উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব তেরো

নয়

উটের ঘেরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেল রুস্তম। বাচ্চা উটকে মা-উট দুধ খাওয়াচ্ছে। বুঝল, মাতৃত্বের টান সব
প্রাণিকুলের মধ্যে একইরকম। মায়ের আদর, দুধের স্বাদ—এসব সৃষ্টির শুদ্ধতম মৌলিক উপহার। এটা
অর্জন করতে হয় না। জিনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে জন্ম থেকে জন্মান্তর। সেই কবে মায়ের দুধ পান
করেছিল মনে নেই রুস্তমের। তবু মনে হচ্ছে, সে যেন সেঁটে আছে মায়ের বুকের সঙ্গে। তৃষ্ণার্ত মনে
মেটাতে চাইছে পিয়াস। আকাশের দিকে চোখ তুলে একবার স্মরণ করল মাকে। মায়ের মুখ ভেসে
উঠল। কল্পনার ক্যানভাসে উঁকি দিলো নববধূ কলির মায়াবী মুখও। একইসঙ্গে দৃশ্যপটে হাজির হলো
দুবাই-কলির মুখ। তার শেষ চিৎকারও ভেসে এলো কানে। হঠাৎ কেঁপে উঠল কুফিয়ার কথা শুনে।

‘রুস্তম! রোদের তেজ দেখুন। আর ওই যে সামনে চারটা উট দেখুন। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। দাঁড়িয়ে
থাকা মায়ের পেটের নিচ দিয়ে ঢুকে পেছনের ঝুলন্ত ওলানে মুখ রেখে কীভাবে টানছে বাচ্চা উট। দেখছেন ?’

‘দেখছি। চোখ তো খোলা। এত সুন্দর দৃশ্য চোখ বন্ধ করলেও দেখা যায়।’

‘বাঃ! সুন্দর কথা বলেন তো আপনি। ভালো। কিন্তু আমি বস। যখন প্রশ্ন করব প্রশ্নের উত্তর দেবেন সরাসরি।
পালটা প্রশ্ন করবেন না। বাঁকা কথা বলবেন না। শেষবারের মতো স্মরণ করিয়ে দিলাম।’

রুস্তম বলল, স্মরণ থাকবে কথাটা। আপনার প্রশ্নের সরাসরি সহজ জবাব হচ্ছে, ‘বাচ্চা উটের দুধ খাওয়া
দেখছি আমি।’

‘ভালো করে লক্ষ করুন। কেবল দেখলে হবে না। দেখার মতো করে দেখতে হবে। বাচ্চা উটটির মুখ দুধের
বোঁটার দিকে। অর্থাৎ, মা-উটের মুখের উলটো দিকে মুখ। বাচ্চা উটের পুরো শরীর মায়ের তলপেটের
মধ্যভাগে, পেছনের পা বরাবর, সামনে নয়। দুই পায়ের মাঝামাঝিতে অবস্থান নিয়ে মুখ উঁচু করে দুধ
টানছে উটশাবক। খেয়াল করেছেন ?’

‘হ্যাঁ। খেয়াল করছি।’

‘উটশাবকের মতো এভাবে ঢুকে যেতে হবে দুধেল উটের পেটের তলে। দুহাতের বুড়ো আঙুল এবং
তর্জনী দিয়ে চেপে ধরে নিচের দিকে আলতো চাপে টানতে হবে দুধের বোঁটা। বেশি চাপ দেওয়া যাবে
না। আলতো চাপেই বেরিয়ে আসবে দুধ। বালতি থাকবে নিচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালতি ভরে উঠবে তরল দুধে।’

‘এত দুধ! অথচ বেঁচে থাকব কষ্ট করে, কেন ? এই অবিচার কেন ?’

‘এত দুধ আমার-আপনার জন্য নয়। রক্ষীরা এসে সব সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে। ঘরের মাচার তলে দেখবেন
অনেকগুলা প্রিজারভেটর আছে। ড্রামের মতো স্টিলের ওই পাত্রে দুধ সতেজ রাখার পদ্ধতিও রয়েছে।
দুধের হিসেবে ঘাটতি হলে, সাজার মেয়াদ বেড়ে যাবে।’

চোখ তুলে একবার কুফিয়া তাকাল রুস্তমের দিকে। চোখের ভাষা কড়া। এর আড়ালেও যে তার মানবিকবোধ
একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, বুঝতে অসুবিধা হলো না রুস্তমের। রুস্তমের কথা একেবারে ফেলে দিতে পারছেন
না বস। বাধা দিয়ে বিতর্ক করলেও কাজটি করে দিচ্ছেন বা করার সম্মতি দিচ্ছেন। একটু  সাহস  নিয়েই রুস্তম
বলল, ‘ভুল কিছু বললাম কি ?’

‘না। ভুল বলেননি। ঠিক কথা বলেছেন। সব ঠিক কথা সব সময় বলতে নেই, সেটা বোঝেন না আপনি। এটাও
একটা ত্রুটি। এটা কাটিয়ে উঠতে আরও শ্রম ঢালতে হবে। উট যেন অতিরিক্ত দুধেল হতে পারে, সে ব্যবস্থা
করতে হবে। পরিচর্যা করতে হবে আরও বেশি। বেশি পরিচর্যায় বেশি দুধ পেলে, সেই দুধের ভাগ সবাই পাব।’

‘কী খেতে পছন্দ করে উট ? এত মরুপশুর খাবার জোগাড় করব কীভাবে ?’
‘ওই যে, সামনে তাকিয়ে দেখুন। ওদের খাবার তালিকায় কী আছে, দেখে নিন।’

রুস্তম কিছুটা এগিয়ে দেখল, একপাশে জড়ো করে রাখা আছে মরুর শুকনো পাতা। অচেনা ঘাসের আঁটির স্তূপ।
একপাশে রয়েছে শক্ত কাঁটাভরা গাছের ডালপালা। ভয়ংকর কাঁটা দেখে ঘাবড়ে গেল রুস্তম। ভেতর থেকে যেন
ছিটকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো, ‘উটেরা এই কাঁটাযুক্ত ডালপালা খায় কীভাবে ? মুখের ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যায় না ?’

‘এর নাম বেঁচে থাকা। এর নামই জীবন। উটের মুখের ভেতরের সারফেস স্টিলের মতো শক্ত আবরণে মোড়ানো।
এসব কাঁটা বিদ্ধ করতে পারে না শক্ত ওই আবরণ। সবকিছু চিবিয়ে সাবাড় করে দিতে পারে উট। খাবারের অভাব
দেখা দিলে হাড়মাস, চামড়া এমনকি তাঁবুও খেয়ে ফেলে। স্বাভাবিকভাবে খায় বিভিন্নরকম মরুখাদ্য—নানাজাতের
ক্ষুদ্র কীট, উদ্ভিদ, লতাগুল্ম। কিন্তু বেশি ক্ষুধার্ত হলে ময়লা-আবর্জনাও খেয়ে ফেলতে পারে।’

‘হজম করতে পারে সব? সমস্যা হয় না ?’

‘হজম তো করেই। করে বলেই বেঁচে থাকে। বিপদও হয় মাঝেমধ্যে। ভুল করে হয়তো খেয়ে ফেলল বিষাক্ত কোনো
মরু-উদ্ভিদ। সঙ্গে সঙ্গে ‘নীলডাউন’-এর ভঙ্গিতে বসে পড়ে মাটিতে। আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। শেষ হয়ে যায়
জীবন। এখানকার পালিত উটের জীবনহানি হলে, কেউ বিপদ এড়াতে পারব না। সব দায় আমাদের। বুঝেছেন ?’

জোরালো প্রশ্নবোধক ধ্বনিটি শোনার পর আর কিছু জিজ্ঞেস করল না রুস্তম। ছোট্ট করে জবাব দিলো, ‘বুঝেছি।’
তবে তার মনে ঘুরতে লাগল বিষাক্ত উদ্ভিদটা। বুঝব কীভাবে কোনটা বিষাক্ত উদ্ভিদ ? কিন্তু প্রশ্নটা চেপে রাখল।

কোন উট বেশি দুধেল, খুঁজতে লাগল কুফিয়া। তার সঙ্গে রুস্তমও ঘুরছে। হঠাৎ খেয়াল করল ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে
কুফিয়া। সব উটের বাচ্চা পেটের তলে ঢুকে দুধ খাচ্ছে না। একটু বড়ো বাচ্চাগুলো একপাশে শরীর রেখে লম্বা
মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে দুধের বাঁটে। পেছনের এক পায়ের সামনাসামনি রয়েছে পুরো শরীর। একবার বিষয়টি
কুফিয়ার নজরে আনার জন্য প্রশ্ন করার উদ্যোগ নিয়েও থেমে গেল রুস্তম।

সামনে এগিয়ে কুফিয়া বলল, ‘পেয়েছি। এটার দুধ দোয়ানো যেতে পারে।’
‘মনে হচ্ছে, একটু আগে পাশে দাঁড়ানো বাচ্চাটি দুধ খেয়ে নিয়েছে। দুধ পাবেন ওই ওলান থেকে ?’

‘রুস্তম, বলেছিলাম প্রশ্ন করবেন না। দেখে যাবেন। দেখে শিখবেন।’ বলতে বলতে ছোটো বালতির মতো হাতে ধরা
কনটেইনারটি ওলানের নিচে রাখল। তারপর নিজের দেহের পুরোটা উটের পেটের তলে না ঢুকিয়ে পেছনের
বাঁপায়ের সামনে বসে পড়ল। মাথা নামিয়ে যেই-না দুধের বোঁটায় টান দিলো, অমনি মা-উটটি বাঁপায়ে লাথি ছুড়ে
দিলো সামনের দিকে। লাথি খেয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে উটের সামনের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল কুফিয়া।
আতঙ্কিত হয়ে রুস্তম ঝাঁপিয়ে পড়ে উটের পায়ের কাছ থেকে কুফিয়াকে টেনে আনল বাইরে। পেছনে দাঁড়ানো
নোমানও ছুটে এলো।

আকস্মিক দুর্ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল রুস্তম। ওর দিকে তাকিয়ে কুফিয়া বলল, ‘কোনো ক্ষতি হয়নি আমার।
পোড়-খাওয়া শরীর এটা। ভয় পাবেন না। এত তাড়াতাড়ি ভয় পেলে মরুতে বেঁচে থাকতে পারবেন না।
পাথরের মতো শক্ত হতে হবে। যে উটকে এত যত্ন করি, সেটিও লাথি মারতে পারে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কী
আছে ? আপন মাও অনেক সময় চড় দেয়। দেয় না ? মায়ের জ্বালায় বউ ছেড়ে গেছে আমার সংসার। মা লাথি
না দিলেও, বড়ো আঘাত এসে পড়েনি জীবনে ? এ আঘাত তুচ্ছ। এমন আঘাত ঘটতে পারে সবার জীবনে।
প্রস্তুত থাকতে হবে বিপর্যয় মোকাবিলা করার মানসিকতা নিয়ে।’

রুস্তমের উদ্দেশে বলল, ‘আঁই কইছিলাম না! হেতে হাগল মানুষ! কইছিলাম না!’

নোমানের চোখের ওপর চোখ রেখে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভাষাতেই রুস্তম বলল, ‘প্লিজ নোমান! এমন করে বলবেন
না। যে লোকটির মনে দুঃখ গেঁথে আছে শেলের মতো, তাকে পাষাণ বলা ঠিক হবে না। নিশ্চয়ই কঠিন ঘা খেতে
খেতে জীবনের কোমলতা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। এমন অবস্থা হয়তো আমাদেরও হবে।’

কুফিয়ার পক্ষ নিয়ে কথা বলাটা পছন্দ হলো না নোমানের। দুমদাম করে স্থানত্যাগ করার সময় বলে গেল, ‘হিয়ারে
বেশি মাথায় তুইললেন না। তুইললে আছাড় খাইবেন নিজে।’

দুজনের বাংলা কথোপকথন না বুঝলেও কুফিয়া এটা বুঝল যে তার সম্পর্কে ভালোকথা বলেনি নোমান। তবে
রুস্তম যে তার পক্ষেই কথা বলেছে, সেটা বুঝতে পারল। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে নিজের দোষ তুলে ধরে কিছুটা
কৃতজ্ঞতা মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘দুটো ভুল হয়েছে আমার : প্রথম ভুল—উটের ওলানে দুধ আছে, এটা ভেবে
নেওয়া। দ্বিতীয় ভুল—উটের পেটের তলে না ঢুকে পেছনের পা বরাবর বসা। আপনার ধারণাটাই ঠিক ছিল।
আপনার কথাটার গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল আমার। এই ভুল থেকেই শিক্ষা নিতে হবে।’

‘হ্যাঁ। ভুল ঠিকই ধরেছেন। এই ঘটনা থেকে ব্যাবহারিক শিক্ষা পেয়ে গেছি আমিও। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা
পেয়েছি আপনার পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা শুনে। নিজের মাকে দোষী ভেবেছেন! ইজ ইট পসিবল?
মা কখনো ছেলের বউয়ের সঙ্গে নির্মম ব্যবহার করতে পারেন?’

‘পারেন। আমার পরিবার তার সাক্ষী। অন্তত আমাদের কালচারে সম্ভব। আপনাদের কালচারের কথা জানি না।
এমনটি ঘটে দ্বন্দ্বের কারণে। এটা বউ-শাশুড়ির ভালোবাসার দ্বন্দ্ব।’

নববধূ কলির কথা মনে পড়ল রুস্তমের। শাশুড়ির বিপক্ষে অভিযোগ করেছিল সে। সত্যতা না থাকলে এমন কঠোর
ভাষায় কথা বলত না সে। কলিকে চিনতে ভুল করেছে বলে মনে হচ্ছে না। সব দেশের অবস্থা একইরকম কেন?
ছেলের বউকে শাশুড়িরা সহ্য করতে পারেন না কেন ? কোন মনস্তত্ত্ব কাজ করে শাশুড়ি-বউ দ্বন্দ্বে? ভিন্ন দেশের
কুফিয়ার জীবনেও ঘটেছে একই ধরনের ঘটনা। কুফিয়ার ভাষায় ওর সংসার ভেঙেছে মায়ের কারণে! কেবল মাই
দোষী? বউ দোষী নয়? একহাতে কি তালি বাজে? তালি বাজাতে কি বউয়ের হাত নেই। কুফিয়ার বউয়ের মতো কি
নিজের বউও সরে যাচ্ছে দূরে? শৌর্যের টানে কি তবে ছিঁড়ে যাচ্ছে মনের সুতা? ধর্মীয় বন্ধনের গিঁটও কি খুলে
ফেলবে কলি ? আকাশসমান ভাবনার উচ্চতার তলে চাপা পড়ে যাচ্ছে মরুর তাপ। মরুর দহন। আবেগ আবার
মাথা চাড়া দিচ্ছে দেখে ভীত হলো রুস্তম।

কুফিয়া ঠিকই বলেছে। বুকে পাথর বেঁধে পড়ে থাকতে হবে মরুতে। পাষাণ হতে হবে। কুফিয়ার পাষাণ বুকের
হৃৎপিণ্ড খুঁড়ে বয়ে যাওয়া কোমল ঝরনাধারাটা অনুভব করতে পারছে রুস্তম। কিছুটা নির্মম হয়ে ওঠার চেষ্টা
করলেও হতে পারল না কুফিয়া। কী আপরাধ করেছিল কুফিয়া ? কেন তার এই মরুকারাবাস? কতদিন ধরে
আছে সে ? জানার ইচ্ছা হলেও কোনো প্রশ্ন না করে বলল, ‘চলুন, ঘরে যাই। কী কাজ করতে হবে বুঝিয়ে দেন।
আর আপনি বিশ্রাম নিন।’

‘দেখিয়ে না দিলে পারবেন ? ভেবেছিলাম, হাতেকলমে শিখিয়ে দেবো। নোমানকে শেখাতে পারিনি। কিছুটা
বিদ্রোহী ধরনের নোমান। ওর সঙ্গে কঠোর আচরণ করলেও নিষ্ঠুরতা দেখাইনি। যখন কাজ করে, বুঁদ হয়ে
যায়। এটা নোমানের ভালো গুণ।’

বসা অবস্থা থেকে উঠতে গিয়েও উঠে দাঁড়াতে পারল না কুফিয়া। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল আবার। বসে একবার
তাকাল রোদে ঝলসানো আকাশের দিকে। তারপর রুস্তমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার তো বোধ হয়
নীলডাউন হয়ে গেছে। হাঁটুর ওপর চোট লেগেছে। বাইরে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে হাড় বোধ হয় ফেটে গেছে।’

সাহস দিয়ে রুস্তম বলল, ‘অবশ্যই হাঁটতে হবে। বসে থাকলে চলবে না।’

নিজের মাথার গোত্রা খুলে কুফিয়ার হাঁটুতে পেঁচিয়ে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করল রুস্তম। কুফিয়া বাধা দিয়ে বলল,
‘থামুন। আমারটা নিন। কাঠের মাচায় শুয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই আমার। আগুনঝরা রোদে কাজ করতে
হবে আপনাকে। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে।’বলতে বলতে হাঁটুতে প্যাঁচানো রুস্তমের গোত্রাটা
একহাতে খুলে অন্যহাতে নিজেরটা বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘ঘরে নিয়ে চলুন। সেখানে মাচার তলে একটা
কনটেইনারে আছে উটের পশম, টোপের মধ্যে পশম ভরে প্যাডের মতো বেঁধে শুয়ে থাকলে ভাঙা হাঁটু
জোড়া লেগেও যেতে পারে।’

‘ভালোকথা বলেছেন, সমস্যা থাকবে জীবনে, বিপদও আসবে। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে এগিয়ে
যাওয়ার নামই জীবন। কথাটা বলতেন আমার নিয়োগকর্তা দুবাইয়ের ইঞ্জিনিয়ার আমির হামজা আল
শামস। এখন তাঁর কথা মনে পড়ছে। ভেঙে পড়লে চলবে না। উঠুন। আমার কাঁধে ভর দিয়ে চলুন।’
বলেই কুফিয়াকে জড়িয়ে ধরল রুস্তম। অনেকটা টেনে নিয়ে পৌঁছল ঘরে।

টেনেহিঁচড়ে কুফিয়াকে নিয়ে রুস্তমকে ঘরে ঢুকতে দেখে ছুটে এসে নোমান তার আঞ্চলিক ভাষায়
বলল, ‘হেতে বেশি দুক হাইছেনি ?’
রুস্তম আরবিতেই জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ। বেশ আঘাত পেয়েছে। পায়ে ব্যান্ডেজ দিতে হবে। মাচার নিচে
কনটেইনারে উটের পশম আছে। বের করুন তো।’
সুবোধ বালকের মতো পশমের কনটেইনারটি বের করে ঢাকনা খুলে নোমান এগিয়ে দিলো রুস্তমের
দিকে।
কনটেইনারে পশমের বিশাল ভান্ডার দেখে অবাক হয়ে রুস্তম প্রশ্ন বলল, ‘এত লোম কীভাবে জমা
করেছেন ?’

কুফিয়া জবাব দিলো, ‘গ্রীষ্মে উটের ত্বকের পুরোনো লোম ঝরে পড়ে, নতুন লোম গজায়। খসে পড়া
লোম কালেকশনে রাখতে হবে। এটাও মালিকদের ব্যাবসা। লোম বিক্রি করে ভালো আয়-রোজগার
হয়। লোম দেখে খুশি হয় মালিককন্যারা। কন্যাদের খুশি করার জন্য মালিকরা ফেলে যায় না
পশমের সামান্যটুকুও। কেবল রোজগার নয়, কন্যাদের খুশি করাও তাদের বড়ো লক্ষ্য।’
কন্যাদের খুশি করার জন্য উটের পশমের অপচয় করে না মা-বাবা। অথচ মুহূর্তে কন্যার
ওপর নির্মম আচরণ করতে পারে! মালিকদের এই দ্বৈত আচরণ এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে
রুস্তমের। ভাবতে ভাবতে গোত্রার সাদা কাপড়ের মধ্যে লোম ভরে প্যাডের মতো করে কুফিয়ার হাঁটুতে
বেঁধে দিলো। বাঁধার সময় মনে পড়তে লাগল দুবাই-কলির দুঃসাহসিক আচরণের কথা। এত বৈভবের
মধ্যে বাস করেও কী দুঃখ লুকিয়ে আছে ওই কিশোরীর মনে? আদর-মমতার অপর পিঠেই কি কঠিন
শৃঙ্খলের বন্ধন ? বাঁধা থাকে দুই পা? সেটা তো দেখতেই পেল রুস্তম। আম্মিজানের ইশারায়
নারীমহলের সিকিউরিটিদের আক্রমণাত্মক মনোভাব। মুহূর্তেই মহলের ‘বাদশাহ নামদার’ কলি হয়ে
গেছে আসামি। আর সে নিজে এখন মরুকারাবাসে। কুফিয়াকেও মনে হচ্ছিল এখনকার বাদশাহ
নামদার। কী দাপট! মুহূর্তেই হয়ে গেছে রোগী! জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে সে শিক্ষা নিল—যতক্ষণ
শ্বাস, ততক্ষণ আশ। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাবে সে। নিজের প্রত্যয়ী মনের নতুন আলোয় চকচক
করে উঠল। মনের গহিন থেকে বেরিয়ে এলো সহযোগিতার আশ্বাস। ‘যতক্ষণ বেঁচে থাকব, পাশে থাকব
আপনার। সেবা-শুশ্রুতার ত্রুটি হবে না। মনে বল রাখুন। নোমানও পাশে থাকবে আপনার। আমরা
অন্যের বিপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তে জানি। বিপদে মরুর উত্তপ্ত বালিতে একা ফেলে রেখে এগিয়ে
যাওয়ার মতো লোক নই আমরা। নির্মমতা নেই আমার দেশের মানুষের মনে। আপনার পাশেই থাকব আমরা।’

নোমানও সায় দিয়ে কুফিয়ার উদ্দেশে বলল, ‘হ্যাঁ। সব কাজ শিখিয়ে দেবো উনাকে। দুজনেই আপনার পাশে
থাকব।’
কুফিয়া বলল, ‘সে প্রমাণ এরই মধ্যে রেখেছেন। আপনাদের প্রতি বিশ্বাস অটুট আমার।’
পাশে শোয়া অপরিচিত লোকটি নড়ে উঠল কুফিয়ার কথা শুনে। চোখ খুলে একবার তাকিয়ে বলল, ‘পানি খাব।’
শুনেই পানি আনার জন্য ছুটে গেল নোমান।
অসুস্থ লোকটিকে রুস্তম জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কেমন লাগছে ?’
‘কেমন লাগছে, জানি না। তবে বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে যায়নি। আপনাকে দেখে আরও বেশি জোরালো হয়েছে সেই
ইচ্ছা।’ প্রত্যয়ী কণ্ঠে বললেন কথাগুলো।
‘আপনার নাম কী ? দেশ কোথায় ?’

‘কুফিয়া সাহেবের ভয়ে প্রথম দিনই ভুল তথ্য দিয়েছিলাম। বলেছিলাম আমার নাম আশিষ গোস্বামী। বলেছিলাম
আমার বাড়ি ভারতের আসামে। আসলে আমার নাম সাদি মোহাম্মদ। আর আমার বাড়ি বাংলাদেশে, চট্টগ্রামের
পটিয়ায়।’

মগে পানি ভরে রুমে ঢুকে নোমান শুনল সাদি মোহাম্মদের কথার শেষাংশ। তারপর চিৎকার করে তার আঞ্চলিক
ভাষায় বলল, ‘আন্নের বাই বাংলাদেশে ? হইট্টায় ?’

‘অঁ। আঁর বাড়ি পইট্টায়!’ বলেই নোমানের হাত থেকে পানিটুকু নিয়ে গলায় ঢেলে দিলো। তৃষ্ণা মিটিয়ে স্বস্তি পেল
সাদি মোহাম্মদ।
‘আন্নে এত চালাকি করলেন ক্যা? মিছা কতা কইছেন ক্যা ?’
‘ইতারা বাংলাদেশের মানুষেরে মিসকিন ভাবে। মিছা কথা ন কই কী কইত্তাম! ইতারার অত্যাচারেরত্তুন বাঁচিবাল্লাই
মিছা কইয়ি।’
রুস্তম জিজ্ঞেস করল, ‘এই মরুকারাবাসে এলেন কেন ?’

‘ইয়ান বড়ো বেশি দুক্কের কতা। রিক্রুটিং এজেন্সির ভুয়া কথার লাই আঁর আজিয়া এই দশা। যে কাজের লোভ দেহাই
আঁরে এডে আইননে, ইয়ান ভুয়া। খাইবার লাইও দুক পাইয়ি। পেটের ভুকেরলাই অপরাধ করি ফালাইয়ি। ইয়ারলাই
এডে জাগা অইয়ে আঁর। দেশের বউত মাইনষে এডে আঁর লাইন অপরাধ গরে। দেশের বউত বদনাম ওইগিয়ে। সাত
মাস আঁই বন্দি আছিলাম। বর্তমানে তিন লাক মানুষ কুনো কাজ ছাড়া আছে ডুবাইতে। এ কথাগান যেন দেশের সব
মাইনষে জানে। আঁই বুজ্ঝি, ডুবাইতে অহন কনস্ট্রাকশনের কাজ প্রায় বন্ধ। আঁরার দেশের প্রায় তিন লাক লোক এ
দেশে অবৈধ। কেউ যেন আর এনডিক্কা ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির ফাঁদত ন পড়ে। যারা বৈধভাবে আছে, ইতারা গম
আছে। বিশেষ করে, যারা অ্যায়ারপোর্টে কাজ পাইয়ে, তারা বেশি গম আছে। ফাঁদত আটকা মাইনষের কষ্টের
কথায়ান আঁরার দেশে দূতাবাসে জানান দরকার।’

নোমান বলল, ‘দূতাবাস বেগ্গিন জানে। আঙ্গো অবস্থা হিয়ারাও হাত্তা দেয় না।’

নিজ দেশের ভাষায় কথা বলার কারণে কুফিয়া কিছুটা বিব্রতবোধ করছে বুঝে রুস্তম আরবিতে বলল, ‘নোমান, এখন
আমাদের কাজ বেড়ে গেছে, দায়িত্ব বেড়ে গেছে। অসুস্থ দুজনকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে হবে, মরুর পশু
দলের দেখভাল করতে হবে। আমাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে। পাশে থাকতে হবে আপনাকে। কী বলেন, নোমান ?’

‘আন্নে চিন্তা করনের দরকার নাই। বেক কাজ করি হালামু আঁই।’
দুজনে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নোমান বলল, ‘আঙ্গো ফদান কাজ হইল উটের জন্য মরুর গাছের বিচি—আঁঠি,
লতাপাতা জোগাড় করা।’
‘এতগুলো উটের খাবার খুঁজে খুঁজে জমা করতে হবে ?’
‘হুঁ। হবে।’
‘ঘের থেকে বের করে বাইরে ছেড়ে দেওয়া যায় না উটগুলো ? চরে বেড়াবে মরুতে, আবার ফিরে আসবে সন্ধ্যায়,
এমন হতে পারে না ?’
‘হারে। কিন্তু উগ্গা উট যদি হারায়, তাইলে আঙ্গো রক্ষা নাই। হিয়াল্লাই খাবার জোগাড় করি আনা ভালা।’
কাজটা বড়ো কঠিন। বুঝেও রুস্তম হাঁটা শুরু করল সামনে। কাঠের ঘের পেরিয়ে হাঁটতে লাগল বিস্তীর্ণ মরুর
উদ্দেশে।
কিছুদূর এগোনোর পর নোমান বলল, ‘কাজ একখান ভুল হই গেছে।’
‘কী ভুল ?’
‘হানি লইতে অইব। হানি লনের কৌট্টা আইনতে অইব। নইলে তিশনায় হরান হাডি যাইব। আন্নে দাঁড়ান, আঁই
লই আই।’
রুস্তম বলল, ‘ঠিক আছে, যান।’

মাথার ওপর আগুন ঝরানো সূর্য। পায়ের তলে গরম বালি। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসেও বেরোচ্ছে-ঢুকছে আগুনে বাতাস।
কিছুটা পথ হেঁটে আসার পরই টের পেল, শরীর ঘামছে। কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে এই পরিবেশে ? ভাবতে
গিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল রুস্তম। জীবনবায়ু নিঃশেষ হয়ে যাবে না তো? ফুসফুসের শক্তি বজায় থাকবে তো?
অজানা আশঙ্কা মাথায় নিয়ে পা বাড়াল সামনে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব বারোউপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব চৌদ্দ >>

One thought on “উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব তেরো

  • এপ্রিল ২৮, ২০২১ at ৪:১১ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    অসাধারণ
    মাথার ওপর আগুন ঝরানো সূর্য। পায়ের তলে গরম বালি। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসেও বেরোচ্ছে-ঢুকছে আগুনে বাতাস।
    কিছুটা পথ হেঁটে আসার পরই টের পেল, শরীর ঘামছে। কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে এই পরিবেশে ? ভাবতে
    গিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল রুস্তম। জীবনবায়ু নিঃশেষ হয়ে যাবে না তো? ফুসফুসের শক্তি বজায় থাকবে তো?
    অজানা আশঙ্কা মাথায় নিয়ে পা বাড়াল সামনে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *