জলমাতালের মুখ; সময় উত্তীর্ণ হওয়ার আয়নাস্বরূপ।। এনাম রাজু

সমালোচক মাত্রই স্রষ্টার আয়না। সাহিত্যে তাই সমালোচক যতো ভালো হবে ততোই সাহিত্যের দাঁড়
উন্মোচিত হবে পাঠক সমাজে। আধুনিক বাংলা কবিতা বাংলা শিল্প সাহিত্যে অনন্য সংযোজন হলেও
যোগ্য সমালোচকের অভাবে পাঠক সমাজে কবিতার দূর্বোধ্যতা রয়ে গেছে। আধুনিক কবিতা নিয়ে
তাই পাঠক মনে বিভ্রান্তির শেষ নেই। তার সাথে যোগ হয়েছে কবিতা নামের কিছু গদ্য। যার সূচনা
হয়েছে বিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকোত্তর কালে রচিত কবিতায়। ছন্দ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না রেখেও যারা
গদ্য কবিতার নামে মূলত কিছু কঠিন ও জঠিল শব্দের মিশ্রণ ঘঠিয়েছে তাদের হাতেই। সব চেয়ে
বিস্ময়কর বিষয় হলো, সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত লেখকরা একটা গোষ্ঠী তৈরি করতে গিয়ে সেই
কবিতাগুলোকে বাহ্বা দিয়ে কবিদের অকবিতা লিখতে উৎসাহিত করেছে। সেই থেকে আজ অবধি এই
ধারা প্রচলিত থাকলেও প্রকৃত লেখকদের কবিতা পাঠ নিলেই বুঝতে পারা যায়, কবিতা লেখা যতোটা
কঠিনই হউক না কেনো, পাঠক তার রস নিতে পারে খুব সহজেই। এই যুগেও গদ্য কবিতা লেখা হয়
প্রচুর তবে সেসব গদ্য কবিতার মধ্যেও ছন্দের তাল, শব্দের সৌন্দর্য, অলঙ্কার ও সময়কে উত্তীর্ণ করার মতো
নির্মাণ থাকে। এমন কিছু কবিতার মিশ্রণে লিখিত বই ‘জলমাতালের মুখ’। ছন্দের সফল প্রয়োগ ও
অন্ত্যমিলের নিরেট ব্যবহার কবিতার সৌন্দর্য প্রচার করতে বাধ্য করে। ‘জলমাতালের মুখ’ কাব্যগ্রন্থের
প্রতিটি কবিতা কথা বলে সময়ের, মানুষের, বাস্তবতার, মানবতার। কাব্যেগ্রন্থটির শিরোণাম কবিতার
প্রথম লাইন পড়েই অভিভূত হতে হবে পাঠককে। দুনিয়া কিভাবে আঁধারে ছেয়ে গেছে, মানুষগুলো
কিভাবে স্বার্থসিদ্ধিতে বুক টান টান করে সত্যের ঘাড়ে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তারই প্রতিচ্ছায়া
যেনো—‘অন্ধকার হয়ে আছে আজ দিবসের আলো।’
কাব্যগ্রন্থটিতে নদী, নারী ও সময়কে সুন্দরভাবে কলমের তুলির আচড়ে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার প্রয়াস
পেয়েছেন কাব্যটির স্রষ্টা।
‘বাইরে এখন বৃষ্টি নামার ধুম, খুনসুটি— ভীষণ প্রপঞ্চনা
ভেতর-বাহির উত্তাপিত লাজক জ্বরে; আগুনও গণগণা
গা ছয়ে যাও অবিরত বর্ষা যত; হোক না বনিবনা ’…(গা ছুয়ে যাও বর্ষা যত)
তীক্ষ্ণ চোখ, স্মর্তব্য, আমাদের যাবার জায়গা নেই শিরোনামের কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়েছে
জীবনানন্দের কবিতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দারুণ কিছু উপমা, শব্দের গাথুনি হৃদয়ে দাগ কেটে
যায়। যেমন,
তারপর সন্ধ্যা আসে— বালিহাঁস ডুব দিয়ে মুখ গুঁজে নেয় ডানার ভেতর;
চাঁদ ওঠে— মুমূর্ষু বাতাস দারুণ উত্তাপে কাঁপতে কাঁপতে
সেই কখন নাপা খেয়ে ঘুমের ভেতর মৃত শালিক হয়ে আছে!
প্রত্যেক কবি তাঁর সমকালীন সময়কে কবিতায় বেঁধে রাখতে চায়। এমন কয়েকটি কবিতা থাকলেও
বিশেষভাবে করোনা শিরোনামের কবিতাটির গুরুত্ব ও উপমার ব্যবহার, সময়ের নির্মমতা, হৃদয়ের ক্ষরণ খুব
সহজে অনুমেয়। মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই প্রত্যেক কবির কবিতায় প্রকৃতি
বন্দনা পাওয়া। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যও কবিতায় ব্যবহার করে অনেক কবি মহৎ কবির
স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঠকদের কাছে। সেই প্রকৃতি যখন বিরূপ আচরণ করে তখনই মানুষ নিরূপায়
দর্শক হয়ে থাকে। করোনা কবিতায়ও সেরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বড্ড ভয়ে ভয়ে থাকি পা রাখি চুপচাপ
হলঘরে, বাজারে সবখানে সাপের উত্তাপ! (করোনা)
কাব্যগ্রন্থটির ‘তোমাকে বুঝি না’ শিরোনামের কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে কবিতাটির
বিরামচিহ্নের দরকার ছিলো— ‘মানুষের জলভরা চোখ কিছু শোক।’ কবি যেহেতু মাত্রা মিলাতে গিয়ে
চোখ শব্দটির সাথে এ—কার ব্যবহার করেননি। তাই ‘মানুষের জলভরা চোখ, কিছু শোক’ এরকম হতে
পারতো। একই কবিতার আরেকটি লাইনে মনে হলো— তোমার বারান্দা—বাহির বাড়িতে থাকে। এই
বাক্যটিও হয়তো এমন হতে পারতো— তোমার বারান্দা—বাড়ির বাহিরে থাকে। তাতেও মাত্রা ঠিক থাকতো।

কবিতা যেহেতু কবির একান্ত গভীর ভাবনার বিষয়। তাই কবিই নিজেই ভালো জানবেন, তিনি কেনো
লাইন দু’টি সাজিয়েছেন।
কাব্যগ্রন্থটির ভাব, ভাষা খুব সহজ হলেও ভাবগাম্ভীর্য পাঠককে অনেক গভীরে ঢুকতে বাধ্য করবে।
কবিতার এই দুঃসময়ে স্রোতের বিপরীতে হেঁটে কবিতায় নিরেট সত্য উপস্থাপন করা, ছন্দের ব্যবহার,
অন্ত্যমিলে চমকপ্রদ শব্দে সাজানো খুব দুঃসাধ্য। কিন্তু কবি অদ্বৈত মারুত এই কাজটি খুব
সহজভাবেই উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—
‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’
গদ্য কবিতার নাম করে দীর্ঘকাল যাবৎ যে ছন্দহীন শব্দের জটিলতায় কবিতার স্বর, সুর হাহাকার করছে তা
থেকে পরিত্রাণের এখনই সময়। সহজভাবে লেখা কবিতা যে কতোটা সহজে পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নেয়,
‘জলমাতালের মুখ’ পড়েই তা আবারও বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম আমরা কতোটা অসহায়।
আত্মার চাবি হারানোর শোক স্মরণীয় হয়ে আছে! (চাবি হারানোর শোক)
জলমাতালের মুখ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে কবিতা পাঠের তৃপ্তি পেয়েছি। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের
সফল প্রয়োগ আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিছু কবিতা মুক্ত গদ্যে লেখা হলেও তাতেও ছন্দের আভাস পাওয়া যায়।
কিছু ছোট ছোট ভুল থাকলেও তা পাঠকের চোখ এড়াতে সক্ষম বলে মনে করি।

জলমাতালের মখু (কাব্যগ্রন্থ)
কবি-অদ্বৈত মারুত
প্রচ্ছদঃ রাজিব রয়
প্রকাশক- পুথিনিলয়
মূল্য- ১২০
বইটি রকমারি ডটকম থেকে ও সংগ্রহ করা যাবে।

One thought on “জলমাতালের মুখ; সময় উত্তীর্ণ হওয়ার আয়নাস্বরূপ।। এনাম রাজু

  • মে ১৮, ২০২১ at ১০:৩০ অপরাহ্ণ
    Permalink

    হাইস্যকর! তাও আবার জাকির তালুকদার সম্পাদিক!!!!!!!! হাইস্যকার

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *