উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ১০ম পর্ব

কী?

মায়ের ছায়াটাই বেহেশ্তের শান্তি। আসিফ আড়ষ্ট গলায় বলে, মা থাকতে বোঝা যায় না। সত্যি যে মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত। এখন বুঝতে পারছি। তুই বুঝতে পারছিস, নিশা?
নিশা চোখ মুছে। কোনো উত্তর দেয় না। পরিবেশটা আরও ভারি হয়ে ওঠল।
আসিফ এক সময় বলল, আমি কোনো টিউশনিও করতে পারব না? ম্যাথে তো আমি খুবই ভালো। কোথাও একটু চেষ্টা করে দেখবি?

নিশা ভাবল টিউশনি করাটা হয়তো সম্ভব। কিন্তু ভাইয়াকে কে নিতে চাইবে? কার মনে এত দয়া আছে? মানুষ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে কিন্তু নিজের সন্তানের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকলে তা কেউ করবে না। সন্তান নিয়ে এই পুঁজিবাদী নাগরিক জীবনে কেউ এক্সপিরিমেন্ট করবে− এমন বুকের পাটা কার? আসিফ পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইল। তারপর নীরবতা। নিশা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে চুপচাপ বসে রইল।

আসিফ বলল, তুই না বলেছিলি একটা ছেলেকে তোর ভালো লাগে। কী হল?
অগ্রগতি অনেক। কিন্তু তুমি মেনে নিতে পারবে কি না জানি না। আমিও ভুল করেছি কি না তাও বুঝতে পারছি না।
কে সে? আমি চিনি?
হুঁ।
কে?
তোমার বন্ধু নাদিম।
আসিফ চমকে ওঠল। হকচকিতভাবে বলল, এটা কী করে হয়? সে তো নাবিলাকে ভালোবাসে। তোর সঙ্গে আবার সে এমন শুরু করছে কেন?
নাবিলার সঙ্গে তার নাকি আর কোনো সম্পর্ক নেই।
কেন? নাবিলা তো খুব ভালো মেয়ে। এমন কিছু ঘটলে তো নাদিম আমাকে বলত। তুই জানিস কেন সম্পর্ক নেই?

না। আমি জানি না। জিগ্যেস করেছিলাম নাবিলার সম্পর্কে। সে বলল, অনেক কারণে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। কারণ বলতে চায়নি। নাবিলা নাকি পরীক্ষার পর সুইডেন চলে গেছে, আর দেশে আসবে না। ওদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগও নেই।

বিষয়টা তাহলে কী হলো? আমাকে বলল না কেন? আসিফ গম্ভীর হয়ে গেল। অকাট্য নৈশঃব্দ্য।
তারপর আস্তে আস্তে আসিফ বলল, ওরা দুজনই খুব জেদি। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। তোরা কতটুকু গড়িয়েছিস তাহলে?
অনেক দূর। সে যখন তখন বিয়ে করতে চাচ্ছে। কী করি বল তো ভাইয়া?

ও আবার আমাদের প্রতি করুণা দেখাচ্ছে না তো? তারপর তার মা তোকে ঘরে তুলবে কি না কে জানে? ওর মা না চাইলে তুই তার ঘরে যেতে পারবি না। তার ইচ্ছার বাইরে অই বাড়িতে কিছু হয় না।

এসব চিন্তা করতে না করেছে আমাকে।
এত দূর গড়িয়ে যাওয়ার আগে বলিসনি কেন?

এসব কী সব সময় বলা যায়? একটা সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যায়?
তা ঠিকই বলেছিস। আমরা তো গাছে কাঁঠাল রেখেই গোঁফে তেল মারি।

এখন তাহলে কী করব ভাইয়া?

তুই-ই সিদ্ধান্ত নে। আমার ওপর ছেড়ে দিস না। আমি এই ভার বইতে পারব না নিশা। আসিফের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। অন্তরাত্মায় কষ্টের একটা সাপ যেন বিষদাঁত বিঁধাতে লাগ। আসিফ আস্তে আস্তে নীল হয়ে যেতে লাগল।
আসিফ আবার বলল, যা করিস চিন্তাভাবনা করে করিস। জীবনের সিদ্ধান্ত বারবার নেওয়া যায় না।

নিশা উঠে গেল কাপ দুটি নিয়ে। তার রুমের পাশে একটা ভাঙা জানালা আছে। সে জানালা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাল। এক সময় মনে হল দূরের আকাশে অনেক সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে কে জানে? কত বিস্তৃত সীমাহীন আকাশ মেঘের নীড়। নিশা ভাবে চার দেয়ালের বাইরে যদি কোনো দিন বের হয়ে এভাবে আকাশে উড়ে বেড়ানো যেত- মুক্ত হয়ে ফুরফুরে মনে। কিন্তু তা কি কোনো দিন হবে?

আসিফ কী যেন ভাবল। সেও উঠে এসে নিশার জানালার পাশে এসে বলল, তুই কি এখানে আছিস?
নিশা বলল, হুঁ। এখানে একটু দাঁড়াবে?
আমি একটু দাঁড়াই। ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল এক সাথে পাশাপাশি। নিশা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
আসিফ বলল, তুই হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছিস তাই না?
হুঁ।

আমি একবার ভাবতাম যখন ছাত্র ছিলাম, এই বাড়িটা বিক্রি করে খোলা জায়গায় একটা বাড়ি বানাব, যে বাড়ির বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যাবে। সকালের কাঁচা মিষ্টি রোদ খেলবে খোলা বারান্দায়। বাড়ির পাশে গাছ থাকবে। পাখি আসবে, গান গাইবে। কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ হয় নাÑতাই না রে নিশা?

মানুষের সব স্বপ্নই পূরণ হয় যদি স্বপ্ন ভালোভাবে দেখে। তুমি কী পচে গেছো? তুমি কি পারবে না একটা বাড়ি বানাতে?
বাড়ি বানাতে পারলেও আকাশ তো দেখতে পারব না।
আকাশ তো শূন্য– এটা না হয় না-ই দেখলে। শূন্যতাকে দেখে লাভ কী?
লাভ আছে। আকাশ দেখলে মানুষের মন বড় হয়।

যাদের এম্নিতেই মন বড় তাদের আকাশ দেখে মন বড় করার প্রয়োজন হয় না। তোমার চোখ কোনো একদিন ভালো হবেÑ এটা আমার বিশ্বাস। তুমি অস্থির হয়ো না। আমি প্রায় রাতেই স্বপ্নে দেখি তোমার চোখ ভালো হয়ে গেছে। একজন বিদেশি ডাক্তার এসে তোমার চিকিৎসা করে তোমার চোখ ভালো করে দিয়েছে।

আসিফের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। সে বলল, এটা কি সম্ভব?

আমি একদিন সম্ভব করে তুলব। প্রয়োজন হলে আমি আমার একটা চোখ তোমাকে দিয়ে দেব। তবুও তুমি খুব বেশি দুশ্চিন্তা করো না, ভাইয়া। নিশার চোখ ভিজে গেছে। সে আস্তে আস্তে বলল, আমার আর কে আছে? বাবাকে ভালোভাবে দেখার আগেই বিদায় হলো। মাও গেল। তুমি ছাড়া আমার এখন আর কে আছে? আসিফ নিশার দিকে হাত বাড়া। নিশাও যেন ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে একটু কাঁদার জন্য অপেক্ষাই করছিল। সে তার ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

পরপর তিনটি ঘটনা ঘটে গেল। একটি হল নাদিম আর নিশা কাজির অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলল। দ্বিতীয়টি হল নাদিমকে তার মা বাসা থেকে বের করে দিলেন এবং তৃতীয়টি হলো নাদিম নিশাকে নিয়ে নিশাদের বাসায় নতুন জীবন শুরু করল।

নাদিমের মা এখন নাদিমের ভাইকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। তিনি নাদিমকে বাসা থেকে বের করে দেওয়ার সময় বলেছিলেন, আমি মনে করলাম তুই মরে গেছিস। নিশার মতো মেয়ে নাদিমদের সামাজিক মর্যাদায় দাঁড়ানোর মত অবস্থাও ছিল না। সে তার বাসা ছেড়ে আসিফদের বাসায় চলে আসার পর আসিফ বিভিন্নভাবে নাদিমকে বোঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এখন তার সব কিছুই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। নাদিমকে আগের মত বন্ধুই সে ভাবে। নিশার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেটা ওদের ব্যাপার। ওরা মানিয়ে চলতে পারলে চলবে, না পারলে না চলবেÑ তাই বলে বন্ধুত্বকে সে খাটো করে দেখবে? তা হয় না। আসিফ যখন হাসপাতালে ছিল তখন নাদিম যে কষ্ট করেছে তার প্রতিদান দিতে গেলে এক জীবন দিয়েও শোধ হবে না। অন্তত তিনটি জীবনের প্রয়োজন।

নিশার টিউশনি এখনো চলছে। নাদিম ঢাকার একটা কলেজে অবৈতনিক কাজ শুরু করেছে। কমিটির চেয়ারম্যান নিশাদের দূর-সম্পর্কীয় এক আত্মীয়। তিনিই নাদিমকে ডেকে পাঠিয়ে কলেজে পড়ানোর কাজে লাগিয়ে দিলেন। শর্ত হলো কলেজ থেকে একটা লামসাম বেতন দেওয়া হবে এবং পরে রেজাল্ট বের হলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। নাদিম তাতেই রাজি হয়ে কাজে লেগে গেল।

বিয়ের কয়েক দিন পরে রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ওরা আসিফের পাশে বসে খোশ গল্প করছিল। এক পর্যায়ে নাদিম বলল, আমাদের তিন সদস্যের সংসদÑনিশাকে স্পিকার বানিয়ে দিই, কি বলিস আসিফ?

আসিফ হাসে। হাসলে এত সুন্দর দেখা যায় যে, এমন সুন্দর আসিফকে নাদিম মনে হয় আর কোনোদিন দেখেনি। নাদিম চেয়ে থাকে আসিফের দিকে। অসহায়ত্বের মধ্যে নির্ভেজাল নির্মল নিষ্পাপ হাসির মধ্যে কি যে নিবিড় আকর্ষণ! এই আকর্ষণ এখন পৃথিবীর মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে বদ্ধ ঘরের মধ্যে আবদ্ধ।
হ্যাঁ তা দে। তবে আমি বিরোধী দলের নেতা। আমার সুযোগ সুবিধা কম হলেই ধর্মঘট শুরু হয়ে যাবে।
অনেকদিন পরে মনে হয় একটা প্রাণখোলা হাসি বেরিয়ে এলে বর্ষার প্লাবনের মতো তার বুক থেকে। দাহিত বক্ষ পিঞ্জরের যন্ত্রণাকে নি®কৃতির জন্য এমন হাসির জরুরি প্রয়োজ।

নিশা আসিফের উদ্দেশ্যে বলল, ধর্মঘট করে আমাদের উন্নতির বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবি না।

আসিফ বলল, ধর্মঘট, হরতাল না করলে তোরা যা ইচ্ছে তাই করবি। বলবি মুই কি হুনুরে। তাই মাঝে মাঝে জানাতে হবে যে তোদের বিরুদ্ধে কথা বলারও লোক আছে। যাক আমাদের দুটি পদ হলো, এখন নাদিমকে কোন পদটি দেওয়া যায়?

নাদিম নিজে বলল, আমি সরকারি দলের নেতা অর্থাৎ সংসদ নেতা।
নিশা বলল, আমাদের একটা সংবিধান থাকা দরকার।

নাদিম উত্তর দিল, তার দরকার নেই। ব্রিটেনের অলিখিত কনভেনশনের মত আমাদের সংসার নামের সংসদটি চলবে। আসলে মাঝে মাঝে ভেবে আশ্চর্য হই যে, ইংল্যান্ডের মতো একটা দেশে সংবিধান নেই। থাক সে কথা, এখন চা নিয়ে এসো।

নিশা চা বানাতে কিচেনে চলে যাওয়ার পর আসিফ বলল, নাদিম সত্যি করে একটা কথা বল তো। তুই কি আমার প্রতি করুণা দেখিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্তটি নিয়েছিস? নাবিলাকে তুই কি ভুলতে পারবি? কোথায় নাবিলা আর কোথায় নিশা?

নাদিমের কথা আটকে গেল। নাবিলাকে ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়। কিংবা দীপালীর মিষ্টি ছোট ছোট কথা তাও সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষের চাওয়াকে যদি সীমিত করে ফেলা যায় তাহলে সবই সম্ভব। মানুষের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই তো সমান। বৈচিত্র্য শুধু মন আর মননে। বাইরের রূপে দৃষ্টি ভরে কিন্তু হৃদয় ভরে না। তাছাড়া সব কিছুর ওপরে হলো স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আবেদন। নিবিড় আকর্ষণের এক অনুপম অনুভূতি। নিশার কাছে স্ত্রী হিসেবে যে আবেদন থাকার কথা তা আছে। সংসার জীবনে সুখ পাওয়ার আর কী প্রয়োজন?

নাদিম বলল, নাবিলা বিদেশে চলে গেছে। আর আসবে না। পরম কিছু পাওয়ার উচ্চাভিলাষ আমার নেই। নিশাকে বিয়ে করেছি তোর প্রতি করুণা করে এমন চিন্তা তোর করা উচিত নয়। নাদিম মনে মনে ভাবল, একটু মিথ্যা বানিয়ে বলতে হবে। সে বলল, নিশাকে যখন নিবিড়ভাবে জানলাম তখন আমি মনে করলাম নিশা খুবই ভালো মেয়ে। তাছাড়া আমাদের বন্ধুত্বের জন্য হতে পারে নিশা সেতুবন্ধন। এতে দুর্ভাবনার কী আছে?

তুই খুব বড় মনের মানুষ। তোকে আগে এতটা বুঝিনি। তোর মতো যদি পৃথিবীর সব মানুষ হতো তাহলে আমি আল­াহর কাছে প্রার্থনা করতাম বেহেশতের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতেই আমাদের থাকতে দাও।

নাদিম হাসল। বেশ বলেছিস। এভাবে আর বলবি না, তাহলে হয়তো অহংকারের দাপটে হাওয়া হয়ে যাব।
এখন আমার একটা কাজ জুটিয়ে দে। এভাবে আর চলতে পারছি না। সময় কাটে না।
রোজীকে খবর দেব?

চোখের পলকে আসিফের মুখ ম্লান হয়ে যায়। বুক চেরা নিশ্বাসের শব্দ ছড়িয়ে পড়লো বদ্ধ ঘরে। নাদিম ভাবে, এমন করে তাকে ম্লান করে দেওয়ার কোনো অধিকার আমার নেই।

রসিকতা করিস? আমি যদি একবার জানতে পারতাম রোজী কেমন আছে, কোথায় আছে তাহলে খুব খুশি হতাম। আসিফ থামে কিছুক্ষণ। সে আবার বলল, সে তো আর আমার ধারেকাছেও নেই। আসিফের বুক ভারি হয়ে ওঠে। মুখের আদলেও পরিবর্তন দেখা দিল।

নাদিম ভাবে এমন করে আর তাকে খুঁচিয়ে লাভ কী? এ যেন আহত সৈনিকের রক্তাক্ত দেহে বেয়নেটের খোঁচা। গতকালও নাদিম দেখেছে আসিফ বালিশের নিচ থেকে রোজীর ছবিটি বের করে একা একা কথা বলছে। রোজী আমি তোমাকে চোখ ভরে দেখে নেওয়ার আগেই আল্লাহ আমার চোখের আলো তুলে নিল। তখন নীরব কান্নার অঝোর ধারা বয়ে গেলো তার বুকে। তারপর জেগে থেকে সাজায় কবিতার পঙ্ক্তি।

একটা কাজ করা যায়। তুই যেসব কবিতা লিখেছিস এগুলো পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেখা যায় ছাপা হয় কিনা? যদি ছাপা হয় তাহলে লেখালেখিকেই প্রফেশন হিসেবে নিয়ে নে। ছাত্র জীবনে তুই তো গল্পটল্পও লিখতে সেগুলো কোথায় আছে? একবার বলেছিলে উপন্যাস লিখবি সেগুলোরই কী অবস্থা।

আসিফ যেন লজ্জায় মুখ লুকোতে চায়। আমার লেখা পত্রিকায় ছাপাবে? তাহলে তো ছাগলের ডাকও ছাপা হয়ে যাবে?
আরে দেখ না দিয়ে। দিতে আপত্তি কোথায়?
পরিচিতি ছাড়া লেখা ছাপে না কেউ। অরণ্য রোধন করে লাভ আছে? তারচেয়ে একটা কাজ দেখ আমি কাজটাজ কিছু করি। এভাবে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না।

আচ্ছা ঠিক আছে তোর কয়েকটা কবিতা আমি পত্রিকা অফিসে নিয়ে যাব। আমার মনে হয় তোর লেখা কবিতাগুলো ভালো। অনেক ভালো। ভালো লেখা হলে অবশ্যই ছাপবে। আর উপন্যাসের ব্যাপারটা ভাবনায় নিয়ে আয়। মানুষের জীবনে একটা বই হিট হলেই হয়। বাকি জীবন বসে খাওয়া যায়। তারপর লেখালেখিকেই প্রফেশন হিসেবে নিতে পারবি।

নিশা চা নিয়ে আসে। নাদিম নিশাকে তাদের আলোচনার রেশ ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমার কী ধারণা নিশা?
নিশা জবাব দেয়, চেষ্টা করে দেখতে তো আর মানা নেই। চেষ্টা করতে তো আর পয়সা খরচ হয় না।
নাদিম টেবিলের ওপর থেকে নোট বইটা নিয়ে আবৃত্তি শুরু করল। আসিফ মনে মনে হাসল। তোকে সত্যি ভূতে পেয়েছে, বলল আসিফ।

আসিফ নাদিমকে আজও অনুরোধ করে আরও কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করতে। নাদিমের মাথায় অন্য বুদ্ধি এল। দেখি তো ক্যাসেটে ক্যামন শোনা যায় আমার আবৃত্তি। যদি ভালো শোনা যায় তাহলে আবৃত্তির ক্যাসেট বের করব। তোমাদের ব্রিটিশ আমলের ভাঙা ক্যাসেট প্লেয়ারটা নিয়ে এসো দেখি।

নিশাও আর কম পাগল কীসে? সে তাদের ভাঙা ক্যাসেট প্লেয়ারটা নিয়ে এল। পুরনো একটা ক্যাসেট নিশা দিল প্লেয়ারে।

নাদিম গভীর মনযোগ দিয়ে আবৃত্তি করে এবং রিউইন্ড করে প্লেয়ার বাজায়। তেমন ভালো শোনা গেল না। তারপর আবার মাঝে মধ্যে নিশার হাসি হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ শোনা যাচ্ছে। আর যা হোক আসিফ আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিল শোনা হলো তো। নাদিম নিজেই বলল, ক্যাসেটে আমার চিকা মার্কা গলা এত ভরাট শোনা গেল কেন? খুবই চমৎকার হয়েছে। তিনজনেই হো হো করে হেসে দিল। সে রাতটা তিনজনের হৈ হল্লাতেই কাটল।

পরদিন সকাল বেলা নিশা বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ও একটা বাজারের ফর্দ্দ ধরিয়ে দিল নাদিমের হাতে। এই হয়তো জীবনে প্রথম বাজারে যাওয়া। এর আগে সে কোনো দিন বাজারে গেছে বলে মনে হয় না।

নাদিম জানে এ টাকা দিয়ে এই ফর্দ্দের বাজার করতে যাওয়া দোকানির কথা শুনতে হবে। তবুও উপায় নেই। সংসারের হাল যে নাদিমের হাতেই। আজ তো আর কাউকে বলা যাবে না বাজারের খরচের কথা।

বাজার করতে গিয়ে নাদিমের নতুন অভিজ্ঞতা হলো। কোনো কোনো জিনিস গোটাটা কিনতে হয়। নাদিম এগুলোর ধারে কাছেও যায়নি। দুটাকা এক টাকা করে সওদা কিনতে গেলে দোকানিরা চেয়ে থাকে। তারা বলে, ‘কি কন স্যার এত কম জিনিস কেউ কিনে?’ নাদিম আস্তে আস্তে বলল, ভাই আমরা তিনজন মানুষ বেশি নিলে নষ্ট হয়। আমাদের ফ্রিজ ট্রিজ নাই। দেন না ভাই। মাছ কিনতে গিয়েই নাদিম বিড়ম্বনায় পড়ল। অনেক দিন ধরে ওরা মাছ খেতে পারে না। নাদিম মনে মনে ভাবল নিশা এতদিন সংসার কীভাবে চালাত? আজও মাছ কেনা যাবে না। বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাদিম চিন্তা করে – চা খাওয়াটা বাদ দিলে মাছ খাওয়া যেতে পারে। পরক্ষণেই আসিফের কথা মনে হয় তার। ও তো চা না খেয়ে থাকতে পারবে না। এই সময় একটা লোক হুমড়ি খেয়ে নাদিমের ওপর পড়ল। লোকটা আবার নাদিমকেই ধমক দিল। বাজারের মাঝখানে দাঁড়ায়ে থাকেন ক্যান? কবি টবি নাকি? লোকটা একটা ত্যাঁদর– মুখের ভাঁজ দেখে বোঝা যায়। নাদিম কিছু না বলে অন্য দিকে চলে গেল। নাদিম ভাবল, ডাল বেশি করে কিনে নিই ডালের প্রোটিনেই চলে যাবে। সে মাছ কেনার যে সামান্য টাকাটা ছিল তা দিয়ে ডাল কিনে নিল।

নাদিম বাজারে চলে আসার পরপরই নাদিমের বাবা এসেছেন নিশাদের বাসায়। চার পাঁচটি পত্রিকা বগলের নিচে। কয়েক কেজি কমলা, আপেল আর গোটা ত্রিশেক বড় বড় কৈ মাছ। তিনি এই প্রথম এলেন।

নিশাকে কাছে বসিয়ে আদর করতে করতে তার বাবা বললেন, নাদিম খুব ভালো। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। কতদিন দেখি না ছেলেটাকে বুকটা ফেটে যাচ্ছে মা। ওর মা এক জ্যান্ত আজরাইল। এমন সোনার ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, বলো? ব্যাগের মাছগুলো দেখিয়ে বললেন, কৈ মাছ ওর খুব প্রিয়, এ জন্যই এনেছি। তুমি ভাজি করোÑ আমরা সবাই এক সাথে খাব আজ। নাদিমের বাবার কথা শুনে নিশা যেন আকাশের চাঁদ পায় হাতে। বাপ-মা এমন না হলে হয়? বাবা এতো ভালো হতে পারে?

নাদিমের বাবা নাদিমকে এত ভালোবাসে আগে কোনো দিন সে বুঝতে পারেনি। বাজার থেকে যখন ফিরে এল তখন নাদিমকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার বাবা শিশুর মতো কাঁদলেন। কোনো কথা বলতে পারেননি। কেন কাঁদলেন তাও বোঝা গেল না। হয়তো নাদিমের কষ্টটা তিনি সহ্য করতে পারছেন না, এ জন্য হতে পারে। নাদিমরা তো কোনো দিন অভাবের মুখ দেখেনি। আজ হয়তো নিশাদের বাসায় এসে কিংবা নিশাদের খবর তো রাখেন−সে দুঃখবোধ থেকেই হতে পারে।

নাদিমের বাবা এমনিতেই কথা বলেন কম। তার ওপর বাড়তি শিশু-সুলভ আবেগ যোগ হওয়াতে আর কোনো কথা বলতে পারেননি। কান্না সংবরণ করে বললেন, বাসাটা ঢুলিকে দিয়ে দেবে। তিনি (নাদিমের ভাইকে তিনি ঢুলি ডাকেন। নাদিমকে ডাকেন সানাই। কারণ, ছোট সময় নাদিমের বড় ভাইয়ের পেটটা ঢোলের  মত বড় ছিল আর নাদিম খুব কাঁদত। এই জন্য তাদের এমন নাম দেওয়া হয়েছিল। তার বাবা এই নামে এখনো ডাকেন।) তার বাবার কথা শুনে নাদিম নিরুত্তাপ। কোনো বৈভবের তার দরকার নেই। সে ভেবেচিন্তেই এখানে এসেছে। নাদিম ভাবল, ঢুলিকে বাড়িটা লিখে দেবে বলেই কী তার বাবা কাঁদলেন? বাড়িটা তার মা লিখে দিতে পারেন। কারণ, এই বাড়ি নাদিমের বাবার কাছ থেকে ওনার নামেই লিখিয়ে নিয়েছিলেন মা। তাও হতে পারে। হতে পারে ছেলেটার কষ্ট দেখে। কেন কাঁদলেন তা নিয়ে আর চিন্তা না করে স্থির হয় নাদিম।

নিশা রান্নাঘরে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন অতিথিকে কীভাবে খাওয়াবে, কী খাওয়াবে? বাসায় যে তেমন কিছুই নেই। আদরের ভাত নুন দিয়েও ভালো। নিশা তার সাধ্যমত চেষ্টা করল শ্বশুর বাবাকে যত্ন করার জন্য। শুধু কৈ মাছের ভাজি দিয়ে কী ভাত খাওয়া যায়? সঙ্গে কৈ মাছের ঝোল, ডাল, বেগুন ভাজি  মন্দ নয়।

দুপুরে সবাই এক সঙ্গে খেতে বসল। খেতে খেতে নাদিমের বাবা বললেন, তোর মা কোনদিন আসবে না। বুঝলি সানাই। আস্ত জানোয়ার তোর মা। নাদিম কথা বলল না। সানাই শব্দটা শুনে নিশা মুখ লুকিয়ে হাসল।

খাওয়ার পর নিশাকে কাছে বসিয়ে নাদিমের বাবা আবার বললেন, এটা একটা জানোয়ার। আমাকে বলতে পারত তোদের বিয়ের কথাটা। না, তা বলেনি। মেয়েটাকে খালি হাতে বিয়ে করেছে সানাইটা। বাবা হয়ে মেনে নেওয়া যায়? লজ্জায় নিশার মাথা নুয়ে পড়ছে। আসিফ নাদিমের বাবার কথা শুনে হাসল। নাদিমের বাবাকে আসিফ অনেক দিন আগে থেকেই চিনে, একজন গম্ভীর আধ-পাগলা লোক হিসেবে। লেখাপড়া ছাড়া কোনো কিছু বোঝেন না। অফিস থেকে এসেই পড়তে বসাÑতারপর কোন রাতে শেষ হয় উনি ছাড়া কেউ জানেন না। কী পড়েন, কেন পড়েন তা তিনি বলতে পারবেন। এমন পড়াসক্তির মানুষ দুনিয়াতে দেখা যায় না ।

নাদিমের বাবা পাঞ্জাবির পকেটে সযত্নে রাখা একটা নেকলেস খুব সাবধানে বের করে নিশার হাতে তুলে দিলেন। এত সুন্দর নেকলেস দেখে নিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

নে পর মা, পর, দেখি কেমন দেখায় তোকে, নাদিমের বাবা বললেন। নিশা নেকলেসটি পরে। তার বাবার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে একটা স্নিগ্ধ প্রসন্ন হাসি। তারপর অন্য পকেট থেকে কানের ঝুমকা, হাতের চুড়ি … ইত্যাদি। চোরে নিয়ে যাবে ভেবে তিনি এগুলো বিভিন্ন পকেটে রেখেছেন। কোনোটারই বক্স নেই। মনে হয় এগুলো বক্সে রাখলে কেউ দেখে ফেলতে পারে– সে জন্যই হয়তো এমন ব্যবস্থা।

নাদিম দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে তার বাবার কর্মকান্ড। পিটপিট করে হাসছে। নিশার কাছে নাদিমের বাবাকে খুব ভালো লাগল। পুত্রবধূকে প্রথমদিনই তুই করে ডাকার মধ্যে যে আনন্দ তা শুধু নাদিমের বাবাই উপভোগ করেননি বরং উপভোগ করেছে এ বাসার সবাই।

যাওয়ার সময় পত্রিকার প্রত্যেকটি পাতা একটা একটা করে গুনে নিলেন। লোকটার আশ্চর্য ধীশক্তি। এমনভাবে দেশ-বিদেশের খবর মনে রাখেন যে একজন কূটনীতিকের পক্ষেও এতসব খবর রাখা সম্ভব নয়। নাদিম অনেক দিন পরীক্ষাও করেছে তার বাবাকে। স্কুলে পড়ার সময় তো এটা ছিল একটা বাতিক। অনেক পুরনো বাসি কথা নিয়ে তার বাবার কাছে গেলে ঝরঝরে তরতাজা করে দিতেন তিনি। এমন কী কোন মাসে কতগুলো খুন, ছিনতাই, রাহাজানি হয়েছে কিংবা কতটা মেয়ে এসিডদগ্ধ হয়েছে এসব খবর পর্যন্ত বলে দিতে পারতেন। এমন আশ্চর্য মানুষ দুনিয়াতে আর আছে কি না সন্দেহ।

নাদিমের মা পত্রিকা পড়া নিয়ে কত রাগারাগি করেছেন তার কোনো সীমারেখা নেই পর্যন্ত। কেন এতগুলো পত্রিকা পড়বে– কী হবে এসব পত্রিকা পড়ে– এই তার অভিযোগ। মাঝে মাঝে রাগ করে পত্রিকা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বলতেন, যেন পরীক্ষার পড়া পড়ছে। এতে নাদিমের বাবা মন খারাপ করতেন। কিন্তু নিরীহ গোছের এই ভদ্রলোক কিছু বলতে পারতেন না অগ্নি মেজাজী স্ত্রীর সামনে। রাগে দুঃখে তিনি পার্কে গিয়ে বসে থাকতেন। তারপর পত্রিকা তারিখ অনুযায়ী জমিয়ে রাখা– একটা রুম ভরে গেছে– এসব নাদিমের মার কাছে অসহ্য।

নাদিমের মা প্রায়ই ঝগড়া করেন পুরনো পত্রিকা জমিয়ে রাখলে কী হবে? প্রথম দিকে তার বাবা তথ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝিয়েও কোনো লাভ হয় না দেখে পরে আর বোঝাতে চেষ্টা করেন না। মনে মনে বলেন, মূর্খকে বুঝিয়ে লাভ কী? নিজেই নিজের মত করে তিনি পত্রিকা গুছিয়ে রাখেন একটা রুমে। রুমটা আস্তে আস্তে এখন এসব পত্রিকার দখলে এখন চলে এসেছে।

একদিন আসিফের কয়েকটি কবিতা নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে নাদিম। ভদ্রলোক যদিও সাহিত্য সম্পাদক কিন্তু সাহিত্যের প্রতি কোনো ঝোঁক আছে বলে মনে হলো না নাদিমের। মনে হয়েছে চাকরির জন্যই এই পদটি দখল করে আছে। হয়তো সম্মাদকের কোনো আত্মীয় স্বজনও হতে পারে। পত্রিকাটি অবশ্যই খুব খ্যাতনামা নয়। নাদিম এই ভেবে এই পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখা করেছে যে নামিদামি পত্রিকায় আসিফের কবিতা হয়তো ছাপা হবে না। তাই ছোট পত্রিকা থেকেই শুরু করা।

ভদ্রলোক বলেন, রেখে যান। যৌবনে তো কবিতা সবাই লিখে। লিখতে হয়। না লিখলে চলবে কি করে? হরমোনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এত তীব্র যে যুবকগুলো খুব অস্বস্তিবোধ করে। বিয়ে করে ফেললে হরমোনের আর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকে না– তখন অনেক কবিই হয়ে যায় হাওয়া।

তিনি আবার বলেন, বুঝলেন, বিদেশিরা অল্প বয়সেই সেক্স করা শুরু করে দেয় বলে ওসব দেশে কবির সংখ্যা অনেক কম। ওরা এত কবিতা-টবিতার ধার ধারে না। হরমোনের বাড়াবাড়ি নেই। বাংলাদেশে যত কবি আছে পৃথিবীর সব দেশের কবি মিলিয়ে এত পাওয়া যাবে না।

লোকটার বাড়তি প্যাঁচাল নাদিমের কাছে ভালো লাগেনি। অতিরিক্ত কথা বলে হীনম্মন্য লোকেরা। যারা নিজেদের সম্পর্কে কিছু জানে না এমন কূপমণ্ডুক লোকেরাই অকাজের কথা বলে বেশি। শূন্য হাঁড়ির ঝনঝনানি। নাদিম ভাবে ভদ্রলোককে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই।

Series Navigation<< উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ৯ম পর্বউপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ১১ম পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *