উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। শেষ পর্ব

২৮

পতিসরের লোকগুলো চলে যাবার পর আসাদের আটকের বিষয়টা নিয়ে কমান্ডার পুনর্বার ভাবছেন। আসাদ করিম স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক। এলাকার মানুষ তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাকে সন্দেহ করার এটাই বড় কারণ। নিষিদ্ধ দলের সদস্য বা নেতারা ছদ্মনাম ধারণ করে লুকিয়ে দলের কাজ করে। আসাদ করিমের পুরো নাম আবু করিম আসাদ। পতিসরে সে আসাদ করিম। লেখক নামও তাই। আসাদ করিম লেখক নামে কয়েকটি গল্প লিখেছে। তার গল্পগুলোতে বাংলাদেশে নতুন করে মৌলবাদী উত্থানের আশঙ্কার কথা আছে এবং মৌলবাদের অন্ধকার দিকগুলো সে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

আসাদ করিম কুঠিবাড়ির আঙিনায় সন্ধ্যায় ক্ষেতমজুরদের গলায় লোকগান, পুঁথিপাঠ আর কিসসা শুনত। ঝড়-বৃষ্টির সময় দু’বার দু’রাতে কয়েকজন ক্ষেতমজুর তার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথমবার ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে কয়েকজন শ্রমিক এসে পুরোনো হোস্টেলে, তার কক্ষেই রাত কাটিয়েছিল। তার পর মোজাম্মেল চেয়ারম্যান যেদিন খুন হয় এর আগে কোনো একরাতে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে ক্ষেতমজুররা আবারও তার ঘরে আশ্রয় নিতে এসেছিল। আসাদ স্বীকার করেছে, সে রাতে পাশের কক্ষের তালা খুলে দিয়ে ওদের থাকতে দিয়েছিল। ওরা রাতে খিচুড়ী রান্না করেছিল। তাকে খিচুড়ী খেতে অনুরোধ করলে সে খিচুড়ী খেয়েছিল। খিচুড়ী তার ঘরে এনে দিয়েছিল। দু’দিনই একই দলের লোক তার ঘরে এসেছিল কি-না আসাদ জানে না। আসাদ বলেছে, তাদের মজুরদের কাউকেই সে চেনে না। তবে শেষের দিন তার অনুরোধে একজন মজুর গান গেয়েছিল, একজন বাঁশি বাজিয়েছিল আর একজন কিসসা শুনিয়েছিল। ঝড় থেমে গেলে ওরা চলে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় একজন দিনমজুর বলেছিল, আসাদ খুব ভালো মানুষ। সে বিপদে পড়তে পারে। সে যেন সাবধান থাকে। একথা সে কেন বলেছিল আসাদ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। কমান্ডারের মনেও এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, একজন অচেনা মজুর আসাদকে কেন সতর্ক করেছিল।

সার্চ রিপোর্ট অনুযায়ী আসাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। গ্রামের নাম পিঠাখালি। বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মারা গেছেন বেশ কবছর আগে। মা বেঁচে আছেন। গ্রামে থাকেন। এসব তথ্য মিলে যাচ্ছে। ডায়েরিতে লিখেছে পতিসর আসার আগে আসাদ ঢাকায় একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় কাজ করত। ডায়েরীর তথ্য যাচাই করে সঠিক পাওয়া গেছে। তাকে চাকুরিচ্যুত করা হলেও বহুল পঠিত সেই দৈনিকের সম্পাদক তার সম্পর্কে বেশ প্রশংসা করেছেন। এমন কি আবার সে পত্রিকায় যোগ দিতে চাইলে তাকে ভালো ডেস্ক দেবেন। সম্পাদক তার ভাষাজ্ঞানেরও তারিফ করেছেন। লালপতাকার আসাদ কোনো পত্রিকায় কাজ করত এমন তথ্য নেই। এই আসাদ লেখালেখি করে। লেখায় কোনো নিষিদ্ধ রাজনীতি বা বামগন্ধও নেই, তবে সমাজ নিরীক্ষণ আছে। তার ডায়েরিতে সামান্য প্রেমের আভাষ আছে, গ্রামীণ বাস্তবতার কারণে লেখক যেন গল্পের চরিত্রটির প্রেমের বিষয়টি ইচ্ছে করেই আড়াল দিয়ে রেখেছে।

আসাদের ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে দুটো চিঠি ছিল। তারিখ দেখে আন্দাজ করা যায় একমাস পর পর চিঠিগুলো এখানে এসে পৌঁছেছে। উত্তর পাঠিয়েছিল কি-না পরের চিঠিটা পড়েও বোঝা যায় না। আগের কোনো প্রসঙ্গ পরের চিঠিতে নেই। ঢাকা থেকে মিতালী নামে কোনো মেয়ে লিখেছে, যার সাথে তার তুই তোকারির সম্পর্ক। সেই মেয়েটি তার ক্লাসমেট ছিল এটা বোঝা যায়। চিঠি থেকে বোঝা যায় ঐ মেয়েটা পতিসর চেনে। মেয়েটা কে? ডায়েরিতে ‘ষাঁড়’ বলে একজনের কথা উল্লেখ করেছে। এই ষাঁড়টা কে? এই চরিত্রগুলো কি আসাদের কল্পনাপ্রসূত নিছক গল্পের চরিত্র? কিন্তু কনকচাঁপা কেবল গল্পে আছে তা নয়, বাস্তব। কনকচাঁপাকে আসাদ প্রথম থেকেই পছন্দ করে এটা বোঝা যায়। আবার মিতালীকেও। শশাঙ্কবাবু আর প্রধান শিক্ষক আবুল কাসেম গল্পে যেমন তেমনি বাস্তবেও উপস্থিত। আসাদ করিম ডায়েরি লিখেছে আবার গল্পও লিখেছে। গল্পে কনকচাঁপার উপস্থিতি উজ্জ্বল। এটা কি মিথ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করার জন্য? কমান্ডার তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না।

আসাদ করিমের ডায়েরিটা বিগত বছরের। লেখার বেলায় দিন-তারিখ উল্লেখ করা নেই। কোনো সই-স্বাক্ষরও নেই। তবে পতিসর আসার পর থেকেই যে আসাদ করিম ডায়েরি লেখা শুরু করেছিল সেটা প্রথম পাতা পড়েই বোঝা যায়। আসাদ ডায়েরি উত্তম পুরুষে লেখে নি। সে সময়টাকে চিত্রায়িত করেছে। নাম-পুরুষের ভাষ্যে লিখেছে। কমান্ডারের মনে বিশ্বাস জাগে যে, একজন ছদ্মবেশী লোক এ রকম করে লিখতেই পারে। আর নিজের জীবন এবং অভিজ্ঞতার কথা অন্য চরিত্রকে দিয়ে বলিয়ে নেয়ার জন্য তাকে যথেষ্ট ভাষাগত এবং ভাবগত কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে বৈকি! ডায়েরিটা এমন করে লেখা যেন এটা তার নিজের কথা নয়; অন্য কোনো আসাদ করিমের কথা এই আসাদ করিম গল্পের মতো করে লিখেছে। অথবা অন্যকোনো আসাদ করিম আর কনকচাঁপাকে নিয়ে সে একটা গল্প লিখতে চেষ্টা করেছে। তবে গল্পটি আকর্ষনীয়। গল্পটিতে কনকচাঁপা আর আসাদ করিমের ভালোলাগার কথা কোনো আড়াল না করেই সে লিখেছে। কনকচাঁপা যে আসাদকে ভালোবেসে সেটা গল্পে যেমন আছে তেমনি কনকচাঁপা নিজেও স্বীকার করেছে।

মেজরের মনে হচ্ছে, আসাদ করিম ডায়েরি লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে গল্পের ভেতর আড়াল করার একটা কৌশল নিয়েছে। চমৎকার একটি গল্পের সূচনার মতোই সে লেখাটা শুরু করেছে। এই লেখাটাই যদি কোনো পত্রিকায় অথবা বই করে প্রকাশিত হয় তখন কেউ আন্দাজ করতে পারবে না সে কেবল পতিসরে তার যাপিত দিনগুলোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে। পাঠক ভাববে, আসাদ একটি ভালো গল্প লিখেছে।

আদালতে ডায়েরিটা উপস্থাপন করা হবে। লেখাটা নিছক গল্প, না দিনলিপি হিসেবে লেখা আসাদের নিজেরই কথা সেটা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। রিমান্ড শেষে তথ্যসহ আসাদকে আদালতে হাজির করা হবে। বিজ্ঞ আদালত কি এই ডায়েরিটা সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় নেবেন? নাকি রিমান্ডে এনে জেরার মাধ্যমে আদায় করা পুলিশের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন? গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেলে আবারও হেফাজতে আনা হবে। মেজর জানেন, হেফাজতে এনে টর্চার করে করে যে তথ্য বের করে আনা হয় সেটা সব সময় সঠিক হয় না। তিনি এটাও জানেন, রিমান্ডের টর্চার সহ্য করতে না পেরে আসামী কখনও কখনও কাল্পনিক গল্পের জন্ম দেয়। কষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কল্পনাপ্রসূত অবাস্তব কাহিনীও বেশ বিশ্বাসযোগ্য করে হেফাজতের আসামী বলতে পারে। আর আসাদ করিম যেহেতু একজন লেখক, এমনিতেই তার কল্পনাশক্তি প্রবল হওয়ার কথা। লেখকমনের কোনো একটি চরিত্র রিমান্ডের যন্ত্রণায় তার অবচেতন মন থেকে কথা বলতে শুরু করলে তা যে কারো কাছে সত্য বলে মনে হতে পারে। সে রকম হলে তো আসল সত্যটাই আড়ালে থেকে যেতে পারে।

এখন তাই কমান্ডারের নিজের মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে যে আসাদ করিমকে আটক করা হয়েছে সে কি আসলেই লাল পতাকার আসাদ? যদি তা না হয়, যদি সে কেবল একটি সাধারণ যুবক হয়, যদি যে কেবল ভাগ্যান্বেষণে এসে থাকে, যে কিনা গ্রাম আর গ্রামের মানুষ নিয়ে ভাবতে চায়, তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে তাকে লালপতাকার সঙ্গে জড়িয়ে কারা ফাঁসাতে চাইছে? কেনই বা ফাঁসাতে চাইছে?

কমান্ডার ডায়েরির শেষ অংশটুকু আবার পড়লেন। আসাদ করিম লিখেছে রবীন্দ্রনাথের মতো আমিও বলতে চাই, ‘সমস্ত সভ্যসমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি তারই এক কোণে বসে মৌমাছির মতো আপনার মৌচাকটি ভরে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলেই আর কিছু চাই নে।’ আর আসাদ নিজের সম্পর্কে লিখেছে, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ হতে পারব না। রবির আলো আমার মধ্যে নেই। আমি এক মাটির প্রদীপ হতে পারি। আমি বলতে চাই, আমার ব্রত মাটির প্রদীপ হওয়া আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।’

কমান্ডারের মনে পড়ছে, কনকচাঁপা নামের মেয়েটি আসাদ করিম সম্পর্কে দৃঢ়কণ্ঠে বলে গেছে ‘আমি আসাদকে জানি। জানি, সে কতটা সরল আর দেশের প্রতি কতখানি নিবেদিতপ্রাণ। সে দেশকে ভালোবাসে, দেশের মানুষকে ভালোবাসে। আর সেটা পোশাকী নয়। যে নতুন প্রজন্ম দেশকে জানে না, সে তাদের দেশের মাটি আর মানুষকে চেনাতে চায়, ভালোবাসতে শেখাতে চায়। সে এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আগামী দিনের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয় সেটাই সে শেখাতে চায়। সে শিশুদের কেবল নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য বাঁচতে শেখাতে চায় আপনাদের বিবেচনায় যদি অপরাধ হয় তাহলে এসবই ওর অপরাধ। আপনারা আমাকে যত অপবাদই দিন না কেন, আমি মানুষের সামনে চীৎকার করে শতবার বলবো, হাজার বার বলবো, আসাদের মতো দুএকজন মানুষ আলো জ্বালাবার জন্য আছে বলেই এখনও অশুভ অন্ধকার দেশটাকে গ্রাস করতে পারছে না।’

Series Navigation<< উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *