উপন্যাস

উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আঠারো

চৌদ্দ

উদ্বেগের আগুনে যেন পুড়ছে উদ্বেগ। মহলের কঠোর শৃঙ্খলের শিকল ছিঁড়ে গেছে রুস্তমের দাবিদাওয়ার কথা শুনে। বেপরোয়া হয়ে জিনাত মহল ছুটে গেলেন প্রশাসনিক সেলে। সেল থেকে দাবি মেনে নেওয়ার নতুন ফরমান জারি হলেও জেলে রুস্তমের বস কুফিয়ার মুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি মহলের কর্তৃত্ববান পুরুষ জিনাত মহলের স্বামী আবদুল্লাহ আল কাফি। তিনি বললেন, ‘কুফিয়ার সাজা আমাদের সেল থেকে হয়নি। ওর মুক্তির ঘোষণা দেওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি আমার হাতে নেই।’

‘চার শর্তপূরণ না হলে তো রুস্তম ফিরবে না। মরুতে মরে পচে-গলে শহিদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত যে ছেলে, কত বড়ো সে, বুঝতে পারছেন?’

‘পারছি। নিজের সুযোগসুবিধার বিবেচনা না করে অন্যের ভালো চাওয়া অনেক বড়ো গুণ। কিন্তু বেগম, কুফিয়ার মুক্তির জন্য একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় ব্যয় হবে। কুফিয়ারও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে─ এই প্রস্তাবে তাকে রাজি করানো যায় কি না দেখুন। অন্য দুজনের মুক্তি দেওয়া সম্ভব। সেই ফরমানও জারি করে দিলাম।’

‘আপনার কি মনে হয়, রাজি হবে সে? নাকি আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকেও কারোর যাওয়া উচিত?’

‘আমার মনে হয় রাজি হবে। কারণ সে বুদ্ধিমান। তার শর্তে অন্য তিনজনের মুক্তির ব্যাপারে বলেছে এদের সাজা মাফ করা যায় কি না, মূল্যায়ন করে দেখতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সে। আইন অমান্য না করে পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছে। আমাদের পরিবারের কারও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং ওর নিয়োগকর্তা দুবাইয়ের আমির হামজা আল শামসকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে পারেন আপনি।’

‘উত্তম কথা বলেছেন, জনাব। সেই ব্যবস্থা করব আমি।’
আবদুল্লাহ আল কাফি বললেন, ‘বেগম, আপনার দাবির আড়ালে কি ছোটো আম্মি কলির কোনো ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে?’

স্বামীর প্রশ্ন শুনে যেন মুখে বসে গেল কালির আঁচড়। মিথ্যে বলতে অনভ্যস্ত জিনাত মহল পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘কী ইচ্ছার কথা জানতে চাইছেন?’
‘আমাদের পরিবারের কারও যাওয়া উচিত কি না, জানতে চেয়েছেন। এটা কি আপনার চাওয়া, না কলির, বেগম?’
স্বামীর প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে অভ্যস্ত জিনাত মহল উত্তর না দিয়ে আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার কী ধারণা?’
কিছুটা দৃঢ়কণ্ঠে কাফি জবাব দিলেন, ‘আমার মনে হয়েছে মেয়ের মমতার কাছে নত হয়েছে আপনার মানবিকতা, মহত্ত্ব। এই প্রস্তাব আপনার নয়। ছোটো আম্মির। ঠিক বলেছি?’

‘না। ঠিক বলেননি। মেয়ের অপরাধবোধ আছে ঠিকই। সে বুদ্ধিমতী। মমতার সহজাত গুণ থাকলেও সেটা দেখাবে না। হয়তো লুকোবে। সহজাত বৈশিষ্ট্য সামাল দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে ছোটো আম্মির। আপনি অনুমান করেছেন সাধারণভাবে চপল ও চঞ্চল কিশোরীর মন বিবেচনা করে। আমাদের ছোটো আম্মির চঞ্চলতা, চপলতার মধ্যেও আছে গভীর কোনো শক্তি। তেজ। সেটি আলাদা করে দেখার সুযোগ পাননি আপনি। প্রশ্ন শুনে সেটাই মনে হলো আমার।’ স্ত্রীর দৃঢ় উত্তর শুনে চমকে উঠলেন আবদুল্লাহ আল কাফি। নরম কণ্ঠে বললেন, ‘নিশ্চিত হতে পারেন আপনি। কুফিয়ার মুক্তির বিষয়টিও চূড়ান্ত করার ব্যবস্থা করব দ্রুত। কথা দিলাম।’

পনের

নিভুনিভু মোমের আলোর মতো আশার আলোটা আবার দপ করে জ্বলে উঠল। সেই আলোয় রুস্তম দেখল নিজের মুক্তি। নোমান ও সাদি মোহাম্মদের মুক্তিও ঘটল। কুফিয়ার উন্নত চিকিৎসা চলছে। মুক্তির প্রক্রিয়াও চলছে। মরুজেলকে মরু খামার বানানোর দাবিও মেনে নেওয়া হচ্ছে— সব দেখেশুনে ক্লান্তি ঝরে গেল দেহ থেকে, পশ্চিমাকাশে লালিমা ছড়িয়ে দিনের সূর্য ডুবে না গিয়ে আবার যেন হেসে উঠেছে পুবাকাশে। মিঠে রোদ আর কোমল অনুভূতি নিয়ে অতিথিশালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুস্তম জড়িয়ে ধরল আমির হামজা আল শামসকে।

পরনে তোব, গোত্রা ও তাগিয়ার আড়ালে রুস্তমকে আর বাংলাদেশের শ্রমিক বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মরুর নতুন এক ধনকুবের দাঁড়িয়ে আছে সামনে। বন্ধুকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতে সাহস পেল না তন্ময়। চেনা বন্ধুকে অচেনা লাগল। মরুর তাপে জ্বলেপুড়ে রুস্তম কি আর সেই রুস্তম নেই! অন্য কোনো ধনবান রুস্তম কি ঢুকে গেছে বন্ধু-রুস্তমের বুকে?

ভাবনাটা বেশিদূর যেতে পারল না। তন্ময়কেও জড়িয়ে ধরে রুস্তম বলল, ‘কেমন আছেন, তন্ময়?’
কোনো উত্তর না দিয়ে তন্ময় বলল, ‘এখানে থাকবেন, নাকি বাসায় যাবেন?’

‘আপাতত এখানে থাকার নির্দেশ জারি হয়েছে। তবে বাসায় যেতে হবে। ব্যক্তিগত টেলিফোনটা সিজ্ড করা হয়েছে। সিকিউরিটি সেলের ইনচার্জের কাছে জমা আছে সেটা, উদ্ধার করতে হবে। বাড়ির খবর জানেন? কোনো চিঠিপত্র এসেছে? ওরা নিশ্চয়, দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
‘আপনার মরুজেলের কথা হয়তো জেনে থাকতে পারে বাড়িতে। এখানকার দূতাবাস থেকে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করেছিলেন স্যার।’ আমির হামজাকে দেখিয়ে বলল তন্ময়।
শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে রুস্তম বলল, ‘আমি জানতাম। আমার মুক্তির জন্য সব করবেন আপনি। আপনার মতো মহান ব্যক্তি দুবাই শহরে আর নেই, স্যার।’

‘এখানে মহত্ত্বের কোনো বিষয় নেই রুস্তম। সত্যটা কেবল তুলে ধরেছি আমরা, এই কাজে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রেখেছে তোমার বিয়ের ছবি। দেশ থেকে সেটা পাঠিয়ে দিয়েছে তোমার স্ত্রী, নূরে জান্নাত কলি!’

হাহাকার করে উঠল রুস্তমের মন। প্রাণভরে  অনুভব করল নববধূ কলির মুখ।

আমির হামজা বললেন, ‘কলি নামের কারণে বিপদ ঘটলেও আপনার স্ত্রী কলি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। যুগল ছবির উলটো পিঠে আসল নামের পাশাপাশি ডাকনামও লিখে দস্তখত করেছে ইংরেজিতে। ফলে সহজেই রহস্যের গিঁট খুলে গেছে।’

রুস্তম বলল, ‘স্যার, আমার সেলফোনটা জরুরি দরকার।’

তন্ময় বলল, ‘আপনার নামে একটা চিঠি এসেছে দেশের বাড়ি থেকে। খামের ওপর লেখা আছে প্রেরকের নাম, নূরে জান্নাত কলি। আপনার স্ত্রী, তাই না? চিঠি আর সেলফোন নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি।’বলেই বেরিয়ে গেল তন্ময়।

আমির হামজা আল শামস বললেন, ‘আমার সেলফোন ব্যবহার করো। দেশের নম্বর মুখস্থ নেই?’
‘ওঃ! স্যার! মুখস্থ আছে! আপনার সেলফোন থেকে কল করা যাবে—ভুলে গিয়েছিলাম।’

আমির হামজার ফোনসেট হাতে নেওয়ার সুযোগ পেল না রুস্তম। গেট দিয়ে ঢুকেছে বিশাল এক কালো লিমুজিন। তিন দরজা গাড়ির মাঝের দরজা খুলে বেরোলেন অভিজাত কালো আবায়া পরনে এক নারী। পেছনের গেট থেকে বেরোল আরও কয়েকজন।

মহলে আম্মিজান জিনাত মহল এগিয়ে গেলেন অতিথিশালার মূল ভবনে।
প্রোটোকল দেখেই রুস্তম বুঝে ফেলল, আম্মিজান এসেছেন। নিজেকে সংযত করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
রুস্তমের সামনে এসে আম্মিজান বললেন, ‘বাঃ! আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। তোব, গোত্রা ও তাগিয়া পরনে আপনাকে এ এলাকার অধিবাসীই মনে হচ্ছে এখন!’

আম্মিজানের প্রশংসায় বরফের মতো জমে গেল না। লজ্জায়ও সংকুচিত হলো না। খানিকটা রোবটিক, খানিকটা মানবিক এক্সপ্রেশন দেখাল রুস্তম। চোখের ভুরু কাঁপল। ঠোঁট কাঁপল। একটা কিছু বলে সাড়া দেওয়া উচিত এই প্রশংসার। এসব বুঝেও সাড়া দিতে পারল না সে। উদ্ধত নয়, অবনতও নয় মাথা, স্বাভাবিক ঢঙে দাঁড়িয়ে রইল রুস্তম।

আম্মিজান আবার বললেন, ‘আপনার ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেল, তার জন্য নিজেকে দায়ী করা উচিত, সরি বলা উচিত। কিন্তু সরি বলে আপনার কষ্ট-যন্ত্রণা কমানো যাবে না, জানি। আপনাকে ফিরিয়েও দেওয়া যাবে না সেই দিনগুলো।’

‘আমার ভাগ্যে যা লেখা ছিল, পেয়েছি। আপনি উপলক্ষ্যমাত্র। নিজেকে দায়ী ভাববেন কেন, আম্মিজান। আমার ওপর দিয়ে যা গেছে, বয়ে বেড়াতে পেরেছি। কিন্তু আমার বাড়ির খবর এখনো জানি না। বাড়িতে বিষয়টা জানাজানি হয়েছে কি না, তাও জানা হয়নি।’

‘আপনার বিয়ের ছবি এসেছে দেশের বাড়ি থেকে। মাশাল্লাহ! আপনার স্ত্রী দেখতে বেশ মিষ্টি। নামটাও সুন্দর, নূরে জান্নাত কলি!’

স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার বেপরোয়া ইচ্ছার ঘূর্ণি উঠল অন্তর্জগতে। আমির হামজা আল শামস দেশে কথা বলার জন্য মুঠোফোনটা দিতে চেয়েছিলেন। এই মুহূর্তে ফোনসেট নেওয়া শোভন হবে না। আম্মিজানকে উপেক্ষা করা যাবে না ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিকমতো কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারল না রুস্তম। ভেতরের অস্থিরতার ছাপ ফুটে উঠল তার মুখে।

আম্মিজান বললেন, ‘আমার মেয়ে, কলি, একই ঘটনার বলি হয়েছে। সে-ও অবরুদ্ধ ছিল তার মহলে। সে-ও মানসিক যাতনাভোগ করেছে। নিজের মুক্তির চেয়ে সে বেশি খুশি হয়েছে আপনার মুক্তিতে।’

দুরন্ত কিশোরীটির কথা শুনে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আম্মিজানের মুখের দিকে। ‘নিজের মেয়েকেও সাজা দিয়েছেন!’ কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারল না বিস্ময়ে ভরা প্রশ্নটি।
আম্মিজান আবার বললেন, ‘আমাদের ছোটো আম্মি অপেক্ষায় আছে। কথা বলতে চায় আপনার সঙ্গে।’বলতে বলতে মুঠিতে ভরা ফোনসেট সামনে তুলে মেয়ের নম্বরে রিং করে ধরিয়ে দিলেন রুস্তমের হাতে।
এবার বরফের মতো জমাট বেঁধে গেল রুস্তমের দেহ। ফোনসেট হাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মিজান তাড়া দিয়ে বললেন, ‘সেট কানের কাছে ধরুন, কথা বলুন। ছোটো আম্মি লাইনে আছে।’

রুস্তমের হাত উঠে গেল কানের কাছে।
‘হ্যালো! হ্যালো! কথা বলুন, আমি কলি বলছি, আপনার মিষ্টি বউ কলি নই, মহলের কলি আমি। কথা বলুন।’
তিরের ফলার মতো ধারালো কিশোরীটি কী বলতে চায়? উত্তেজনা সামলে ভদ্র ভাষায় সহজ কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ফোন করার জন্য ধন্যবাদ। কী বলবেন, বলুন।’

‘আমি কেবল বলে যাব, আপনি শুনবেন। আম্মিজান আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন—তাই জবাব দিতে হবে না প্রশ্নের। কিছু বলতেও হবে না। কেবল শুনেই যাবেন না। মাঝে মাঝে হুঁ-হ্যাঁ করবেন, আপনি যে লাইনে আছেন, বুঝতে হবে আমাকে। আম্মিজানের সামনে থেকে সরে যেতে হবে না, ঠিক আছে ?’

‘হুঁ।’

‘গুডবয়। এবার শুনুন আসল কথা। সততা, নৈতিকতা, চারিত্রিক মহত্ত্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন আপনি। চাঁছাছোলা
পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। পরীক্ষায় একশোতে দুশো নম্বর পেয়েছেন আপনি।’
একবার বলার ইচ্ছা হলো, জীবনের পরীক্ষায় ঠেলে দিয়ে ভালো করেছেন? তাছাড়া আমার সাজার বিরুদ্ধে তো আপনি প্রতিবাদ করেছিলেন আম্মিজানের ভুল হয়েছিল বলেই। চিৎকার করে শুনিয়েছিলেন সেকথা! আপনি পরীক্ষায় ফেললেন কখন? কিন্তু কিছুই বলল না রুস্তম। চুপ করেই শুনতে লাগল দুবাই-কলির কথা।

‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমি সাজা দিইনি। আম্মিজান ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই কষ্ট পেতে হলো আপনাকে, তাই না? থাক উত্তর দিতে হবে না, শুনুন, আম্মিজান ভুল করলেও ভুল করিনি আমি। মহলে নিরিবিলিতে ডেকে আপনার লোভ ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা কতটুকু আছে, যাচাই করতে চেয়েছিলাম একটা বিশেষ কারণে। এরই মধ্যে কথাবার্তায় বিষয়টির আলামত দিয়েছিলাম। আম্মিজানও ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশে যাওয়ার। মনে আছে?’
‘হুঁ।’
‘ছোটোবেলায় আমার কাজিনের মা মারা গিয়েছিলেন। ওর বাবা চারটা বিয়ে করেছিলেন। সৎমায়ের ইচ্ছায় আমার চাচা মেয়ের বিয়ের উদ্যোগ নেন পঞ্চাশোর্র্ধ্ব এক ধনাঢ্য আমিরের সঙ্গে। কাজিন ছিল আমার দুই বছরের বড়ো, খেলার সাথি, প্রাণের সখী। প্রাচুর্যে ভরা জীবন ছেড়ে সে বেছে নিয়েছে জরাজীর্ণ জীবন। সুখের আশায়। দরিদ্রতা সেই সুখ দেয় না কখনো। চেয়েছিলাম আমার নামে যে স্বর্ণব্যাবসা চলছে, দেরা দুবাইয়ের বিখ্যাত গোল্ড সুকে (Gold Souk) ‘হেরা’র ম্যানেজারের দায়িত্ব দেবো আপনাকে। আপনার বেতনের চেয়ে বেশি বেতন দেবো। অতিরিক্ত টাকাটা দেশে আমার কাজিনকে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। গোপনে এই পরিকল্পনার সঙ্গে যেটা সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন, সেটা ছিল আস্থা-বিশ্বাস-সততা। সেই,পরীক্ষার ময়দানে আপনি ছিলেন। এজন্য আপনার পাসপোর্ট আমার দখলে রাখতে চেয়েছিলাম। মাঝখান দিয়ে গোলযোগ বাধিয়ে দিলো আম্মিজানের ভুল ধারণা। ভুল সিদ্ধান্ত। রুস্তমের ভাবনার জগতে আবারও প্রশ্ন উঠে এলো, ‘তাহলে আমাকে আপনার ইচ্ছাপূরণের গিনিপিগ বানাতে চেয়েছিলেন, আমার প্রতি আপনার কোনো অনুরাগ জাগেনি?’

ভাবনা থেমে গেল কলির ধারালো কথা শুনে। ‘এটা ভাবার কারণ নেই যে আমার ইচ্ছার ক্রীড়নক বানাতে চেয়েছি আপনাকে। আপনাকে দেখলে আমার হৃদয়ে চাঁদের কোমল আলোটা কমল হয়ে ফুটে উঠত। এর মানে এই নয় যে আপনাকে ভালোবেসেছি আমি। ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক জিনিস নয়। সততা ও দৃঢ়তার জন্য আপনাকে ভালো লাগলেও ভালো না বাসলেও, যেদিন আপনার আর কলির বিয়ের খবর শুনলাম এবং যেদিন আপনার বিয়ের ছবিটা দেখলাম, পুরো দেহে আগুন লেগে গিয়েছিল যেন। মনে হচ্ছিল ওই আগুন ছড়িয়ে গেছে দেহেমনে, মহলে। এমনকি ফুটফুটে জোছনা রাতে মনে হয়েছিল আগুন লেগে গেছে চাঁদেও। কেন এমন অনুভবে কেঁপে কেঁপে উঠেছিলাম, জানি না। তবে আমি নিশ্চিত ঈর্ষাপ্রবণ কিংবা পরশ্রীকাতর নই আমি। অন্যের আনন্দে আনন্দ পাই। অন্যের উপকারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠা করি না, করবও না। আপনাকে উপকারের প্রস্তাব দেবেন আম্মিজান। আপনাকে উপহারও দেবেন। উপহার ও উপকারের প্রস্তাব না করতে পারবেন না। এটা আমার নির্দেশ।’কঠিনভাবে নির্দেশ দিলেও দুবাই-কলি হেসে উঠল খিলখিল করে। হাসি থেমে গেল। কথা থামল না। ছোট্ট করে বলল, ‘আপনার নববধূ কলি খুউব মিষ্টি। খুউব।’
লাইন কেটে গেল।

।।ষোল।।

নববধূর সৌন্দর্যের কথা শুনে আনন্দসুখে ভিজে উঠল প্রবাসী মন। ফোনসেটটা তুলে দিলো আম্মিজানের হাতে। ঝরঝরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘দুবাইয়ের অভিজাত এলাকা, ইমার স্কয়ারে (Emarr Square) ছোটো আম্মির নামে রয়েছে এক ডজন ফ্ল্যাট। একটি উপহার হিসেবে দিচ্ছি আপনাকে। এই উপহারে সম্মতি আছে আমার স্বামীর। আমরা চাই, দুবাইয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে দেশের বাড়ি থেকে স্ত্রী ও মাকে নিয়ে আসেন আপনি।’

একবার ভাবল, ‘আবার পরীক্ষার মধ্যে ফেলল না তো দুবাই-কলি?’ লোভ পরিমাপ করছেন না তো তার ? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল কলির এই মুহূর্তের কথা, উপহার ও উপকারের প্রস্তাব ‘না’ করা যাবে না। এটা তার নির্দেশ।

‘না’করার শক্তি খুঁজে পেল না রুস্তম। হ্যাঁও বলতে পারল না।

আম্মিজান আবার বললেন, গোল্ড সুকে ‘হেরা জুয়েলারির’নির্বাহী ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আপনাকে। প্রথম তিন মাস প্রশিক্ষণে যেতে হবে। তারপর দায়িত্ব পাবেন। আশা করি, যোগ্য মানুষই বাছাই করেছে আমার ছোটো আম্মি।

হাসলেন আম্মিজান। ভুবনমোহিনী হাসি দেখা গেল না। ঢাকা রইল কালো নেকাবের আড়ালে। হাসি ছড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি লিমুজিনের দিকে। তার দৃপ্তপায়ের ভঙ্গি বলে দিচ্ছে, অন্যায় সিদ্ধান্তের পাপমোচন করে, ভারমুক্ত হয়ে ঢুকে গেলেন লিমুজিনে।

আম্মিজান কথা বলার সময় সামনে থেকে সরে গিয়েছিলেন আমির হামজা আল শামস। কথোপকথনের বিষয়ে কিছুই জানতে চাইলেন না। সহমর্মী হয়ে রুস্তমের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নাও সেলফোন, কথা বলো দেশে।’

মুখস্থ নম্বর চেপে কল করল দেশের বাড়িতে। রিংটোন হচ্ছে। প্রথম পালস বেজে থেমে গেল। আশ্চর্য হয়ে গেল রুস্তম। নিজের মধ্যে কোনো অস্থিরতা নেই, উদ্বেগ নেই। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য গ্লাস হাতে তুলে যদি দেখা যায় যে জল নেই, তখন তৃষ্ণা আরও বেড়ে যায়। বাড়তি তৃষ্ণায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে অস্থির মন। নিজের সে-তাগিদ নেই কেন? তবে কি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার আবেগ!

আবার কল করতে গিয়ে ভাবল, তার কাক্সিক্ষত মানুষ কে এখন? মা, নাকি নববধূ কলি? দুবাই-কলির সঙ্গে কথা বলে প্রাপ্তির যে জোয়ার এসেছে, সেই জোয়ারে কি তবে ভেসে গেল সে?
হ্যাঁ। রিংটোন বাজছে।
কল অ্যাটেন্ড করে রুশনা বেগম বেপরোয়া এক চিৎকার দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কে?’
‘আমি রুস্তম।’

‘কে?’ আবারও চিৎকার করে উঠলেন।
‘আপনার ছেলে, রুস্তম?’
‘তুমি ছাড়া পেয়েছ, বাবা?’
‘হ্যাঁ মা।’

ছেলের কণ্ঠ শুনে কেঁদে ফেললেন মা।
কাছেই ছিল রওনক জাহান। ছুটে এসে মায়ের হাত থেকে মুঠোফোন নিয়ে বলল, ‘রুস্তম! আমি তোমার আপা।’

‘ওঃ! আপা? কবে এসেছ?’
‘এই তো! কিছুদিন হলো।’
‘তোমরা কেমন আছো?’

‘কেমন থাকব বলো? তোমার ফোন বন্ধ? শুনলাম জেলে ছিলে! এ কথা শুনে ভালো থাকা যায়?’
কান্না থামিয়ে মেয়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে রুশনা বেগম প্রশ্ন করলেন, ‘ছোটো বউটা দেখতে কেমন রে, বাবা?’
‘জি!  বিস্ময়ের মোড়ক ফুঁড়ে বেরোল শব্দটি।’
রুশনা বেগম আবার বললেন, ‘ছোটো বউ দেখতে কেমন? দেশে আসবে তো? নাকি দুবাইতেই থাকবে?’

মায়ের প্রশ্ন শুনে যেন নিজেকে আবিষ্কার করল মাকড়সার বাসায়—চোখেমুখে জড়িয়ে যাচ্ছে মাকড়সার জাল। মনে হচ্ছে বিষের পাত্র হাতে তুলে দিয়েছেন মা। ছেলেকে বলছেন, ‘পান করো, বাবা।’মুক্তির আনন্দে যে মনের মধ্যে ফুলের নতুন কলি ফুটছিল, পূর্ণতার আগেই ঝরতে লাগল পাপড়িদল। শব্দতরঙ্গের কম্পন নয়, সহস্র অস্পষ্ট ঝিঁঝির শব্দ অনবরত বাজতে লাগল কানে। মায়ের কণ্ঠ আর চেনা লাগছে না। অচেনা কণ্ঠে অপরিচিত কোনো নারী যেন প্রশ্ন করে যাচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্কের ধ্বনি-তরঙ্গের গহিনে।

‘বাবা, কথা বলছ না কেন? ছোটো বউ কি খুব বড়োলোকের মেয়ে? আমাকে শাশুড়ি হিসেবে মানবে তো?’

হাতে ধরা ফোনসেটের দিকে হঠাৎ তাকাতে বাধ্য হলো রুস্তম। মনে হলো একটা জ্যান্ত সাপ মুঠিতে ধরে আছে। সমস্ত আনন্দ নিভে গেল তার। হতাশা ঘিরে ধরল চারপাশ। ক্ষতের মধ্য থেকে আবার জেগে উঠল নতুন ক্ষত।

এবার বড়ো আপা প্রশ্ন করল, ‘কথা বলছ না কেন রুস্তম? তোমার উত্তর না পেয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন আম্মা।’

মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে রুস্তমের গলা থেকে বেরিয়ে এলো চিৎকার, ‘কী কথা বলব? কীসব প্রশ্ন করছ তোমরা? কলিকে দাও। কলির সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘কলি তো বাপের বাড়ি চলে গেছে।’

Series Navigation<< উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব সতেরো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *