উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ৯ম পর্ব

ফিরলে নাদিমের মা খুশি হয়েছেন তা চোখ-মুখ দেখলেই বোঝা যায়। তিনি মনে মনে ভাবলেন, হয়তো ওদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। পরদিন বিকেলে নাদিম ইউনিভার্সিটি থেকে এসে দেখে তার বাবা চার পাঁচটা পত্রিকার মাঝে ডুবে আছেন। বাসাটি ফাঁকা। দীপালীকে কিংবা তার মাকে বাসায় দেখা যাচ্ছে না। নাদিম তার বাবার কাছে এসে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার বাবা, মা কোথায়? পত্রিকা থেকে মুখ তুলে নাদিমের বাবা নাদিমকে দেখলেন। কথা বলতে যেন তার প্রচণ্ড অনীহা। মনে হচ্ছে খুব কষ্ট করে বলেন, সাদিয়া খুব অসুস্থ।

সাদিয়া দীপালীর মা। দীপালীর বাবা নেই। মেয়েটি খুব দুঃখী। হঠাৎ মায়ের এমন অসুখ হলো কেন?
নাদিম জানে অযথা কথা বলার কোনো আগ্রহ তার বাবার নেই। তিনি কথা বলেন খুব কম। একেবারে জরুরি কিছু না হলে কিছু বলেন না। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই তাকে পাগল বলে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নাদিম ভাবে দীপালীর সামান্য একটা ইচ্ছাও পূরণ হলো না তাহলে।

নাবিলা আগের উচ্ছলতা হারিয়ে নির্জীব হয়ে পড়েছে। মনে হয় দেহে কোন প্রাণ নেই। বাসায় কারো সাথে তেমন ভালো আচরণ করে না। কথাও বলে কম। মনে হচ্ছে জীবন তার কাছে একটা বোঝা। সে নাদিমকে কোনভাবেই ভুলতে পারছে না। আর নাদিমের অবহেলা তাকে বিষিয়ে তুলছে। নাদিমের কাছে চূড়ান্তাভাবে হেরে গেছে সে জানে তবে এ নিয়ে নাদিমের সঙ্গে সে আর কোন কথাও বলতে চায় না। সব কথাই যেন শেষ হয়ে গেছে। নাদিমের এই প্রত্যাখ্যান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না আবার কোনো কিছু করতেও পারছে না। বুকের ভিতরের ঘুমন্ত অজগর ফুঁসছে আর বংশবিস্তার করে যাচ্ছে।

নাবিলা কখনো ভাবে নাদিমের ওপর প্রতিশোধ নেবে। তাকে একটা চরম শিক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজনে সুইসাইড করে হলেও তাকে শিক্ষা দিতে হবে। ইদানীং সে প্রায়ই ভাবছে আমাকে যে আগুনে সে পোড়াল আমিও তাকে সে আগুনে পোড়াব। আবার নিজেকে সামলিয়ে আবার ভাবল, না তা কেন হবে? আমি যে নাদিমকে ভালোবাসি। তাকে কেন আগুনে পোড়াবো আমি? গত রাতে নাবিলা সুইসাইড করার একটা প্ল্যান করেছিল। একশ সিডাক্সিন খাবে। বুকের ওপর থাকবে নাদিমের একটা ছবি। এই ছবিটা ওরা এক সময় ডিপার্টমেন্টের এক পিকনিকে তুলেছিল। বড়িগুলো খাওয়ার আগে লিখবেÑ ‘নাদিমের জন্য আমি আত্মহত্যা করলাম। আমরা তিন বছর প্রেম করেছিলাম…। সিডাক্সিন কীভাবে সংগ্রহ করবে তারও একটা পরিকল্পনা করে নাবিলা। রাত তখন গভীর। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নাবিলা বাইরে এসে একবার পৃথিবীটা দেখে নেয়। আস্তে আস্তে পৃথিবীর প্রতি তার একটা ভালোবাসা জন্মে। তখন সে ভাবল মানুষকে জোর করে আটকে রাখা যায় না। যে যেতে চায় সে চলে যাক। পরিকল্পনা অনুযায়ী আত্মহত্যার আর কাজটি হয়নি।

প্রায়ই মধ্যরাতে নাবিলা ব্যালকনিতে হাঁটাহাঁটি করে। নাবিলার মা-বাবাকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে বিষয়টি। মেয়েটি অসম্ভব জেদি বলেই নিজেকেই নিজে সামলাবে বা নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে অন্যদের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। তার মা-বাবাও জানে নাবিলাকে কোনো কিছু বলে করানো সম্ভব নয়। সেই শিশু বয়স থেকেই দেখে আসছে তারা নাবিলার জেদের মাত্রা কতদূর গড়াতে পারে। মধ্যরাতে ব্যালকনিতে পায়চারি কেন? একদিন নাবিলার বাবা এসে দাঁড়ালেন নাবিলার পাশে। একটু ভেবে তিনি জিগ্যেস করলেন, শরীর খারাপ করেছে তোমার?

না তো।
এত রাত ঘুমুতে যাওনি, কী ব্যাপার?
না, কিছু না। দেখছি আর ভাবছি বাবা।
নাবিলার বাবা হাসেন। কী দেখছো আর কী ভাবছো?
চাঁদ ক্যামন অপূর্ব তাই না? জোছনা ভালোভাবে দেখিনি কোনোদিন। তুমি দেখেছো কোনোদিন সারারাত জেগে?
নাবিলার বাবা বললেন, না, এমন তো কোনোদিন হয়নি। সারারাত জেগে চাঁদ দেখার কাজটি হয়নি।
আমি কী ভাবছি জানো?
কী ভাবছো?

ভাবছি একটা চাঁদকে উপভোগ করব উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত। যখন উদয় হবে তখন থেকে অস্ত যাওয়া অব্দি আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকব। মাঝে মাঝে চাঁদের সাথে হাঁটব। এমনটি তুমি কোনোদিন করেছো?
পাগল মেয়ে। এমনটি কেউ কোনোদিন করে? যাও, ঘুমুতে যাও। এসব পাগলামির কোনো মানে আছে?
আছে। একটা চাঁদ কীভাবে বাড়ছে, ক্ষয় হচ্ছেÑএটা শুধু বই পড়েই জানব? নিজের চোখে দেখব না? আমি দেখব বাবা তুমি ঘুমুতে যাও। আমি এর শুল্কপক্ষ থেকে কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত দেখব। তাই প্রতিদিন এখন সন্ধ্যা হতেই ব্যালকনিতে থাকি।

নাবিলার বাবা জানেন মেয়েকে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই। এ এত সহজ মেয়ে নয় যে বাবার শাসনে নুয়ে পড়বে। তবে কিছু একটা হয়েছে তা নিশ্চিত। নাবিলার বাবা মেয়ের অনুমতি নিয়ে ব্যালকনিতে পাতা একটা চেয়ারে বসেন। আমিও তোর সাথে চাঁদের ক্ষয়-বৃদ্ধি দেখব। মিনিট দু-এক পরেই নাবিলার বাবার স্থূলাকার দেহটা হেলিয়ে পড়ে চেয়ারে। তার কিছুক্ষণ পরে শোনা যায় নাক ডাকার শব্দ। ঘ্যারত ঘ্যারত, প্যারত প্যারত, ওয়াং, ঘং যে শব্দ বানান করে লেখা যায় না। নাসিকার গর্জনের ভাষাও কত রকম হতে পারে!

নাবিলা জানে বাবার এই কৌতূহল কিছুক্ষণের জন্যই। এভাবেই কাটতে থাকে রাতের প্রহর। নাবিলা কখনো ভাবল, জাহিদের সাথে অবাধ মেলামেশা করে প্রতিশোধ নেব। পারব কি? জাহিদকে কীভাবে গ্রহণ করব? কীভাবে তার হাত ধরব। যে হাত দিয়ে সারা জীবন গোলাপের চাষ হয়েছে সে হাতে… না – তা হবে না।

সব মানুষ ইচ্ছে করলেই নোংরা কাজে নামতে পারে না। নাবিলা কোনোভাবেই প্রতিশোধ নিতে পারেনি নাদিমের প্রতি বরং জীবনের চারপাশে তৈরি করে এমন এক অভেদ্য প্রাচীর যেখানে পুরুষ মানুষের প্রবেশাধিকার দুর্লভ ও দুঃসাধ্য। জীবন তো বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী। যৌবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় জীবন। যৌবন আর কদিনই থাকে। নাবিলার চাওয়া-পাওয়ার পৃথিবীতে আর যেন কিছুই নেই। কিংবা তার পৃথিবীটা ছোট হতে থাকে। কিংবা হতে পারে তার জীবনের পরিধি আরও বিস্তৃত। শুধু নাবিলাই জানে রেশমগুটির তার ভেতরে কেমন রহস্যময় বেড়াজাল সৃষ্টি করে যাচ্ছে।

নাদিম যেমন নাবিলাকে এড়িয়ে চলে নাবিলাও তেমনই এড়িয়ে চলে। মনে হয় কারও সঙ্গে কারও জানাশোনা নেই। বিগত তিন বছরের সম্পর্কের যোগ-বিয়োগের খতিয়ানে এখন একটা শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই। তবে দুজনের মধ্যে হাহাকার আছে, বুকের গভীরে দংশন আছে। দুজনেই যন্ত্রণায় বারবার নীল হয়ে ওঠে। আবার সমাজ সংসারের চাপে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কখনো বা ভান করে পাথরের মতো পড়ে থাকে।

এক সন্ধ্যায় নাদিম ওর রুমে বসে পড়ছে। হঠাৎ মায়ের শব্দ শুনতে পায়। নাদিম কান খাড়া করে দীপালী আসছে কি না তা বোঝার জন্য। না, দীপালীর কোনো শব্দ নাদিম পায়নি। হঠাৎ দীপালীর জন্য ওর মন খারাপ হয়ে গেল। নোট খাতাটি বন্ধ করে নাদিম চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল। কেন মানুষের জীবন এত জটিল জালে আটকে যায়। জীবন কেন সহজ হয় না, কেন সরল হয় না? নাদিমের ভাবনায় ছেদ পড়ে মায়ের ডাকে। চোখ বন্ধ করে কী করছিস?

না, কিছু করছি না।
সাদিয়ার শরীরটা খুব খারাপ। আমি ওকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। শোন্, তোকে একটা কথা আমি সরাসরি বলতে চাই।
নাদিম মায়ের দিকে তাকাল। নাদিম বুঝতে পারে মা কী বলবেন।
বাবা মরা মেয়েটাকে আমার কাছেই রাখব। নাদিম তোর পরীক্ষার পরই দীপালীকে বৌ করে নিয়ে আসব ঘরে। আমি সাদিয়াকে কথা দিয়ে এসেছি। তুই আমার কথার অবাধ্য হবি না আশা করি।

নাদিম ভাবল কথা এখন সরাসরি বলাই ভালো। আর কোনো কিছুই ঝুলিয়ে রাখতে চাই না। সে বলল, না, মা আমার দ্বারা দীপালীকে বিয়ে করা হবে না?
কি বললি?
হ্যাঁ আমার দ্বারা হবে না।
কেন হবে না? আমার কথার অবাধ্য হওয়ার মানে কি তুই জানিস তো?
জানি।

নাদিম জানে তার মায়ের কথার অবাধ্য হলে তাকে ঘর ছাড়তে হবে। মায়ের আদর ভালোবাসা চিরদিনের জন্য ত্যাগ করতে হবে। তাও ভালো। এত কিছু ত্যাগ করেও যদি আসিফের জন্য কিছু করা যায়; তাও ভালো। অন্তত বিবেকের কাছে কিছুটা সান্ত¡না পাওয়া যাবে।

নাদিমের মার মুখের ওপর কথা বলার সাহস হয়তো নাদিম আজকেই দেখাল। তাই এত বড় একটা ধাক্কা তিনি খাবেন বুঝতে পারেননি। তার চোখ বড় হয়ে গেল মুহূর্তে। তিনি কী করবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না। নাদিমের দিকে তাকালেন। নাদিম নোট খাতায় চোখ রাখল। নাদিমের মা যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি উঠে গেলেন নাদিমের কাছ থেকে।

রাতে মা ভেবেছেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা এমনটি করেই থাকে। তার সঙ্গে নিজেও রাগ দেখালে হয়তো কাজটা হবে না। কোনোমতে বিয়ের কাজটি সেরে ফেললে পরে আর কোনো অসুবিধা হবে না। পরীক্ষার পর বিয়ের ব্যবস্থাটা করে ফেলতেই হবে।

নাদিমের ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করলেই কি-ই-বা এমন হবে? ঢাকা শহরে চারতলা বাড়ির মালিক। শুয়ে বসে খেলেও নির্বিঘেœ চলে যাবে একটা জীবন। নাদিমকে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তার মায়ের আগ্রহটা এ জন্য একটু বেশিই।

নাদিমের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করে আসিফদের বাসায় গেল। আসিফ জানাল ওর মায়ের খুব বেশি অসুখ। ঢাকা মেডিকেলে আছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে বলে ডাক্তার জানিয়েছেন। আসিফের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বলতে বলতে। নিশা হাসপাতালে। তুই একটু যাবি নাদিম?

কেন যাব না? নিশ্চয়ই যাব। টাকা পয়সা?
নিশা কোত্থেকে জোগাড় করেছে জানি না। ও-ই করছে সবকিছু। মায়ের অবস্থা ভালো না। জানি না কী হয়? আসিফের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।
কোন কেবিনে আছে?
কেবিন আবার পাগল? টাকা পয়সা যা ছিল তো আমিই শেষ করেছি এখন কেবিনের টাকা হবে কোত্থেকে? আট নম্বর ওয়ার্ডে আছে। বাইশ নম্বর সিট।
আমি যাচ্ছি।
যা। আমাকে একটা খবর দিস। খুব অস্থির লাগছে।

নাদিম হাসপাতালে গিয়ে দেখে নিশার মা বিছানার সঙ্গে মিশে আছেন। একটা সাদা চাদর তার গায়ে জড়ানো। একটা মানুষকে বিছানা হতে আলাদা করে শনাক্ত করাই কঠিন। অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া। শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। টিপটিপ করে শিরায় ঢুকছে স্যালাইন। নিশা তার মার বেডের পাশে একটা ফাইবার চেয়ারে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। চোখ নিরুত্তাপ, নিপ্রভ। মুখটা এতই মলিন যে তার দিকে তাকাতে নাদিমের কষ্ট হচ্ছে।

নাদিমকে দেখে নিশা উঠে দাঁড়ায়। খুব অস্পষ্ট স্বরে বলল, বসো নাদিম ভাই। নাদিম কী বলবে না বলবে বুঝতে পারছে না। নিশার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে ডান হাতের অনামিকার নখ চেপে ধরে।
নিশা বলল, বসো, নাদিম ভাই। নাদিম বসে। কিছুক্ষণ কেটে যায় নীরবতায়। নাদিম এক সময় জিগ্যেস করে, খাওয়া-দাওয়া…?
নিশা বলল, না। মুখে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ কেটে যায় কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। নাদিম আবার জিগ্যেস করল, অষুধ-টসুধ সব পাওয়া যাচ্ছে?

নিশা বলল, কিছু কিছু অষুধ কিনা যাচ্ছে না। অনেক দামি। হাসপাতাল থেকে যা দেওয়া হয় তাই চলছে।
নাদিম বের হয়ে গেল। বাসায় এসে এখানে সেখানে খুঁজে কিছু টাকা নিয়ে আবার হাসপাতালের দিকে পা বাড়ায়। রাস্তায় নেমে ভাবে ব্যাংকে কিছু টাকা আছে তার। স্টাইপেন্ডের টাকা। মায়ের আলমারি থেকে কিছু টাকা নিতে হবে চুরি করে।
নাদিম হাসপাতালে এসে দেখে নিশা নেই। নাদিম নার্সকে জিগ্যেস করল, কোনো অষুধ লাগবে কি না?

নার্স গম্ভীর হয়ে গেল। তার মুখ কালো হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, অষুধ দিয়ে মনে হয় আর লাভ হবে না? ওনার অবস্থা খুব ভালো নেই। কথাটা শুনে নাদিম চমকে ওঠল। তার মাথাটা আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে এল। ধীর পায়ে নিশার মায়ের বেডের দিকে এগিয়ে গেল।

বেশ কিছুটা রাত হলে নিশা হাসপাতালে ফিরে আসে। নাদিমকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে নিশা কিছুটা অবাকই হয়। নিশা কাছে এসে বলল, ভাইয়াকে খাওয়াতে গিয়েছিলাম। তুমি কখন এলে?
একটু আগে, নাদিম উত্তর দিল। নিশা বেডের পাশে বসল। নাদিম বলল, তুমি না হয় বাসায় চলে যাও। আজ আমি থাকি? কদিন ধরে না ঘুমিয়ে কেমন হয়েছো খেয়াল আছে?

নিশা হাসতে চেষ্টা করল। মনে হাসি না থাকলে মুখে হাসি ফুটে না। বলল, তা কী করে হয়? তুমি থাকবে আর আমি চলে যাব? ভাইয়ার জন্য যা করেছো তার ঋণই কীভাবে শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না।
নাদিম কথা বলল না। তার বুকের ভেতরটা মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। নিশার কথাটা যেন বুকের চাপা আগুনটা উসকে দিল। নাদিম অনড় হয়ে বসে রইল।

রাত বাড়ে। হাসপাতালে মহিলাদের ওয়ার্ডে পুরুষদের থাকা নিষেধ। নার্স এসে একবার বলে গেছে নাদিমকে চলে যাওয়ার জন্য। নাদিমের চলে আসতে মন চাচ্ছে না। নিশাও বলল, তুমি তো থাকতে পারবে না। চলে যাও। তোমার তো খাওয়াও হয়নি। চলে যাও কাল দিনের বেলায় এসো একবার।

নাদিম নিশার চোখের দিকে তাকাল। রাত জাগা নিশাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। মুখের লাবণ্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। নিশাও নাদিমের দিকে তাকাল। নিশা একবার উঠে এসে নাদিমের পাশে দাঁড়াল। কাঁদতে পারলে শোকের পাথরটা হালকা হত হয়ত। নাদিম চেয়ে দেখে নিশার চোখ থেকে পানি পড়ছে।
পরদিন সকালেই ব্যাংক থেকে তার সব টাকা উঠিয়ে নিল নাদিম। তারপর সময় বুঝে মায়ের স্টিলের আলমারি থেকে দশ হাজার টাকা চুরি করে আসিফের মায়ের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যায়। নাদিম নার্সকে বলল, যদি ভালো কোনো অষুধ লাগে ডাক্তারকে বলে লিখিয়ে আনেন। আমি কিছু টাকা যোগার করেছি। নার্স বলল, এখন একটা ইনজেকশন খুব জরুরি— এটা নিয়ে আসেন। নার্স একটা কাগজে ইনজেকশনের নাম লিখে দিল।

আরও কয়েক দিন চলল নাদিমের হাসপাতালে যাওয়া-আসা। এর মধ্যে কয়েকবার সে ডাক্তারদের ওপর রাগারাগি করেছে। ডাক্তারদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সে। সামান্য এন্টিবায়োটিক ছাড়া আর কোনো অষুধ হাসপাতালে পাওয়া যায় না। এদেশে আবার চিকিৎসা! রাগারাগি করে লাভ কী, নিশা একদিন নাদিমকে প্রশ্ন করল। নাদিম বলল, লাভ কিছু নেই জানি। তবু মনকে মানাতে পারি না। সামান্য এন্টিবায়োটিক ছাড়া আর কোনো ওষুধই তো দেওয়া হয়নি এই কদিন। নিশা বলল, গরিব মানুষের ভালো চিকিৎসা আশা করা ঠিক না। মাকে হাসপাতালে থাকতে দিয়েছে এটাই ভাগ্যের ব্যাপার।

নাদিমের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। সে বলল, হাসপাতালটা কী ডাক্তারদের বাবার সম্পত্তি? তাদের বাপের টাকা খরচ হবে? চিকিৎসা ডাক্তারদের বা সরকারের করুণা নয়; মানুষের অধিকার। আমাদের অধিকার। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় এসব হয়। ওরা জনগণের সার্ভেন্ট মাত্র। নিশা বলল, এভাবে বললে কোনো লাভ হবে? আমরা তো ভাগ্যকেই মেনে নিয়েছি। তুমি রাগ করছো কেন?

নিশার কথায় নাদিম শান্ত হয়। সে ধীর পায়ে গিয়ে চেয়ারে বসে। নিশাও আস্তে আস্তে নাদিমের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নাদিম অনুভব করে নিশা নাদিমের খুব কাছে। অনেক বেশি কাছে। মানুষ যখন শোকে কাতর হয় তখন অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এতে মনে হয় শোক কমে। ইড়ফরষু পড়হঃধপঃ-এর মাধ্যমে শোক কিছুটা হালকা হয় বা স্থানান্তরিত হয় বলেই হয়ত কারও মৃত্যুর পর আপনজনকে জড়িয়ে ধরে মানুষ কাঁদে। অথবা তাও হতে পারে সমানুভূতির সংশ্লেষণে শোক কমে যায়। এতে আছে সহানুভূতি ও সমানুভূতি। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনচারে এই দুটি বিষয় খুবই প্রয়োজন।

আলমারি থেকে দশ হাজার টাকা খোয়া যাওয়ার পরই নাদিমের ওপর মায়ের বাক্যবাণ শুরু হতে লাগল। ছোট লোকের বাচ্চাদের জন্য এত দরদ কেন? তোকে কী দেখিয়েছে ওরা? ওদের সাথে সম্পর্ক রাখলে আমার সাথে তোর সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন নেইÑএটা আমার শেষ কথা। এখানে আরও একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, নাদিমের মা আরও একদিন দীপালীর বিয়ের বিষয়টা নাদিমের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। কিন্তু নাদিম আগের মতই জবাব দিয়েছিল। সে দিন থেকে নাদিমের মা নাদিমের কোনো কিছুই সহ্য করতে পারছেন না। এর মধ্যে আলমারি থেকে টাকা খোয়া যাওয়া এবং নাদিম বলেছে যে, সে সে টাকা নিয়েছে আসিফের মায়ের চিকিৎসার জন্য তখন থেকেই মা এমন অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছেন।

সেদিন নাদিম বাসায় কিছু না বলেই বের হয়ে যায়। হাসপাতালে গিয়ে দেখে নিশা পাথরের মত বসে আছে। নাদিম দেখতে পায় আসিফের মায়ের শিরায় স্যালাইন ড্রপ যাচ্ছে না। অক্সিজেন মাস্কটা খোলা হয়ে গেছে। একটা সাদা চাদর দিয়ে সমস্ত শরীর ঢাকা।

সকাল বেলা নাশতা খেয়ে চা নিয়ে ভাঙা সোফায় বসেছে নিশা আর আসিফ। দুজনেই চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ওদের মার মৃত্যুর পর ওদের কথা বলা অনেক কমে গেছে। পরপর দুটি ঘটনা গা-সহা হতে অনেক সময় লাগছে ওদের। নিয়ম মাফিক কথা ছাড়া তেমন কোনো কথা হয় না। আসিফ চাচ্ছে সব কিছু মেনে নিয়ে স্বাভাবিক হতে কিন্তু যখন তার মনে হয় সে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তখন সব কিছু আবার কোথায় যেন তলিয়ে যায়। আসিফ মনে মনে ভাবে, আমি যেমনই থাকি নিশাকে ভালোভাবে বাঁচতে দিতে হবে। ওর জন্য নতুন কোনো পথ তৈরি করতে হবে। আসিফের ভাবনা দেখে নিশা জিগ্যেস করে, কী ভাবছ ভাইয়া?

আমাদের কী আর ভাবনা থাকতে পারে? জীবন নিয়েই তো বড় ভাবনা।
ঐ মেয়েটির কথা তোমার মনে পড়ে না ভাইয়া?
পড়ে। প্রায় সব সময়ই মনে পড়ে। হঠাৎ কেন যে ওর সাথে দেখা হয়েছিল?
আমি একটা চিঠি দেব?
না। চিঠি দিবি কেন? কিছুক্ষণ পর আসিফ বলল, মার একটা ছবি তুলেছিলাম তোর মনে আছে?
হ্যাঁ, আছে।
ছবির নেগেটিভটা কোথায় আছে জানিস?
না, মনে নেই। খুঁজে দেখতে হবে।
নেগেটিভটা পেলে একটা ছবি বড় করে বাঁধিয়ে দিতে পারবি তোর টিউশনির টাকা দিয়ে? আমার রুমে টানিয়ে দিবি। পারবি?
পারব। এ মাসে আরও একটা টিউশনি পেয়ে যাব। গতকাল আলাপ হয়েছে।
মার ছবিটা আমার মনে উত্তাপ ছড়াবে। ক্লাস টেনে একটা হাদিস পড়েছিলাম না, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তোর মনে আছে?
হুঁ। আছে।
আমার কী মনে হয় জানিস?

Series Navigation<< উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ৮ম পর্বউপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ১০ম পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *