উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরো

২৫

বর্ষাকাল বলে এখন গ্রামের পথঘাট স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়ানোর মতো নয়। আসাদ করিমও এখন খুব একটা বের হয় না। বৃষ্টির এই দিনগুলো আসাদের ভাবতে ভাবতে লিখতে লিখতে কাটছে। গল্পের মতো করে সে পতিসরের অভিজ্ঞতা লিখছে। বৃষ্টিধারায় একা বসে লিখতে বেশ ভালো লাগে। লিখতে লিখতে আর ভাবতে ভাবতে সে জানলা পথে তাকালে দেখতে পাচ্ছে, দীঘির জলে বৃষ্টি কখনো খই ফোটায় কখনো বা ধীরলয়ে ঝুমঝুমি বাজাচ্ছে। আর দীঘির ওপাড়ে শানবাধানো ঘাটে মেয়েরা ধারাবরিষণ উপেক্ষা করে শরীর মাঞ্জন করছে। তারা যেন পরস্পর আমোদে মেতে আছে। একজনের সুগন্ধি সাবান নিয়ে অন্যজন ব্যবহার করছে। তাদের কারো মুখ সফেদ ফেনায় ভরে ওঠে আবার বৃষ্টিতে ধুয়েও যাচ্ছে। তারা রিমঝিম বৃষ্টিতে মৎস্যকন্যার মতো আনন্দে ডুবসাঁতার কাটছে। তাদের সাদা হাত রূপালি মাছের মতো জলে ভেসে ওঠে আবার ডুবে যাচ্ছে। গোসল সেরে যে নারী উঠে যাচ্ছে, চলার পথে তার লতানো চুল মাটি ছুঁতে চায়। এইসব নারীদের রূপ আসাদ চুপি চুপি জীবনানন্দের মতো একাকী দেখে যায়।

আজ বিকেলে বৃষ্টি থেমে গেলে আসাদ নিত্যানন্দের চা-এর দোকানে চা খেতে গেল। আজ চা-এর দোকানে লোকজন নেই। চা খেতে খেতে সে আশপাশ দেখতে থাকে। সে দেখতে পায়, বর্ষার পানিতে নদীটা ভরে এসেছে, সামান্যমাত্র স্রোতও বুঝি আছে। ছোটো শিশুরা নদীর জলে লাফিয়ে পড়ে আর সাঁতার কেটে আনন্দ করছে। আসাদের রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ছে। বালকদের দেখে ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের কথা মনে পড়ছে। সে ভাবে, এতবছর পর রবীন্দ্রনাথের চরিত্রগুলো একটুও বদলায় নি। আবহমান বাংলার বুঝি বদল হয় না। এর মানুষও বদলায় না।

আসাদ যখন কিশোরদের সাঁতার কাটা দেখছিল তখন কনকচাঁপা পেছন এসে দাঁড়িয়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল, আপনার কোনো খবর নেই যে!

আসাদ ফিরে তাকালে দেখল কনকচাঁপার মুখে বৃষ্টি ধোয়া কাঁঠালচাপার আলো। কিন্তু ওর হাতে একই বোঁটায় ফুটে থাকা দু’টি কদমফুল। 

আমার আঙিনা দিয়া পরশি হেঁটে যায়, আমাকে সে কেন না জাগায়!

আছে যে বিষঘুমে কে জাগাতে পারে তাকে?

সবসময় আমাকেই আপনার খবর নিতে হবে। আপনি কি আমাদের খবর নিতে পারেন না?

তা পারতাম। কিন্তু─

আমরা যদি কিন্তুর সীমানা অতিক্রম করতে না পারি, তাহলে কেমন করে হবে?

কী হবে আসাদ জানে না, কিন্তু সে জানে সীমানা লঙ্ঘন করা সহজ নয়। যেমন এখন ওর কনকচাঁপার হাতের কদমফুল ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। সে পারছে না। একটা কদমফুল ওর খোঁপায় গুজে দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সে কি সীমানা অতিক্রম করতে পারছে?

আসাদ বলল, সবাই সীমা অতিক্রম করতে পারে না।

কনকচাঁপা বলল, সীমানা লঙ্ঘন না করে নতুন সীমানায় পৌঁছা যায় না।

ঠিক বলেছেন। এমন করে আগে ভাবি নি।

আমাদের বাড়ি চলুন। চা খাবেন।

আজ বরং আমার ওখানে চলুন। নিত্যবাবুকে চা পাঠিয়ে দিতে বলি।

আমাদের বাড়িতেই চলুন। গল্প করতে করতে চা খাবো। আর

আর কী?

আজ আপনাকে নতুন কিছু শোনাবো।

কনকচাঁপা আসাদের চোখে চোখ রাখল। ওর চোখে আসাদ নতুন আলো দেখতে পেল। সে ভাবল, কনকচাঁপা নতুন কোনো কবিতা লিখেছে। সে কবিতা শোনাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছে। কবিতার চাইতে কনকচাঁপার সঙ্গটাই এই পড়ন্ত বিকেলে ওর কাছে বেশি লোভনীয় বলে মনে হলো। সে ভেতরে রোমাঞ্চ অনুভব করছে।

ঠিক আছে, চলুন।

দরোজা খুলে কনকচাঁপা ঘরে ঢুকল। আসাদ বুঝতে পারল বাড়িতে আর কেউ নেই। আজ আর কনকচাঁপার সঙ্গে একা ঘরে ঢুকতে ওর মনে কোনো দ্বিধা কাজ করল না।

বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি।

মনে হয় চা খাওয়াবার জন্যই ডেকেছেন। আর চা খাওয়ার পর্বটা দ্রুত শেষ করে বিদায় দিতে চান।

কনকচাঁপা অপ্রস্তুত। সে আসাদের চোখে চোখ রাখল। এমন কথা শোনার জন্য সে আসাদকে ডেকে নিয়ে আসে নি। একটা সাহিত্যের লোক এমন বুদ্ধু হয় কী করে! কতটা উতলা হয়ে সে ওকে ঘরে নিয়ে এসেছে সেটা বোঝার মতো সামান্য বুদ্ধিও কি নেই!

আসাদ কনকচাঁপার চোখে তাকিয়ে ওর মন বুঝতে চাইছে। অন্যদিনের চাইতে ওকে বেশী চঞ্চল দেখাচ্ছে। সহসা কী যেন সে আবিষ্কারও করে ফেলে।

আচ্ছা, চা নিয়ে আসুন। ভেজা মনটা তাতে চাঙ্গা হবে। আজ আমি নতুন কবিতা না শুনে যাবো না।

আসাদের কথা শুনে কনকচাঁপা আর চা বানাতে গেল না। সে ওর পাশে বসে পড়ল। বসে নিজের দুহাতের নখের রঙ দেখতে লাগল। ওর আঙুলগুলো দেখাচ্ছিল সদ্যফোটা কলার থোড় থেকে বেরিয়ে আসা শিশু কলার মতো। সেগুলো নাচের মুদ্রার মতো অথবা ইশারায় কী কথা বলছিল। আর আসাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কনকচাঁপা বলার মতো নতুন কথা ভাবছিল। ওর ঠোঁট গোলাপপাঁপড়ির মতো কাঁপছে। আর চোখের পাতায় প্রজাপতি নাচছে। তখন বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলে কনকচাঁপা আবৃত্তি করল─এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন বরষায়…। আসাদ অভিভূত হয়ে কনকচাঁপার ঠোঁটের কাঁপন দেখছিল।

কনকচাঁপা আসাদের হাতে হাত রাখল। আসাদ ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে কোনো দ্বিধা করল না। কনকচাঁপা ওর শিহরিত হাতটা আরো বাড়িয়ে দিলে আসাদ হাতটাকে হাতের মুঠোয় নিল। তারপর কনকচাঁপার ঠোঁট আসাদের ঠোঁট স্পর্শ করল। আসাদের মনে হলো, আমি পেলাম। আর যা পেলাম তা অনুপম। ক্রমশ আসাদের তৃষ্ণা বেড়ে যেতে থাকে। আরো বেশি পেতে মন উতলা হয়ে ওঠে। আর তখন বিকট শব্দে বাজ পড়লে দুজনেরই মনে হলো ওদের মাথার উপরই সেটা পড়েছে। ওরা সম্বিত ফিরে পায়। তবু যা পায় সে অপূর্ব, অতুলনীয়। দু’জন নীরবে তাকিয়ে থাকে দু’জনের চোখে। আসাদ ভাবছে, এটা কি সে ঠিক করল? একরকম অপরাধবোধ ওর ভেতরে কাজ করছে। কিন্তু, কনকচাঁপার চোখে আনন্দ তারার মতো ঝিলিক দিচ্ছে। সে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। ওর চোখে কোনো দ্বিধার চিহ্ন মাত্র নেই। কোনো পাপবোধ কিংবা কলুষতা নেই। সে আবার আসাদের হাত নিজের হাতে তুলে নিল।

আমি যে কথা বলতে চাই, তুমি তা শুনতে চাও?

হ্যাঁ।

আমি তোমাকে ভালবাসি।

কনকচাঁপা কোনো দ্বিধা না রেখে আসাদের চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল। কথাটা আসাদের কানে অশ্রুতপূর্ব এক অমোঘ কবিতার মতো শোনাল। আসাদ চুপ করে রইল। ওর কানে কনকচাঁপার কথাটা বারবার অণুরণিত হতে লাগল। কনকচাঁপা আসাদের চোখে পুনর্বার চোখ রাখল, মুখের কাছে নিজের মুখ এনে পুনর্বার ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। আসাদ এবার শান্ত, ধীর। সে চুমো খেয়ে ওকে পাশে বসাল। কনকচাঁপার হাতটা ওর হাতে ধরে রাখল।

আমি তোমাকে ভালোবাসি, আসাদ।

তুমি সবকিছু ভেবে বলছো, পূর্বাপর?

আমি ভেবেছি। আমি এতদিন এমন কাউকে খুঁজেছি যে হবে আমার বোধের অংশীদার। আমার বিশ্বাস জন্মেছে, তুমি আমার বোধের অংশীদার হতে পারবে।

কেমন করে আমার উপর তোমার এতটা বিশ্বাস জন্মেছে?

আমি দেখতে পেয়েছি, আমি যা চাই তুমি তাই চাও। আমি মানুষের পাশে থাকতে চাই। মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। মানুষ বড় অসহায়। তুমি আমার পাশে থাকলে আমরা মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য কাজ করতে পারব।

বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর মেঘ ডাকছে। আসাদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে কনকচাঁপাকে নিয়ে ভেবেছে। কিন্তু কনকচাঁপা ওকে নিয়ে যেভাবে ভেবেছে সে সেরকম করে ভাবে নি। সে জানে, ভাললাগা আর ভালবাসার অর্থ এক নয়। ভালবাসার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। ভালবাসা সবকিছু অতিক্রম করতে সাহস রাখে। কনকচাঁপা সীমা অতিক্রম করার সাহস সঞ্চয় করেছে। সে কি সেই সাহস সঞ্চয় করেছে? ওকে যে সীমানায় এনে আজ কনকচাঁপা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সে কি সেখান থেকে পেছনে ফিরে যাবে নাকি সীমা অতিক্রম করবে?

বাইরে বৃষ্টি আর হাতে হাত রেখে ওরা বসে আছে। যেন হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব করছে। কনকচাঁপা এখন ভাবছে, আসাদকে ভাবতে আরো সময় দিতে হবে। সে ওর নিজের কথা বলেছে। সে মনে করে, প্রতিটা মানুষেরই ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকে। আসাদের যদি এমন কোনো সীমাবদ্ধতা থাকে সেটা অতিক্রম করতে ওকে আরো সময় দিতে হবে। মানুষ মাত্রই সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করে। আর মানুষ সকল সীমা খুব সহজে এবং চাওয়া মাত্র অতিক্রম করতে পারে না।

পতিসরে আসার পর যা যা ঘটেছে আসাদের মনে সব ভেসে উঠছে। আসাদ কাউকে কখনো ভালোবাসার কথা বলবে ভাবেনি। কাউকে কাউকে যে কখনো ভালো লাগেনি তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেয়েই ওর বন্ধু ছিল, ওদের সান্নিধ্য ভালোও লাগত। এখন ওদের কারো সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ নেই। মিতালীকে ওর ভালো লাগত। একমাত্র মিতালীর সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে। আসাদ মনে করতে পারে, কখনো কখনো ওর অজান্তেই একাকী কনকচাঁপার কথা সে ভাবে। ওর সান্নিধ্য ওকে আনন্দ দেয়। ওকে সে ওর ভাবনায় পাশে চায়। কনকচাঁপা যেন ওর পতিসরের একাকী জীবনে চাঁপা ফুলের সৌরভের মতোই। অনেক রাত সে ওকে নিয়ে ভেবেছে। মিতালীকে নিয়ে সে এমন করে কখনো ভাবেনি। তাহলে সে কি কনকচাঁপাকে ভালোবাসতে চায়? আর সেকথা মুখ ফুটে ওকে বলতে পারছে না?

হঠাৎ বহির্দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলে ওরা সম্বিৎ ফিরে পেল। কনকচাঁপা বুঝতে পারল শশাঙ্ক বাবু ফিরে এসেছেন। তিনি ছেলেকে দেখতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তার আজ আসার কথা নয়। কিন্তু এমন ঘনঘোর বর্ষায় তিনি এলেন কী করে! কনকচাঁপা ছাতা নিয়ে দরোজা খুলে দিতে গেল।

বাবা তুমি! এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কী করে এলে?

আমি কখন থেকে কড়া নাড়ছি।

আমি শুনতে পাইনি, বাবা।

তুই একা একা থাকবি ভেবে চলে এলাম। তা কী করছিলি?

গল্প করছিলাম।

কার সঙ্গে? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শশাঙ্ক বাবু জানতে চাইলেন।

আসাদ সাহেবের সঙ্গে।

বসার ঘরে শশাঙ্ক বাবু আসাদকে দেখতে পেলেন।

আদাব। আসাদ দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাল।

আদাব। বসুন। বসুন। এই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে কী করে এলেন!

আসাদ সাহেব বৃষ্টি নামবার আগেই এসেছেন। কুঠিবাড়ির সামনে বেচারা একা একা চা-এর দোকানে বসেছিলেন। বেশ কদিন দেখা হয় নি, মনে করলাম, গল্প করব আর চা খাব। তাই ধরে নিয়ে এলাম। তারপর বৃষ্টি নামল অঝোরে।

ভালো করেছিস। তুই আবার আমাদের জন্য চা তৈরি কর। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।

শশাঙ্ক বাবু ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। কাপড় বদলিয়ে গায়ে চাদর চাপিয়ে আবার বসার ঘরে এসে বসলেন। কনকচাঁপা চা নিয়ে এল। শশাঙ্কবাবু চা খেতে খেতে কী যেন ভাবছেন। আসাদ ভাবছিল, কী নিয়ে কথা শুরু করবে। কনকচাঁপার নতুন কথা শোনার পর ওর মনে হচ্ছে, যা কিছু বলার সেটা কনকচাঁপাকে বলতে হবে। একমাত্র ওকে যা বলবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ওর আর কাউকে কিছু বলার নেই। সে তাই কিছু বলতেও পারছে না। শশাঙ্ক বাবু চা-এ চুমুক দিয়ে নীরবতা ভাঙলেন।

বুঝলেন, মানুষ যখন ভালো কাজের মূল্য বুঝতে পারে না, আর যারা বুঝতে পারে তারাও যখন ভালো কাজের বিরুদ্ধাচরণ করে তখন সমাজ এগোয় না। সমাজে গতি না থাকলে আবর্জনা জমে পূতিগন্ধ হয়। আর কবি তো বলেই গেছেন, যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে এসে তারে।

আসাদ বুঝতে পারছে, শশাঙ্ক বাবু কোনো ঘটনার গৌরচন্দ্রিকা করছেন। সে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিল কিন্তু─ওর মনজুড়ে কনকচাঁপা বসে আছে। সে ওর কথা শোনার জন্য প্রতীক্ষা করছে।

আপনি যত ভালো কাজই করুন না কেন এই সমাজের যারা হর্তাকর্তা তারা সেটা ভালোভাবে নেবে না। তারা আপনাকে নয়, বরং মানুষকে পশ্চাৎমুখী করে রাখার যত আয়োজন সেখানে সহযোগিতা করবে।

এটা তো নতুন কিছু নয়। ধর্মীয় উন্মাদনায় যতটা সহযোগিতা করতে দেখা যায় ততটাই বিরোধিতা করতে দেখা যায় ধর্মনিরপেক্ষ কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আয়োজনে।

আমি ধর্ম-অধর্ম নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমি অন্য কথা বলতে চাইছি। শশাঙ্ক বাবু চা-এ চুমুক দিয়ে শুরু করলেন, আমাদেরই একটা ছেলে, আখলাক আহমদ, ছেলেটি গত বছর ডাক্তারি পড়তে সুযোগ পেয়েছে। ওর বাপ জমির উদ্দিন, সাধারণ একজন মুদি দোকানদার। তার সামান্য জমিজমা ছিল। জমি বন্ধক দিয়ে ছেলেটিকে পড়তে পাঠিয়েছে। সে জমি ছাড়িয়ে আনতে গেলে দেখতে পেল সাফকবলা দলিল করা হয়ে গেছে। এ নিয়ে দরবার বসলে আফজল মেম্বার নতুন কথা বলল।

কী নতুন কথা বলল, বাবা?

বলল, আফজল মেম্বারের মেয়ের সঙ্গে আখলাকের বিয়ে দিতে। তাহলে বন্ধকী জমির সঙ্গে আরো জমি তার নামে লিখে দেবে। আখলাক ছেলে মানুষ, একথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। আর মেম্বারও অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে গেল।

কনকচাঁপা মন্তব্য করল, মানুষের লোভের কোনো সীমা নেই।

তারপর কী হলো?

এর পরের ঘটনা আরো দুঃখজনক। জমির উদ্দিন এখন চেয়ারম্যান হত্যা মামলার আসামী হয়ে জেলে আছে।

কী করে? জমির উদ্দিন কী সর্বহারা পার্টি করে?

জমির উদ্দিন সর্বহারা দল করে না। সর্বহারা যারা করে তাদের নামে মামলাও হয় নি। হবেও না। কারণ, তাদের নাম যারা এজাহারে দিবে তারা বাঁচতে পারবে না। বরং সর্বহারাদের তারা নিয়মিত চাঁদা দিয়ে সম্পর্ক ভালো রাখতে চেষ্টা করবে। জমির উদ্দিনকে আফজল মেম্বার সর্বহারা বানিয়েছে, তার মেয়ে বিয়ে না দিতে পারার প্রতিশোধ নিতে। সে বলেছে, জমির উদ্দিনের ভিটেয় সে ঘুঘু চরিয়ে ছাড়বে।

কেউ এ নিয়ে কথা বলবে না? জমির উদ্দিনের পাশে কেউ দাঁড়াবে না?

কে দাঁড়াবে? যে দাঁড়াবে তাকে সর্বহারা দলের সদস্য বানিয়ে ছাড়বে। আসাদ সাহেব আমি আপনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আপনাকে কে কখন কী ভাবে কোনোভাবে ফাঁদে ফেলে। আপনার চিন্তা আর কাজ অনেকেই পছন্দ করছে না।

আমি তো কারো সাতে-পাঁচে নেই।

জমির উদ্দিনও কারো পাকা ধানে মই দেয়নি। আপনি সাবধান থাকবেন।

আসাদ ঠিক বুঝতে পারছে না! কেন ওকে ফাঁদে ফেলতে পারে। সে শিক্ষকতা করে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সমাজ আর সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলে। ওর কথা ওরা মন দিয়ে শোনে। ওরা ওকে ভালোবাসে। কিন্তু জমির উদ্দিন আর তার মেধাবী ছেলেটার কথা ভেবে ওর খারাপ লাগছে। আর এভাবেই সে কনকচাঁপাকে উত্তর দেবার বিষয়টি তখন ভুলে যেতে পারল। রাত হয়ে গেছে। সে বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ায়।

আমি আজ আসি।

না না, বসুন। আহারটা আমাদের সঙ্গে সেরে তারপর যাবেন। আমি খুশি হবো। বেগুনভাজা টাজা আর খিচুরি করলেই হবে। কনকচাঁপা সেটা করতে পারবে। ততক্ষণ গল্প করে কাটিয়ে দেয়া যাবে।

আজ থাক। জমির উদ্দিন আর তার ছেলের বিপদের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আজ আসি। ভালো থাকবেন।

কনকচাঁপা বাতি নিয়ে দরোজা পর্যন্ত এল। সদর দরোজা পর্যন্ত এসে আন্তরিকভাবেই ওকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল।

আবার দেখা হবে। ভালো থাকবেন।

আসাদ করিম দরোজার চৌকাঠ পেরোবার আগে একবার দাঁড়াল, কনকচাঁপার চোখে চোখ রাখল। কিন্তু, কিছু বলতে পারল না। তখন আবার মুষল ধারায় বৃষ্টি নামল। সে সামনে দ্রুত পা বাড়াল।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসাদ যাচ্ছে। কনকচাঁপা ভাবল, ছাতাটা ওকে দিলে পারত। ততক্ষণে আসাদ বেশ দূরে চলে গেছে। ওর চলার পথে পেছন থেকে কনকচাঁপা তাকিয়ে রইল। আসাদ ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে আসাদ ওকে ছেড়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। কনকচাঁপা ছাতার তলে দাঁড়িয়ে আছে, তবু কেন যেন ওরও বুকের ভেতরটা ভিজে যাচ্ছে।

২৬

আসাদ করিম তার ডায়েরিতে পতিসরে রবীন্দ্রনাথের আগমন সম্পর্কে লিখেছে। এখানকার প্রকৃতি আর মানুষকে কবি কীভাবে দেখেছিলেন সেকথা উল্লেখ করেছে। তার ডায়েরিতে আছে, রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছেন, ‘এটা ধানের দেশ’। মেজর রফিকও আসাদের সঙ্গে একমত। এখানে এসে তারও মনে হয়েছে পুষ্পভরা না হলেও এখানকার মাঠ ধানেভরা। ধানকাটার মৌসুমে প্রতিবছরই এই এলাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে বহুসংখ্যক ক্ষেতমজুর আসে। সংখ্যায় তারা কত হবে সেটা কেউ বলতে পারে নি। আট-দশ, পাঁচ-ছয়, কিংবা তার কম সংখ্যক ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয় তারা কৃষকের ধান কাটার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। দলে উঠতি বয়সের ছোকরা থেকে মধ্যবয়সী এমন কি বয়োবৃদ্ধও থাকে। তারা সবাই কাঁথাবালিশ, হাঁড়িপাতিল, কাস্তে আর বস্তা সঙ্গে নিয়ে আসে। কোনো দল উত্তর থেকে, কোনো কোনো দল দক্ষিণ থেকেও আসে। তবে কোথা থেকে কারা আসে সে কথা কোনো জোতদার বিবেচনায় নেয় না। তাদের কেবল বলিষ্ট শরীরের শ্রম দরকার। এই ক্ষেতমজুররা ইউনিয়ন পরিষদ, স্কুল বা মাদ্রাসার বারান্দায় রাত কাটায়। কোনো কোনো দল পলিথিন দিয়ে ছাউনি করে কৃষকের বাড়ির আঙিনায়ও রাত কাটিয়ে দেয়।

মোজাম্মেল হক একজন জোতদার ছিল। অন্য চেয়ারম্যানরাও তাই। তবু মানুষ তাদের সকল নির্বাচনে ভোট দিয়ে পাশ করায়। এলাকার মানুষ বলে, পাশ না করিয়ে তাদের উপায়ও নেই। তাদের বিপক্ষে যাওয়ার শক্তি সাধারণ মানুষের নেই। বেঁচে থাকার জন্য যারা এক সময় বিলের উপর নির্ভর করত এখন তাদের জোতদারদের করুণার উপর নির্ভর করতে হয়। বিলের জল বর্ষা মৌসুমে জোতদারদের বাধাই জালের দখলে আর শুকনো বিলের তলাও এখন আবাদী জমি, তাদেরই দখলে। বিলে পানি থাকলে মাছ হয়, শুকিয়ে গেলে ধান হয়। জাল আর নৌকা জোতদারদের, জলদাস মাছ ধরে দেয়, জোতদার বিক্রি করে। বিলের পাড়ের দিনমজুররাই জোতদারের ধান রোপন করে আর বানের পানিতে তলিয়ে যাবার আগেই অন্যজেলার মজুর এসে কেটে দেয়। আর সে ধান গোলায় তোলে জোতদার। যে জোতদার জলদাস আর ভূমিদাসদের বিলের পানি আর মাটি কেড়ে নেয় তারা জোতদারের লোক হবে কেন?

কমান্ডার আসাদ করিমের ডায়েরি এবং খুনের প্রেক্ষাপট মনে মনে পর্যালোচনা করলেন। কিন্তু ডায়েরি পড়ে তিনি তার সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। তিনি ভাবছেন, যাদের নাম ডায়েরিতে আছেÑশশাঙ্ক বাবু, আবুল কাসেম মাস্টার আর কনকচাঁপাতিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। আসাদকে আশ্রয় দেবার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার কথা স্থানীয় সূত্রও উল্লেখ করেছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান আর নেতারাও প্রধান শিক্ষক আবুল কাসেম, অঙ্কের মাস্টার শশাঙ্ক বাবু আর তার মেয়ে কনকচাঁপাকে বামপন্থী কর্মকর্তা জড়িত থাকার কথা বলে গেছে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর এই এলাকার ভূ-কৌশলগত সুবিধা আর সমস্যা অনুসন্ধান করতে গিয়ে মেজর রফিক জানতে পেরেছিলেন উত্তরাঞ্চলের এই চলনবিল এলাকা সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। এখান থেকেই বৃহত্তর চলনবিলের শুরু। এর উজানে বরেন্দ্রভূমি। প্রাচীন পুন্ডনগর খুব বেশি দূরে নয়। এই চলনবিলের মৎস্যজীবীরাই দিব্যকের নেতৃত্বে সামন্তরাজের উৎখাত করেছিল। জমিদারি আমলে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের ঢেউও এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছে ছিল বলে জানা যায়। নকশাল আন্দোলনও এই এলাকাতেই দানা বেঁধেছিল। একজন নকশালপন্থী নেতার নেতৃত্বে একসময় বিপ্লবী রাজনীতি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। নকশালপন্থী হয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদান রেখেছিলেন। গোপন আক্রমণের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর নর্দান কমান্ডকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। আত্রাই-এর সাহাগোলা রেলসেতু কমান্ডো আক্রমণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়ে শতাধিক পাকিস্তানি আর্মিকে তার দল হত্যা করেছিল। সেই নেতা স্বাধীনতাত্তোরকালেও গোপন একটি বিপ্লবী দল সংগঠিত করেছিলেন। একপর্যায়ে ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে একটি সমঝোতার মাধ্যমে তিনি গোপন রাজনীতি ছেড়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন। কমান্ডার জানেন যে, একবার অস্ত্রাগারের অস্ত্র বাইরে চলে গেলে তার সবকটি আর অস্ত্রাগারে ফিরে আসে না। তেমনি কোনো এলাকায় গোপন দল একবার কোথাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েও একেবারে নির্মূল করা যায় না। এটা মারাত্মক অণুজীবের সংক্রমণের মতো। এর জীবাণু থেকে পুনরায় মহামারী আকার ধারণ করতেও পারে। সন্ত্রাসবাদী দলের কার্যকলাপ তাই চিরতরে মুছে ফেলা যায় না। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিলিয়ে থাকে বলে চিরুনি অভিযানেও সব সন্ত্রাসীকে কখনো ধরা সম্ভব হয় না। আর আসল সন্ত্রাসীরা জঙ্গলের বর্ণিল গিরগিটির মতো। তারা বিপদে নিজেদের রঙ বদলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে খুবই পারদর্শী। আর সেকারণেই প্রকাশ্য হাটের উপর শিকার করেও তারা সহজেই লুকিয়ে পড়তে পারে। মানুষের মাঝে লুকিয়ে থেকেই সর্বহারারা তাদের ভয়ানক ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য মাঝে মাঝে এমন কি প্রতিবছরই কোনো না কোনো প্রভাবশালীকে টার্গেট করে খুন করে। সে ক্ষেত্রে যার দাপট আর অত্যাচার বেশি তাকেই তারা বেছে নেয়।

মেজর রফিক ভাবছেন, বিলের পাড়ের গ্রামগুলোর জলদাস আর ভূমিদাসদের মধ্যে একটি সশস্ত্র গলাকাটা দল কি একারণেও জন্ম নিতে পারে না? নিজেদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিলে তারাই বা ছেড়ে দেবে কেন? খুন হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত মোজাম্মেল চেয়ারম্যানের বাড়িতেও ক্ষেতমজুর ছিল। বাইরের জেলা থেকে আসা ক্ষেতমজুর আর কয়েকজন স্থানীয় মজুরও ছিল। খুনের পরদিন পুলিশের ভয়ে তাদের সকলেই গ্রাম থেকে ভেগেছে। তারপরও পুলিশ আশে পাশে যাদের পেয়েছে তাদের এবং স্থানীয় দু’চারজনকে বেঁধে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের মধ্যে একজন প্রাক্তন চেয়ারম্যানও আছে। কিন্তু কারো নিকট থেকেই কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারে নি। মোজাম্মেল চেয়ারম্যানের আগে সর্বহারাদের হাতে আরো কয়েকজন খুন হয়েছে। তারাও সমাজে প্রভাবশালী ছিল। খুন করার পর সর্বহারারা শ্লোগান দিতে দিতেই সকলের সামনে দিয়ে সরে গিয়েছিল। কেউ তাদের চিনতে পারে নি। পুলিশ কারো খুনিকেই পরবর্তীতে ধরতে পারে নি।

 মেজর এখন দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি যেমনটি ভেবেছিলেন বিষয়টা সেরকম বলে এখন আর মনে করতে পারছেন না। ডায়েরিটা পড়বার আসাদের গ্রেফতারের বিষয়টা তার কাছে ঘোলাটে হয়ে উঠছে। তিনি ভেবেছিলেন আসাদের গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে সর্বহারার নামে যারা মানুষের গলা কাটে, আড়াল থেকে হুমকি দিয়ে চাদাবাজি করে,অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায় তাদের কাবু করার একটা উপায় বের করা যাবে। কিন্তু আসাদ নামের লোকটাকে গ্রেফতার করার পর যেন সর্বহারাদের বিপক্ষে আসলে এলিট বাহিনীর গোয়েন্দাগিরির দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়ে গেছে।    

Series Navigation<< উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব ষোলউপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *