উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব চৌদ্দ

দশ।।

পেরিয়ে গেছে প্রায় এক মাস। ফোন করছে না রুস্তম!

গাছের পাতারা ঝরে যাচ্ছে। এ সময় সন্ধ্যার আগেই নেমে আসে কুয়াশা। দিনের রোদ হারিয়ে
দ্রুত নামে সন্ধ্যা। প্রকৃতির বিষন্নতার মতো পরানেও বাজে বিষাদের ঘণ্টা।
ঝরাপাতায় জমে থাকা ভোরের নরম শিশির কচিরোদের পরশে যেভাবে দ্রুত মিলিয়ে যায়,
ফোন কলের আশায় আশায় থাকতে থাকতে তেমনি মিলিয়ে গেল কলির অভিমান।
পাহাড়সমান জমাট ক্রোধ তরল হয়ে উৎকণ্ঠার ঢেউ হয়ে ছুটছে মরুপানে।
স্বামীর খবর জানার জন্য মরিয়া হয়ে শাশুড়ির বিছানার পাশে বসে বলল,
‘আম্মাজান, উপজেলা অফিসে কি খোঁজ নেওয়া যায় না?’

শোয়া থেকে উঠে রুশনা বেগম বললেন,
‘যায়। কে যাবে, বলো? সংসারে তো পুরুষমানুষ কেউ নেই।’
‘কেন, শৌর্যের বাবা, আতর আলি চাচাজানকে পাঠানো যায় না?’
‘সে তো গিয়েছিল খবর নিতে। পাঠিয়েছিলাম তাকে। তেমন কোনো খবর নিয়ে আসতে
পারেনি।’
‘পাঠিয়েছিলেন? আমি তো জানি না। আমাকে জানাননি কেন?’
‘সব কথা তোমাকে বলতে হবে! কৈফিয়ত দিতে হবে!’

উদ্বেগের বিদ্যুৎঝলক চকিতে ভেসে উঠল মনের অন্ধকার আকাশে। সে আলো চট করে
জানান দিয়ে গেল শাশুড়ি নিশ্চয়ই জানেন রুস্তমের খবর।
তাকে জানাচ্ছেন না বা আড়াল করে রাখতে চাইছেন কোনো দুঃসংবাদ বা সুসংবাদ!
দীর্ঘ উৎকণ্ঠার পর স্বস্তিদায়ক শীতল হাওয়া বয়ে গেল মনে। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না শীতল
পরশ। মুখ তুলে উদ্ধত চোখে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কৈফিয়ত দেবেন কেন? দুশ্চিন্তা দূর করবেন না? আপনার ছেলের বউ না আমি?’

‘খবর শুনলে দুশ্চিন্তা দূর হবে না। আরও বাড়বে। সব জেনেশুনে নিশ্চিত হয়ে জানাব
ভেবেছিলাম।’

কলির ফণা তোলা জিহ্বা নেতিয়ে গেল। কোনো শব্দ খরচ না করে খাট থেকে উঠে বেরিয়ে
গেল রুম থেকে। কয়েকটি ধারণা উদয় হলো, ‘ছেলের খোঁজ পেয়েছেন শাশুড়ি।
ঘটন-অঘটন যাই-ই ঘটুক, বেঁচে আছে স্বামী। সব খবর শোনার
প্রয়োজন নেই আর। এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হয়েছে মন। অভিমান জেগে উঠল চাচাশ্বশুরের
ওপর। ছেলের মাকে জানালেই দায়িত্ব শেষ হতে পারে? চাচাশ্বশুর অন্যায় করেছেন। তাঁর
সাহায্য চাওয়া কিংবা তাঁকে জিজ্ঞাসা করার আগ্রহ চাপা পড়ে গেল অভিমানের পাথরে।
কিন্তু চকিতে মনে এলো আরেকটি কথা। সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তা জাফর
আহমেদ তো আর ফোন করেননি! সেল নম্বর টুকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার চোখে
দেখেছিল ফোন করার লিপ্সা। মুগ্ধ পুরুষচোখ চিনতে ভুল হয়নি কলির। বয়স কাঁচা,
অভিজ্ঞতা কম হলেও স্বল্প সময়ে অভিজ্ঞতার বদ্ধঘরের জানালা খুলে যাওয়ায় দেখেছিল সেই
চোখের গভীর আকাক্সক্ষার প্রকাশ। সে খবরও কি লুকিয়েছেন চাচাশ্বশুর? তেলে-বেগুনে জ্বলে
ওঠার কারণে আতর আলি মুনশির ওপর অভিমানের পাথর আরও ঠেসে ধরল। ছলকে-বলকে
বেরোতে লাগল রাগ আর ক্রোধ। রোষের ঝাঁজ গিয়ে পড়ল শৌর্যের ওপরও।

এবার আর কারও সঙ্গে কথা বলবে না সে। এমনকি সামনাসামনি হলেও এড়িয়ে যাবে। এমনি
মনের খেদ নিয়ে আবার ঢুকল শাশুড়ির রুমে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘সমাজসেবা
অফিসের কর্মকর্তা জাফর সাহেব কি ফোন করেছিলেন,
আম্মাজান?’

প্রশ্নের ঝাঁজে যেন ছ্যাঁকা খেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে রুশনা বেগম জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।
করেছিল, ধরিনি। কথা বলিনি।’

‘কল না ধরে, কথা না বলে কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে তিনি ফোন করেছেন? তার নম্বর তো
স্টোর করা ছিল না আমাদের ফোনসেটে!’
মিথ্যা বলতে গিয়ে ধরা খেয়েও শাশুড়ি পরাজিত হতে চাইলেন না, ‘উনার নাম স্টোর করেছি
সেটে। নাম দেখেই বুঝেছি।’
‘আপনি তো স্টোর করতে জানেন না। কেবল কল করা এবং রিসিভ করা ছাড়া আর কোনো
বিষয়ই জানা নেই আপনার।’
‘শিখে নিয়েছি।’
‘কে শেখাল?’
‘সেদিন ঘুমিয়েছিলে তুমি। পাশের ঘরে সেট নিয়ে গিয়েছিলাম। শৌর্যই শিখিয়ে দিয়েছে সব।’

‘শৌর্য’ শব্দটা আচমকা মাথায় আঘাত করল। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল নিয়ন্ত্রিত মনের বাঁধ। তেড়ে
উঠল অভিমানের ঢেউ। ঢেউয়ের আঘাতে ভেসে যাওয়ায় আর কোনো বিচারবিশ্লেষণ ঠাঁই
পেল না মাথায়।
বেসামাল অভিমানের ঢেউ আবার আছড়ে পড়ল শৌর্যের ওপর। চুপ হয়ে গেল কলি। দ্রুত
বেরিয়ে এলো বাইরে। খোলা আকাশটাকে আর খোলা মনে হলো না। যেন চেপে আসছে
চারপাশ থেকে।
হেমন্তের গাছের পাতার মতো শৌর্যও যেন ঝরে গেল স্বজনের তালিকা থেকে।
ঋতুপরিবর্তনের মায়াময় বাতাসের পরশ পেয়েও চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো
পুকুরপাড়ে। হাতে বয়ে আনা বোরকাটি গায়ে চাপাল। বাড়ির সীমানা পার হওয়ার সময় দেখল
ধান কাটা শূন্য মাঠ পেরিয়ে ঝাঁকিজাল হাতে শৌর্য এগিয়ে যাচ্ছে পাশের খালের দিকে। খালে
পানি নেই বললেই চলে। নবান্নের এ সময়টায় প্রায় শুকিয়ে যায় খাল। এমন শুকনো খালে কী
মাছ ধরবে শৌর্য? রাস্তায় দুপাশের মাঠে কাটা ধানের গোছার দিকে তাকাতে তাকাতে এগোতে
লাগল বড়ো রাস্তার দিকে। কিছুদূর গিয়ে একবার পেছনে তাকাল। না, শৌর্য খেয়াল করেনি
বোরকা পরা কলিকে। আপনমনে সে নেমে যাচ্ছে খালের ঢাল বেয়ে। শুকনো খালের সঙ্গে
নিজের জীবনের মিল খুঁজে পেল। খালের শূন্যতাকে মনে হলো তার নিজের। বর্ষার জলকে
বরণ করার জন্য যেমন অপেক্ষা করছে জীর্ণশীর্ণ মৃতপ্রায় এ খাল, তেমনি সে-ও অপেক্ষা
করছে রুস্তমের জন্য। এই অপেক্ষার মধ্যে কাকতালীয়ভাবে কেন আগমন ঘটে শৌর্যের?
ভেবে কূল পেল না। অভিমানে ভরে উঠল মন। মাথা থেকে এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে উঠে
এলো বড়ো রাস্তায়। কিষানিরা রাস্তার ওপর বিছিয়ে দিয়েছে পাকা ধানসমেত গাছ। ছুটে
যাওয়া গাড়ির চাকার চাপে সহজেই গাছ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে ধান। একটি বাস চলে
যাওয়ার পর রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এক কিষানি এগিয়ে গিয়ে দুহাতে জড়ো করে ধরে ঝাঁকি
দিতে লাগল চাপা-খাওয়া কাটা ধানগাছ। রাস্তায় জমা হতে লাগল চকচকে সোনালি ধানের
স্তূপ। কাটা নতুন গাছ আবার বিছিয়ে দিলো রাস্তায়। গাছ থেকে ধান ঝরে যাওয়ায় ধানগাছ
হয়ে যায় খড়। রাস্তার পাশের জমিতে কৃষক নিপুণ হাতে সোনালি খড়ের গাদা সাজিয়ে
রেখেছে। বড়ো দৃষ্টিনন্দন। বাড়িতে প্রায় বন্দি থাকার কারণে এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি।
ধান, খড়, খড়ের গাদা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল কলি। মুগ্ধতা নিয়ে এগোতে লাগল উপজেলা
পরিষদ ভবনের দিকে। বেশিদূর নয়। পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গেলে সময় লাগবে
দশ মিনিট। প্রথমে ভয় পেলেও, এখন কেটে গেছে। মনে মনে রুস্তমের উদ্দেশে বলল, চলে
এসো রুস্তম। দেখে যাও পুরো এলাকার মানুষ মেতেছে উৎসবে। চলে এসো। নতুন চালের
ধোঁয়া-ওঠা ভাত রেঁধে, টাকি মাছের ভর্তা আর শিং মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়াব তোমায়।’

ভিন্ন গ্রামের ছাত্রী হলেও স্কুলে পড়ার সময় কয়েকবার এসেছিল উপজেলা পরিষদ-প্রাঙ্গণে।
তাই জায়গাটা একেবারে অচেনা নয়। তবে সমাজসেবা অফিসটা কোথায়, জানা নেই।
সাইনবোর্ড দেখে দেখে এগোতে লাগল। চারপাশে অনেক মানুষজনের আনাগোনা। সেদিকে
খেয়াল না করলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না, বোরকা পরা তার ওপর সবার চোখ। টেনশন
বাড়ছে। বুক ধড়ফড় বাড়ছে। মুখও শুকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ায় খুশিতে
ঝলমল করে উঠল চোখ।

মূল ভবনের নিচের তলায় উত্তরের রুম বরাবর ঝুলছে সাইনবোর্ডটি। বারান্দায় উঠে এগিয়ে
গেল সেখানে। খোলা দরজার সামনে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে বেরিয়ে বয়স্ক
এক লোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলবেন?’
‘জি।’
‘বলুন।’
‘জাফর আহমেদ সাহেবের কাছে এসেছিলাম। দেখা করা যাবে?’
‘ভেতরে এসে এ চেয়ারে বসুন। উনি এখনো আসেননি।’

‘আসবেন তো?’
‘সঠিক বলতে পারছি না। ফিল্ডে কোনো কাজ থাকলে অফিসে ঢোকেন না। বাইরের কাজ
সেরে সময় পেলে অফিস টাচ করে বাসায় যান।’
উত্তর শুনে অনিশ্চয়তায় আঁধারে ছেয়ে গেল মন। অধীর হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আজ কি ফিল্ডে
যাওয়ার কোনো প্রোগ্র্যাম আছে?’
‘না। আমার জানামতে নেই। তবে নিশ্চিত নই।’
তবু ভালো। মনে মনে ভাবল, কিছুটা আশার আলো থাকলে বসা যায়। ভেবে চেয়ারে বসে
পড়ল কলি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত লাগল অফিসের চারপাশ।


মাছ ধরে ফিরে যাওয়ার সময় পুকুরের উত্তর পাড়ে উঠে রুশনা বেগমকে দেখে শৌর্য প্রশ্ন
করল, ‘কী কাকিমা, অস্থির হয়ে কী খুঁজছেন?’
‘বউমাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তোমাদের ঘরেও খুঁজে এসেছি। তোমার মা বলল, মাছ ধরতে
বেরিয়েছ তুমি। ভেবেছিলাম, তোমার সঙ্গে বেরিয়েছে। তাই এদিকে এলাম।’
‘না। আমি তো দেখিনি ভাবিকে।’
‘তবে? কোথায় গেল?’
‘বনেজঙ্গলে ঘুরে পাখি দেখছে হয়তো। পাখি দেখার খুব শখ ভাবির।’
‘ঝোপঝাড় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোথাও পেলাম না?’
‘কটু কথা বলেছেন কি? বকা দিয়েছেন?
‘না। বকা দেবো কেন? তবে সমাজসেবা অফিসার ফোন করেছিল কি না জিজ্ঞেস করেছিল।
বলেছি, ফোন করেছিল। ধরিনি আমি।
তখন সে-ই রাগ দেখিয়েছিল।’
একটু ভেবে শৌর্য প্রশ্ন করল, ‘ভাবি কি বোরকা পরে?’
‘বাইরে গেলে তো বোরকা পরেই যায়।’
‘বোরকা পরনে এক মহিলাকে বড়ো রাস্তার দিকে যেতে দেখেছি! সে-ই না তো! আপনার
ওপর রাগ করে বেরিয়ে যায়নি তো বাড়ি থেকে?’
‘কতক্ষণ আগে দেখেছ?’
‘এই তো, আধঘণ্টা হতে পারে।’
‘মনে হয় সে-ই হবে। হয়তো উপজেলা পরিষদে গেছে সমাজসেবা অফিসে। রুস্তমের খবর
নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছে সে।’
‘ব্যাকুল তো হবেই। সে তো আর পাথর নয়। আপনি নিশ্চয়ই খারাপ কিছু বলেছেন।’
‘আমি আবার কখন খারাপ কথা বললাম!’

কথা বাড়াল না শৌর্য। মাছের খালুই আর জাল মাটিতে রেখে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে একবারে
গোসল সেরে উঠল। গোসল করার সময় চোখে ভেসে উঠছিল বোরকা পরা মহিলার বারবার
পেছনে ফিরে তাকানোর দৃশ্যটা। বিষয়টা তখন আমলে নেয়নি। আশ্চর্য! দেখেও কথা না
বলে চলে যেতে পারল ভাবি! অভিমানে ভরে উঠল বুক। তবু দ্রুত রওনা হলো ঘরের দিকে।
কাকিমাকে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। এখনই রেডি হয়ে উপজেলা অফিসে যাচ্ছি।
ভেবেছিলাম স্কুলে যাব। আজ আর স্কুলে যাব না।’

শৌর্যের ত্বরিত সিদ্ধান্তের কথা শুনে ভালো লাগল। তবু বউমার পক্ষ নিয়ে কথা বলায়
সন্দেহটা রয়েই গেল শৌর্যের ওপর।

বিড়বিড় করে বললেন, ‘কী সাংঘাতিক ছেলে রে! আমাকেই দোষ দিচ্ছে!’ মনের আড়ালে
জমা হতে লাগল ক্রোধ। ছেলের বউকে খোঁজার চিন্তা ভুলে গিয়ে উলটো বউয়ের দোষ
ধরতে ধরতে ঘরের দিকে রওনা হলেন।

অফিসে ঢুকতেই হোঁচট খেলেন জাফর আহমেদ। ওয়েটিং রুমে বোরকা পরা মহিলার দিকে
একবার তাকিয়ে পাশ কেটে রুমের ভেতরে ঢোকার সময় বসা থেকে চট করে দাঁড়িয়ে কলি
বলল, ‘আমি নূরে জান্নাত। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

থমকে দাঁড়ালেন জাফর আহমেদ। প্রথমে চিনতে পারেননি। মাথা তুলে মুখোমুখি তাকাতেই
কালো বোরকায় গোলাপের মতো ফুটে থাকা মুখটা দেখেই চিনলেন। বললেন, ‘ইয়েস! চিনতে
পারছি। আপনি কলি। রুস্তম সাহেবের স্ত্রী! আসুন, ভেতরে আসুন!’

ধীরপায়ে জাফর আহমেদের পেছন পেছন এগিয়ে গেল কলি। জাফর নিজের চেয়ারে বসে
কলির উদ্দেশে বললেন, ‘বসুন প্লিজ।’
জাফর আহমেদ বললেন, ‘অনেকবার ফোন করেছিলাম। আপনার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা
হয়েছিল।
দুর্ভাগ্য, কথা বলতে পারিনি।’
‘কেন ? কেউ ফোন ধরেনি?’
‘ধরেছিলেন আপনার শাশুড়ি। কখনো আপনি পুকুরে, কখনো খেতে, কখনো হাঁস পরিচর্যা
করছেন─
এসব শুনে শুনে আর কল করিনি।’
‘কী কারণে কল করেছিলেন?’
‘কেন, আপনার শাশুড়ি কিছু বলেননি?’
‘না। কিছুই বলেননি।’
‘আপনার চাচাশ্বশুরও এসেছিলেন। যতটুকু খবর পেয়েছি, জানিয়েছি উনাদের।’
‘কী খবর?’ সরাসরি জানতে এলাম।
‘খবরটা বিব্রতকর! কীভাবে বলব! কীভাবে নেবেন, ভাবছি।’
‘ভাবনার কিছু নেই। উনি ভালো আছেন। এটুকু জানলেই খুশি হবো আমি।’
‘হ্যাঁ। ভালো আছেন। তবে…’
‘থেমে গেলেন কেন? বলুন। উনি ভালো আছেন, এর চেয়ে আনন্দের খবর কিছু নেই আমার
জন্য!’
‘আপনি কি কিছু আঁচ করতে পারেননি?’
‘না! পারিনি। খোলাখুলি বলুন। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আমার।’

‘বাঁধ ভাঙলে তো চলবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। সাহসের সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করতে
হবে পরিস্থিতি। কথা দিচ্ছি, আপনার পাশে থাকব আমি। সাহায্য করব। মনোবল হারাবেন
না। আপনার মতো রূপসি বধূর জীবনের যে-কোনো দুর্দশা মোকাবিলায় কিছু করতে পারলে
ধন্য মনে করব নিজেকে।’

জাফর আহমেদের অতি আন্তরিক কথায় প্রশস্তি থাকায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে।
দমন করতে পারছে চটজলদি আসল খবর জেনে নেওয়ার বেপরোয়া তাড়না। মুগ্ধ প্রশস্তির
আড়ালে কোনো লিপ্সা থাকতে পারে, তা ভাবতে পারছে না এ মুহূর্তে।
এমন চিন্তা মাথায়ও এলো না। বরং তার কথাগুলো বদলে দিলো কলির মনে প্রবহমান উদ্বেগের
স্রোত। সুদূর মরুতে স্বামীকে নিয়ে অশুভ চিন্তার ছায়াটা মুছে যেতে লাগল।
আর যাহোক, সবকিছু মেনে নেবে সে। শুধু বেঁচে আছে, এটাই মূল খবর। এই খবর জানা হয়ে
গেছে। বাকি কিছু জানার তীব্র তাগিদও কমে আসতে লাগল।

কলিকে নীরব থাকতে দেখে জাফর আহমেদ বললেন, ‘আসল খবর জানানোর আগে বলতে চাই,
আপনার হাতে মোবাইল ফোন থাকা দরকার। তাহলে স্বামীর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে
পারবেন। প্রয়োজনে আমিও কাছে আসতে পারি আপনার।’

‘মোবাইল রাখার অনুমতি পাইনি।’ মুখ নিচু রেখেই জবাব দিলো কলি।
‘আমার একটা অতিরিক্ত সিম ও ফোনসেট আছে। রাখবেন আপাতত? সমস্যা কাটিয়ে ওঠার
জন্য আমার সঙ্গেও যোগাযোগ থাকাটাও জরুরি।’
‘সমস্যা কী তাইতো এখনো জানতে পারিনি। তবে মোবাইল ফোন হাতে থাকা প্রয়োজন। তবুও
আপনার ফোন নেওয়াটা ঠিক হবে কি?’

‘নৈতিক দিক থেকে ঠিক কথাই বলেছেন। ইউ আর রাইট। কিন্তু পরিস্থিতির ধাক্কায় ভেঙে
পড়তে পারেন। সেই সময় আমার মতো কেউ পাশে থাকলে খারাপ পরিস্থিতিটা কাটিয়ে উঠতে
পারবেন।’
‘কী খারাপ পরিস্থিতি? বলবেন প্লিজ!’

‘মন শক্ত করে শুনুন। ধনাঢ্য আমিরের ছোটো মেয়েকে বিয়ে করেছেন রুস্তম! এমন কথা শুনেছি
আমরা।’
কেউ যেন কালসাপের বিষ ঢেলে দিলো কলির কানে। চোখের আলো নিভে গেল তার। বুকের মধ্যে
পুষে রাখা ভালোবাসার পাপড়িগুলো পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে উড়তে লাগল বাতাসে।
জাফর আহমেদ চেয়ার থেকে উঠে এসে কলির পাশে দাঁড়ালেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘আপনার পাশে আছি আমি। প্লিজ শক্ত হন।’

মাথায় রাখা হাত সরিয়ে দিয়ে কলি বলল, ‘আপনার চেয়ারে গিয়ে বসুন। মমতা জানাচ্ছেন। মানুষ
হিসেবে ভালোই বলব আপনাকে। গায়ে হাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’
‘গায়ে হাত নয়, মাথায় হাত দিচ্ছি। এ হাত সহমর্মিতার। সহানুভূতি নয়।’
‘সহানুভূতি কিংবা সহমর্মিতার প্রয়োজন নেই। ভেসে যাইনি আমি। স্বামী বিয়ে করেছে ধনাঢ্য
আমিরের মেয়েকে। এটা আনন্দের খবর। রুস্তমের সে যোগ্যতা আছে ভেবে গৌরববোধ করছি।’

ভেঙে না পড়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কলির ক্ষমতা দেখে কিছুটা স্তব্ধ হয়ে নিজের চেয়ারে
গিয়ে বসলেন জাফর আহমেদ।কিশোরী বধূর মানসিক আঘাত সইবার শক্তি দেখে অবাক হলেন
জাফর আহমেদ। গোপনে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের সংবাদ যে-কোনো স্ত্রীর জীবনেই সবচেয়ে মর্মান্তিক
সংবাদ। কলির চোখ বেয়ে আকস্মিক নেমে এলো জলের ধারা। চোখের পানি মুছে বলল, ‘স্বামীর
সঙ্গে কথা বলা দরকার। ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ। এই নিন। আমার মোবাইল ফোন থেকে কথা বলুন। নম্বর কি মুখস্থ আছে?’
‘আছে।’ বলেই ফোনসেট হাতে নিয়ে মুখস্থ নম্বর টিপে কল করল। লাইন কানেক্ট হলো না।

হতাশ হয়ে চেয়ে রইল জাফর আহমেদের চোখের দিকে। শূন্যচোখের ভেতরও জাফর আহমেদ
খুঁজতে লাগলেন নববধূর উদ্ভিন্ন যৌবনের আলো। ভিন্নমাত্রার আকর্ষণের সন্ধান পেল লোভী চোখ।
টের পেয়ে বললেন, ‘চোখের জল মুছে ফেলুন। প্রত্যাখ্যান না করে স্বামীর বিপদে পাশে থাকা
উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক।’
‘বিপদে মানে? বিয়ের সঙ্গে বিপদের কী সম্পর্ক?’ আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল রুস্তম।
‘প্রথম পক্ষের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ের কারণে রুস্তম সাহেবের বিপদও হতে পারে। জেলও
জুটতে পারে কপালে।’
‘না!’ আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো কলির কণ্ঠ থেকে।
‘না কী? এমন চিৎকার করলেন কেন?’
‘প্রথম কথা হচ্ছে, স্বামীর বিয়ের কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বিয়ে করলেও,
তার যেন জেল না হয়। আমার যা করণীয়, তা করব তার জন্য।’
‘আপনার করণীয় একটা আছে—দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন, এরকম একটা দরখাস্ত পাঠিয়ে
দেন।’
‘দরখাস্ত পাঠালে কি উপকার হবে?’
‘হ্যাঁ। উপকার হবে।’
‘কী উপকার?’

‘দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ হয়ে যাবে। বৈধ বিয়ে হলে আইন লঙ্ঘিত হয়েছে বলে ধরা হবে না। আইন লঙ্ঘিত
না হলে সাজাও মওকুফ হয়ে যাবে।’কলির প্রতি নিজের লোভ সামলে পরামর্শ দিলেন জাফর
আহমেদ।

এই উপদেশের পেছনে অসৎ কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না বোঝার ক্ষমতা নেই এই মুহূর্তে। কালো
মেঘে জীবনের সূর্য ঢেকে গেলেও মেঘ ফুঁড়ে রোদের আশায় কলি বলল, ‘প্রয়োজনে তাই করব।
দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিপত্র পাঠিয়ে দেবো।’

মুখে এ কথা বললেও বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরমার হতে লাগল। সেই কষ্টটা জাফর সাহেবকে
দেখানোর প্রয়োজনবোধ করল না। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এখন আসি।’

‘আমার অতিরিক্ত সেটটা নেবেন না? আপনার আলাদা একটা ফোনসেট থাকা জরুরি না। কী
বলেন?’
‘জরুরি। কিন্তু গোপনে অন্যের ফোন নেওয়া ঠিক হবে না।’

‘আপনার সুহৃদ ভেবে নিন আমাকে। বন্ধুও ভাবতে পারেন। মন খারাপ হলে শাশুড়ি থেকে
লুকিয়ে কথা বলতে পারবেন। রুস্তম সাহেবের কোনো খবর পেলেও জানাতে পারব! নিন এটা।’
বলতে বলতে মোবাইল ফোন ঠেসে ঢুকিয়ে দিলেন কলির হাতের মুঠোয়।

ঠিক জায়গায় ঢিল ছুড়েছেন জাফর আহমেদ। ‘রুস্তম সাহেবের কোনো খবর পেলে জানাতে
পারব?’ কথাটা বুকে গেঁথে গেল।

রুস্তমের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার ব্যাকুলতায় প্রত্যাখ্যান করতে পারল না জাফর আহমেদের এই
দাবি। মুঠোবন্দি ফোনসেট হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। ওয়েটিং রুমে শৌর্যকে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে বিস্মিত হলো কলি। ‘তুমি এখানে?’

জবাব না দিয়ে ভাবির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শৌর্য।

নির্বাক দেবরের দিকে তাকিয়ে কলি ভাবল, ফোনসেট নেওয়ার কথা কি শুনে ফেলেছে শৌর্য! মনে
হলো কাঠুরিয়ার কুড়ালের আঘাতে গাছের বাকলের মতো খুলে যাচ্ছে নিজের দেহের ত্বক।
নদীভাঙনের মতো ঝুপঝাপ ভেঙে পড়তে লাগল তার দেহ, মন, সবকিছু। স্বামীর প্রকৃত খবর
পাওয়ার আশায় ফোনসেট নিয়েছে সে। তবু দেবরের সামনে নিজেকে ছোটো মনে হতে লাগল।
অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘তোমার ভাইজান আরেকটা বিয়ে করেছেন দুবাইয়ে।’

জ্বলে ওঠা অবুঝ কিশোর মরিয়া হয়ে বলল, ‘মিথ্যে কথা! ভাইজান কক্ষনো অন্য মেয়েকে বিয়ে
করতে পারেন না।’
শৌর্যের কথায় জ্বলে ওঠা বিশ্বাসের আঁচ লাগল কলির মুখেও। কথার ফাঁকে হাতের মুঠোফোন
লুকোতে লুকোতে প্রশ্ন করল, ‘এতবড়ো বিশ্বাস পেলে কীভাবে তুমি?’
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শৌর্য বলল, ‘বাসায় চলো। কাকিমা তোমার খোঁজে দিশেহারা হয়ে গেছেন।’
‘আর কেউ দিশেহারা হয়নি?’
চোখ তুলে কলির মুখের দিকে তাকিয়ে শৌর্য জবাব দিলো, ‘হয়েছে।’
‘কে?’

এ প্রশ্নেরও জবাব না দিয়ে বলল, ‘চলো। কথা বাড়িয়ো না। কাকিমার ওপর রাগ করে একাকী
এসেছ স্বামীর খোঁজ নিতে। ভালোকথা। আমাকে দেখেও কথা না বলে একা এলে কেন? তুমি
বললে আমি কি সঙ্গে আসতাম না?’

সম্পর্কের দাবি নিয়ে শৌর্য কথা বললেও মন গলে না কলির। পুরোনো অভিমানটা জেগে উঠে
মুহূর্তেই নিভে যায় আবার। জাফর আহমেদের কাছ থেকে ফোনসেট নেওয়ায় অপরাধবোধ
জাগে মনে।
‘তুমি আমার কে? কেন সঙ্গে আনব তোমায়?’
হঠাৎ প্রশ্ন করেই অফিস থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায় কলি।

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব কথা শুনেছেন জাফর আহমেদ। বাইরে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
শৌর্যের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি কে?’
আচমকা প্রশ্ন শুনে লোকটার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে নিজেকে সংযত রেখে গম্ভীর স্বরে
জবাব দেয় শৌর্য, ‘এই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। আমার নাম শৌর্য।’
উত্তর শুনে চমকে উঠলেন জাফর আহমেদও। সংযত হয়ে আবার প্রশ্ন করলেন,
‘কলির সঙ্গে সম্পর্ক কী তোমার?’

প্রশ্নটা শুনেছে রুম থেকে বেরোনোর সময়। উত্তর দেওয়ার সময় পেল না আর। ভাবির
পেছন পেছন ছুটে এসে দেখল, রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করেছে দ্রুতপায়ে। রাস্তায় চলমান
মানুষজন, রিকশারোহী সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে বোরকা পরা দ্রুত ধাবমান মেয়েটিকে। দৌড়ে
পাশে গিয়ে শৌর্য বলল, ‘শোনো, ভাবি। কষ্ট পেয়ো না।
আমি আবারও বলছি, রুস্তম ভাইজান অন্য কোনো মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারেন না।’

দেবরের কথার জোর দেখে অন্ধকারে ডুবতে বসা কলি আবার স্পর্শ পেল আশার আলোর। তার
হাঁটার গতি কমে গেল। অপরাধবোধ আর রোষ মিলেমিশে ভিন্নমাত্রার আবেগের ঘূর্ণি তৈরি হলো।
চাপ কমে গেল মনের।
দেখল, সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে মায়ার বীজ। এই বীজ থেকে ফুল ফুটবে? শস্যে ভরে উঠবে
জীবন? কোন বৃক্ষের অঙ্কুরোদ্গম ঘটবে? বয়সে কচি হলেও নাঙ্গা তলোয়ারের মতো
ঝকঝকে জীবনবোধের আলোয় ভরা শৌর্যের মুখ। সেদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ভাইয়ের
সততা আর বিশ্বস্ততার ব্যাপারে এত নিশ্চিত হলে
কীভাবে?’

অবুঝ কিশোর বরফগলা নদীর স্রোতের চলমান উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘ভাবি, তুমি নিজেই জানো
না কত সুন্দর আর কীরকম মিষ্টি মেয়ে তুমি! এত মিষ্টি বউকে রেখে কি বিদেশিনির মালা গলায়
পরতে পারে কেউ! পারে না। পারবেও না। নিশ্চিত থাকো, প্লিজ।’

চকিতে যেন সব আঁধার মিলিয়ে গেল। প্রত্যয়ের আলোর ধাঁধায়। এই আলোর উৎস রুস্তমের
প্রতি বিশ্বাস নয়। উৎসমুখ হচ্ছে নিজের রূপলাবণ্য, সৌন্দর্য যা শৌর্যের কথার জোয়ারে ভেসে
কলির মনের মন্দিরে জমা হলো। নিজের বুকের ভেতরটা পূর্ণ হলো অদৃশ্য রত্নমালায়। এরই
মধ্যে কলির হাঁটার গতি স্বাভাবিক হয়ে গেল।
শৌর্যকে বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাকে।’
‘আমাকে ধন্যবাদ জানানোর কী আছে, ভাবি?’
‘তোমার কথা শুনে বুকের আগুন নিভে গেছে, ভালো লাগছে এখন। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করলাম। নিজের ইচ্ছায় নয়, মনে হচ্ছে কেউ করিয়ে নিয়েছে ভেতর থেকে।’
‘কে করালো?’
‘তা তো জানি না।’
‘তুমি খুব অদ্ভুত, ভাবি। অদ্ভুত কথা বলো মাঝে মাঝে!’
‘আমি বলি না। কেউ বলায় আমাকে দিয়ে। কে বলায়। বুঝতে পারি না।’
‘কে বলায় বুঝতে পারো না, ভাবি?’
‘খুঁজে দেখিনি। খুঁজব এখন।’
‘আচ্ছা খোঁজো। আর কখনো এমন কাজ কোরো না। ভাইজানের খবর নিতে হলে আমায়
নিয়ে এসো সঙ্গে। মনে থাকবে?’

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম তিনটি─ এতবড়ো বিশ্বাস পেলে
কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল—আর কেউ দিশেহারা হয়নি? এ
প্রশ্নের উত্তর পাইনি। রাগের মাথায় তৃতীয় প্রশ্ন ছিল—তুমি আমার কে? এটিরও জবাব
মেলেনি। উত্তরগুলো দেবে এখন?’

‘আবারও বোকার মতো প্রশ্ন করলে। একা উপজেলা পরিষদে এসেছ, বুঝতে পেরে আমি
কি স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে ছুটে আসিনি? আর কে দিশেহারা হলো বোঝোনি?’
‘বুঝেছি।’
‘তো! প্রশ্ন করলে কেন?’
‘কিছু কিছু বিষয়ে উত্তর জানার পরও বারবার শুনতে ভালো লাগে। এখনো ভালো লাগল
জানা উত্তরটা শুনেই!’
‘তোমার ভালোলাগার জন্য ছুটে আসিনি। আমার টেনশন কমাতেই দৌড়ে এসেছি বাড়ি
থেকে।’
‘এ দৌড় তো তোমার জন্য দাওনি, আমার জন্যই দিয়েছ, তাই না?’
‘জানি না।’
‘থাক। জানার দরকার নেই। এবার তৃতীয় প্রশ্নের জবাবটাও দাও।’

‘এটা একটা প্রশ্ন হলো, ভাবি? তখন রাগের মাথায় করেছ প্রশ্নটি। ওই মুহূর্তে কষ্ট পেলেও,
এখন আর কষ্ট নেই। তোমাকে সহজ হতে দেখে মাথা থেকে উড়ে গেছে খারাপ লাগাটুকু।
আমি তোমার কে? এই সহজ প্রশ্ন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না-করাই ভালো।’

‘ঘাঁটাঘাঁটি করলে কী হবে?’

‘কঠিন উত্তর বেরিয়ে আসবে। সেই উত্তর সামাল দেওয়ার শক্তি তোমার থাকবে হয়তো।
আমার নাও থাকতে পারে। ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যেতে পারি। তাই বন্ধু ভাবো আমাকে,
খেলার সাথিও ভাবতে পারো। কেবলই চাচাতো দেবর ভেবো না। প্লিজ।’

উত্তর শুনে ভেতরের ঘূর্ণি সামলে কলি তাকাল আকাশপানে। সূর্য এখনো পূর্ব দিগন্তের
সীমানা অতিক্রম করেনি। কড়া রোদের উত্তাপে দূর আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের ঢেউ
বিলীন হয়ে যায়নি। শীতের পরশ আর নরম রোদের ছোঁয়া বুকে বরণ করে এখনো চকচক
করছে আকাশে স্থির সাদা মেঘ। নিজের বুকেও জমাটবদ্ধ মেঘের কোলে রোদের পরশ
পেল। উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর আলোয় প্রতিফলিত সাদা মেঘের বুনোট টের পেল
চৈতন্যবিহীন আকাক্সক্ষার নবধারা। দুজনের ইচ্ছা একত্রে গেঁথেছে গোপন সুতোর মালা।
ছড়িয়ে গেছে নবধারা জলে। এ জল গড়াবে কোন মোহনায়! জানে না তারা।

প্রসঙ্গ পালটে কলি বলল, ‘দেখছ, কী সুন্দর কচিঘাস মাড়িয়ে যাচ্ছি আমরা।’
‘দেখছি।’
‘খারাপ লাগছে না!’
‘না। খারাপ লাগার অনুভূতিও জাগছে না।’
‘আমার খারাপ লাগছে।’
‘কেন?’
‘মনে হচ্ছে, তোমার ভাইজান আমার বুকের গালিচায় গজানো কচিচারা পায়ে দলে ছুটছে
নতুন চারার সন্ধানে।’
‘কতদূর যাবে। সামনে এগিয়ে দেখবে মরীচিকা—ধু-ধু বালুচর। ফিরে আসতেই হবে তাকে।
আসতে বাধ্য।’
‘না এলে কী হবে?’
‘নতুন গালিচা আবার হেসে উঠবে সবুজ রঙে। সবুজে সবুজে ভরে উঠবে নতুন জীবন।’
‘ও জীবন চাই না আমি।’

চাওয়ার দরকার নেই। আপনা-আপনি সামনে এসে দাঁড়াবে নতুন পথ। কখন হেঁটে যাবে
সেই পথ ধরে, টেরই পাবে না, ভাবি।’

‘সত্যি বলছ?’
‘হ্যাঁ। সত্যি।’
‘তাহলে আসল সত্যটা জানাওনি কেন আমাকে?’
‘আসল সত্য মানে?’
‘মানে সহজ। জাফর আহমেদের ফোন নম্বর স্টোর করা শিখিয়ে দিয়েছিলে তোমার
কাকিমাকে! কেন লুকোলে আমার কাছে?’
‘কী বলছ? আমি কোনো নম্বর স্টোর করিনি! শিখিয়েও দিইনি।’
‘শাশুড়ি কি তাহলে মিথ্যা বলেছেন?’


‘অবশ্যই মিথ্যা বলেছেন। এ ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি।’
‘তোমার আব্বাজান যে উপজেলা অফিসে এসেছিল, জানতে না তুমি?’
‘না। জানতাম না তো!’
‘বাড়ির সবাই জানে রুস্তমের বিয়ের কথাটা। অথচ আমার কাছে লুকিয়েছে! তোমার
আব্বাও লুকোতে পারল!’

‘এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছি না।   নিশ্চয়তা দিতে পারি তোমাকে—আব্বাজান
বিয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হলে অবশ্যই জানাত তোমাকে। আমার মনে হয় উড়োখবর
বলেই জানাননি তিনি।’

‘শাশুড়িই তোমার আব্বাজানকে পাঠিয়েছিলেন উপজেলা অফিসে। কীভাবে অবিশ্বাস
করি, বলো? বিয়ের খবর মিথ্যে হলে বেঁচে যেতাম। এখন বাঁচার সাধ কমে যাচ্ছে। আকাশ
ভেঙে পড়েছে মাথায়। কল্পনায় অবিশ্বাস করলে চলবে? আবেগে ডুবে থাকার কারণে
বাস্তবের চোখ খুলে দিয়েছেন শাশুড়ি, আতর আলি চাচাজান, এমনকি জাফর আহমেদও।
কেবল তুমিই পাশে দাঁড়িয়েছ সাহসের সঙ্গে। আমার মনের জোর
বাড়ানোর চেষ্টা করছ। তোমার ঋণশোধ করব কী দিয়ে?’

‘বুঝেছি এখন। এখানে আসার সময় কেন অপরিচিত মহিলার মতো আমার সামনে দিয়ে চলে
গেছ। কী অভিমানে এমনটি করেছ, এখন বুঝতে পারলাম। আমাকে বিশ্বাস করো। আমার
ওপর অভিমান কোরো না। আমি নিশ্চিত, রুস্তম ভাইজান বিয়ে করেননি। বিশ্বাস করো।’

শৌর্যের কথা শুনে অচেনা অভিমান একেবারেই মুছে গেল। বন্ধুর মতো তাকে পাশে পেয়ে বলল,
‘তোমার মনের জোরই এখন আমার জোর। তোমার-আমার ইচ্ছা একাকার হয়ে থাকুক। এটাই
চাই এখন।’

‘ভাবি, এত সাহসী হলে কীভাবে? একাকী কেন এলে উপজেলা পরিষদ অফিসে? যদি কোনো
বিপদ হতো তোমার?’

‘কী বিপদ?’ যে কাজটি আমার করা উচিত, জাফর আহমেদের মতে, আরেক বিয়ের
অনুমতিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া। তাহলে তোমার ভাইজানের বিপদ ঘটবে না। জেল হবে না।
আমার স্বামী জেলে থাকবে, ভাবতে চাই না।’

‘ভাবি! কী বলছ এসব!’
‘এটাই সত্যি। সত্য মোকাবিলায় পাশে থাকবে না?’
‘কী করতে হবে আমাকে। তোমার আদেশ জীবন দিয়ে হলেও পালন করব।’

‘একটা অনুমতিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া জরুরি। বাসায় ঠিকানা আছে। কখনো চিঠি লিখিনি।
আজ একটি অনুমতিপত্র লিখব। রুস্তমের আবার বিয়ের অনুমতিপত্র। তুমি পাঠিয়ে দেবে।
ঠিক আছে?’

ভাবির কথা শুনে শৌর্য অবাক  হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’

কথা বলতে বলতে কলি নিশ্চিত হলো জাফর আহমেদের দেওয়া মোবাইল ফোনসেটের কথা
শৌর্য জানে না। স্বস্তি পেল কিছুটা।


‘এই যে, একা পুরুষমানুষের চেম্বারে ঢুকে গেলে?’
‘বিপদ তো হয়নি।’
‘হতেও তো পারত!’
‘জানি না। জাফর আহমেদ কী বলল, শোনোনি।’
‘না। শুনিনি। যখন তুমি বেরোলে, ঠিক তখনই ওয়েটিং রুমে ঢুকেছিলাম আমি।’
‘ওঃ! তাহলে তো উনার উপদেশ শুনতে পাওনি।’
‘না।’
‘এক বউ থাকলে আরেকটা বিয়ে করতে প্রথম বউয়ের অনুমতি লাগে। না হলে জেল খাটতে হয়।
আমি চাই না রুস্তম জেল খাটুক।’
‘বলো কি? সত্যিই বিয়ে করেছেন তিনি?’

‘তেমনই শুনলাম। যে কাজটি আমার করা উচিত, জাফর আহমেদের মতে, আরেক বিয়ের
অনুমতিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া। তাহলে তোমার ভাইজানের বিপদ ঘটবে না। জেল হবে না।
আমার স্বামী জেলে থাকবে, ভাবতে চাই না।’
‘ভাবি! কী বলছ এসব!’
‘এটাই সত্যি। সত্য মোকাবিলায় পাশে থাকবে না?’
‘কী করতে হবে আমাকে। তোমার আদেশ জীবন দিয়ে হলেও পালন করব।’

‘একটা অনুমতিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া জরুরি। বাসায় ঠিকানা আছে। কখনো চিঠি লিখিনি।
আজ একটি অনুমতিপত্র লিখব। রুস্তমের আবার বিয়ের অনুমতিপত্র। তুমি পাঠিয়ে দেবে।
ঠিক আছে?’

ভাবির কথা শুনে শৌর্য অবাক  হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’

কথা বলতে বলতে কলি নিশ্চিত হলো জাফর আহমেদের দেওয়া মোবাইল ফোনসেটের কথা
শৌর্য জানে না। স্বস্তি পেল কিছুটা।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব তেরোউপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব পনেরো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *