উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব সাত

মাত্র সপ্তাহের ব্যবধানে জীবনটা কেমন পাল্টে গেল! এ রকম সন্ধ্যা আসাদ করিমের ব্যস্ততায় কাটত। বলতে গেলে সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ছিল ওর কাজের সময়। কোন খবরটার পর কোনটা সাজানো হবে, কোন শিরোনামটা পাল্টাতে হবে, কোন শব্দটা পরে কোনটা আগে যাবে, এ নিয়ে গোটা কাগজের লোক ব্যস্ত। কখনো তেমন কিছু ঘটলে শুধু সম্পাদকের নয়, গোটা কাগজের লোকের মাথা খারাপ অবস্থা। যেন এই বিশেষ খবরটা কভার করতে না পারলে দেশ রসাতলে যাবে অথবা এই পত্রিকাটি কাল থেকে আর লোকে পড়বেই না। পৃষ্ঠা সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে সম্পাদকের গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত রদবদল, সংযোজন বিয়োজন চলতে থাকবে। একটি পত্রিকা নিজের উপর এবং পাঠকের উপরও এত অবিশ্বাস নিয়ে কেন চলছে এটা আসাদ ভেবে পেত না। কেন একটা যথাযথ শব্দ শেষ মুহূর্তে বাদ দিতে হবে এই নিয়ে বার্তা সম্পাদকের সাথে আসাদের প্রায়ই খিটিমিটি লেগে যেত। খবরের শিরোনামে একটা শব্দের সঠিক প্রয়োগ কত গুরুত্ব বহন করে সেটা আজকাল কেউ ভাবে না। যথার্থ শব্দটি বাক্য থেকে বাদ দিলে বাক্যটি দুর্বল, অর্থহীন অথবা অর্থ রদবদল হয়েও যেতে পারে। আর ভাষাশিল্পের বিবেচনায় বলা যায় ভাষার সৌন্দর্যটুকুও তাতে বাক্য থেকে হারিয়ে যায়। বাগানের ফুলে ফুলে যে রঙিন প্রজাপতিটা উড়ে বেড়ায় সেটিকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলে অনেক রঙের বাহারও আর আকর্ষণীয় মনে হয় না।
আসাদ করিম তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তবু শেষ পর্যন্ত পত্রিকা তাকে ছাড়তেই হলো। অত যোগ্যতা সম্পন্ন লোক পত্রিকায় দরকার নেই, সম্পাদক সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন।
আসাদ করিম পর পর দু’দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল। তৃতীয় দিন আর ঘুমের নাগাল না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে অনেকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরছিল। সময় কাটানোর জন্যই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বানরের খেলাও দেখেছে। এমনকি লতাপাতা-শেকড়-বাকল নিয়ে পথের পাশে কবিরাজের যৌনোত্তেজক কথাও শুনেছিল। বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল কেমন করে সে পথিকের করুণা আদায়ের জন্য চমৎকার অভিনয়ও করে। তার পরও সময় কাটছিল না। একজন কর্মহীন মানুষের সময় কাটানো যে কত কষ্টের সেটা সে বেশ টের পাচ্ছিল। সে ভাবছিল, একটা কিছু করতেই হবে, তবে আপোস করে নয়।
সেদিন আসাদ করিম আজিজ মার্কেটের একটি বই-এর দোকানে লিটলম্যাগ উলট-পালট করছিল।
এই আসাদ, আসাদ?
ও তুই!
কী ব্যাপার বলতো? চীৎকার করে ডাকছি, আশেপাশের সবাই তাকাচ্ছে, তুই শুনতে পাচ্ছিস না। কী হয়েছে তোর?
ঢাকা শহরে এত অশ্রাব্য চীৎকার আর অকথা শুনে কান তো ঠিক থাকার কথা নয়।
তাই বল। আমিও কান বন্ধ করে চলি।
তাহলে তো বেশ আছিস─ কিছু শুনতে বা দেখতে হয় না। তাই না?
আচ্ছা, বাদ দে। তোর মোবাইল বন্ধ, পত্রিকায় খবর নিলাম বলল সেখানেও যাচ্ছিস না। কী হয়েছে, বলতো।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর খালি মুখে তো এত প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে না। আগে কিছু খাওয়া, তার পর বলছি।
চল, আমার সংগে চল।
কোথায়?
জাহান্নামে। কেন আমার সাথে জাহান্নামে যেতে পারবি না?
তা হলে আশরাফ ভাই কার সাথে যাবে?
কেন? আমার কি তোদের মতো দু’চারটে কবি-লেখককে একসঙ্গে জাহান্নামে নেবার ক্ষমতা নেই?
সেটা তোর আছে। আবার তুই বেহেস্তেও নিতে পারিস। তোর যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যাস।
সে সময় এলে দেখবো। আপাতত আমার বাসায় চল। বাসায় গিয়ে চা খাবো আর বসে গল্প করবো। আজ কিন্তু বলবি না, সম্পাদক ডাকছে। এখুনি দেশটা উদ্ধার করতে চলে যেতে হবে। আজ কিন্তু তোর কোনো কথা শুনবো না।
এত জোর করছিস, নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। কোনো নতুন খবর আছে নাকি? স্যারের প্রমোশন হলো নাকি?
ষাঁড়ের প্রমোশন হবে কীরে? ষাঁড় প্রমোশন পেয়ে কী আর মোষ হতে পারবে? সে তো আমলা হয়ে বলদ হয়েই গেছে।
তুই এত বাজে বকতে পারিস, এখনো!
আগে বাসায় চল। ষাঁড় তোর জন্য শিং তেলিয়ে অপেক্ষা করছে। তোকে সে খুঁজছে।
কেন, আমি আবার কী অপরাধ করলাম?
তোর স্যার তোর গল্পের খুব প্রশংসা করল। বলল, আসাদকে বাসায় ডাকো। ওর সংগে বহুদিন গল্প করা করা হয় না, ওকে খবর দাও।
আশরাফ স্যার! আমাকে?
হ্যা। তোকে তো জানানোই হয় নি। তোর গল্পটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে।
কোন গল্পটা?
ঐ যে ‘একজন লেখকের অপমৃত্যু’। বলল, কী ট্র্যাজিডি। ওর ধারণা তোর গ্রামের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। বলল, অভিজ্ঞতা তোকে সমৃদ্ধ করবে। তোর গল্পে মফস্বলের লেখকের অনুভূতিটা চমৎকার ফুটে উঠেছে, কিন্তু গ্রামীণ পরিবেশটা আরো বাস্তবসম্মত হয়ে উঠতে পারত। এ জন্য তোকে গ্রামে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।
আমি গ্রামের অভিজ্ঞতা কীভাবে অর্জন করবো?
আশরাফ সেকথাই বলছিল। বাসায় গিয়ে বাকীটা ওর কাছেই শুনবি।
তোর গাড়িতে তো বেশ আরাম। ঢাকায় যে এত গরম গাড়িতে চড়লে বোঝার উপায় নেই। আছিস তো বেশ আরামেই, তাহলে এত হতাশ ভাব দেখাস কেন?
না, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর হাহুতাশ করব না। ভেবে দেখলাম হতাশ হয়ে কী হবে? জীবন তো একটাই। নিজেকে কষ্ট দিয়ে আসলে কোনো লাভ নেই।
তাহলে তুই এখন বেশ ভালোই আছিস। যাক, বেশ ভালো শেষ পর্যন্ত আমলার বউ হিসেবে নিজেকে তাহলে মানিয়ে নিতে পেরেছিস!
আমি তো আর আশরাফকে বদলাতে পারব না। আমি চাইলেই কী সে বদলাবে? ভালোবেসে বিয়ে করলাম, আর এখনো তো ওকেই ভালোবাসি। ভালোবাসার জন্য ত্যাগ না করে উপায় আছে? তুই তো প্রেম করিস নি, তুই বুঝবি না কাউকে ভালো বাসলে কতটা ছাড় দিতে হয়। ভালোবাসার মানেই হচ্ছে, কী পাবে ভেবো না, কেবল দেবার জন্য সর্বক্ষণ তৈরী থাকো।
তাহলে তো তোর কথামতো প্রেম ব্যক্তিসত্ত্বাকে অস্বীকার করে। ব্যক্তির স্বাধীনতাকে ব্যক্তি নিজেই ধীরে ধীরে হত্যা করে।
অত কিছু বলতে পারবো না। আমি ভালো আছি এতে কি তুই খুশি না?
অবশ্যই খুশি।
দাঁড়া, তোর ষাঁড়কে এখনই বাসায় আসতে বলি।
তুই ভালো আছিস দেখে আমার আজকের দিনটা অন্যরকম লাগছে। আমি একা একা এখানে সেখানে ঘুরছিলাম। কিছুই ভালো লাগছিল না।
তোর গলায় হতাশা, তোকে তো কখনো এমন দেখি নি। তোর কণ্ঠে তো হতাশা মানায় না, আসাদ।
আমার দ্বারা আসলে কিছুই হবে না।
তুই না নিজেই বলতি চাপে আর তাপেই কার্বন হীরক হয়ে যায়। তুইও একদিন তাই হবি। আমি বিশ্বাস করি তোর স্বীকৃতি একদিন তুই পাবি। এর জন্য তোকে হয়তো আরো মূল্য দিতে হবে, আরো গরল পান করতে হবে। ঝিনুক তো কষ্ট মেনে নিয়েই মুক্তা তৈরী করে।
কিন্তু, একটা মুক্তার জন্য কতগুলো ঝিনুককে খুন হতে হয় সেটা জানিস?
থাক, খুনোখুনি বাদ দে। এসে গেছি, নেমে আয়।
মিতালী একটা নতুন বহুতল ভবনের সামনে এসে দাঁড়াল। উত্থানরথে চেপে সুন্দর একটা ফ্লাটের সামনে নেমে মিতালী বেল টিপল। করিডোর থেকে নতুন ঢাকার নতুন-নতুন আকাশমুখী ভবন আর খানিকটা আকাশও দেখা যাচ্ছে। ঢাকা শহরটা প্রতিদিন বদলাচ্ছে। কাল যেখানে খালি জায়গা ছিল, গর্ত বা জলাভূমি ছিল, সেখানেও আজ আকাশ ছোঁয়া ইমারত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আশরাফ কবির দরোজা খুলে দিলেন।
দেখো, কাকে ধরে নিয়ে এসেছি।
আরে, আসাদ যে! গল্পকার আসাদ করিম আমার বাসায়, আমার যে কী সৌভাগ্য!
আসাদ বিব্রত। ওর শিক্ষক─ বর্তমানে একজন আমলাÑওকে এমন করে অভ্যর্থনা করবেন এটা সে কল্পনাও করে নি। বরং ভেবেছে একজন আমলা ওর সাথে কেমন করে কথা বলেন সেটাই আজ ওর জন্য দেখার বিষয় হবে। কিন্তু সে মুখ না খুলে পারল না।
স্যার, এভাবে বললে তো আমি আপনার সামনে আর দাঁড়াতে পারব না।
কী বলো, তুমি দাঁড়াবে কেন─ এসো, বসো। তুমি তো এখন খুব ভালো লিখছ। কতদিন পর তোমার দেখা পাওয়া গেল, বলো তো?
বেশ কবছর আপনার সংগে দেখা করা হয়নি। আপনার স্বাস্থ্য আগের চাইতে অনেক ভালো হয়েছে।
তোর মাথা খারাপ জানতাম, কিন্তু চোখও যে এত খারাপ হয়ে গেছে জানতাম না তো! কয়েক দিনের আমলাগিরিতেই তোর স্যারের ভুড়িটা সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে আর তুই বলছিস ওর স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে?
আসাদ, তোমাকে দাড়িতে বেশ মানিয়েছে।
ওর মতো কবি-লেখকদের দাড়ি রাখা নতুন কিছু নয়।
লেখক তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজেও তো লিখতে পারছি না।
কেন? তুমি তো ইদানিং বেশ ভালোই লিখছ। আমি বেশ কিছুদিন পর তোমার একটা গল্প পড়তে পেলাম। তাও তোমার বন্ধু সেদিন আমার হাতে তুলে দিয়েছিল বলেই পড়তে পেলাম। তা না হলে পড়াই হতো না। আজকাল সাহিত্যপাতা দেখার সময়ই পাই না। সারাক্ষণ ব্যস্ততায় কাটে। তবু মাঝে মাঝে কিছু একটা লিখতেও ইচ্ছে করে। যখন ভাবনাটা দানা বাঁধতে শুরু করে তখনই কোনো একটা উটকো ঝামেলা এসে এ শহরের ছিনতাইকারির মতো ভাবনাটাকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। কখনো কখনো হতাশ হয়ে অসহায় হম্বিতম্বিও করি। মাঝে মাঝে এমন ব্যস্ত থাকি যে মিতালীর ফোনও ধরতে পারি না। সে যা হোক, তোমার গল্প─ ‘একজন লেখকের অপমৃত্যু’ আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে।
স্যার, গল্পটা আপনি পড়েছেন জেনে আমার খুব ভালো লাগছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের দরকার নেই। এরকম একটি গল্প সৃষ্টির জন্য তোমাকে অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছে করছিল। আমি মিতালীকে বললাম তোমাকে খুঁজে বের করতে। আমি জানতাম মিতালী তোমাকে আনতে পারবে।
আপনাদের নতুন বাসার ঠিকানা আমার জানা ছিল না। আসলে আমিও─
থাক ওসব কথা। তোমার গল্পে ফিরে আসি। এমন একটি প্লট নিয়ে অনেকে তো লিখতে সাহসই করবে না। তোমার সাহস আছে, তুমি পেরেছো। তুমি চালিয়ে যাও। সাহসটা ধরে রাখ, তোমাকে দিয়ে হবে। যারা সময় আর জীবনের সাথে আপস করে ফেলে তাদের দ্বারা কিছু হয় না। তবে তোমাকে জীবন আরো বেশী করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তোমার মধ্যে যে জীবনবোধ আছে, যদি বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশেল দিয়ে জীবনের সত্যিকার স্বরূপটি সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারো─ আমি বিশ্বাস করি তুমি অনেকদূর যাবে। একদিন তুমি অন্যদের চাইতে আলাদা হয়ে উঠবে।
আমি চেষ্টা করবো। জানি না সম্ভব হবে কি-না।
মানে? তোমার কোনো সমস্যা?
এই শহরে জীবন নিয়ে টিকে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপস না করলে এখানে বোধহয় টেকা সম্ভব হবে না। আর আপস করে তো সাহিত্য করাও হয় না।
তুমি ঠিকই বলেছো। তবুও আমরা যেন আপস করার প্রতিযোগিতায় নেমেছি।
মিতালী টেবিলে নাস্তা দিতে দিতে ওদের কথা শুনছিল।
আসাদকে কেমন হতাশ মনে হচ্ছে না? শুনলাম সে অফিসেও যাচ্ছে না মোবাইল ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। ঘটনাচক্রে আজিজ মার্কেটে দেখা হয়ে গেল তাই ধরতে পারলাম। এই, তোর কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে আমাদের বল। তোর স্যারকে বল। সম্ভব হলে সে তোকে নিশ্চয় সহযোগিতা করবে।
পত্রিকা অফিসে যাচ্ছো না, মানে তুমি আর ওখানে কাজ করছো না?
না, সেখানে আর যাচ্ছি না।
অন্য কোথাও কিছু করবে ভাবছো?
এখনো সেরকম কিছু জোটাতে পারি নি।
বুঝতে পারছি। তোমার আপাতত যেমনই হোক একটা কাজ দরকার। আচ্ছা, তোমার গ্রামে যেতে আপত্তি আছে?
কাজটা পছন্দ হলে আপত্তি নেই। কাজটা কী?
আসাদ, চা-এর টেবিলে আয়।
চলো, চা খেতে খেতে গল্প করি। তোমার লেখাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, আই মিন, আরো বেগবান করতে হবে। এর জন্য শাণিত করতে হবে নিজেকে। তোমাকে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হতে হবে। বুঝতে পারছো?
জ্বী।
উপদেশ দেয়ার আগে তুমি ওর একটা কাজের ব্যবস্থা করো। তার পর যত খুশি উপদেশ দাও।
তোমার বন্ধু, আমার ছাত্র, উদীয়মান লেখক আসাদ করিমের জন্য আমি কিছু করবো না, সেটা কি হয়?
নাও, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
তোমার গল্পে সোসাল ক্যাপিটালের চমৎকার ব্যবহার করেছো। আমার কাছে ব্যাপারটা দারুণ লেগেছে, বাংলা গল্পে এটা আগে লক্ষ্য করিনি।
এটা আসলে নতুন বিষয় নয়। বাংলা গল্পে সামাজিক পুঁজির ব্যবহার আগেও হয়েছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে সামাজিক পুঁজির সার্থক প্রয়োগ আছে। ‘হারানের নাতজামাই’ সামাজিক পুঁজির সার্থক প্রকাশ। কে কীভাবে দেখবে সেটাই বিবেচ্য। সাহিত্যকে খন্ডিত করে দেখার একটা খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। একদল সমালোচক গল্পে বামের ভূত খুঁজে বেড়ায় আর এক পক্ষ ডানের গন্ধ। ফলে সাহিত্যের সবটুকু কেউই দেখতে পায় না। আর সামাজিক পুঁজি সমবায়েরই সামাজিক দিক। মানুষ কেবল আর্থিক স্বার্থের জন্য যতটা ঐক্যবদ্ধ হয়─ রাজনৈতিক আদর্শের জন্য সেরকম ঐকবদ্ধ থাকে না। বরং রাজনৈতিক আদর্শ মানুষকে বিভক্ত করে। রাজনীতি এ যুগে ধর্মের স্থান দখল করেছে। মধ্যযুগে শাসকের ধর্মের দ্বারা অন্য ধর্মের মানুষ নির্যাতিত হয়েছে, এখন রাজনীতি সে স্থান দখল করেছে। রাজনীতি সমাজকে গুরুত্ব না দিলে সমাজ তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। সফলও হয়। কারণ সমাজবদ্ধ হয়েই মানুষ বাঁচে। সমাজের অনেকগুলো উপাদান তাকে একত্রিত করে রাখে। যে কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও সামাজিক প্রয়োজনে সে সমাজের সদস্য হিসেবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এটিই সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তি। আর মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলে সমাজ জয়ী হয়।
কিন্তু, আমাদের সময়ে তো এটারই আকাল।
সামাজিক পুঁজি সমাজে আছে। মানুষের অন্তরে আছে। যখন তারা পরস্পর নিজের বিষয়ে কথা বলে তখন বোঝা যায় সেটা আছে। সেই পুঁজিটা মানুষের অন্তর থেকে বের করে এনে কাজে লাগানোর জন্য যে নেতৃত্ব দরকার সেটা নেই। রবীন্দ্রনাথ সামাজিক পুঁজির প্রয়োগ করতে শ্রীনিকেতন গড়েছিলেন। তখনকার নেতৃত্ব তাঁকে বুঝতে পারে নি। বরং তাঁর কর্মকান্ডকে বাড়াবাড়ি আর মূল দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থাকার কৌশল বলে অপবাদ দিতে ছাড়েন নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হঠকারিতা পছন্দ করতেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশের মানুষকে মানসিক ভাবে তৈরী করতে না পারলে স্বরাজ এলেও তাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আসবে না। তৎকালীন নেতারা সেটা বুঝতেন না। তাঁরা কেবল ক্ষমতা বুঝতেন। নিজেরা ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তাই তাঁরা ইংরেজদের কাছ থেকে যেভাবেই হোক, যে ফর্মুলায়ই হোক, এমন কি সেটা যদি ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীগুলোকে কেটেকুটে─ প্রায় একক দেশগুলোকে─ যেমন, পাঞ্জাব, বাংলা, কাশ্মীর এসবকে ভাগ করেও ক্ষমতা পাওয়া যায়─ সেটিই করতে চেয়েছেন। তাঁরা কেবল ক্ষমতাই চেয়েছেন, মানুষের মুক্তি নয়। মানুষের উপর শ্রেণীগত কারণেই─ যেহেতু তাঁরা পরজীবী অর্থাৎ জমিদারশ্রেণীর প্রতিনিধিই ছিলেন─ মানুষের জন্য তাঁদের দরদ ছিল না, আস্থাও না। ইংরেজরা উপমহাদেশীয় সামাজিক পুঁজিকে আমাদেরই নেতৃত্বের কাছে লোভের কড়াতে ভাগ করে দিয়ে গেছে। যার ফল উপমহাদেশের মানুষ এখনো ভোগ করছে। মানুষের উপর রবীন্দ্রনাথের আস্থা ছিল─ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এটা অর্জন করেছিলেন। তিনি মানুষের কাতারে নেমে এসেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ কি জমিদারির বিপক্ষে ছিলেন?
প্রমথ চৌধুরীর রায়তের কথার মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের লেখা ‘রায়তের কথা’য় বলেছেন─ জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিসটার ’ পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। আমি জানি, জমিদার জমির জোঁক, সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব।
কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ তো শেষপর্যন্ত জমিদারি ত্যাগ করেন নি।
রবীন্দ্রনাথ জমিদারি ছেড়ে দিতে চান নি সেটা সঠিক নয়। তিনি মানুষকে ভূমিস্বত্ব ধারণ করার উপযোগী করে গড়ে তুলে তার পর ভূমির মালিকানা দেবার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, প্রজাদের সক্ষম না করে জমিদারি ছেড়ে দিলে সেটা দিতে হতো ইংরেজদের হাতে অথবা চলে যেত অন্য কোনো জমিদার বা জোতদারের কাছে। জমিদারি আইন বজায় থাকবে, আর জমি প্রজাদের হয়ে যাবে এটা কি সম্ভব ছিল? তিনি মনে করতেন, প্রজাদের হাতে জমি দিলে তারা সে জমি রাখতে পারবে না, দরিদ্র কৃষককে প্রস্তুত না করে জমি তাদের হাতে ছেড়ে দিলে সেগুলো চলে যাবে মহাজনদের হাতে। ভাগ হতে হতে ছোটো ছোটো জমিগুলো স্থানীয় মহাজনদের বড়ো বড়ো বেড়াজালের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়বে।
তুমি বেশ ভালো কথা বলেছো। এখনো গ্রামে একই অবস্থা। এখনো ছোটো ছোটো কৃষকের জমি তাদের অভাবের সুযোগ নিয়ে বিদেশ ফেরত কাঁচা পয়সাওয়ালা, ঠিকাদার, ব্যবসায়ী আর দাদনদাররা নিয়ে নিচ্ছে। গ্রামের প্রান্তিক চাষীরা জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। আচ্ছা, তুমি কী গ্রামের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাও?
আমি একা দাঁড়িয়ে কী করবো?
রবীন্দ্রনাথও একাই গ্রামে এসেছিলেন।
যা চলে যা। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। সময় হলে আমরাও আসবো। আমার দাদাশ্বশুর যখন ডাকবেন তখন আমিও আসবো।
মিতালীও যেতে বলছে। তুমি কি পতিসর গিয়েছো কখনো?
না।
আমার দাদাশ্বশুরের বাড়ি। তুই এখনো যাস নি?
তোর ফাজলামো গেল না।
সত্যি বলছি, সেখানে আমার দাদাশ্বশুরের বাড়ি। আর রবীন্দ্রনাথও আমার একজন দাদাশ্বশুর-সেটা তুই জানিস না।
আসাদ, তুমি পতিসর যাবে?
সময় করে একবার যাওয়া যাবে।
বেড়াতে নয়─ কাজ করতে যাবে কিনা বলো?
আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।
তোমাকে খুলেই বলি, পতিসরে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত একটা স্কুল আছে। আমি সেই স্কুলের ছাত্র। তুমি সেখানে বাংলা পড়াতে যেতে চাইলে আমি সেখানকার প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে পারি।
আমাকে নেবে?
তোমার মতো যোগ্য লোক তারা পাবে কোথায়? তুমি যাবে কিনা ভেবে দেখো। যদি যাও─ আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অবশ্য সেখানে টাকাপয়সা খুব একটা পাবে না, কিন্তু তুমি তোমার লেখার রসদ আর পরিবেশ পাবে, নতুন অভিজ্ঞতাও হবে। গ্রাম নিয়ে লিখতে চাইলে অভিজ্ঞতার তো বিকল্প নেই। এখন লেখক আর কবি জন্মানোর পর আয়ু পাচ্ছে না− কেন বলতে পারো? অভিজ্ঞতা নামক পুষ্টির অভাব। তুমি দেখবে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের লেখায়ও দেখা আর জানাশোনার অভিজ্ঞতার প্রতিফলনই ঘটেছে। তোমার মধ্যে আমি একজন গল্পকার হয়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, তুমি অভিজ্ঞতা অর্জন করলে ভালো গল্প লিখতে পারবে।
ঠিক আছে। আমি যাবো সেখানে।
যাও। তবে আরেকটা কথা মনে রেখ, রবীন্দ্রনাথও প্রথমবার পতিসর গিয়ে পরদিনই কলকাতায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর সুমতি হয়েছির, ফিরে যান নি। তার পর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবত সেখানে তাঁর যাওয়া-আসা ছিল। সে কীসের টানে তিনি বারবার ঐ অজপাড়ায় যেতেন সে বিষয়ে জানার চেষ্টা তোমাকে করতে বলবো। কেউ এ বিষয়টি নিয়ে এখনো ভাবেন নি।
স্যার, আমি পতিসরে রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা করব।

গাছে গাছে পাখি ডাকতে শুরু করলে আসাদ করিম স্মতির সময় থেকে পতিসরের বর্তমানে ফিরে এলো। বর্তমানে ফিরে এসে দেখল, এখনো বাংলাদেশে কোথাও কোথাও পাখির কাকলিতে সন্ধ্যা নামে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব ছয়উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *