উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// দুই

বিশাল আকাশের তলে মাঠের মাঝখানে আসাদ করিম দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে পীতাভ সবুজ, সবুজের ভেতর কোথাও পাখির বাসা। সেখানে চোখ না-ফোটা ছানার চিঁ চিঁ ডাক। মা পাখিটা ওর মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে সবুজ ঝোপের ভেতর হারিয়েও গেল। আবার সেই সবুজ গাছপালার ভেতর থেকে হিমেল বাতাস এসে ওর চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। এমন সবুজ বাতাস আসাদ করিম বহুদিন উপভোগ করে নি। তার মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। প্রতিদিনই ঘুম ভাঙলে সে নারীপুরুষের গলা খিস্তিখেউড় শুনতে পায়। সে আজও এসব না শোনার জন্য বালিশটাকে কানের উপর চেপে ধরে উৎকর্ণ হয়ে রইল। কিন্তু আজ কোনো সোরগোল নেই। চারিদিক সুনসান। সে প্রতিদিনই কাকের কোলাহল, হৈচৈ, নোংরা চীৎকার ঘুম না ভাঙতেই শুনতে পায়। কিন্তু আজ কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে ভাবছে এই নোংরা শহরের কাকগুলোও কি রাত থাকতেই শহর ছেড়ে চলে গেছে? বস্তি উচ্ছেদ করার ঘোষণা দেওয়ায় রাতের আঁধারেই সব বস্তিবাসী তল্পিতল্পা গুটিয়ে কোথাও চলে গেছে কি! ঘুমিয়ে ছিল বলে সে কিছুই বুঝতে পারে নি। কিন্তু, বস্তির মানুষের যদি যাবার কোনো জায়গা থাকত তাহলে কি তারা এই আবর্জনার মধ্যে পড়ে থাকত! কিন্তু আসাদ আবর্জনার গন্ধ পাচ্ছে না। ঘরের পেছনের ডাস্টবিনটা কেউ কি কোনো অদৃশ্য শক্তির ইশারায় রাত না পোহাতেই দূরে কোথাও সরিয়ে নিয়ে গেছে? চোখ না খুলেই নিঃস্তব্ধতা আর মৃদুমন্দ বাতাস উপভোগ করতে করতে আসাদ করিম আধো ঘুম আর আধো জাগরণের এক অভূতপূর্ব অনুভুতি নিয়ে আরো কিছু সময় বিছানায় লেপ্টে থাকে। আধো ঘুম আধো জাগরণের এই সকালটাতে তার প্রিয় একটি কবিতার লাইন মনে পড়ে ঘুমের অলসতায় চোখ বুঁজে আসার মতো শান্তি, আর প্রশান্তি উপভোগ করার কালে কোথা থেকে কয়েকটা পায়রা এসে বাক-বা-কুম ডেকে উঠলে সে সন্দিগ্ধ হয়ে যেন অধিবাস্তবতা থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে জেগে ওঠে। আসাদ করিম চোখ মেলে তাকায়। ঘুম ভাঙলে প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সে জীবনানন্দের বিমর্ষ মুখটা দেখতে চায়। তার মুখ দেখে আসাদের মনে পড়ে যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা! আসাদের ঘুম না এলে রাতের অন্ধকারে বিমর্ষ জীবনানন্দ দাশও জেগে থাকে। আজ মলিন দেয়ালে জীবনানন্দের নিরানন্দ ছবিসহ বর্ষপঞ্জিটা ঝুলছে না দেখে আসাদ অবাক হয়। জীবনানন্দকে কে সরিয়ে নিল? চারপাশে তাকিয়ে ছবিটা না থাকার বিষয়টা সে নিশ্চিত হতে পারল। ছবির বদলে একটা আলোক বিম্ব এসে দেয়ালে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় ওদের স্কুলের চালের ফুটো গলে এমন আলো এসে পড়ত বাংলার শিক্ষক এরকম আলোকবিন্দুকে বলতেন রবিচ্ছটা। কিন্তু এই বস্তির ঘরে রবিচ্ছটা পৌঁছানোর কথা নয়! আসাদ ঘর থেকে বের হয়ে এল। একটা লম্বা বারান্দা, দীঘল মাটির ঘর, টালির ছাদ। আসাদ হাঁটতে হাঁটতে লম্বাঘরটার বারান্দার শেষে এসে থামল। চারিদিকে গাছপালা, নীরবতা, পুরোনো পলেস্তরা খসে যাওয়া দেয়াল, একটা কাঠের ভাঙা দরোজা। সামনে খোলা চত্বর, একটা পুরোনো দ্বিতল বাড়ি। তমালের ঘন ছায়া বাড়িটিকে ঘিরে আছে। চারপাশে অফুরন্ত সবুজের সমাহার, তবু পুরোনো দেয়ালের পাশে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ লাল রঙের ঝলমল পাগড়ি মাথায় ধারণ করে আশপাশের সবুজ ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে আছে। কোথাও একটা অচেনা পাখি ডাকছে ‘হটিটি-হটিটি- হটিটি’। আসাদের কানে বাজল ‘অতিথি-অতিথি-অতিথি’। সে এখানে একজন আগন্তুক পাখিরা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আসাদ করিম চারপাশে তাকাল। দেয়ালের বাইরে একটা পুকুর পুকুরটা বেশ বড়, দীঘিও বলা যায়। টলটলে পানি। ওপারে লোকজন গোসল করছে। এপাড়েও একটা ভগ্নঘাট আছে। কোথাও বা লাল ইটের কঙ্কাল বেরিয়ে রয়েছে, দু’একটা ইট আবার খোয়াও গেছে। রবীন্দ্রনাথ একটি ঘাটের কথা লিখেছিলেন। এরকম একটি ভাঙা ঘাট রবীন্দ্রনাথের গল্পে জীবনের করুণ কাহিনী বলতে গিয়ে নিজেও জীবন্ত আর মানবিক হয়ে উঠেছিল। এই জীর্ণ ঘাটটিকে আসাদের প্রবীণ কোনো মানুষ বলে মনে হলো। দীঘির টলমলে পানিতে আসাদের সাঁতার কাটতে ইচ্ছে হলো। বহুদিন হয় সাঁতার কাটা হয় না। সে একটা তোয়ালে আর সাবান নিয়ে ঘাটের দিকে গেল। অভ্যাস নেই বলে বুক পানিতে নেমে দাঁড়িয়ে সে শীতল পানিতে ডুব দিলো। দ্বিতীয়বার ডুবে অনেকক্ষণ দম নিয়ে থাকল, ডুবে থেকে ওর মনে পড়ল ‘সরোবর অতলের মতো শান্তি’। জলের তলে ডুব থেকেই গতকালের সব
কথা আসাদ করিমের মনে ভেসে উঠল। ট্রেন থেকে নেমে আসাদ করিমের মনে হয়েছিল রাত অনেক হয়ে গেছে। সে ছাড়া আর মাত্র দু’জন লোক ট্রেন থেকে নেমে দ্রুত আঁধারে মিলিয়ে গিয়েছিল। ঘড়িতে তখন মাত্র আটটা। চারিদিক স্তব্ধ, প্লাটফর্মে কোথাও কোনো আলো নেই। কোথায়, কোন দিকে যাবে সেটা বোঝার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে, এদিক ওদিক তাকিয়ে দিকচিহ্নহীন অন্ধকারে তাকিয়ে কিছুই মালুম করতে পারছিল না সে। খানিকটা সময় পর সে দেখল একটা সবুজ বাতি দুলতে দুলতে ক্রমশঃ ওর নিকটবর্তী হচ্ছে। এরকম সবুজ বাতি নিয়ে কাউকে পথ চলতে সে আগে আর কখনো দেখে নি। বাতিটা ওর সামনে এসে থেমে গেল। চেহারা দেখতে না পেলেও আসাদ বুঝতে পারল একটা লোকই সবুজ আলো হাতে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বুঝতে পারল লোকটা রেলের সিগন্যালম্যান। তার কাজই হলো সবুজ আর লাল বাতি দেখানো। লোকটি ওর মুখের সামনে বাতি তুলে ধরল। আসাদ তখন ভাবল, সবুজ বাতি দেখিয়ে এবার ওর পথ বাতলে দিলে ভালো হয়। পতিসর কী ভাবে যাব, দয়া করে একটু বলবেন কী? সন্ধ্যার পরই যানবাহন মেলে না, এমন কি ভটভটিও না।
ভটভটি কী জিনিস?
ভটভটি চেনেন না!
লোকটির বিস্মিত চোখ দুটি আসাদ করিম দেখতে পেল না আর প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারল না। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে সিগন্যালম্যান হাতের বাতিটা আবার ওর চোখের সামনে তুলে ধরে দোলাতে লাগল। ওর চেহারা, পোশাক, হাতের ব্যাগ আর হাবভাব সময় নিয়ে দেখতে লাগল। তারপর বাতি নামিয়ে আর কোনো প্রশ্ন না করে একবার এদিক একবার ওদিক দেখে নিয়ে লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। লোকটা সন্দেহমুক্ত হতে পেরেছে কি-না আসাদ বুঝতে পারছিল না।
কোথা হতে আসতিছেন?
ঢাকা থেকে।
পতিসর কুঠিবাড়ি দেখতে যাবেন?
কুঠিবাড়ি?
তা হলে, অন্য কাজে এসেছেন। কুঠিবাড়ি তো আর অন্ধকারে দেখার
বিষয় না। তাই না?
কতদূর, পতিসর গ্রাম?
তা বিশ কিলো তো হবেই। তবে দূরত্বটা তো বড় কথা নয়, রাত হয়ে গেছে সেটাই আসল সমস্যা। যাওয়ার কী কোনো উপায় নেই? কালীগঞ্জ ফিরতি ভটভটি মাঝে মধ্যে খালিও চলে যায়। যদি ভাগ্য ভালো হয়, পেতেও পারেন। তাহলে, রাতে থাকার মতো কোনো জায়গা আশেপাশে পাওয়া যাবে না? আহসানগঞ্জ গেলে পেতে পারেন।
কোন দিকে?
নদীর ওপারে। সেতু পার হয়ে গিয়ে ডানে এক কিলো মতো গেলেই হবে। আসাদ দাঁড়িয়েই ছিল। আর লোকটাও বাতি তুলে ধরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। যেন কিছু একটা পাওয়া যায় কিনা তাই বাতির আলোয় খুঁজছিল। সহসা ভটভট পটপট মতো একটা যান্ত্রিক শব্দে নীরবতা ভাঙলে লোকটা তখন আবার লণ্ঠনের সবুজ আলো উঁচুতে তুলে ধরে অন্ধকারে তাকিয়ে বিষয়টা আন্দাজ করতে চেষ্টা করল। লোকটা বলল, মনে হয়, একটা ভটভটি আসল। নিচে নামি দেখতে পারেন ফিরতি কালিগঞ্জ যাবে কি-না।
কোন দিক দিয়ে নামতে হবে?
অ, আচ্ছা, আসেন, আমার সঙ্গে আসেন। লোকটা সবুজ বাতি নিয়ে প্লাটফরম ধরে আঁধারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আসাদ তার পেছনে হাঁটছিল। লোকটার হাতের সবুজ বাতিছাড়া চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। একসময় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকলে আসাদের মনে হচ্ছিল, সে যেন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অন্য কোথাও, যেন অন্য এক জগতে ঢুকে যাবে। সিগন্যালম্যানের হাতের ক্ষীণ আলোর সলতেটা এই আঁধার সমুদ্রে কোনো দিকচিহ্নের হদিস দিতে পারছিল না। লোকটা বাতিটা দোলাতে দোলাতে অন্ধকার সিঁড়িভেঙে নিচে নামতে থাকলে আসাদ তার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নামল। সে লোকটার সঙ্গে নীরবে হেঁটে যেতে যেতে অন্য একটা মৃদু আলোর বাতির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। স্টেশনটা যে অনেক উঁচুতে- নামার পরই আসাদ বুঝতে পারল। নিচ থেকে বোঝার উপায় নেই, উপরে স্টেশন বলে একটা কিছু আছে। সে দেখতে পেল একটা ছোটো দোকানের দোকানি তার দোকান বন্ধ করার শেষ আয়োজন করছে। সিগন্যালম্যান কুপির আগুনে একটা বিড়ি ধরাল। দোকানদারকে গামলার ময়লা পানি ফেলে দিয়ে চা-এর কেটলির তলের আগুন নিভিয়ে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করার জন্য ঝুলন্ত কলা আর বনরুটি নামাতে দেখে আসাদের ক্ষুধার কথা মনে পড়ল। ট্রেনে বসে সে ভেবেছিল, আত্রাই স্টেশনে নেমে কিছু খেয়ে পতিসর রওনা দেবে। কিন্তু ট্রেনটা আত্রাই-এর সামান্য দূরে নলডাঙা নামক একটা ফাঁড়ি স্টেশনের আউটারে এসে দু’ঘণ্টার বেশী সময় থেমে ছিল। দোকান বন্ধ হওয়ার আগেই আসাদ পেটে কিছু তুলে নেয়ার কথা ভাবছিল। সে দুটো কলা আর একটা বন কিনে নিল। শুকনো রুটি মুখে দিয়ে চিবোতে-চিবোতে ভাবছিল এখান থেকে পতিসর যেতে পারলে যাবে, না পারলে আবার প্লাটফরমে ফিরে গিয়ে বসে থেকে রাতটা কাটিয়ে দেবে। প্লাটফরমে তো কত লোকই রাত কাটায়। সে কি আর একটা রাত পার করতে পারবে না? তখন একটা বাহন ভট ভট শব্দ করে দোকানটার কাছে এসে দাঁড়াল। এর চালক ‘মুস্কিপুর, কালীগঞ্জ, মুস্কিপুর, কালীগঞ্জ’ বলে চীৎকার করে যাত্রী তালাশ করছেন আসাদ জানতে চাইল
পতিসর যাওয়া যাবে?
মুস্কিপুর নামতে পারবেন।
সেখান থেকে পতিসর কীভাবে যাবো?
অল্প রাস্তা, হেঁটে চলে যেতে পারবেন।
আসাদ আর না ভেবেই উঠে ভটভটিতে উঠে বসল। বসে অবশিষ্ট রুটি আর কলা শেষ করল। তার পরপরই আরো চার-পাঁচজন উঠে পাশে বসল। ওর মনে হলো, লোকগুলো যেন এতক্ষণ অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল। তারা উঠেই ড্রাইভারকে তাগাদা দিতে লাগল, ‘যাও, চালাও, আর পাবে না। রাত হয়ে গেছে, চলো, চলো। যাত্রীরা তাড়া দিল। অতপর ভটভট ভটভট শব্দ করে তিনচাকার যন্ত্রটা একচোখা প্রাণীর মতো এক-বাতির আলোয় পথ চিনে চিনে আঁধার থেকে ক্রমশঃ আরও আঁধারে ঢুকে যাচ্ছিল। আশপাশে কী আছে আসাদ কিছুই বুঝতে পারছিল না। আর সমস্ত চরাচর ছিল নিদ্রিত যন্ত্রটা মাঝে মাঝে হঠাৎ থেমে কাউকে আঁধারে নামিয়ে দিয়ে আবার অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ঘোঁ ঘোঁ করে ছুটছিল। এক সময় আসাদ ছাড়া ভটভটিতে আর কোনো যাত্রী ছিল না। সে ভেবে পাচ্ছিল না কতদূর নিয়ে যাবে। তখন ওর মনে হচ্ছিল, যন্ত্রযানটা কোনো এক রূপকথার জন্তু তাকে পৃথিবীর বাইরে অন্যকোনো জগতে নিয়ে যাচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ পর ভটভটি পথের উপর হঠাৎ থেমে ওকেও নামিয়ে দিয়েছিল।
মুস্কিপুর নামেন।
ভাড়া কত?
দশ টাকা।
আসাদকে অন্ধকারে রেখে ভটভটিটা ভটভট করতে করতে আঁধার ভেদ করে চলে গিয়েছিল। নিঃশব্দ পথের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর মনে হয়েছিল, সত্যি অন্য কোনো অন্ধকার জগতে ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। কোন দিক যাবে, কী করবে সে বুঝতে পারছিল না। চারপাশে তাকিয়ে সে ঠাহর করার চেষ্টা করছিল। সে কোথাও পড়েছিল, সমুদ্রের নাবিকরা অন্ধকারে আকাশের তারা দেখে পথ চিনে নেয়। কিছু ঠাহর করতে না পেরে আকাশের দিকে তাকালে অনেক দিন পর আকাশের মিটি মিটি তারাগুলো ওর খুব চেনা মনে হচ্ছিল। ওর মনে পড়ছিল অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা…। মনে হচ্ছিল সে যেন সত্যি কোনো আঁধার-সমুদ্রে পথ হারিয়ে ফেলেছে। ওর মনে হচ্ছিল এই আঁধার সাগর সারারাত সাঁতরেও সে পতিসর পৌঁছাতে পারবে না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল হয়তো ভোর হওয়া পর্যন্ত এই পথের উপরই অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ওর ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে সহসা কোথা থেকে একটা ভ্যান সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কুঠিবাড়ি যাবেন?
পতিসর যাবো।
ওঠেন।
আসাদ আর কিছু না ভেবেই এবং কোনো কথা না বলেই ভ্যানে উঠে পড়েছিল। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে আশপাশে কিছু দেখতে না পেয়ে আসাদ আকাশের দিকে আবারও তাকিয়ে ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল তীর আর ধনুক হাতে এক বীরপুরুষ আকাশজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে আকাশের গায়ে একটা বৃশ্চিক ফুটে আছে। কালপুরুষ যেন তাকে বধ করার জন্য নিশানা করছে। আকাশের তারা দেখতে দেখতে একসময় ভ্যানটা কোথাও এসে থেমে গিয়েছিল।
চলে এসেছি!
কার বাড়ি যাবেন?
আসাদ কোনো উত্তর দিতে পারল না। চারপাশে তাকিয়ে সে দিক খুঁজে পাচ্ছিল না। তবু একটু সময় নিয়ে পকেট
হাতড়ে একটা নোট পেয়ে ভ্যানের তলায় ঝুলন্ত হারিকেনের আলোয় একবার পরখ করে দেখল, পঞ্চাশ টাকার নোট। সেটা ভ্যানওয়ালাকে দিলে সে আবার হারিকেনের আলোয় নোটটা একই রকম করে পরখ করে দেখে নাড়াচারা করল।
পঞ্চাশ টাকার ত ভাঙতি নাই।
আমার কাছেও তো নাই, তাহলে?
এত রাত, মুস্কিল হয়ে গেল। ভাঙতি কই পাবো? ভাংতি না থাকায় আসাদ কিছুটা স্বস্তি বোধ করছিল। সে ভাবছিল, ভ্যানওয়ালা পঞ্চাশ টাকা নেবে নিক, তার বদলে সে যতক্ষণ সম্ভব ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকুক। সে মনে মনে আরো প্রত্যাশা করছিল, মুস্কিপুরের মাথায় যেমন এই ভ্যানওয়ালা এসে হাজির হয়েছিল তেমনি ভ্যানওয়ালার মতো আর কেউ বাকী পথ দেখানোর জন্য উপস্থিত হোক! ওর এমন কাউকে দরকার ছিল, যে ওকে এই আঁধার থেকে উদ্ধার পেতে সহযোগিতা করতে পারে। সে আশপাশে এমন করে তাকাচ্ছিল যেন, ওকে পথ দেখাতে কারো আসার কথা রয়েছে। অথচ এখনো এসে পৌঁছে নি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আসাদের মনে হচ্ছিল, ভ্যানওয়ালা ছাড়া এতল্লাটে আর যেন কোনো জনমানব নেই। আর ভ্যানচালকও টাকাটা হাতে নিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন আসাদকে কারো কাছে বুঝিয়ে দিয়ে তার পরই ঘরে ফিরবে। অচেনা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অচেনা ভ্যানচালককে আসাদের খুবই আপন বলে মনে হচ্ছিল। তখন টর্চ জ্বেলে জ্বেলে সত্যি সত্যি একজন এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।
কে?
আমি আবুল কালাম।
এই রাতের বেলায় ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো? কারো অসুখ করল নাকি? না স্যার, অসুখ-বিসুখ না। স্যার, আপনার কাছে কি পঞ্চাশ টাকার নোটের খুচরা হবে?
খুচরা লাগবে, কী জন্য?
মুস্কিপুরের মাথা থেকে একজনকে তুলে আনলাম। তার কাছে ভাঙতি নাই।
দাঁড়াও দেখি।
আসাদ করিম দেখল, লোকটি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলেন। হাত পকেট থেকে বের করে টর্চের আলোয় নোট দেখতে দেখতে তিনি আসাদ করিমের দিকেও একবার তাকালেন। আসাদ এই সুযোগে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। আমার নাম আসাদ। আমি এখানে নতুন এসেছি।
আসাদ মানে আপনি আবু করিম আসাদ!
আপনি আমার নাম জানেন!
জানি। সে কথা পরে হবে। এত রাত্রে কী করে এসে পৌঁছুলেন!
ট্রেনে আত্রাই। তারপর…।
কালাম, এই নাও টাকা।…আসুন, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। লোকটা টর্চের আলো জ্বেলে হাঁটতে শুরু করলে আসাদ তার পরিচয় বা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা না জেনেই পরম নির্ভরতায় পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল।
পথে কোনো অসুবিধে হয় নি তো?
না, কোনো অসুবিধা হয় নি। আত্রাই নেমে একটা ভটভটি পাওয়া গেল। সে মুস্কিপুর রাস্তার মাথায় নামিয়ে দিয়ে কালীগঞ্জ চলে গেল। আমি তো কিছু চিনি না। এই ভ্যানটা না পেলে আমার সত্যি সত্যি খুব অসুবিধা হতো।
যাক, অন্ধকার রাত, ভালোয় ভালোয় যে পৌঁছাতে পারলেন! কিন্তু, আমার নাম আপনি জানেন কী করে?

Series Navigation<< উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// একউপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// তিন >>