উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব পাঁচ

কাজে লেগে গেল সে। কিন্তু হাতের কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারছে না। শরীর-মন থরথর করে কাঁপছে। রাতে খাবার খেতে বসে কলি বলল,
‘আম্মাজান, দুবাই থেকে কল আসছে না কেন? চিন্তা লাগছে।’
এমনভাবে কথাটা পাড়ল সে, যেন রুস্তমের কলের ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। সত্য কথাটা এড়িয়ে রুশনা বেগম জবাব দিলেন,

‘নিশ্চয়ই ও খুব ব্যস্ত। সময় পেলেই কল করবে। সব সময় রুস্তমের কলের জন্য বসে থাকলে কি চলবে! অত চিন্তার কী আছে?’
রুশনা বেগমের জবাব আর পালটা প্রশ্ন শুনে শান্তচোখে কলি তাকাল শাশুড়ির মুখের দিকে। মনে হলো তার সামনে বসে আছেন অচেনা শাশুড়িকে আঘাত করার পরিবর্তে নিজেই আঘাতটা বুক পেতে নিল। সরে এলো রসুইঘরে। তার বুকের স্পন্দন যেন থেমে গেছে। নিজেকে মনে হলো একটা প্রাণহীন জড়পদার্থ কেমন অনুভূতিশূন্য! ওই অবস্থাতেই কোনো নারী। এ যেন তার শাশুড়ি নয়। কষ্টের নীল দরজায় দাঁড়িয়ে রুশনা বেগমের চোখের ওপর চোখ রেখে কলি এবার প্রশ্ন করল,
‘আপনি তো আমার স্বামীর মা। মায়ের মন সব সময় সন্তানের শুভচিন্তায় বিভোর থাকে—সে কেমন আছে, কী খাচ্ছে, ঠিকমতো ঘুমাতে বা বিশ্রাম নিতে পারছে কি না, কোনো বিপদ হলো কি না। আর আপনি ছেলের কোনো খোঁজ বা কল না পেয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত! কেমন মা আপনি?’
চিতাবাঘের থাবা পড়ল যেন শাশুড়ির গায়ে। কঠিন কথা উচ্চারণ করলেও ভেতরের রাগ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখত পেরেছে কলি। নিয়ন্ত্রণ না-হারানোর কারণে শীতল ক্রোধের মাত্রা ক্রমাগতভাবে ধারালো অস্ত্রের মতো চকচক করে উঠতে লাগল। একবার মাত্র বউমার দিকে চোখ তুলে আবার সেই চোখ নামিয়ে নিলেন রুশনা বেগম। বউয়ের ঠান্ডা চোখকে মনে হলো বিষধর সাপের চোখের মতো। ছোবল মারার সময় সাপ যেমন তার শরীর বাঁকা করে সামনে ছুড়ে দেয় বিষের লালা, তেমনি করে যেন শব্দ ছুড়েছে কলি। কলি দেখল উদ্ধত ফণা তোলার পরিবর্তে নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেলেন শাশুড়ি। চোরের গলা বড়ো হলেও এই মুহূর্তে রুশনা বেগমের কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না।
‘চিন্তার কী আছে ?’
কথাটায় নিশ্চিন্ত থাকার যে আত্মবিশ্বাসী ঘোষণা দিয়েছেন, সেই বিশ্বাসে চিড় না ধরলেও বউয়ের কথার মধ্য থেকে অশ্রদ্ধার যে বিস্ফোরণ দেখলেন, তাতেই কেঁপে উঠেছে তার আন্তরাত্মা। গৃহবিবাদের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠলেও নিজেকে কৌশলে সংযত করলেন রুশনা বেগম। খাট থেকে নেমে সরে যাচ্ছিলেন কোনো কথা না বলে। উত্তর না দিয়ে চেয়েছিলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। কিন্তু কলির শীতল কণ্ঠের ভেতর থেকে আগুন ঝরে পড়ল। বলতে লাগল কলি,
‘ছেলের সঙ্গে একাই কথা বলে লাইন কেটে দিয়েছেন। আমাকে কথা বলার সুযোগ দেননি। রুস্তম শুধু আপনার ছেলে নয়, আমারও স্বামী। সেকথাটা, আশা করি, ভুলে যাবেন না আপনি।’
বউয়ের চিৎকার করা কথা শুনে থমকে গেলেন রুশনা বেগম। গলার মধ্যে যেন পাক-খাওয়া একটা রশির ফাঁস টের পেলেন। মনে হলো কেবল কথার তুবড়ি নয়, পাক খেতে থাকা রশির অন্যপ্রান্তে টান দিয়ে বউমা ক্রমাগতভাবে তাকে ফাঁসে জড়িয়ে ফেলছে। এ মুহূর্তে বউমাকে মনে হলো একটা উড়ন্ত শকুন। মুহূর্তেই সেই শকুনটা যেন তুলে নেবে তার দু-চোখ। ক্রোধ নয়, বুকের গভীরে একটা আগুনের হলকা জ্বলে উঠেই নিভে গেল দপ করে। টুঁ শব্দ না করে চট করে তিনি সরে গেলেন বউমার সামনে থেকে। প্রায় চিৎকার করে শাশুড়িকে শুনিয়ে কলি বলল,

‘ছেলে শুধু আপনার একার নয়। আমারও স্বামী। আলাদা মোবাইল সেট কিনব এবার। স্বামীর সঙ্গে কথা বলব আমি। আপনি বাধা দেওয়ার কে?’
এবার ঝড়ের গতিতে কলির দিকে এগিয়ে এসে রুশনা বেগম বললেন, ‘আমি বাধা দেবো কেন?
তোমার স্বামীই কথা বলতে চাইল না তোমার সঙ্গে। উঠতিবয়সি কিশোরের সঙ্গে ঝোপঝাড়ে কথা বলবে, ফিসফিস করে আলাপ করবে, আবার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চাইবে, স্বামীরও ভালোবাসা পেতে চাইবে, তা হবার নয়।
’গলা নামিয়ে কথা বলো, বউমা।’
কলি বুঝতে পারল, সামনে দাঁড়িয়ে যিনি, তিনি তার শাশুড়ি নন, স্রেফ একজন রাক্ষুসী। ঈর্ষার আগুন বুকে পুষে, ছেলের বউকে শায়েস্তা করতে গিয়ে, ছেলের বুকেই বিষের ছোবল বসিয়ে দিয়েছেন। বউয়ের নামে কুৎসা গেয়ে আঘাত করেছেন ছেলেকে, টের পাননি তিনি। বিষের যন্ত্রণায় হয়তো ছটফট করছে রুস্তম।
বউকে অবিশ্বাসী ভেবে এ মুহূর্তে নিশ্চয়ই পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়-মন। অভিমানে লাইন কেটে দিয়েছে সে কারণেই। এত ভয়ংকর হতে পারেন শাশুড়ি! কলির বুকজুড়ে উঠল হাহাকার। এখনো সন্ধ্যারাত। গভীর হতে অনেক বাকি। আজ আকাশে চাঁদ থাকবে না। তারা থাকবে না। গভীর অন্ধকার থেকে বিষণ্ন আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে আর্তস্বরে কান্নার আওয়াজ। ব্যথিত মন সঁপে দেবে কার কাছে? বুকজোড়া হাহাকার নিয়ে একাকী গোপন কথা বলবে কার সঙ্গে? অভিমানের পাহাড়সমান চাপবোধ করল কলি। ভাবনার পর ভাবনার তোলপাড়। রুস্তম নিশ্চয় মায়ের কথা বিশ্বাস করবে। মাভক্ত রুস্তম বলেছিল,

‘আমার সামনে মায়ের উচ্চতা হচ্ছে হিমালয়ের সমান উঁচু। আমার সে-ই মায়ের মর্যাদা ধরে রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেলাম তোমাকে। মায়ের মনে কষ্ট দিয়ো না। তাকে কষ্ট দিলে আমিও কষ্ট পাব। মরুভূমির বুকে ঢেলে দেওয়া আমার শ্রমও বৃথা যাবে।’
এই মুহূর্তে মনে পড়ল স্বামী রুস্তমের বলা সেই কথাগুলো। শাশুড়িকে কষ্ট দিতে চায়নি। অথচ না বুঝে কী এক দুর্ভেদ্য কারণে শাশুড়ি ছেলের কানে ঢেলে দিয়েছেন বিষাক্ত গরল। বউয়ের নামে কুৎসা গেয়ে যে ছেলের ক্ষতি করলেন তিনি, সেকথা মোটেও বুঝলেন না। অশিক্ষিত হলেও গ্রামীণ এই জনপদেও বেশ চটপটে তার শাশুড়ি— রুশনা বেগম। তার তো বোঝা উচিত ছিল সব। আর কি তাকে শ্রদ্ধা করা সম্ভব? যে শাশুড়ি ছেলেকে বউয়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করতে পারেন, তাঁকে কি শ্রদ্ধা করা সম্ভব? মনে হতে থাকে বুকের পাঁজর ভেঙে শ্বাসপ্রশ্বাস সব বেরিয়ে যাচ্ছে।
শূন্যতার বুক চিরে অচেনা পাখির মতো ধেয়ে আসুক এখন রুস্তমের কল—এই প্রবল তাড়না নিয়ে ফোনসেট খুঁজতে লাগল কলির ভেতরের দু-চোখ। হ্যাঁ, সেট দেখতে পেয়েছে। কলির শব্দবাণে আক্রান্ত রুশনা বেগম ভুলে মোবাইল ফোন রেখে দিয়েছেন খাটের ওপর।
রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় উত্তেজনার বশে অরক্ষিত রেখে গেছেন মুঠোফোনের দখল। দেখামাত্রই অনেকটা উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে সেটটা হাতে নিয়ে নিজের রুমে ঢোকে কলি। দরজা ভালো করে বন্ধ করে খাটে উঠে বসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সেটটার দিকে। মনে হলো,
কেবল সে সেটটাই হাতে নেয়নি, স্পর্শ করেছে রুস্তমকেও। কল অপশনে গিয়ে রুস্তমের নম্বরে কল করল। সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল লাইন। পুরো পাল্স রিংটোন বাজার পর থেমে গেল। কল ধরেনি রুস্তম। আবার কল দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকল সেটের দিকে। কল রিসিভ করামাত্রই অন হয়ে গেছে সেকেন্ডের কাঁটা। কানে দিয়েই অপরপ্রান্তের সম্বোধন না শুনে ঝোড়ো প্রশ্ন করল কলি,
‘আমার সঙ্গে কথা না বলে লাইন কেটে দিয়েছ কেন?’
ভুলে গেল সে স্বামীকে আপনি সম্বোধন করতে। প্রশ্ন শুনে রুস্তম মরুভূমির বুকে ঝড়ের আভাস পেল। সেই ঝড় আর কেউ নয়, কলি নিজে। কিন্তু বুকে অভিমানের পেরেক ঠুকে থাকার কারণে চুপ করে থাকল কিছুটা সময়। হিংস্র বাঘিনির মতো আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলো কলি,
‘কথা বলছ না কেন?’
কলির প্রশ্নের প্রবল ঝাপটার তোড়ে বাধা অপসারিত হয়ে কথা ফুটল তার মুখে। বুকের আগুনের তাপে দিশেহারা রুস্তম ভাঙা গলায় প্রশ্ন করল, ‘আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা কি তোমার আছে?
’রুস্তমের প্রশ্ন শুনে নিজেকে মনে হলো নর্দমার পড়ে থাকা একটা বেওয়ারিশ লাশ।
তবু নিজেকে স্বাভাবিক করে কলি পালটা প্রশ্ন করল,
‘ইচ্ছারা কোথায় পালাবে? বসে বসে কেবল প্রহর গুনি তোমাকে দেখার আশায়। তোমার কথা শোনার আশায়। আর সে-ই তুমি কি না বাঁকা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছ!’
রুস্তম বলল, ‘বাঁকা প্রশ্ন নয়। আমার সোজা প্রশ্ন—শৌর্যের সঙ্গে তো তোমার ভালোই সময় কাটছে। আমার সঙ্গে কি তোমার কথা বলার ইচ্ছা জাগতে পারে?’
চোখে এখন অশ্রু নেই। আগুনের শিখা নেই। স্তব্ধ শরীরের নিথর অণুপরমাণুর ভেতর থেকে ক্ষুব্ধ কিংবা শোকার্ত
কোনো শব্দও বের হলো না। পালটা যুক্তি খুঁজে পেল না মস্তিষ্ক। অবিরল ভাঙতে লাগল দেহের কোষ। অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্নের তলে চাপা পড়ে গেল ক্ষুব্ধ শব্দমালা। মুঠোফোন ধরে থাকা হাত কেমন শিথিল হয়ে গেল।
আকাক্সক্ষার গোপন শিখাও দপ করে নিভে গেল। স্বামীর সঙ্গে কথা বলার বেপরোয়া আকাক্সক্ষা অকস্মাৎ দপ করে নিভে গেল। নির্জন রাত আরও নির্জন হতে লাগল। লাইন কেটে সেট অফ করে শুয়ে পড়ল কলি। একবার ইচ্ছা হয়েছিল নিজের মুঠোফোনটিকে নিজের কাছে না রেখে শাশুড়ির খাটে রেখে আসার।
নিজের মধ্যেই শৃঙ্খলিত কলি ভেতর থেকেই কেমন অবশ হয়ে যেতে লাগল। রুস্তমকে আর খুঁজতে ইচ্ছা হলো না তার। অভিমানের গভীর জালে জড়িয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যেতে লাগল। নির্বাসনের সেই একাকিত্ব টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন নিঃস্ব মনে হতে লাগল নিজেকে।
শুকনো চোখ বেয়ে নামতে লাগল অবিরল নোনাজল। হঠাৎ তার মগ্নতার ঘোর কেটে গেল দরজায় উপর্যুপরি আঘাত করা দুমদুম শব্দে। রুশনা বেগমের চিৎকার আর প্রশ্ন,
‘মোবাইল ফোন নিলে কেন? ওটা ফিরিয়ে দাও।’
বিশ্রী চিৎকার শুনেও থামল না গাল বেয়ে নামা অশ্রুর ধারা। সেই অবস্থায় খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কলি। চাঁদ উঠেছে আকাশে। তারাও দেখা যাচ্ছে। চাঁদকে বড়ো বেশি নির্লজ্জ মনে হলো। একাকী চাঁদ বুঝি কাঁদছে আর্তস্বরে! আবার ভাবনার খেই ছিন্ন হলো কলির। আবার দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনতে পেল। বিছানা থেকে না উঠেই কলি পালটা চিৎকার করে বলতে চাইল কটু কথা। কিন্তু তার গলার স্বর জোরালো হলো না।
ঝাঁঝালো কথার পরিবর্তে কণ্ঠ থেকে বের হলো দৃঢ় অথচ নরম স্বর, ‘মোবাইল সেট বন্ধ রেখেছি। আপনার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করব না। যে অরুচিকর অশ্লীল কথা ছেলের কানে ঢেলে দিয়েছেন, তা রুস্তমের মাথা ওলটপালট করে দিয়েছে। আমার জন্য তার মুখ থেকে আর ঝরবে না এতটুকু আদর-মমতাও। নিজের ঘরে গিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ুন। আপনার ছুড়ে দেওয়া বিষের তির শুধু রুস্তমকেই আমার কাছ থেকে আলাদা করে দেয়নি, নিজের শরীরের শক্তিও শুষে নিয়েছে। ওঠার শক্তি পাচ্ছি না। চিৎকার করবেন না, ফিরে যান।’
কলির কণ্ঠস্বরে কী আছে, সেটা বুঝতে পারলেন না শাশুড়ি। রাগ যে নেই, সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে তার ঠান্ডা-শীতল কথার মধ্যে যে শ্লেষ মাখানো আছে, সেটা বুঝতে পারলেন। এ সবকিছুর বাইরেও যেন আছে ভয়াবহ কোনো পরিণতির ইঙ্গিত! ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করেই চমকে উঠলেন রুশনা বেগম। আত্মহত্যা করবে না তো আবার বউমা? কিছুদিন আগে এ এলাকার এক মেয়ে গলায় ফাঁস নিয়ে মরেছে। সেই ভয়াবহ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের কথা থেমে গেল। দরজা ধাক্কানোর কথা ভুলে গেলেন তিনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলেন। বাড়ির অন্য কারোর সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে হঠাৎ করেই দ্রুত বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। একই বাড়ির দখিনের ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে উঠোনের উত্তর পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন কাউকে।
কে? বোঝা যাচ্ছে না। এক-পা, দু-পা করে তার সামনে হাজির হয়ে দেখলেন, দখিনদিকে মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে শৌর্য। তাকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলেন রুশনা বেগম। মনে হলো, শৌর্য ডাকলে নিশ্চয় দরজা খুলে দেবে বউমা। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা রুশনা বেগমকে সামনে দেখে শৌর্য প্রশ্ন করল, ‘কাকিমা, আপনি? কী হয়েছে আপনার?’
‘আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে বউমা। এখন দরজায় খিল দিয়েছে। রাগের মাথায় কী করে ফেলে, বলা যায় না।’
‘ভাবি খারাপ ব্যবহার করেছে!’ বিস্ময় ঝরে পড়ল শৌর্যের কণ্ঠ থেকে।
‘হ্যাঁ। করেছে।’
‘নিশ্চয়ই আপনিও খারাপ ব্যবহার করেছেন’,
পালটা প্রশ্ন করল শৌর্য। শৌর্যের জবাব শুনে তেড়ে উঠলেন না রুশনা বেগম। চমকে শুধু বললেন,
‘তুমি তো সেই অভিযোগ করবেই। তলে তলে তো…।’
কথা শেষ করলেন না রুশনা বেগম।
‘তলে তলে কী, কাকিমা? সব খুলে বলুন।’
‘কিছু না। এখন উদ্ধার করো বউমাকে।’
রুশনা বেগমের রহস্যজনক কথার তল খুঁজে পেল না শৌর্য। খোঁজার চেষ্টাও করল না।
‘এখন উদ্ধার করো বউমাকে’
—কেবল কাকিমার উদ্বেগমাখা কথাটা শৌর্যের মনে সৃষ্টি করল এক চরম উৎকণ্ঠা। কথা না বাড়িয়ে সরল মনে একদৌড়ে গিয়ে হাজির হলো ভাবির দরজার সামনে। দরজায় ধাক্কাতে ধাক্কাতে চিৎকার করে শৌর্য বলতে লাগল,
‘ভাবি, আমি শৌর্য। দরজা খোলো।’
অভিমান, দ্রোহ আর পাথর চাপা কষ্টের ঘোরে ডুবেছিল কলি। হঠাৎ শৌর্যের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোঝার চেষ্টা করল শৌর্যের উপস্থিতির কারণ।উত্তর না পেয়ে শৌর্য আবার চিৎকার করে বলল,
‘ভাবি, দরজা খোলো।’
নিজেকে সামলে নিয়ে কলি প্রশ্ন করল,
‘কেন এসেছ তুমি? কেন আমার দরজা ধাক্কাচ্ছ?’
কলির প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দিতে পারল না শৌর্য। অনুনয় করে কেবল বলল,
‘প্লিজ ভাবি, দরজা খোলো।’
শৌর্যের উপস্থিতির কারণে ভয়ে ব্যাকুল হয়ে কলি প্রশ্ন করল,

‘কেন এসেছ? চলে যাও। আমার কাছে এলে শাশুড়ি তোমাকে আর আমাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই কুৎসা রটাবে। তুমি যাও। প্লিজ, যাও।’
কলির কথা শৌর্যের কানে ঢুকল এবার। শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকল কিছুটা সময়। পাশে দাঁড়ানো কাকিমার দিকে তাকাল ক্ষুব্ধচোখে। শৌর্যের চোখের দিকে ভালো করে তাকালে রুশনা বেগম বুঝতে পারতেন সরল কিশোরটির মনোভাব। সেদিকে না তাকিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রুশনা বেগম বললেন,
‘শৌর্য, ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলো। খিল দেওয়া ঘরে বউমা হয়তো আত্মহত্যা করে বসবে। পুলিশ এসে তখন সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। দরজা ভেঙে ফেলো।’
রুশনা বেগমের কথায় ধন্দে পড়ে গেল শৌর্য। হকচকিয়ে বলে বসল, ‘ভাবি, দরজা খোলো। না-হলে দরজা ভেঙে ফেলব আমি।’
বাইরে থেকে বলা শাশুড়ির কথা কলির কানে ঢুকেছিল। বোঝার বাকি রইল না যে, শাশুড়িই ভয় পেয়ে ডেকে এনেছে শৌর্যকে। তাই দ্রুত খিল আলগা করে দরজা খুলে উদ্বিগ্ন শৌর্যকে দেখে প্রশ্ন করল কলি,
‘কেন এসেছ তুমি ?’
হাঁপাতে হাঁপাতে শৌর্য জবাব দিলো, ‘তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি। কাকিমা বললেন, আত্মহত্যা করার জন্য দরজায় খিল দিয়েছ তুমি। বলেই দ্রুত সামনে থেকে সরে গেল শৌর্য।এই ফাঁকে টুপ করে রুমে ঢুকে গেলেন রুশনা বেগম। মুঠোফোন অন করার কিছুক্ষণের মধ্যে রিংটোন বেজে উঠল। কল ধরার সঙ্গে সঙ্গে কে রিসিভ করল না জেনেই, রুস্তম প্রশ্ন করল,
‘আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেট অফ করে রেখেছ কেন?’
ছেলের প্রশ্ন শুনে রুশনা বেগম বললেন,
‘আমি কলি না, তোমার মা। খিল দেওয়া দরজা খুলে বউমাকে উদ্ধার করেছে শৌর্য। এই ফাঁকে সেট চালু করেছি আমি।’
দরজার মুখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শৌর্যের চলে যাওয়া দেখছিল কলি। হঠাৎ শাশুড়ির বলা কথা কানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শৌর্যের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এবার উদ্ধত পায়ে শাশুড়ির সামনে এসে প্রশ্ন করল,
‘ছেলের কাছে কী বলছেন এসব?’
রুশনা বেগম বললেন,
‘কেন, মিথ্যা কী বললাম! আমার শত অনুরোধে দরজা খোলোনি তুমি। অথচ শৌর্যের কথায় মুহূর্তে দরজা খুললে তুমি। মিথ্যা বললাম?’
ঝাপটা দিয়ে শাশুড়ির হাত থেকে মুঠোফোনটি কেড়ে নিয়ে রুস্তমের উদ্দেশে চিৎকার করে কলি বলতে লাগল,
‘শুনেছেন আপনার মায়ের কথা ? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত করে তোলার জন্যই গোপন ঈর্ষা কাজ করে তাঁর মনে। ঈর্ষার আগুনে কেবল আমাকে নয়, আপনাকেও পোড়াবেন তিনি। বুঝতে পারছেন?’
চিৎকার করে রুস্তম জবাব দিলো,
‘খবরদার! আরেকটি কথাও বলবে না আমার মাকে নিয়ে।’
আকাশে ওঠা চাঁদ ভেঙে খানখান হয়ে পড়ল এ বাড়ির ছাদে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কলি বুঝতে পারল শাশুড়ি সামনে নেই। মুঠোফোন নিয়ে চলে গেছেন নিজের ঘরে। আবেগশূন্য কলি একাকী দাঁড়িয়ে ভাবল,
মুহূর্তে কী ঘটে গেল জীবনে! জীবন কি এরকমই। কিন্তু এতকিছুর পরও অসহায় লাগছে না নিজেকে।
যার কচিবুকে এমন কষ্ট জমা হতে পারে, অসহায় হবে কেন সে? বরং কষ্ট পাওয়া তো একটা অভিজ্ঞতা।
নির্মম কষ্টের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে পারে যার মন, সে কেন শূন্য হবে? অসহায়ই বা হবে কেন?
সে তো ঐশ্বর্যবান! নিজেকে ঐশ্বর্যবান ভেবে স্থির-প্রশান্ত হলো কলির মন।
নতুন কলিকে এখন দখল করে নিয়েছে পুরোনো কলির সত্তা। নতুন আর পুরাতনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মিশেলে জন্ম হলো অন্য এক কলির।

Series Navigation<< উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব চার॥উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব ছয় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *