে পড়ে পুলিশ মেয়েদের লাঠিপেটা করেছে। এই দৃশ্য দেখে ছাত্ররা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। ইট-পাথরের ছোড়াছুড়ি যেন টর্নেডো ওলট-পালট করে দিচ্ছে সব।

পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ছাত্রছাত্রীরা আবার মিছিলে নেমে পড়ল। মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। ‘স্বৈরাচারের গদিতে আগুন, জ্বালো একসাথে।’ ‘এরশাদের চামড়া তুলে নেব আমরা।’ মধুর কেন্টিন, অপরাজেয় বাংলা, টিএসসির প্রাঙ্গণ একই —স্লোগানে মুখরিত। ক্যাম্পাসের সরু সরু পথগুলো মিছিলের পদভারে  প্রকম্পিত।

নাদিমও একটি মিছিলে অংশ নিয়েছে। আকাশের দিকে তার হাত ছুড়ে মারছে। কিন্তু মিছিলে যেন ওর সর্বসত্তা দিয়ে আগের মতো এগুতে পারছে না। মাঝে মাঝেই ওর কণ্ঠ থেমে গেল। মাঝে মাঝে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। আসিফের চিন্তা তাকে টেঁটাবিদ্ধ করে রেখেছে। সে থেমে থেমে এগিয়ে গেল মাত্র। এক সময় সে মিছিলের পিছনের দিকে চলে গেল। শরীরের শক্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

মিছিলের পিছন দিকে নাবিলা দৌড়াতে শুরু করেছে। নাদিমের পিছে পিছে কয়েক কদম গিয়েই হঠাৎ শার্টের কলার চেপে ধরল। নাদিম সাপের মত ফোঁস করে উঠল। কিন্তু নাবিলার চোখে চোখ পড়াতে ঝিমিয়ে পড়ে। নাদিম ও নাবিলা দাঁড়িয়ে রইল’ মিছিলটি আস্তে আস্তে সামনের দিকে চলে গেল।

নাবিলা রাগে তিরতির করে কাঁপছে। তোমাকে মিছিলে যেতে নিষেধ করেছিলাম না?  তুমি আমার নিষেধ শুনোনি, কেন, নাবিলা নাদিমের কলার চেপে ধরেই বলল।

নাদিম নম্র ভাষায় বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যদি জাতীয় আন্দোলনে শরিক না হই তাহলে এদেশের সুস্থ নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করব কীভাবে? জাতীয় আন্দোলনকে এড়িয়ে চলা ঠিক না নাবিলা। তাহলে এদেশের মানুষের সুখে-দুঃখে থাকার কোনো অধিকার যে আমার থাকবে না।

নাবিলা বলল, বুঝলাম তোমার জাতীয় আন্দোলন। কিন্তু লাশ হয়ে যদি ঘরে যাও তাহলে জাতীয় আন্দোলনে শরিক হবে কে? কে করবে তোমার মূল্যায়ন?

নাদিম বলল, কেউ না করুক। এদেশের ইতিহাস তুমি জানো। রক্ত, লাশ, মৃত্যু ছাড়া আমরা কিছুই অর্জন করতে পারিনি। এভাবে লাশের বিনিময়ে একদিন অর্জিত হবে গণমানুষের সত্যিকার অধিকার, গণতন্ত্র। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না।

নাবিলার মুখে কপট হাসি। বলল, নাটকের সংলাপ রাখো। ভাবছ তোমার সাহস দেখে আমি আহ্লাদে গদগদ হবো? এসব বস্তা পচা রাজনীতিকে আমি ঘৃণা করি।

বিস্ময়ের সঙ্গে নাদিম বলল, নাবিলা…।

নাবিলা জোরালোভাবে বলল, না। তোমার কোনো কথা নয়। আমার কথায় আসতে হবে তোমাকে। তুমি কোত্থেকে উঠে এসেছো ভালো করেই জানো। আজকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়াটা… হুম… কীভাবে পেয়েছো তা জানো না? আমি যদি তোমাকে পলিটিক্স থেকে ফিরিয়ে লাইব্রেরিতে না বসাতাম তাহলে তুমি কোথায় থাকতে একবার চিন্তা করে দেখেছো? একটা সেকেন্ড ক্লাস ছাড়া তোমার কপালে কিছুই জুটত না।

নাদিম জানে নাবিলার হস্তক্ষেপের ফলে দুবছর পলিটিক্সের সঙ্গে জড়িত ছিল না। লেখাপড়া আর রেজাল্টের পাওনা স্বীকার করলে নাবিলারই প্রাপ্য।

আমি তোমার কনট্রিবিউশন স্বীকার করি। কিন্তু…

কোনো কিন্তু নয়। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। এই ক্যাম্পাসে আমি তোমাকে টিচার হিসেবে দেখতে চাই। এই ডিপার্টমেন্টে তুমি টিচার হয়ে থাকবে এটিই আমার শেষ চাওয়া।

মনে হলো ফনা তোলা এক বিষধর সাপের মাথায় কঠিন টোকা পড়ল। নাদিম সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওর কোনো কথা নেই।

নাবিলা রাগে কাঁপছে। ক’বছর আগে এই ক্যাম্পাসে এসেছো? কখন তোমার বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল? বয়সকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? পারবে না। তাহলে এটা তোমাদের জাতীয় আন্দোলন হতে পারে না? হুম! রাজনীতি আমার!

চলো, কথা আছে।

কোথায় বসবে?

চলো নিরিবিলি কোথাও। লাইব্রেরির কাছে চলো। নাবিলা একা একাই এই কথা বলল নাদিমকে। নাবিলা আগে আগে যায় আর আর নাদিম পিছনে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির আঙিনা ছেড়ে পাবলিক লাইব্রেরির দিকে পা বাড়াল ওরা। নাদিম কোনো কথা না বলেই নাবিলার অনুবর্তী হয়। নাদিম জানে নাবিলা তাকে আজ অনেক কথা শোনাবে। নাবিলার সঙ্গে ওর অনেক দিন যোগাযোগ নেই। নাবিলা এটা মেনে নিতে পারছে না—সহজেই অনুমেয়।

পাবলিক লাইব্রেরির পশ্চিম পাশে ওরা গিয়ে বসল। নাবিলার চোখ মিটমিট করছে। রাগ-ক্ষোভ-যন্ত্রণায় এমন চোখের পেশি সংকুচিত হলে যা হয়। নাবিলা রুষ্টভাবে বলল, তুমি এতদিন এভাবে এড়িয়ে চলছো কেন? আমি সঠিক জবাব চাই। কোনো প্রকার দুই নম্বরী করবে না।

এড়িয়ে? না তো।

না তো… মানে কী? তিন মাস আমার সাথে যোগাযোগ রাখোনি। একবার দেখা করোনি। একটা খবর জানতে চাওনি। তোমার বাসায় গিয়েও তোমার খোঁজ করতে পারিনি। তোমার কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলতে হবে এখন।

আসিফ অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তাকে একটু দেখাশোনা করতে হচ্ছে। তাই তোমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছি না।

তাই বলে এতদিন? নাবিলা উত্তেজিতভাবে বলে।

হ্যাঁ এতদিন, যত দিন ও ভালো না হয়। তত দিনই আমি ওর পাশে থাকব।

তোমার বন্ধুকে নিয়ে পড়ে থাকবে আর আমার খোঁজ-খবর পর্যন্ত নেবে না? তোমার কাছে আসিফ আমার চেয়ে বড় হয়ে গেল?

আস্তে কথা বল। আমি উত্তপ্ত কথা বলা পছন্দ করি না।

তোমার বন্ধু যদি কোনো দিন ভালো না হয়? তাকে নিয়েই চিরদিন থাকবে?

নাবিলা। আর কোনো কথা নয়।

উত্তেজিত হচ্ছো কেন? আমার কথার জবাব দাও।

তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? আমি কোনো হোপলেস কথা শুনতে চাই না। আমি শুনতে চাই আসিফ ভালো হবে। সবাই বলবে আসিফ ভালো হবে। সে তার দৃষ্টি ফিরে পাবে। আমি এই কথার বাইরে আর কোনো কিছুই শুনতে চাই না। আমি সহ্য করতে পারি না।

তাহলে আসিফই তোমার সব হয়ে গেল? সেটাই বল।

হ্যাঁ, আসিফ হাসপাতাল থেকে না আসা পর্যন্ত তাকে আমার দেখতে হবে, তার সাথে থাকতে হবে। ব্যাস এর বেশি কোনো কথা নয়।

তোমার লেখাপড়া?

গোল্লায় যাক। লেখাপড়ার বদার করি না।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাদিম? মানুষের জীবনে কত রকমের অ্যাকসিডেন্ট ঘটতে পারে। একজন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতেই পারে। তার দায়ভার তোমার কাঁধে নিয়ে বেড়াতে হবে?

হ্যাঁ আমাকে নিয়ে বেড়াতে হবে। কারণ সে আমার খুব প্রিয় বন্ধু।

নাদিম, তুমি বুঝতে চেষ্টা করো।

নাবিলা কিছুটা নমনীয় হয়। তুমি তো জানো আমি তোমার সাথে প্রতিদিন দেখা করতে না পারলে কেমন ভেঙে পড়ি। এলোমেলো হয়ে যাই। সবার সাথে অ্যাবনরমাল বিহেভ করি। এরপরও কেন তুমি তিন মাস দেখা না করে থাকলে? আসিফের দুর্ঘটনার জন্য আমিও মর্মাহত। কিন্তু তুমি আমাকে খরবটা পর্যন্ত দাওনি। আমিও তো তার পাশে থাকতে পারতাম। না কি পারতাম না?

তোমাকে খবর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা আমার ছিল না।

তোমার শরীরের অবস্থাটা একটু খেয়াল করে দেখেছো? কী অবস্থা হয়েছে?

আর শরীর। শরীর বেঁচে থাকে মনের জোরে। যে শরীরে মন মরে যায় সে শরীর বেশি দিন বাঁচে না।

নাদিম ভাবছে আসিফের দুর্ঘটনা সম্পর্কে বলে দেবে কি না। কেন আসিফের এ কঠিন দুরবস্থা হলো? মানুষের সামান্য ইচ্ছের কাছে জীবন কীভাবে ধ্বংস হতে পারে সেটা বলে নাদিম কিছুটা হালকা হতে চাইল। পরক্ষণেই ভাবল না নাবিলার কাছে বলে লাভ নেই। নাবিলা খুব প্র্যাকটিক্যাল। বাস্তববাদী মানুষের কাছে আবেগ, যন্ত্রণা, সুখ-দুঃখের, হাসি-কান্না অর্থহীন। বরং নাবিলার কাছে এই কৌতূহল প্রকাশ না করে চাপা রাখা অনেক ভালো।

কেন তোমার মন মরে যাবে? তুমি এ রকম কথা বলছো কেন?

না, এমনিই বলছি।

আসিফ যদি মরে যেত তাহলে কী করতে? মানুষ কি মরে যায় না?

নাবিলা স্টপ, স্টপ ইউর মাউথ। নাদিমের চোখে মুখে তীব্র উত্তেজনা আর যন্ত্রণার ছাপ। তোমার কোনো কুলক্ষণে কথা শোনার আগ্রহ আমার নেই।

দেখ নাদিম। তুমি এত ভেঙে পড়ো না। এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই। আমিও তোমার সাথে থাকব যতদিন না আসিফ ভালো হয়। চলো আজ আমরা সারা দিন ঘুরে বেড়াই। রিকশায় পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে গুলশান পর্যন্ত। ম্যারাথন জার্নি বাই রিকশা।

না, আমার এসব ভালো লাগছে না। হাসপাতালে যেতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যে আসিফ রিলিজ হবে।

তুমি এত দিন তার সাথেই ছিলে। আজ একটু সময় আমাকে দাও।

না, আমি পারব না।

তাহলে কি তোমার বন্ধু আমার চেয়ে বড় হয়ে গেল?

তুমি আসিফের সাথে নিজেকে তুলনা করবে না। প্রত্যেকের স্থান আলাদা। আমি কারও সাথে তুলনা করা পছন্দ করি না।

প্লিজ নাদিম আজ চলো। তোমার খুব ভালো লাগবে। অন্তত ঘণ্টা দু-একের জন্য চলো ঘুরে বেড়াই। আমিও খুব এলোমেলো হয়ে আছি।

না, নাবিলা। আজ আমাকে দিয়ে হবে না। আমার মন মেজাজ ভালো না।

তাহলে চলো দুজন মিলে রোদে দাঁড়িয়ে থাকি।

কেন?

রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মন ভালো হয়।

তোমার যতসব উদ্ভট কথাবার্তা। পাগলামি।

তুমি যা করছ তাতে পাগল হওয়া ছাড়া উপায় নেই। শোনো রোদে দাঁড়ালে মন ভালো হয়ে যাবে কেন জান?

না, জানি না।

শুনবে?

না, শুনব না। এ রকম পাগলামি কথাবার্তা শোনার ধৈর্য আমার নেই।

পাগলামি নয়। এটা পরীক্ষিত।

নাদিম মনে মনে হাসে। পাগল। আস্তা পাগল। নাবিলা মাঝে মাঝে পাগলামি করে। এমন সব কাজ করে বসে যা সাধারণ মানুষকে ভাবান্তরে ফেলে দেয়। তার কাজগুলোতে আবার যুক্তিও আছে।

এই তো কিছুদিন আগে কার্জন হলের সামনে একটা লোক ফুটপাতে পড়ে ছিল। নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সহানুভূতি দেখাচ্ছে। কেউ কেউ টাকা পয়সাও দিচ্ছে। কেউ কেউ টাকা ছুড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

নাবিলা এই বৃদ্ধ লোকটির হাত ধরে টেনে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিল। জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে নাবিলার সন্দেহ হলো। রাস্তা থেকে টাকাগুলো কুড়াল। সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগল অবাক কান্ড। মেয়েটা করছে কী, কেউ কেউ আস্তে আস্তে বলল। নাবিলার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। লোকটি বলছিল তার খুব ক্ষিধে। খাবারের জন্য টাকা চায়। দুদিন ধরে খায় না। শরীর দুর্বল। তাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।

নাবিলা হঠাৎ আবিষ্কার করল লোকটির পেটের কাছে একটা থলের মতো। সে ওই থলেতে হাত দিতেই লোকটি নাবিলার কাছ থেকে কোনো মতে নিজেকে ছুটিয়ে দিল দৌড়। আর এই কান্ড দেখে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কেউ কেউ বলেছে আল্লাহ্ মাইয়্যা মানুষ বানাইছে একটা। নাবিলা তখন কুড়ানো টাকাগুলো নিয়ে খুব বিপদে পড়েছিল। কী করবে এই টাকা দিয়ে? এক সময় মনে হলো টোকাইদের নিয়ে মজা করা যায়। নাবিলা টাকাগুলো নিয়ে পার্কের ভিতর ঢুকে টোকাইদের ঝালমুড়ি খাওয়ালো।

নাবিলা বরাবরই কৌতূহলী। কোনো কিছুকেই সে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। স্বাভাবিকতার ভিতরে অস্বাভাবিকতা খুঁজে পেয়েই নির্মল আনন্দ পায় সে। সাধারণ নিয়মের বাইরে কোনো কিছু দেখলেই সে কৌতূহলী হয়। চলতে থাকে অনুসন্ধান।

আজ রোদে দাঁড়িয়ে থাকবে আর তাতে মন ভালো হবে এমন কথা নাদিম কোনো দিন শোনেনি। এটা কীভাবে পরীক্ষা করেছে সেই জানে।

নাদিম বলল, নাবিলা আজ বরং চলে যাও তোমার মতো করে তুমি আর আমার মতো করে আমি।

খুব অন্যমনস্ক হয়ে নাবিলা দাঁড়িয়ে রইল। নাদিম দুপা এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়াল। কি, যাবে না?

Series Navigation<< উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চারউপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ছয় পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *