উপন্যাস

উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো

২৭

আসাদ করিমের সঙ্গে ঘনিষ্ট এমন তিনজন লোককে ক্যাম্পে ডেকে আনা হয়েছে। তাদের একজন নারী। তারা কী ভাবে এমন একজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে ঘনিষ্ট হলেন? তার না জেনেও আসাদকে আশ্রয় দিয়ে থাকতে পারে, তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে মেয়েটি তরুণী সে একজন যুবকের প্রেমে পড়তেই পারে। আবার তাদের কারো সঙ্গে তার মতাদর্শগত মিলও থাকতে পারে। কমান্ডার ভাবছেন, তাদের কথা শুনতে হবে, অর্থাৎ জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

যে তিনজন লোক এসেছে তাদের ভেতরে নিয়ে এসো। সবাইকে এক সঙ্গে নয়,একজন একজন করে আনবে।

ইয়েস, স্যার। প্রথমে কাকে আনব?

আবুল কাসেম মাস্টার।

সিপাই এসে আবুল কাসেমকে ভেতরে নিয়ে গেল। কনকচাঁপা আর শশাঙ্ক বাবু বসে রইলেন। কনকচাঁপার মনে নীরবে আসাদ করিম এসে উপস্থিত হলো। ওর মনে পড়ছে, হঠাৎ করেই লোকটা উপস্থিত হয়েছিল। একটা তরুণ যে ঢাকা শহর ছেড়ে এমন অজগাঁয়ে এসে অশিক্ষিত মানুষের সন্তানদের মানুষ করতে এমন নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠতে পারে সেটা আসাদকে না দেখলে সে কখনো ভাবতে পারত না। আর পতিসরের মানুষগুলোকে কদিনের মধ্যেই সে কেমন আপন করে নিতে পেরেছিল। এই গ্রামে জন্ম নিয়ে, এখানকার মাটি আর আলো-বাতাসের কৃপায় জীবনধারণ করেও এই গ্রামকে এখানকার লোকগুলো আসাদ করিমের মতো ভালোবাসতে পারে না। অল্প কদিনের মধ্যেই সে এ গাঁয়ের মানুষের কত না আপন হয়ে গিয়েছে। শুধু স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই নয়, গ্রামের সাধারণ মানুষেরও মনে সে স্থান করে নিয়েছে। কনকচাঁপা ভাবছে, সবচাইতে বেশি কি কনকচাঁপার মনেই স্থান করে নেয় নি? কনকচাঁপার মনের আকাশে সন্ধ্যাতারার মতো আসাদের মুখটা ঝলমল করছে। এই ঘনায়মান গ্রামীণ অন্ধকারে সেই আলোকোজ্জ্বল তারাটি কি হারিয়ে যাবে?

শশাঙ্ক বাবু চারপাশে তাকাচ্ছেন। গেটের দু’পাশে বালির বস্তা সাজিয়ে দু’জন সৈনিক মাথায় হেলমেট পরে বালির বস্তার উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের নল রেখে সামনের দিকে তাক করে পাহারা দিচ্ছে। আর তিনতলা সায়েন্স ভবনের প্রতিটি বারান্দায় অস্ত্রহাতে শত্রুর মোকাবেলা করতে সেপাই দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের উপরও একজন সেপাই যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে বন্দুক তাক করে বসে আছে। তার ভেতরে কেন যেন এক অচেনা আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। তিনি সেটা মনের ভেতরে চেপে রাখতে চেষ্টাও করছেন। বাইরে যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে সে জন্য হাসিমুখে মেয়ের চোখে চোখ রাখলেন। কিন্তু মেয়ে বাবাকে চেনে। সে নীরব-প্রতিউত্তরে অভয় দিল, বাবা, ভয় কি? আসাদ তো কোনো অন্যায় করে নি, সে অন্যায় করতে পারেই না।

আবুল কাসেম মেজরের ঘরে ঢুকে দেখলেন বেসামরিক পোশাকে এক যুবক চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকছে। তিনি আন্দাজ করলেন, তার বড় ছেলেটা বেঁচে থাকলে এর মতোই বয়স হতো। তিনি শিক্ষক মানুষ, আজীবন মানুষের সম্মান পেয়ে এসেছেন। এই বয়সী ছেলেদের দেখলে তার নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায়।

কমান্ডার সিগারেট হাতে নিয়ে আবুল কাসেমকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। নিরীক্ষণ শেষ করে নাক-মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।

আবু করিম আসাদকে আপনি কতদিন যাবত চেনেন?

পতিসর স্কুলে যোগদানের পর থেকে।

এর আগে চিনতেন না?

না।

সে কতদিন আপনার স্কুলে আছে?

একবছর।

সে স্কুলে চাকরি পেল কী করে?

ছেলেটি আমার ছোটোভাই-এর পরিচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে সে তার ছাত্র ছিল। আমাদের বাংলার শিক্ষক ছিল না। সে তাকে রাজি করিয়ে গ্রামে পাঠিয়েছিল।

বাংলার মাস্টার! স্কুলে বাংলা পড়াতে আলাদা শিক্ষক লাগে নাকি?

কী বলছেন! বাংলা শেখানোর জন্য আলাদা শিক্ষক দরকার নেই?

যাক, বাদ দেন। আপনার ভাই-এর নাম কী?

আশরাফুল ইসলাম কবির। আমরা কবির বলে ডাকি।

তিনি কী শিক্ষকতা করেন?

না। সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। ডেপুটি কমিশনার অব কাস্টমস্।

আপনি বললেন, আসাদ করিম তার ছাত্র ছিল।

সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক ছিল। পরে কাস্টামস ক্যাডারে যোগ দিয়েছে।

ঘুষ খাওয়ার জন্য ইউনিভার্সিটির চাকুরি ত্যাগ। বেশ, ভালো।

আবুল কাসেম এর কোনো জবাব দিতে পারলেন না। সত্যিই তো। তাছাড়া কেনই বা সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক চাকুরি ছেড়ে দেবে? তিনি চুপ করে রইলেন। কমান্ডার আবার নাকেমুখে ধোঁয়া নির্গত অবস্থায় তীব্র চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন,

কবির সাহেবের স্ত্রীর নাম কী?

ফরিদা কবির।

আমি তো জানি তার নাম মিতালী। তার নিকনেম কি মিতালী নয়?

আমি তার ডাকনাম জানি না।

আচ্ছা, আমাকে ঠিকঠাক বলুন তো, আসাদ করিমের কাছে কারা আসা-যাওয়া করত?

আমি এমন কারো কথা জানি না।

তার কক্ষে গভীর রাতে ধানকাটার লেবার এসে মিটিং করত।

আমি এ সম্পর্কেও কিছু জানি না।

আপনি কোনো দল করেন?

আমি কোনো দলীয় রাজনীতি করি না।

আপনি স্বীকার না করলেও আমরা জানি, আপনার মতাদর্শ কী। আপনি একজন নকশালিস্ট।

আবুল কাসেমের তখন অহিদুর রহমানের কথা মনে পড়ল। সুদখোর মহাজন আর জোতদার ভূস্বামীর নির্যাতন থেকে কৃষকদের মুক্তির জন্য তিনিও সাম্যবাদে বিশ্বাসী হয়ে জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তেভাগা আন্দোলনে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। আবার অহিদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধও করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে সেই চেতনা পরিত্যক্ত হওয়ায় বিরুদ্ধ মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছিল। আর ঘরের শত্রু বিভীষণ সুযোগ মতো আঘাত করতেও ভুল করেনি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যতটুকু অর্জন হয়েছিল শুধু নেতৃত্বের ভুলের কারণে তার থেকে শতগুণ পিছিয়ে গেল দেশ।

কী আপনার কোনো জবাব আছে?

দেখুন, মতাদর্শ প্রত্যেক মানুষেরই থাকে। আমারও অবশ্যই আছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করে আছি। সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা আমি এখনো ভাবি।

তাহলে তো আপনি লালপতাকার সাপোর্টরই।

সাধারণ মানুষের কথা ভাবলেই লালপতাকার সাপোর্টার হওয়া লাগে আমি জানতাম না। আপনি, আমি বলতে চাইছি, যারা কোনো বাহিনীতিতে আছেন অথবা সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কি সাধাধারণ মানুষের কথা ভাবার দরকার নেই? তারা কি এখনো, ঔপনিবেশিক মানসিকতাই লালন করে যাচ্ছেন?

কমান্ডার আবুল কাসেমের একথার উত্তর সহসা দিতে পারলেন না। তিনি নীরবে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর আবুল কাসেমও তীর্যক দৃষ্টিতে তার প্রশ্নের উত্তরের জন্যই তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কমান্ডার এ বিষয়ে আর কোনো কথা বললেন না।

ঠিক আছে, আপনি আজ আসুন। আবার যখন প্রয়োজন হবে, ডাকবো। ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবেন। মনে থাকবে তো?

মনে থাকবে।

আসুন।

মেজরের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে আবুল কাসেমের মনে হচ্ছিল, তিনি ১৯৭১ সালে ফিরে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে যেমন কাউকে ধরে নিয়ে আসা হতো তাকে তেমনি পাক আর্মি ধরে নিয়ে এসেছিল। 

সেপাই এসে শশাঙ্ক বাবুকে ভেতরে যেতে বলল। আবুল কাসেমের মুখের দিকে তাকিয়ে শশাঙ্ক বাবু তার ভেতরের অবস্থাটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন। মেজরের কাছে যাওয়ার আগে তিনি কনকচাঁপার দিকেও একবার তাকালেন। বাবার চলে যাওয়া দেখে এবার কনকচাঁপার মনে একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কন্যার লেখা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথার কোনো কোনো পাতা ভেসে উঠতে লাগল। ঐ স্মৃতিকথায় সে পড়েছিল, একজন পিতা তার সন্তানের সামনে থেকে পাকবাহিনীর টর্চার ক্যাম্পে যাচ্ছেন। পিতা আর সেই কন্যা বুঝতে পারছে তাদের আর দেখা হবে না। কিন্তু তারা কেউ শেষ বিদায়ের কথাটাও পরস্পরকে বলতে পারছে না। এমনকি কাঁদতেও পারছে না।

যতক্ষণ শশাঙ্ক বাবু ফিরে না এলেন ততক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রত্যক্ষদর্শী কন্যার বর্ণিত দৃশ্যটা কনকচাঁপা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিল না। সে মনে মনে শুনতে পাচ্ছিল শশাঙ্ক বাবুকে জিজ্ঞসাবাদ চলছে।

শশাঙ্ক দাস! আপনার নাম?

হ্যাঁ।

আপনি কী পড়ান?

অংক করাই।

আপনার বাড়িতে আসাদ যাতায়াত করত?

হ্যাঁ।

আসাদের সঙ্গে কী বিষয়ে কথা বলতেন?

সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে।

অংক পড়ান কিন্তু সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা বলতেন?

অংক করালে কি রবীন্দ্রনাথ আর সাহিত্য নিয়ে কথা বলা যায় না?

যাবে না কেন? না গেলে আপনারা তো বলতেন না। আপনার কী যেন নাম বললেন?

শশাঙ্ক দাস।

শশাঙ্ক দাস। আপনার ছেলে-মেয়ে ক’জন?

একটি মেয়ে আর একটি ছেলে। ছেলেটো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আর কনকচাঁপা গ্রামের স্কুলে পড়ায়, বাড়িতেই আছে।

ঠিক আছে। আপনি এখন আসুন। আপনাকে আবার প্রয়োজন হতে পারে। ডাকলে আসবেন। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

সাফ, একে দিয়ে আস, আর মেয়েটাকে নিয়ে আস।

শশাঙ্ক বাবু ফিরে এলেন। তিনি ফিরে এলে আবুল কাসেম যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তিনি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়েছিলেন। শশাঙ্ক বাবুকে ফিরতে দেখে নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। তিনি যেন এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচেন। কনকচাঁপা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, হেড স্যার ফিরে এসে কিছুই বললেন না। তার কাছে কিছুই জানা গেল না। বাবাকে কি কিছু বলেছে? সে বাবার মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু, শশাঙ্ক বাবুর মুখটা আরো বেশি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিনি যেন কোনো রকমে দেহটা বয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন।

বাবা! তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

না, আমি ঠিক আছি।

তোমাকে কী বলেছে?

তেমন কিছু না।

তাহলে?

মা, তোকেও কমান্ডার একাই যেতে বলেছে।

আমাকে? একা!

হ্যাঁ।

আসাদ সাহেবের কথা কী বলল? তাকে ছেড়ে দেবে তো?

আমি জানি না। আমাকে কিছু বলেনি। তুই কথা বলে দেখতে পারিস।

কনকচাঁপা ভেতরে যেতে থাকলে ওর পিতা আর শিক্ষক যতদূর দেখা যায় পেছন থেকে তাকিয়ে রইলেন। তাদের দুজনের দৃষ্টি থেকে নীরব আশীর্বাদ কনকচাঁপার জন্য বর্ষিত হচ্ছিল। তবু দু’জনই আলাদা করে ভাবছিলেন, মেয়েটাকে না আনলেই পারতেন। ওকে জোর করে রেখে আসতে পারতেন। ওকে কী পরিস্থিতির শিকার হতে হবে কে জানে! কিন্তু যে জেদি মেয়ে! বরং তারা মনে মনে ওকেই বেশি ভরসা করে এসেছেন। সে কথা যা বলে যুক্তি দিয়ে বলে। শশাঙ্ক বাবু আর আবুল কাসেম যখন কনকচাঁপাকে নিয়ে নানা কথা ভাবছেন তখন মেজর ওকে প্রশ্ন করছেন।

কী নাম! আপনার?

কনকচাঁপা।

সুন্দর নাম। আপনি কী করেন?

স্কুলে পড়াই।

আপনি মাস্টারি ছাড়া আর কী কী করেন?

আর কী করবো?

আর কিছু করেন না। কিন্তু আমি জানি, আপনি ভালো গান করেন। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ আর ‘আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো’ ধরনের গান আপনি খুব ভালো গাইতে পারেন। আর আপনি নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেন। কি ঠিক বলিনি? আর কবিতাও লেখেন। আসাদ করিম আপনার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়। বলুন, সব সত্যি বলছি না? মাঝে মাঝে কবিতার আসর বসে আপনার বাড়িতে। বলুন তো, কখন বসে আসর? দিনে নাকি রাতে?

আমাদের বাড়িতে কখনো কবিতার আসর বসে নি।

আমি কতগুলো তারিখ বলে দিতে পারি। যেমন─এপ্রিলের ১৩, মে মাসের ১ তারিখ আপনাদের বাড়িতে আসর বসেছিল। আসাদ করিম এসেছিল।

কনকচাঁপার মনে পড়ল, ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তি ছিল। আর পহেলা মে ছুটির দিন। সেদিন আসাদ এসেছিল। ওর কবিতা শুনতে চেয়েছিল। সে নিজের কবিতা না শুনিয়ে মে দিবসে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা শুনিয়েছিল। সেকথা মনে করে কনকচাঁপা চুপ করে রইল।

আমি জানি, আপনি উত্তর দিতে পারবেন না। আচ্ছা, আসাদ করিমকে আপনি কতদিন যাবত চেনেন?

তিনি এখানে আসার পর থেকে। প্রায় একবছর যাবত।

তার সঙ্গে কী ভাবে পরিচয় হয়েছিল?

তিনি আমার বাবার সহকর্মী, তার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তখনই পরিচয় হয়েছিল।

তারপর থেকে আপনার বাবা না থাকলেও তিনি আপনার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে আসতেন। তাই না?  

কখনো কখনো আসতেন।

তখন তার সঙ্গে কবিতা ছাড়াও বিপ্লবের কথা হতো, তাই না?

হ্যাঁ। আমরা কখনো কখনো একসঙ্গে গল্প করেছি আর চা খেয়েছি। তাতেই সমস্যা হয়েছে?

না। সমস্যা তাতেই হয় নি। গল্প-টল্প করা যেতে পারে। চা-টাও কখনো কখনো খাওয়া যেতেই পারে। আচ্ছা, একটা প্রশ্নের সঠিক জবাব দেবেন?

কেন দেব না?

আসাদ করিম আপনাকে ভালোবাসে।

আমি কী করে বলব?

আসাদ আর আপনি একই ভ্যানে কালীগঞ্জ মেলায় বেড়াতে গিয়েছিলেন।

গিয়েছিলাম।

সে আপনাকে ভালোবাসে না অথচ তাকে কবিতা শোনান, সে এসে গল্প করে, মেলায় যায়, আপনারা বেড়াতেও যান, এটা কেমন দেখায় না? আর ভালোবাসলে তো এসব করতেই পারেন, বেড়াতে যেতেই পারেন, সেটা সমাজের চোখে ভালো না ঠেকলেও আমি তাতে আপত্তি করতে পারি না। ভালোবাসার বয়স আসাদেরও হয়েছে। আপনার হয়েছে। কিন্তু ভালো না বাসলে সে কী জন্য আপনার কাছে আসে?

কেবল ভালোবাসলেই আসতে পারবে? আর কোনো কারণে আসতে পারে না?

তাও তো ঠিক। ভালোবাসা ছাড়াও তো আসতে পারে। অন্য কারণেও আসতে পারে। সে বিশেষ কারণটা কী বলবেন?

বিশেষ কোনো কারণ নেই।

তার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হতো?

না। কখনো সখনো। কী অপরাধে আসাদ সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছেন─সেটা বলবেন কি?

সেটা জানা কি আপনার খুব দরকার?

তার বিষয়টা দেখার মতো তেমন কেউ নেই। আমরা তাকে আইনগতভাবে সহায়তা করতে চাই।

আপনি তাহলে আসাদ করিমকে খুবই আপন মনে করেন?

কনকচাঁপা সহসা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। এরকম কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হবে সে ভাবেনি। সে আসাদকে ভালোবাসে। ওর মনে আসাদের যে স্মৃতি ধারণ করা আছে তা স্বল্প সময়ের এবং সামান্য হলেও অসামান্য মূল্য নিয়ে উপস্থিত হতে পারে সেটা সে কখনো ভাবে নি। প্রথম দিনের পরিচয় আর কথা বলার স্মৃতি, স্কুলে আলেয়ার জন্য ওর পক্ষে কথা বলার স্মৃতি, পুকুর ঘাটের কবিতা আর মেলায় যাওয়ার স্মৃতিগুলো এতদিন এমন মূল্যবান মনে হয় নি। অথচ এখন সব এক একটা স্মৃতি ওর মনে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। যতই স্মৃতিগুলো মনে ভাসছে ততই আসাদকে ওর খুব আপন আর কাছের মানুষ মনে হচ্ছে। সেকথা আজ মেজরকে জোরগলায় বলতে ইচ্ছে করছে।

কী, বললেন না, একজন এলিয়েন, আপনার খুব আপন হলো কেমন করে?

মানে?

মানে! একজন আগন্তুক কেমন করে আপনার খুব আপন হয়ে গেল সেটা জানতে চাইছি।

আসাদ একজন ভালো মানুষ। আমি তাকে ভালোবাসি।

ভালোবাসেন সে ভালো কথা। কিন্তু কী করে জানলেন! সে একজন ভালো মানুষ?

মানুষের আচার ব্যবহার আর কাজকর্ম দিয়েই মানুষকে চেনা যায়।

ভুল। মানুষ চেনা সবচাইতে কঠিন। আমাদের কাছে তথ্য আছে! সে একজন খুনি, সর্বহারা দলের পলাতক নেতা। আপনারা তাকে চিনতে পারেন নি।

কনকচাঁপা আর স্থির থাকতে পারল না। সে অস্থির আর আবেগপ্রবণ হয়ে মাথা নাড়তে লাগল।

আপনারা ভুল করছেন। ভুল করে একজন নিরীহ মানুষকে ধরে এনেছেন। সে কোনোভাবেই সর্বহারাদলের সঙ্গে জড়িত নয়। আমি ওকে চিনি।

আপনি নিজেই বলেছেন, আপনি তাকে অল্পদিন যাবত চেনেন। ভদ্রতা আর গোবেচারার লেবাসেই সর্বহারা সদস্যরা সাধারণ মানুষের কাছে এসে ভেড়ে। মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে সমাজে মিশে থাকে। আর আসল চেহারা সব অপরাধীই লুকিয়ে রাখে, কেবল সর্বহারা নয়।

আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের চারপাশে অনেকেই ভদ্রতার মুখোশ পরে আছে। মুখোশের আড়ালে তাদের অন্ধকার দিকটা আড়াল করে আছে। তারা নিজেদের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রেখে পেছন থেকে মুক্তমনের মানুষগুলোকে আঘাত করে। একাত্তরে আলবদররাও এই কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু আসাদ সেরকম কেউ নয়।

কারা সেই মুখোশধারী লোক! আপনি চেনেন তাদের?

যারা আসাদ সম্পর্কে আপনাদের মিথ্যা তথ্য দিয়েছে তারাই সেই মুখোশধারী। আপনি ভালো করে খবর নিলেই জানতে পারবেন, যারা সমাজে প্রভাবশালী তারাই রাতের অন্ধকারে সর্বহারাদের টাকা দেয়। তাদের আশ্রয়ও দেয়। আপনি তাদের ধরে এনে রিমান্ডে দেন, তথ্য পেয়ে যাবেন।

আপনি খুব সাহসিনী, আর বুদ্ধিমতিও। কিন্তু আপনি আসাদের বিষয়ে এত আবেগ দেখাচ্ছেন কেন?

আমি আবেগ দেখাচ্ছি না, আমি উৎকণ্ঠিত। একটা নিরপরাধ মানুষকে আপনারা সর্বহারা ভেবে ধরে নিয়ে আসবেন, আমাদের কি উৎকণ্ঠিত হবার কোনো কারণ নেই?

আপনি বলতে চান আসাদ সর্বহারা নয়?

ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ালেই কেউ সর্বহারা হয়ে যায় না। আর ধর্মের লেবাস পরে থাকলেই কেউ মুমিন হয়ে যায় না। মানুষের ক্ষতি করলেও এসব লেবাসধারী কথা আপনারা বিশ্বাস করে নিরপরাধ লোককে ধরে আনবেন? লেবাসছাড়া ভালো মানুষ কি সমাজে নেই? ভালো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কি কেউ থাকবে না? সমাজের সব মানুষই কি বিবেকহীন হয়ে যাবে? আর কেউ যদি না থাকে, আমি আসাদের পাশে থাকব।

আসাদের পাশে আপনি কেন থাকবেন?

আপনারা আসাদকে চিনতে না পারলেও, আমি তাকে চিনতে পেরেছি। সে একজন ভালোমানুষ। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি সে কতটা নিবেদিতপ্রাণ, সে কথা আপনাদের পক্ষে হয়তো জানা সম্ভব হয়নি। তাই তাকে বিশ্বাস করতে পারেন নি। কারো ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তাকে ধরে এনেছেন। আমি আন্দাজ করতে পারছি, কারা আপনাদের ভুল তথ্য দিতে পারে। আপনারা যাদের কথায় আসাদকে ধরে এনেছেন তারা যে দেশটাকে অন্য এক অন্ধকারে ঠেলে দিতে চাইছে সেদিক নিয়ে আপনারা ভাবছেন না। কারণ, তাদের সম্পর্কে আপনারা এমন কি দেশের যারা কর্ণধার তারাও ভাবে না। আপনারা তাদের সুন্দর লেবাস দেখতে পান, তাদের আসল চেহারাটা কখনো দেখতে পান না। এদের চেহারা কেবল গ্রামের ভুক্তভোগী মেয়েরা দেখতে পায়। যাক, সে কথা বলে আর কী হবে! তবু কয়েকটা কথা না বলে পারছি না। আমি মনে করি, আসাদ আপনাদের চাইতেও বেশি দেশকে ভালোবাসে, দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসে। সে নতুন প্রজন্মকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখাতে চায়; বাঁচার মতো বাঁচতে শেখাতে চায়। সে মেয়েদের চোখ খুলে দিতে চায়, আমি বুঝতে পারছি, এসবই ওর অপরাধ। যারা অন্ধকারের যাত্রী, দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে ফায়দা হাসিল করতে চায়, তারা আসাদের মতো আলোকিত মানুষকে সহ্য করতে পারে না। অন্ধকারের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে অন্ধকার সুযোগ পেলে তাদের কোনো ছাড় দেয় না। কৌশলে প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আসাদের মতো কিছু মানুষ আছে বলেই এখনো দেশটাকে অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করতে পারছে না। আপনি জেনে রাখুন, আসাদের জন্য পতিসরের মানুষ প্রতীক্ষা করবে। আর আমি আমার সাধ্যমতো সবকিছু করব।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরোউপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। শেষ পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *