উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।।পর্ব তেরো

গ্রামের ভেতর ঢুকলে চোখে পড়ে ছোটো ছোটো ঘর। খুবই কাছাকাছি গা ঘেষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড় যেন সত্যি মিলেমিশে আত্মীয়ের মতো আছে। আর কাজল কালো দীঘি তো আছেই। এখন বাড়তি সৌন্দর্য মাঠভরতি

সোনালি ধান। ‘মাঠভরা ধান তার জলভরা দীঘি’ ‘যে কত বাস্তব পতিসর না এলে আর কোনো দিনই হয়তো আর মনে পড়ত না। মাঠের ধান দেখে আসাদ করিমের রবীন্দ্রনাথকেও মনে পড়ছে। পতিসর থেকে এক চিঠিতে ধান মাড়াই করার জন্য একটা কল বসানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘এটা ধানেরই দেশ।’

এরই মধ্যে প্রতিটা বাড়ীর উঠোন আর গোলাঘর লেপেমুছে ঝকঝকে তকতকে করা হয়ে গেছে। সবুজ আর হলুদ মিশিয়ে ফসলের মাঠ যে মনোরম সেজেছে তার থেকে চোখ ফেরানো যায় না। মানুষের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। সকলের মধ্যেই কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। পুরুষেরা হাট থেকে বাঁশ-বেতের নতুন ধামা, চাটাই কিনে বাড়ী ফিরছে। ঈদের জন্য যেমন শিশুরা প্রতীক্ষা করে তেমনি মাঠের দিকে তাকিয়ে নতুন ফসলের জন্য উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছে। উত্তর জানা থাকলেও মানুষের মুখে মুখে একই প্রশ্ন ঘুরে ফেরে বারবার। দোকানে, হাটে-পথে-ঘাটে সবখানে একই প্রসঙ্গ, ধান কে কবে কাটবে। মাসের কতদিন আর বাকী আছে? আজ তারিখ কত? বার-তের মনে হয়। আর দুএকদিন। আল্লাহ আল্লাহ কর। শিলা পড়ে সব শেষ যেন না হয়। আল্লাহ যেন মাঠ বাঁচিয়ে রাখে। হ্যাঁ, বৃষ্টিও নাই, মেঘও নাই, তবু গরম যা পড়ল। এমন গরম কালবৈশাখীর লক্ষণ। আল্লাহ ভরসা।

তারপর দেখতে দেখতে চারিদিকে ধান কাটার ধুম লেগে গেল। মাঠে ধান, পথে ধান, উঠোনে ধান, হাটেও।

ধানকাটা শুরু হওয়ার পর মানুষের ব্যস্ততার শেষ নেই। সহসা কেমন করে যেন পতিসরের জনজীবন বদলে যেতে লাগল। দেখা গেল কোথা থেকে কুঠিবাড়ির সামনে কিছু লোক এসে জড়ো হচ্ছে। তারা দূরের কোনো জেলা থেকে জন খাটতে এসেছে। ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে পুকুর পাড়ে, গাছের তলায় গল্প করছে, দোকানের সামনে জড়ো হয়ে বসে বিড়িও ফুঁকছে। নিত্যানন্দের দোকানেও এখন বেশ জটলা। তাদের আগমনের কারণ আসাদ বুঝতে পারল যখন বিত্তবান কৃষকদের কেউ কেউ এসে তাদের সঙ্গে ধান কাটা আর মাড়াই নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। বিঘাপ্রতি ধানের পরিমাণ নিয়ে দরকষাকষি করে বনিবনা হলে কোনো কোনো কৃষক মজুরদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।

বিকেলে মাঠের একপাশে চুলা জ্বালিয়ে চাল-ডাল-সবজি একসঙ্গে বড় পাতিলে লোকগুলো রান্না করছিল। দূর থেকেই খিঁচুড়ি রান্নার সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। সূর্য ডোবার আগেই তারা খাওয়াও সেরে নিল। সন্ধ্যার পর থেকেই কুঠিবাড়ির বারান্দায় চাটাই-মাদুর পেতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটু দূরে দূরে জনাকয়েক বসে। কেউ গান ধরেছে, কেউ রাজারানির কিস্সা বলছে। কেউ একটু দূরে দীঘির পাড়ে বসে মেঠো সুরে বাঁশী বাজাচ্ছে। আসাদ করিমের বনভোজনের কথা মনে পড়ল। এরই মধ্যে কেউ চাদরমুড়ি দিয়ে নাক ডাকছে। কেউ মুখস্থ পুঁথিপাঠ করছে। অন্যরা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শুনছে। শুনতে শুনতে কেউ টিপ্পনি আর ফোড়ন কাটছে। দেখে মনে হচ্ছে লোকগুলোর কোনো চিন্তাভাবনা নেই। যেন এদের চাইতে সুখীও আর কেউ নেই। তারা যেন এদেশের সন্ন্যাসী কিংবা আউল-বাউলদের চাইতেও নির্ঝঞ্ঝাট। যেন কারো কোনো সংসার নেই, ছেলেপুলে নেই, পিছুটান নেই। কিংবা সংসারের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহও নেই। কখন যে পেঁচারা শিমুলডালে এসে বসেছিল কেউ খেয়ালও করে না। পেঁচা ডাকলে সত্যি সত্যি রাত নেমে আসে। তখন পুটলা-পুটলি মাথার তলে দিয়ে কুঠিবাড়ির বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন হলে আসাদও নিজের ডেরায় ফেরে। এদের দেখে এসে আসাদ করিমের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পল্লীসাহিত্য প্রবন্ধের কথা মনে পড়ল। তার মনে পড়ল, সামান্য পতিসর যেমন করে রবীন্দ্রনাথকে গভীর মমতায় বুকে ধারণ করে রেখেছে তেমনি এইসব অশিক্ষিত মানুষেরাই বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকসাহিত্যের লেশমাত্র হলেও মুখে মুখে ধারণ আর লালন করে আজো বাঁচিয়ে রেখেছে। শহীদুল্লাহ যেমন আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে গেছেন তেমনি করে এইসব হারানো সাহিত্যের কণাগুলোকে যদি আবার নতুন করে জীবন দেয়া যেত! ভাবতে ভাবতে রাত আরো গভীর হয়ে আসে। তখন আকাশে ঢাকঢোল আর দামামা বাজিয়ে বাতাস আর বৃষ্টি হতে শুরু করল। আসাদ শুনতে পেল, দরোজায় কেউ হয়তো কড়া নাড়ছে। সে ভালো করে কান পাতে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর বাজ পড়ার শব্দ। তারপর পুনর্বার দরোজায় করাঘাত।

কে?
দরোজাটা একটু খুলবেন, আমরা বিপদে পড়েছি।

আসাদ কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর দরোজা খুলে দেয়। দমকা বাতাসে বৃষ্টির পানির ছাঁট ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ক্ষেত মজুরও না ঢুকে পারে না। তারা ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। ঢুকে এমন কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইল যেন বড় অন্যায় করে ফেলেছে।

আমরা বারান্দায়ও জায়গা পাই নাই। কী করুম। না পাইরা ঢুকছি। আপনি ঘুমান। আমরা চুপ কইরা মাটিতে বইসা থাকুম। একটুও নড়াচড়া করুম না।
কিন্তু সবাইকে বসার জায়গা কোথায় দিই?
আপনার আর কিছু করা লাগব না। আপনি খালি আমাদের একটু বসার অনুমতি দেন। বৃষ্টি ছাড়লে চইলা যামু। আমরা মাটিতে বসতে পারুম।
আপনারা বসুন।

লোকগুলো মাটিতেই বসে পড়ল। হারিকেনের তেল ফুরিয়ে গেলে বাতিও নিভে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকগুলো গায়ে গা মিলিয়ে জড়ো হয়ে এক অদ্ভুত একাত্মতায় মিলেমিশে নাক ডাকতে শুরু করল। আসাদ অগত্যা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ধীরে বাতাসের দাপট কমে গিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সমস্ত চরাচর বৃষ্টির ধারাপাতে সিক্ত হতে লাগল। শরীরের সঙ্গে শরীর মিলিয়ে এই নিঃস্ব মানুষগুলোর গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার মধ্যেও সে এক পরম ঐক্যবন্ধন উপলব্ধি করে। কিন্তু এই বন্ধনটা ক্ষমতার পালা বদলের সময় আর থাকে না। এখনো গ্রামে পঞ্চাশভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে। আশিভাগ সম্পদ বিশভাগ মানুষের হাতে। তবু নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবে এমন নেতৃত্ব তারা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কেন পারে না? এই প্রশ্ন আসাদকে রাতভর জাগিয়ে রাখল।

১৬

পুজোর ছুটিতে অখÐ অবসর। আর চারিদিক নীরব, শান্ত। এখানকার লোকজনের সাথে আসাদ তেমন একটা মিশতে পারছে না। এখনও এখানে নিজেকে খড়ের গাদার পাশে বসতে যাওয়া আঁটোসাঁটো পোশাকের সেই যুবকের মতো মনে হয়। আল-মাহমুদের কবিতায় এমনি এক যুবক আছে যে গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে আধুনিক পোশাক পরে আবার গ্রামে ফিরে এসে আর সহজ হতে পারে না। এখানকার লোকজনও ওকে সেই যুবকের মতো আর নিজেদের লোক ভাবতে পারছে না। হয়তো ওদের মতো করে সেও ভাবতেই পারছে না। সে এখানকার ভাষায় কথা বলতে পারে না। সে ভাবে, তাহলে ভাষার দূরত্ব মানুষের সাংস্কৃতিক দূরত্ব অতিক্রম করার বেলায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ ভাষাই সংস্কৃতির প্রধান বাহন। আসাদ এই দূরত্ব অতিক্রম করতে চায়। ইদানিং সে সামান্য মুখচেনা কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাসিমুখে ‘কেমন আছেন’ ‘আপনার ছেলেটা কেমন পড়ালেখা করছে’ ইত্যাদি বলে তাদের সঙ্গে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ কেউ ওর কথা বুঝতে না পেরে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো কখনো ওকে বিব্রতও হতে হয়। যেমন, সে যাকে ছেলের পড়ালেখার কথা জিজ্ঞেস করে পরে হয়তো জানতে পারে ঐ লোকটির কোনো ছেলেই নেই।

তবু আসাদ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে নিজেকে তাদের কাছের লোক হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এতে ওর ভুলভ্রান্তি হবে সেটা সে জানে। সে ভাবে, রবীন্দ্রনাথ যদি জমিদারপুত্র হয়ে গ্রামের মানুষের কথা আর তাদের মনে স্থান করে নিতে পারেন সে কেন পারবে না? কবি কেমন করে পেরেছিলেন সেটাই ওকে বুঝতে হবে।

আজ সকাল থেকেই আসাদ রবীন্দ্রনাথে ডুবে ছিল। অনেকটা আলস্য-জড়তা কাটানোর জন্য বেলা এগারটার দিকে কুঠিবাড়ির দিক ঘুরতে বের হলো। সেখানে এখন সারাদিনই চা পাওয়া যায়। কুঠিবাড়ির মাঠে এখন মহিষের গাড়ি ছাড়াও ভটভটি ভীড় করে থাকে। ধান কেনার জন্য আগত পাইকাররা গেরস্থদের ধান কিনে নিয়ে এসব বাহনে করে চাতালে নিয়ে যায়। তাই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকে। চা-এর স্টলেও সারাদিনই আগুন জ্বলে।

আসাদ স্টলে বসে চা-এ চুমুক দিয়ে দেখতে পায়, কুঠিবাড়ির সামনে বেশ লোক সমাগম হয়েছে। বস্তাভর্তি ধান ভটভটি আর ভ্যানে তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে ধান মাপা হচ্ছে। হাটবার না হলেও ধান কেনাবেচা হচ্ছে। ওর মনে পড়ে কোনো একটি কবিতায় সে পড়েছিল, ‘কৃষকের মুখে সোনালি ধানের হাসি লেগে আছে।’ আর ‘কৃষাণির নাকফুল সোনার ধানের মতো হাসে।’ সে কুঠিবাড়ির গেটে একটা সাদা গাড়ি দেখতে পায়। বুঝতে পারে কোনো আগন্তুক কুঠিবাড়ি দেখতে এসেছেন। তাতেই এই ভীড়। ভীড় দেখে ওর নিজের মনেও কিছুটা আগ্রহ জেগে উঠেছে। টাইস্যুট পরা একজন সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে আরেকজন সাহেব আগে আগে হাঁটছেন। আর খানিকটা দূরত্ব রেখে এলাকার লোকজনও তাঁর সঙ্গে হাঁটছে। সাহেব মাঝে মাঝে ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক কুঠিবাড়ির ছবি তুলছেন। সে চা শেষ করে কাছাকাছি যেতেই শুনতে পেল─

ঐ যে, মাস্টার সাহেব আসছেন। তিনি ভালো বলতে পারবেন।
আপনি টিচার?
জ্বী।
কী পড়ান?
বাংলা।
আপনি সাহিত্যের লোক?
জ্বী।
পতিসর আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানেন?
সামান্য কিছু।
কী নাম আপনার?
আসাদ করিম।
হ্যাঁ, সাহিত্যিক নামই বটে। লেখালেখি করেন?
কখনো সখনো।
কী লেখেন? কবিতা?
না, গল্প।

খুব ভালো। রবীন্দ্রনাথ আর পতিসর সম্পর্কে জানেন কিছু?
আমি পতিসর সম্পর্কে তেমন জানি না। এখানে আসার পরই রবীন্দ্রনাথের জমিদারি ও পতিসরের সংগে তাঁর যোগসূত্র সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। এখনও এ বিষয়ে পড়ছি।

স্থানীয় কেউ কি জানে না?
শশাঙ্ক বাবু জানতে পারেন।
শশাঙ্ক বাবু?
আজ্ঞে, আমি স্যার, শশাঙ্ক দাস। আমি রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান শিক্ষক।
আপনি কী জানেন?

এই জমিদারি দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে কিনেছিলেন। তারপর উত্তরাধিকার সূত্রে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সব শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে পারিবারিক এজমালি সম্পত্তি হিসেবে দেখাশোনার দায়িত্ব পান এবং পরে জমিদারি ভাগাভাগি হলে নিজের ভাগের অংশ হিসেবে নিজেই এই কালীগ্রাম পরগনার জমিদার হন।

সাহেব হাঁটতে হাঁটতে কথা শুনছেন, দেখছেন আর ছবিও তুলছেন। ভাঙা দেয়ালের দিকে তাঁর চোখ পড়লে তিনি থেমে গেলেন। সেখানে কে একজন নতুন একটা দোকান ঘর তুলছে। তিনি প্রশ্ন করলেন

এ-সব বাড়ী-ঘর, জায়গা-জমি কে দেখাশোনা করছে?
আসাদ বা শশাঙ্ক বাবুও এ বিষয়ে কথা বলল না। পাশ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তহশিলদারকে তথ্য দিতে ইঙ্গিত করলেন।
স্যার, আমি এখানকার তহশিলদার।
ঐ যে ঘর উঠছে সেটা বৈধভাবে তুলছে বলে মনে হয় না। এসব দেখুন। আচ্ছা, আপনি বলতে পারবেন, জমিদারের খাস জমাজমির পরিমাণ কত ছিল?
স্যার, রেকর্ডপত্র অনুযায়ী এখনো প্রায় ১২৫ একর সম্পত্তি জমিদারের খতিয়ানেই আছে। তবে সবই এনিমি প্রপার্টি, মানে ভেস্টেড প্রপার্টির তালিকাভুক্ত।
হোয়াট! কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পত্তি এনিমি প্রপার্টি? কী করে হলো?
জ্বী, স্যার, জরিপ বিভাগের রেকর্ডপত্রে তাই তো আছে।

রবীন্দ্রনাথ মারাই গেলেন ১৯৪১ সালে, আর এনিমি প্রপার্টি অর্ডিন্যান্স হলো ১৯৬৫ সালে, স্টেট একুইজিশনও হয়ে গেল ১৯৫৫ সালে। তাহলে কী ভাবে সম্ভব! না না, এটা অসম্ভব।

স্যার, সম্ভবত জরিপ বিভাগের ভুল হয়েছে।
বাংলাদেশ দেশ স্বাধীন হবার পরও তো জরিপ হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ জরিপ কত সালে হয়েছে?
স্যার, ১৯৭৮ সালে।

না, না, এতবড় ভুল কী করে হয়! আসলে এমন ভুল হতে পারে না। আমার মনে হয় না, এটা নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতো ভুল কাজ। আচ্ছা, বাড়ীটা কীভাবে, কার দখলে আছে?
সরকারের দখলেই আছে। কুঠিবাড়িতেই স্যার তহশিল অফিস। সব কাছারি বাড়ীই স্যার স্বাধীন হওয়ার পর তহশিল অফিস করা হয়েছে।

অন্য জমিদারের বাড়ী আর রবীন্দ্রনাথের বাড়ী এক হয় কী করে? এটা তো কোনো সাধারণ বাড়ী নয়। এটাতো রবীন্দ্রনাথের বাড়ী, বাঙালীর হেরিটেজ। একে রক্ষা করা উচিৎ।
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, স্যার আমরা ব্যবস্থা নিব।
হ্যাঁ, তোমার ডিসিকে বলবে প্রত্নত্ত্ব বিভাগকে লিখতে। আমি বিষয়টা উপর থেকেও দেখবো।
জ্বী, স্যার। আমি স্যারকে আজই আপনার কথা বলবো।
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রথম কখন আসেন?
রবীন্দ্রনাথ প্রথম পতিসর আসেন ১৮৯১ সালের জানুয়ারী মাসে।
কী করে এসেছিলেন এই অজগাঁয়ে?

তখন স্যার এখানে আসার আসলে তেমন কোনো পথ ছিল না। শিলাইদহ থেকে কবিগুরু বজরায় এসেছিলেন। পরেও বহুবার এসেছেন। তিনি এখানকার মানুষকে খুব ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন বলেই এই দুর্গম আর এই সভ্যতাবর্জিত জনপদে আসতেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখানে এসেই মাটি আর মানুষের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। এখানে না এলেও রবীন্দ্রনাথ হয়তো খ্যাতি অর্জন করতেন কিন্তু তিনি মাটির কাছের মানুষকে তেমন করে চিনতেন কিনা সন্দেহ করি।

মানে?

চিত্রা আর চৈতালির কাব্যভাবনা আর তাঁর আগের কাব্যভাবনা মিলিয়ে দেখুন তাহলেই তফাৎটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। সন্ধ্যা পতিসরে রচিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা। দেখুন না কী আছে এই কবিতায়Ñ

                                ক্ষান্ত হও, ধীরে কথা কও। ওরে মন,
                             নত করো শির। ওই শোনো বাজে
                             নিঃশব্দ গম্ভীর মন্দ্রে অনন্তের মাঝে
                             শঙ্খঘণ্টাধ্বনি। ধীরে নামাইয়া আনো
                             বিদ্রোহের উচ্চকণ্ঠ পূরবীর ম্লান-মন্দ স্বরে।

এই কবিতায় কবির ভাবনায় যে পরিবর্তন সেটা লক্ষ্য করবার মতো। এর আগে তো কবি কল্পনার জগতেই ছিলেন। সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট তাঁর কবিতায় এর আগে এমন ভাবে দেখা যায় নি। তাঁর নিজের ভাষায়─

                                সংসারে সবাই যখন সারাক্ষণ শতকর্মে রত
                             তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
                             মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ন তরুচ্ছায়ে
                             দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
                             সারাদিন বাজাইলি বাঁশি।

দেখুন, পতিসর আসার আগে রবীন্দ্রনাথ মানুষ থেকে কতটা দূরে ছিলেন সেটা কবি নিজেই বলেছেন। তিনি তো এর আগে মাটিতেই নামেন নি। স্বর্গের দেবতাদের নিয়েই ছিলেন, তাঁর কাব্যদেবতারা যে মর্ত্যভ‚মিতে বসবাস করেন সেটা তো বাংলাদেশের গ্রামে এসেই প্রথম উপলব্ধি করেন। এখানেই প্রথম মাটিতে নেমে আসেন। এখানে এসেই কবি সত্যিকার মাটির মানুষ দেখেন। এর আগে উঁচুতলার দেবতাদের মতো সুন্দর সুন্দর মানুষ দেখেছেন। কাব্যেও স্বর্গের দেবতার বন্দনা করেছেন। পতিসর না এলে হয়তো কবির কবিতায় মাটির মানুষকে পাওয়া যেত না। কবি হয়তো কালিদাস আর অন্যান্য কবির মতো স্বর্গের দেবতাদের গুণকীর্তন করেই অনেক সুন্দর কবিতা লিখতেন। কিন্তু মানুষ চিনতে পারতেন না। যদি মানুষের কাছে না পৌঁছুতেন তাহলে তাঁর কবিতায় পতিসরকে পাওয়া যেত না। আমি কী ভুল বললাম?

সচিব শশাঙ্ক বাবুর দীর্ঘ বর্ণনা শুনে মুগ্ধ হলেন। তিনি বললেন, আমি রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েছি, কিন্তু আপনার মতো করে পড়েছি বলে মনে হয় না। আমি এভাবে কখনো ভেবে দেখি নি। আর রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাঠ করেছি একজন উদার প্রকৃতিপ্রেমী আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি আত্মসমর্পিত কবি হিসেবে। আধুনিক মানুষও আধ্যাত্মিক সংকটে তাঁর কবিতায় আশ্রয় খুঁজে পান। তিনি জমিদারের সন্তান, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে চারদেয়ালের মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন। খুব অল্প বয়সেই বিলাত গিয়েছেন, সেখানে ইংরেজ পরিবারে তাঁর নগর জীবনাচরণের দীক্ষা হয়েছিল। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর চলাফেরা উঁচু মহলে। তাঁকে আমরা উঁচু তলার মানুষ বলেই ভাবতে অভ্যস্থ। এখনো সেই অভ্যাস আর চিন্তা মাথায় নিয়েই আমরা রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে আর জানতে চেষ্টা করি। মাটির কাছের কবি হিসেবে কখনো তাঁকে ভাবি নি।

স্যার, আপনার কথা সবই সঠিক। কিন্তু, আমি বলছি বাংলাদেশে আসার পর কবির ভাবনায় পরিবর্তন এসেছিল। গ্রামে এসে মানুষের দারিদ্র্য আর দুঃখকষ্ট দেখে তাঁর জীবন দর্শনেও পরিবর্তন ঘটেছিল। আসলে মাটির কাছের রবীন্দ্রনাথকে কেউ এ পর্যন্ত পরিচিত করিয়ে দেন নি।

সচিব বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল, তিনি মাটি ও মানুষের নাগাল থেকে দূরে অবস্থান করেছেন, স্বপ্নবিলাসী ও বুর্জোয়া মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন।

আসাদ নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারছে। সে রবীন্দ্রনাথ পড়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে আরো ভিন্নতর পাঠ, মাটির মানুষের চোখে মানুষের রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে পাঠ সম্ভব সেটা আগে ভেবে দেখে নি। এমন কী বাংলা সাহিত্যের বড় বড় পন্ডিতদের ক’জন এমন করে ভেবেছে তাও ভেবে দেখার বিষয়।

শশাঙ্ক বাবু বেশ উৎসাহিত বোধ করছেন। তিনি বললেন, সনাতন ধর্ম মতে মানুষ প্রকৃতিরই সন্তান। তাই বোধের সূচনাতেই মানুষ প্রকৃতিকে পূজা করতে শুরু করেছিল। রবীন্দ্রনাথ একথা মানতেন। প্রকৃতিকেও কেউ না কেউ সৃষ্টি করেছেন। যে স্রষ্টা প্রকৃতির এমন বিপুল ভান্ডার, জীব আর জড়বস্তুর ভারসাম্য করে সৃষ্টি করেছেন তাঁকে তিনি কখনো অস্বীকার করেন নি। কিন্তু স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি হয়েও মানুষ যখন অমানবিক আচরণ করে তখন রবীন্দ্রনাথ তাদের অন্তর থেকে ধিক্কার দিয়েছেন।

সচিব শশাঙ্ক বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এত কথা জানলেন কী ভাবে?

স্যার, কবির নিজের লেখাতেই গ্রামের মানুষ নিয়ে তিনি কী ভাবতেন তা আছে। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ উপন্যাস সবখানেই আছে। আর এসব তিনি তো নিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকেই। এখানে এসে তিনি বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের অবস্থা চাক্ষুষ করেন। এখানে আসাতেই তো কবি গ্রাম চিনেছিলেন আর গ্রামের মানুষের দুঃখ-কষ্টও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি গ্রামের মানুষের জীবন, তাদের দুঃখ-কষ্ট দেখে তাদের জন্য কিছু করবার চিন্তা করেন। এখানে আসার পরই তাঁর গ্রামোন্নয়নের চিন্তা মাথায় আসে। কবি এখানে এসেই দেখেন, ‘গ্রামের মধ্যে চেষ্টার কোনো লক্ষণ নাই। … যে-সকল পন্ডিত সমাজের বন্ধন ছিলেন তাঁহাদের গন্ডমূর্খ ছেলেরা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যবসায় ধরিয়াছে।…দুর্ভিক্ষ ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে; আকাল পড়িলে পরবর্তী ফসল পর্যন্ত ক্ষুধা মিটাইয়া বাঁচিবে এমন সঞ্চয় নাই।…অন্ন নাই, স্বাস্থ্য নাই, আনন্দ নাই, ভরসা নাই, পরস্পরের সহযোগিতা নাই, আঘাত আসিলে মাথা পাতিয়া লই,…।’ ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় এই চিত্রটা সরাসরি উঠে এসেছে। সাম্পপ্রতিককালে বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনায়কগণও গ্রাম বাঁচানোর কথা বলেন, জনগণের শক্তিকে কাজে লাগানোর কথা বলেন। এসব কথা আসলে রবীন্দ্রনাথেরই কথা। কবির সঙ্গে তাঁদের তফাৎ হলো, তাঁরা কথা বলেন বেশী বেশী, কিন্তু মাটিতে নামেন না, মাটির সঙ্গে সংযোগ না থাকায় মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন না। অথচ কীভাবে গ্রাম বাঁচানো যায়, কীভাবে মানুষের কল্যাণ হয় সে পথ রবীন্দ্রনাথ একশ বছর আগেই এই পতিসরে দেখিয়েছিলেন।

কী ভাবে মানুষকে পথ দেখিয়েছিলেন? সচিব প্রশ্ন করেন।

রবীন্দ্রনাথ পতিসরে এসে উপলব্ধি করেন, গ্রাম বাঁচাতে হলে সমবায় নীতি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। ভাগকরা শক্তির অপচয় তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। কবি নিজেই বলেছেন, সাধারণের হিতের জন্য প্রত্যেককে নিজের সামর্থ্যে খাটাইবার অভ্যাস যদি কোনোমতে পাকা হইয়া যায় তাহা হইলেই তোমার চেষ্টার সার্থক হইবে। পল্লীউন্নয়ন কী ভাবে হবে, তার মডেল তৈরী করে পতিসরে বাস্তবায়ন করেন।

কবি দেখতে পেয়েছিলেন, বাংলাদেশে সমবায় প্রণালী কেবল টাকা ধার দেওয়ার মধ্যেই ম্লানয়ে আছে। ঐ ব্যবস্থা মহাজনী গ্রাম্যতাকেই কিঞ্চিৎ শোধিত আকারে বহন করছে। সম্মিলিত চেষ্টায় জীবিকা উৎপাদন ও ভোগের কাজে সে লাগল না।…কো-অপারেটিভ যোগে অন্য দেশে যখন সমাজের নীচের তলায় একটা সৃষ্টির কাজ চলছে, আমাদের দেশে টিপে টিপে টাকা ধার দেওয়ার বেশী কিছু এগোয় না। কেন না ধার দেওয়া, তার সুদ কষা এবং দেনার টাকা আদায় করা অত্যন্ত ভীরু মনের পক্ষেও সহজ কাজ। মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে সমবায় পদ্ধতিতে ১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষিব্যাংক চালু করেন। নোবেল পুরস্কারের ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকাও এই ব্যাঙ্কে বিনিয়োগ করেন। গ্রামের মানুষকে স্বনির্ভর ও জাগরিত করে তোলার মধ্যদিয়েই গ্রামোন্নয়ন সম্ভব! এটা ছিল রবীন্দ্রনাথের উন্নয়নাদর্শের মূল কথা। এমন কি তিনি রাজস্ব নির্ধারণ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য হিতৈষী সংঘ এবং মন্ডলীপ্রথা চালু করেন। সম্ভবত, এটাই বৃহত্তর বাংলাদেশে প্রথম কৃষি ব্যাংক। গ্রামোন্নয়নের আর অন্যসব বিষয় তো ছিলই। তিনি নিজের ছেলেকে সেকালে আমেরিকার ইলিনয়স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যা শিখিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের জমিদারি এলাকায়। রথীন্দ্রনাথকে পতিসর নিয়ে এসে কলের লাঙল চালিয়ে কৃষির আধুনিকায়ন করে বহুমুখী কৃষিখামারের ধারণাটির সফল বাস্তবায়ন করেছিলেন। এদেশের কৃষি আর গ্রামের উন্নয়নের জন্য তিনি কী কী করেছিলেন সেসব তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখায় আর বক্তৃতায় আছে। তাঁর এখানকার জমিদারির প্রজারা ছিলেন মুসলিম। তাদের সঙ্গে কবির কী মধুর সম্পর্ক ছিল সেটা বোঝা যায় ১৯৩৭ সালে যখন শেষবার কেবল ভালোবাসার টানে পতিসরের মানুষের সাথে দেখা করতে আসেন।

আপনি যা বললেন এরকম আগে আর শুনি নি। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা শান্তি-নিকেতন, শিলাইদহ আর শাহজাদপুরের কথা বলেন। পতিসরের কথা তো তেমন করে বলেন না। সচিব মন্তব্য করলেন, আমার মনে হয়, পতিসরের দুর্গমতাই পতিসরকে পন্ডিতদের চোখ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।

স্যার, সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি ছিল কালীগ্রাম-পতিসর। শাহজাদপুর এজমালি থাকতেই বিক্রি হয়ে যায়, শিলাইদহ ঠাকুর জমিদারি শেষবার ভাগ হওয়ার পর তাঁর ভাইয়ের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ভাগ্যকুলের জমিদার কুন্ডুদের কাছে ১৯২২ সালেই বিক্রি করে দেন। ১৯২২ সালের পর পতিসর এলেও রবীন্দ্রনাথ আর শিলাইদহ যান নি। দেশভাগের সময় কালীগ্রাম-পতিসরই ছিল পূর্ববঙ্গে একমাত্র ঠাকুর জমিদারি।

পতিসরে কবি কী কী রচনা করেছেন?

পতিসরের জীবন ও ছবি তাঁর অনেক লেখায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আছে। এখানে বসে তিনি প্রথম রচনা করেন ‘সন্ধ্যা’ কবিতা, ১৩০০ সালে। গোরা উপন্যাসের খানিকটা, চিত্রার কিছু কবিতা, সোনারতরীর অনেক কবিতা ছাড়াও য়ুরোপযাত্রীর ডায়রিসহ আরো কিছু সুন্দর গান এখানে রচিত হয়েছে। আর এখানকার ভাব প্রকাশ পেয়েছে কলকাতায় গিয়ে এমন লেখাও অনেক আছে। যেমন, ১৩০০ সালেরই ফাগুন মাসে এখান থেকে রাজশাহী গিয়েই লিখেন ‘এবার ফিরাও মোরে’। ‘দুই বিঘা জমি’ তো এখানেই রচিত।

সচিব মহোদয় কুঠিবাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের যুগল ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তার পর কৃষকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দাঁড়ানো ছবিটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন!

রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে থাকতেন?
আজ্ঞে স্যার, কবিগুরু এখানে এসে অবস্থান করতেন।
তাঁর কী কী স্মৃতি আছে এখানে?
এই যে ছোটো পুকুরটা, এটা কবিগুরু গ্রামবাসীর জন্য খনন করিয়ে দিয়েছিলেন। এতে নাবা-গোসল নিষিদ্ধ ছিল। এখান থেকে কেবল পানের জল তোলা যেত।

পাহারাদার নিয়োগ করা থাকত যাতে জল নষ্ট না করতে পারে। আগে যেখানে কলেরায় অনেক লোক মারা যেত এই পুকুর কাটার পর কলেরায় আর তেমন লোক মারা পড়ত না। তখন টিউবওয়েল পাবে কোথায়? আর ওপাশের দিঘিটা ছিল আরসব ধোয়ামোছার জন্য। ওপাশের লম্বা ঘরটা ওটি আসলে ছাত্রাবাস ছিল না। কর্মচারী আর পাহারাদারদের ব্যারাক ছিল। কুঠিবাড়ির পূর্বপাশে আরো কয়েকটি লম্বা ঘর ছিল, সেগুলোতে রাজকর্মচারীরা থাকত। সেগুলো নেই, ভেঙে পড়ে গেছে। আর ঐ যে দেখছেন সেগুলোও জমিদারের কর্মচারীদের জন্য ছিল। সেখানে থাকতেন হাসপাতালের ডাক্তার আর কম্পাউন্ডারগণ। কবিগুরু এই এলাকার জনসাধারণের জন্য পতিসরে স্কুল ছাড়াও হাসপাতাল আর কৃষিব্যাংক স্থাপন করেছিলেন।

হাসপাতাল?
জ্বী, স্যার।

সচিব বললেন, যে গ্রাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এতটা ভেবেছেন, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কেউই সেই গ্রামকে না দেখে, না জেনে রবীন্দ্রচর্চা করছেন। সে যা হোক, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আপনারা আজ আমাকে সমৃদ্ধ করলেন। এখানে না এলে আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এতকিছু অজানা বিষয় জানতে পারতাম না। আপনাদের কথা আমার খুব ভালো লেগেছে। আজ আমি আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। আপনারা সত্যিই ভালো শিক্ষক। নিশ্চয় ভালো পড়ান। আর আসাদ আপনিও লিখুন। এইসব গ্রামের মানুষের কথা আপনার গল্পে লিখবেন। রবীন্দ্রনাথের কথা লিখুন। মাটির কাছের কবিকে মানুষের জানা দরকার। আর হ্যাঁ, আমার কার্ড রাখুন। ঢাকায় এলে দেখা করবেন। কথা বলবো। আপনাদের কাছ থেকে পতিসরের খবর নিতে পারবো।

আপনাকে স্যার, কষ্ট করে এখানে আসার জন্য অনেক-অনেক ধন্যবাদ।
আজ আসি। ভালো লাগল রবীন্দ্রকুঠি দেখে। আপনারা ভালো থাকবেন।
সচিব মহোদয় গাড়িতে উঠে গেলে আসাদ আর শশাঙ্ক বাবু পুরোনো হোস্টেলের দিকে চলেছেন। লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রধান শিক্ষকও তাদের সঙ্গে আছেন।
শশাঙ্ক বাবু, আজ আপনি পতিসরের মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন।
কী ভাবে?
আজকে আপনি রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন থেকে পতিসরে ফিরিয়ে আনলেন।

আমি রবীন্দ্রনাথ সামান্য পড়েছি। সাহিত্য পড়েছিও খুব অল্প। আসাদ সাহেব সাহিত্যের মানুষ, তিনি রবীন্দ্রনাথকে ভালো জানেন। তিনি আমাদের ছেলেমেয়েদের ভালো করে রবীন্দ্রনাথকে জানতে আর পরিচিত করাতে পারবেন। একদিন এর সুফল আমরা পাবো। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যখন রবীন্দ্রনাথকে সঠিকভাবে জানতে পারবে তখন পতিসরে রবির আলো ঝলমল করতে থাকবে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব বারোউপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। চৌদ্দ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *