উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// এক
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// দুই
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// তিন
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিলো, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব চার
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// পাঁচ পর্ব
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।।পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব পনরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। শেষ পর্ব
বিশ্ব ভ্রমণ শেষ করে এসে বাংলার সৌন্দর্যে বিমোহিত কবির মনে হয়েছিল, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের ’পরে/একটি শিশির বিন্দু।’ তাহলে প্রকৃতি অবলোকনই সব দেখার শ্রেষ্ঠ দেখা! তাও ধানের শীষ আর শিশির বিন্দু! তার মানে? রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ জানার অধিক্ষেত্র হচ্ছে? প্রকৃতি আর শস্যালোকিত সোনালি ধানের মাঠ!
রবীন্দ্রনাথ সৌন্দর্যের পিয়াসী ছিলেন। এই পিপাসা মেটাতে জীবনভর তিনি ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন।
এই দেখার শুরুটা কি তাহলে পতিসর থেকে? আসাদ ভাবছিল।
ছিন্নপত্র পড়তে পড়তে আসাদ দেখছে─রবীন্দ্রনাথ সেদিন বিকেলে তাঁর বজরাটাকে কাছারি থেকে দূরে মাঠের নির্জনতায় নিয়ে গিয়ে মাঠের পাশে নদীর ধারে নেমে গেছেন।…সূর্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষ রেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। …বহু দূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটু গাছপালার ঘের দেওয়া ছিল, সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠছে─নীলেতে লালেতে মিশে এমন আবছায়া হয়ে গেছে─কবির মনে হচ্ছে, ঐখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি, ঐখানে গিয়ে সে আপনার রাঙা আঁচলটি শিথিল ভাবে এলিয়ে দেয়, আপনার সন্ধ্যাতারাটি যত্ন করে জ্বালিয়ে তোলে, আপন নিভৃত নির্জনতার মধ্যে সিঁদুর পরে বধূর মতো কার প্রতীক্ষায় বসে থাকে, এবং বসে বসে পা দুটি মেলে তারার মালা গাঁথে এবং গুন গুন স্বরে স্বপ্ন রচনা করে। সমস্ত অপার মাঠের উপর একটি ছায়া পড়েছে─একটি কোমল বিষাদ─ঠিক অশ্রুজল নয়─একটি নির্নিমেষ চোখের বড়ো বড়ো পল্লবের নীচে গভীর ছলছল ভাবের মতো।…দেখে তাঁর মনে এই বোধ জন্ম হয়…মা পৃথিবী লোকালয়ের মধ্যে আপন ছেলেপিলে এবং কোলাহল এবং ঘরকন্যার কাজ নিয়ে থাকে─যেখানে একটু ফাঁকা, একটু নিস্তব্ধতা, একটু খোলা আকাশ, সেইখানেই তার বিশাল হৃদয়ের অন্তনির্হিত ঔদাস্য এবং বিষাদ ফুটে ওঠে; সেইখানেই তার গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস শোনা যায়। ভারতবর্ষের যেমন বাধাহীন পরিষ্কার আকাশ, বহুদূরবিস্তৃত সমতল ভূমি আছে, এমন ইউরোপের কোথাও আছে কি না সন্দেহ। এই জন্যে আমাদের জাতি যেন পৃথিবীর সেই অসীম ঔদাস্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। এই জন্যে আমাদের পূরবীতে কিম্বা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের অন্তরের হাহাধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে, কারও ঘরের কথা নয়।…
…বাঁ পাশে ছোট্ট নদীটি দুই ধারের উঁচু পাড়ের মধ্যে এঁকেবেঁকে খুব অল্প দূরেই দৃষ্টি পথের বার হয়ে গেছে, জলে ঢেউয়ের রেখামাত্র নেই, কেবল সন্ধ্যার আভা অত্যন্ত মুমূর্ষু হাসির মতো খানিক ক্ষণের জন্যে লেগে আছে। যেমন প্রকাÐ মাঠ তেমনি প্রকান্ড নিস্তব্ধতা। কেবল এক রকম পাখি যত অন্ধকার হয়ে আসছে তত তার নিরালা বাসার কাছে একজন অভাবিত আগন্তুককে আনাগোনা করতে দেখে ব্যাকুল সন্দেহের স্বরে টী টী করে ডাকতে লাগল। তারপর কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো ঈষৎ ফুটে উঠছে পূর্বাকাশে…।
বিকেলে আসাদ নদীর ধারে চলে গেল। সেই একই আকাশ আর একই প্রকৃতি দেখে সে অভিভূত হয়ে পড়ে। ওর মনে হলো, একটা বজরা কি থাকতে পারত না ঘাটে? আর মাঠের পাশে সেই তরুণ কবি! আলো-অন্ধকারে মাঠের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিল, এই আধো আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সেদিন কী ভাবছিলেন কবি?
নদীর ধারে অনেকক্ষণ বসে থেকে আসাদ ওর কক্ষে গিয়ে রবীন্দ্ররচনাবলী দেখতে থাকে। পতিসরের কবিকে সে নতুন করে আবিষ্কার করতে চায়। সে দেখতে পাচ্ছে, ১৮৯১ সালেই কবি বেশ কিছুদিন পতিসর ছিলেন। সে কি কেবল জমিদারির হিসেব-নিকেশ দেখার জন্য? নাকি অন্য কারণে তিনি এই অজগাঁয়ে আসতে ব্যকুল হয়ে উঠেছিলেন?
মাত্র কদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ থেকে নির্ধারিত সময় না কাটিয়ে তার আগেই চলে এসেছেন। ইংল্যান্ডে তাঁর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এসব বর্ণনা ডায়ারিতে তিনি লিখেছেন। তিনি জানেন, এদেশের মানুষ ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। যেন সেখানে একবার যেতে পারলেই মোক্ষলাভ। আর গিয়ে প্রত্যাবর্তন করার পর মুখে খৈ ফুটতে থাকে, যেন সেদেশের পক্ষে বিনা পয়সায় এমবাসেডর। কবি এর আগে, কৈশোরেই বিলাত ঘুরে এসেছেন। থেকে, দেখে, আদবকায়দা জেনে এসেছেন। তাঁকে পাঠানোও হয়েছিল সেকারণেই, ইংরেজদের সমাজে চলার উপযোগী করে গড়ে তোলা। তখন না হয় তিনি বেশ অবুঝ ছিলেন, নিজের মতো করে কিছু ভাবতে পারতেন না। কিন্তু এবারে তো ইউরোপকে জানা আর বোঝা অনেকটাই সহজ ছিল। তিনি এবার ইউরোপের সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-সাহিত্য সবকিছুই জানতে আর বুঝতে চেষ্টা করেছেন। নানারকম মানুষের সাথে আলাপ করেছেন, ভাব বিনিময় করেছেন, ইউরোপীয় ও বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা আর নাটক নিয়ে কথা বলেছেন। থিয়েটার দেখেছেন, গান শুনেছেন, সুর আর ভাব নিয়ে তাঁর নিজের মত প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া ইউরোপে যে নবজাগরণ ঘটেছে সে সম্পর্কে জানতে ইবসেনের নাটক দেখেছেন, ম্যাথু আরনল্ড ও ব্রাউনিং-এর কবিতা আর অ্যালফন্স দুঁদ-এর গল্প পড়েছেন। সমাজ ও সমসাময়িক বিজ্ঞানের অগ্রগতি বুঝতে ওয়েলস-এর ডারউইনিজম এবং মডার্ন থট এন্ড মডার্ন সায়েন্স-এর মতো পুস্তক আগ্রহের সঙ্গে অধ্যয়ন আর পর্যালোচনা করেছেন।
কবির মনে কদিন ধরে প্রাচ্য, পাশ্চাত্য আর স্বদেশ নিয়ে ভাবনা কাজ করছে। এবার ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে আধুনিক ইউরোপ আর প্রাচীন ভারতভূমি পাশাপাশি রেখে দেখতে চেয়েছেন কার কোথায় অবস্থান। ইউরোপে থাকতেই তিনি মনে একটা তুলনামূলক চিত্র লিখতে বসেছিলেন। তিনি দেখেছেন, ইউরোপীয়ানদের কাজকর্মের মধ্যে অদম্য ক্ষমতার বিকিরণ দেখা যায়। সেই বিকিরণে চোখ ঝলসে যায়। এরা অল্পে সন্তুষ্ট হয় না। আবার এই স্বল্পসংখ্যক মানুষের আমোদপ্রমোদের জন্য যে অন্যদিকে অসংখ্য মানুষের চরম শক্তি অবিরাম খেটে মরছে সেটা কেউ খেয়াল করছে না। এটা ইউরোপের সভ্যতার অন্ধকার দিক। এই সুখসমৃদ্ধির অন্তরালে কী অসহ্য দারিদ্র্য আপনার জীবনপাত করছে সেটা চোখে পড়ে না, কিন্তু প্রকৃতির খাতায় সে হিসেব জমা হচ্ছে। দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করার প্রতিশোধ প্রকৃতি একদিন নেবেই। ইউরোপ যদি তার সভ্যতাকে রক্ষা করতে চায় তবে যাদের শ্রম, রক্ত-ঘামে এই সমৃদ্ধি তাদেরকে সাথে নিতে হবে, তাদের মঙ্গলের কথা ভাবতে হবে। আলোর নিচে যে অন্ধকার জমা হচ্ছে সেখানেই প্রলয়ের গোপন জন্মভূমি। অন্যদিকে ভারতভূমির মানুষ সেই আদিমকালে যেমন ছিল সেখানেই থেমে আছে। কোনো আলোড়ন নেই, সমাজে কোনো তরঙ্গ নেই। বিশাল জলধির উপর শেওলা জমে এর তলে জল আছে কি নেই সেটাও আর বোঝা যাচ্ছে না। এই সমাজের গভীরে কোনো নতুন সূর্যালোকে পৌঁছানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। নিয়ম আর সংস্কারের শেওলার নিচে জমাটবাঁধা জীবন শীতল মাছের মতো স্থির ঝিমুচ্ছে। কবি এইসব দিক মানুষকে জানাতে চান। তিনি চান অচিরেই ইউরোপের অভিজ্ঞতার আলোকেই এই সমাজের মানুষগুলো নতুন করে ভাবতে পারে কিনা দেখুক। আসাদ দেখল ইউরোপযাত্রীর ডায়ারি এই চিন্তার ফসল।
বন্ধুদের আগ্রহে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপযাত্রীর ডায়ারি প্রকাশ করার চিন্তা করছিলেন। সেটা ছাপার অক্ষরে বের করতে আরো কিছু ঘষামাজা করার প্রয়োজন। ডায়ারিটা তিনি সঙ্গে করে পতিসর নিয়ে এসেছেন। বোটে নিরালায় বসে সেটাই তিনি পুনর্লিখন করছেন। তিনি যাত্রার শুরুতেই চিন্তা করে রেখেছিলেন জাহাজে ওঠার পর থেকেই প্রতিটা ঘটনা লিখে রাখবেন। বাস্তবেও তাই করেছিলেন। বিশে সেপ্টেম্বর ১৮৯০ সালে তিনি পুনা স্টিমারে চড়লেন। জাহাজের ছয় দিন যে কবির কী কষ্টে কেটেছে সেটা দিয়েই তিনি ডায়ারি লেখা শুরু করেন।
কী আশ্চর্য! আসাদ ডায়ারিটা পড়তে গিয়ে দেখে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ থেকে ইন্দিরা দেবীকে পত্র লিখেছেন। ভ্রাতুষ্পুত্রীকে কতটা ভালোবাসতেন সেটা ছিন্নপত্র থেকেও বোঝা যায়। আসাদ কোথায় যেন পড়েছিল ইন্দিরা দেবীর জন্যই তিনি কাউকে না জানিয়ে ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ছিন্নপত্র পাঠ করে আসাদের এখন মনে হচ্ছে তিনি বাংলাকে ভালোবেসেই ইউরোপে থাকতে চান নি। কেন রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ থেকে ফিরে আসার পর বাংলাদেশে জমিদারি দেখার জন্য দায়িত্ব নিয়ে গ্রামে চলে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি, বরং তিনি এখানে আসার জন্য উদগ্রীব হয়েই ছিলেন সেটা ইন্দিরা দেবীকে ইউরোপ থেকে লেখা চিঠিতে উঠে এসেছে। ইউরোপে থাকতেই তিনি বাংলাকে ঘিরে তাঁর জীবন কাটাবেন সেরকম মনঃস্থির করে রেখেছিলেন। তিনি ইউরোপ ছাড়িয়ে এশিয়ার সীমানায় পৌঁছেই লিখেন, ‘আমি প্রাচ্য, আমি আসিয়াবাসী, আমি বাংলার সন্তান, আমার কাছে য়ুরোপীয় সভ্যতা সমস্ত মিথ্যে─আমাকে একটি নদীতীর, একটি দিগন্তবেষ্টিত কনকসূর্যাস্তরঞ্জিত শস্যক্ষেত্র, একটুখানি বিজনতা, খ্যাতিপ্রতিপত্তিহীন প্রচন্ড চেষ্টাবিহীন নিরীহ জীবন এবং যথার্থ নির্জনতাপ্রিয় একাগ্রগভীর ভালোবাসাপূর্ণ একটি হৃদয় দাও, আমি জগদবিখ্যাত সভ্যতার গৌরব, উদ্দাম জীবনের উন্মাদ আবর্ত এবং অপর্যাপ্ত যৌবনের প্রবল উত্তেজনা চাই নে।’
আসাদ করিমের মনে আর কোনো প্রশ্ন জাগে না কেন মাত্র ত্রিশ বছরের যুবক-কবি বাংলার বুকে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন। ছিন্নপত্র পড়তে পড়তে আসাদের মনে পড়ে, সে তো মাত্র ঢাকা ছেড়ে এসেছে, আর রবীন্দ্রনাথ ধানের শীষ আর শিশিরবিন্দু দেখতে কলকাতা ছেড়ে শাহজাদপুর-পতিসর আসতেন।
১২
রবীন্দ্রনাথ পতিসর এলে পড়ন্ত বিকেলে আঁকাবাঁকা এই নদীর তীর ধরে একা একা হেঁটে বেড়াতেন। তাঁর মাথার উপরে আকাশ, চোখের সামনে মাঠ, আর একটু দূরে গ্রাম। তিনি লিখেছেন, সমতল বাংলাদেশের আকাশই তাঁকে সবচাইতে বেশী আনন্দ দেয়। আকাশের নিচে সমতল, নদীতীরের দৃশ্য, তাঁর বেশী ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরুদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্ত মণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। যখন স্তিমিত শ্রান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না। চেয়ে চেয়ে দেখবার এবং দেখে দেখে মনটা ভরে নেবার এমন জায়গা আর নেই।
বিকেলে নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে আসাদের কবির লেখা চিঠি মনে পড়ছে। ‘এখানকার প্রত্যেক দিন আমার নিজের দিন─ নিত্য-নিয়মিত-দম-দেওয়া কলের সংগে কোনো যোগ নেই। আমার আপনার মনের ভাবনাগুলি এবং অখন্ড অবসরটিকে হাতে করে নিয়ে মাঠের মধ্যে বেড়াতে যাই। সময় কিম্বা স্থানের মধ্যে কোনো বাধা নেই। সন্ধেটা জলে স্থলে আকাশে ঘনিয়ে আসতে থাকে, আমি মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বেড়াতে থাকি।’
আসাদের মনে হতে থাকে, এই শুকনো ছোটো নদীটাকে রবীন্দ্রনাথের মতো করে না পারলেও সে কিছুটা হলেও ভালোবেসে ফেলেছে। প্রতিদিনই সে নদীটাকে দেখে। তবু প্রতিদিনই বিকেল হলে সে নদীর তীরের আঁকাবাঁকা পথটা ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যায়। দুপাশে দেখে। কী দেখে? দেখে একই মাঠ, একই গ্রাম, একই আকাশ, একই মেঘ, একই মাঠের মানুষ, তাদের আসা যাওয়া, দুপারের ঘরগেরস্থালি। তবু পরের দিন যখন আবার দেখে তখন মনে হয় আজই দেখছে। বাংলার আকাশ প্রতিদিনই বদল হয়। বাংলার মাঠ ঋতুতে ঋতুতে তো বদল হয়ই, কিন্তু প্রতিদিনও কিছু না কিছু বদলায়। কেউ ধান কাটে তো কেউ ধান বোনে, কেউ নিড়ানি দেয় তো কেউ চাষ করে। কেউ মাঠে গান গায়, কেউ গরু চরায়। এভাবে প্রতিদিনই একটা কিছু নতুনত্ব নিয়ে পতিসরের আকাশ, মাঠ, গ্রাম আর গ্রামের মানুষ আসাদ করিমের চোখের সামনে উপস্থিত হয়। আর এসব দেখা যেন এখন ওর নেশার মতো হয়ে গেছে। তার পর সন্ধ্যাটাও প্রতিদিন বদলে যায়।
আজ সন্ধ্যায় চাঁদ উঠলে কাল আরেকটু পর, তার পর দিন আরো পরে। একেক দিনের সন্ধ্যের আকাশ একেক রূপে হাজির হয়। কোনো দিন আকাশ পরিষ্কার থাকলে একরকম, কোনো দিন আকাশে মেঘ থাকলে অন্যরকম, আবার মেঘটা কোথাও জমে আছে নাকি ভেসে চলেছে সেটাও দেখার বিষয়। কখনো মেঘ মিনারের মতো, কখনো মেঘ ভেলার মতো, কখনো মেঘ অসংখ্য ভেড়ার মতো আকাশে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। তখন হয়তো চাঁদ উঠতে শুরু করে, হয়তো চাঁদের দেখা মেলে বেশ খানিকক্ষণ পর, হয়তো উদিত সরু চাঁদ আঁধার হতে হতেই ডুবে যায়। আর তখন মুক্তার মতো অগুনতি তারা ফুটে উঠে আকাশ আলোয় ভাসিয়ে দেয়। আকাশের অদৃশ্য সম্রাজ্ঞীর জন্য বিশাল সাঁকোর মতো ছায়াপথ উদিত হয়। এসব কি নিত্যদিন একইরূপ থাকে? থাকে না। তাই তো পৃথিবীটা মানুষের কাছে কখনো পুরোনো হয় না। অথবা পুরোনো পৃথিবী প্রতিদিন মানুষের কাছে নতুন রূপে ধরা দেয়। এ যেন পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের এক অদৃশ্যমান প্রেমের সম্পর্ক।
আসাদ ভাবতে ভাবতে হিঙুলকান্দি ছাড়িয়ে চলে এসেছে। এখানে নদীটা একটু দূরে সরে গেছে। আর বাঁধের উপর দিয়ে রাস্তাটা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে। দেখতে দেখতে বাড়িঘর কেমন করে চোখের সামনে এসে পড়েছে। অথচ সে এর আগে এমনটি ভাবতেই পারে নি। আঙিনা, খড়ের গাদা, গরুর গোয়াল, খাবার দেবার জন্য গামলা, মাটির দেয়ালের পাশে উন্মুক্ত মাচার তলে রান্নাঘর, উলঙ্গ শিশু বাচ্চাসহ মুরগি আর বিড়াল এবং অতর্কিতে ওর সামনে হঠাৎ একটা ঘেউ ঘেউ কুকুর।
আসাদ দাঁড়িয়ে পড়ে। কুকুরটা ওর কাছে এসে পায়ের কাছে মাটিতে মুখ নিয়ে গন্ধ শুঁকে লেজ নাড়াতে থাকে। কীভাবে কুকুরটাকে এড়িয়ে যাবে সে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। কুকুরটাকে দূর থেকেই কে যেন চু চু করে ডাকলে সে লেজ নাড়াতে নাড়াতে সেদিক চলে যায়। আর সেদিকেই ওর চোখে পড়ে, একটু দূরে একটা পুকুর ঘাটে মহিলারা নিত্যকর্মে ব্যস্ত। তাদের নানারকম কথার রেশ ওর কানে আসছে। কিন্তু কী কথা বলছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না; হয়তো ঘর ঘেরস্থালির কথা, হয়তো সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি। তাদের সারাদিন কোনো অবসর নেই, সংসারের সকল কাজ শেষে পুকুর ঘাটে গোসল বা মাজাঘষা করার ফাঁকে একটুখানি ফুরসতে মনের কথা বলা। শিশুরা এই বিকেলেও পুকুরে সাঁতার কাটছে। মহিলাদের কেউ কেউ মাথায় কাপড় রেখেই পানিতে ডুব দিয়ে আবার সেভাবেই উঠে আসছে। উঠে চারিদিক তাকিয়ে পরনের কাপড় ঠিক করে নিচ্ছে। ওকে তাদের কেউ দেখে থাকবে। নিজেদের আব্রæ রক্ষায় কিছুটা আড়াল করতে তাদের নড়াচড়াও সে খেয়াল করে।
আসাদ আর সেদিক না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। যেতে যেতে ওর পতিসর থেকে ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথের সেই চিঠিটার ছবি মনে ভেসে ওঠে।─গুটিকতক খোড়োঘর, কতকগুলি চাল-শূন্য মাটির দেয়াল, দুটো-একটা খড়ের স্ত‚প, কুলগাছ আমগাছ বটগাছ এবং বাঁশের ঝাড়, গোটাতিনেক ছাগল চরছে, গোটাকতক উলঙ্গ ছেলে মেয়ে নদী পর্যন্ত একটা গড়ানে কাঁচা ঘাট, সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ বাসন মাজছে; কোনো কোনো লজ্জাশীলা বধু দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে একটি সদ্য স্নাত তৈলচিক্কন বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টিতে বর্তমান পত্র লেখক সম্বন্ধে কৌত‚হলনিবৃত্তি করছে…।
আসাদ গ্রাম ছাড়িয়ে আবার নদীর ধারে। নদীতে এতটুকু জলও নেই? বুক শুকিয়ে কাঠ। তবে শুকনো নদীর বুকে একটা পরিত্যক্ত ডিঙি ঠিকই আছে। তার পর আবার অনেকটা দূর পর্যন্ত শস্যশূন্য মাঠ, এবং দুটো একটা গরু নদীর ঢালু তটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এসে তৃণ অন্বেষণ করছে দেখা যাচ্ছে। আর চারিদিক স্তব্ধ, নির্জন। সে দেখছে সব কিছুই আছে ঠিকঠাক? সেই গ্রাম, সেই মানুষ, সেই শুকনো নদী, সেই আলো, সেই আঁধার, একশ বছর পর সেই আগের মতোই, আজও হাঁটছে একজন? এক মহামানবের পথের ধুলোয় হাঁটছে এক নগণ্য লেখক আসাদ করিম। তার পর আরো আরো কেউ কেউ হাঁটবে। হেঁটে হেঁটে কেউ হয়তো রবীন্দ্রনাথের মতো ভাবীকালের সীমানায় পৌঁছেও যাবে।