উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব নয়

‘চুপ করে থাকলে চলবে না। কথার নড়চড় হতে দেবো না। অবাধ্য হলে বিপদে কেবল আপনিই পড়বেন না, আমারও শাস্তি হবে। শাস্তি হিসেবে জানালা-দরজাবিহীন ওমেন্সরুমে সিলগালা করে মৃত্যু পর্যন্ত আটকে রাখা হবে। চিৎকার কিংবা কান্না যেন বাইরে যেতে না পারে, তেমন একটি রুমে বিশেষ ফুটোর মধ্য দিয়ে খাবার দেওয়া হবে, বিশেষ সময়ে। অন্য সময় ফুটো বন্ধ করে রাখবে। ফ্লোরে বিশেষ ফুটো তৈরি করবে মলমূত্র ত্যাগের জন্য। এমন নির্মম-পাষাণ দেয়ালের মধ্যে আটকে রেখে শেষ করে দেওয়া হয় ব্যভিচারিণী নারীদের, জানা আছে আপনার? জানা নেই। সহস্র নারী নিজেদের ভুল কিংবা পাপের শাস্তি পেয়ে যান ইহজগতে। এমন নির্মম শিকলে কেন আপনাকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছি, শোনার চেষ্টা করবেন না ? শুনবেন না আমার দ্বিতীয় শর্তটি কী? এক সপ্তাহ পর আবার কল পাবেন আপনি। অনুমোদনও পেয়ে যাবেন ভেতরে ঢোকার। ওইদিন আপনার পাসপোর্টটা নিয়ে আসবেন। বিশেষ প্রয়োজন আছে। এটা হচ্ছে আমার দ্বিতীয় শর্ত।’

ঝোড়ো কথাগুলোর মধ্যে আছে বিষাদের ঘনঘটা। কালো মেঘের শরীর ভেঙে উষ্ণ বৃষ্টি এসে আচ্ছন্ন্ন করে দিলো রুস্তমকে। পাসপোর্টে কী দেখতে চায় এই অপ্সরী ? জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। হ্যাঁ-বোধক সায় দিলো কেবল।

‘আর শুনুন, আসার আগে গোসল করে আসবেন। আজ থেকে প্রতিদিন খাওয়ার পর এবং শোয়ার আগে ওরাল ওয়াশ নেবেন, টুথ ব্রাশ করবেন। মুখের হাইজিন রাখতে যে জানে না, সে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে গর্দভ শ্রেণির মানুষ। নারীদের কাছে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জানেন?’

রুস্তম বলল, ‘এখন জানলাম।’

‘জেনে ভালো করেছেন। জীবনচর্যায় বিষয়টি ভুলে থাকলে চলবে না।’

‘ভুলে যাব না। মনে রাখব। তবে বিষয়টি কেবলই কি পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য, নারীদের জন্য নয়?’

‘হ্যাঁ। নারীদের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন, নারীরা তা জানে। পুরুষরা জানে না।’

‘ওঃ!’ ভাবল, বধূকলি কি জানে বিষয়টি? মনে হয় জানে। ওর মুখ থেকে সুঘ্রাণ ছাড়া কখনো দুর্গন্ধ পাওয়া যায়নি। ভেবে বলল, ‘ঠিকই বলেছেন, মেয়েরা সব জানে।’

কলি জবাব দিলো, ‘নতুন বোধের জন্য ধন্যবাদ। এখন বলুন, বেডের ওপর বসবেন, নাকি বাথরুমের সার্কিট ঠিক করবেন?’

‘সার্কিট কি সত্যি সত্যিই নষ্ট?’

‘অবশ্যই নষ্ট। না হলে কি বেডরুমে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যেত?’

‘কেউ কি যাচাই করে দেখে গেছে? নষ্ট বলে সার্টিফাই করেছে?’

‘হ্যাঁ। অন্দরমহলে নারী সিকিউরিটি রয়েছে। সরেজমিনে দেখেশুনে তারা রিপোর্ট পাঠিয়েছে। সার্কিট ঠিক হলো কি না, আবার এসে দেখবে।’

বাথরুমের দিকে এগোনোর আগে পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে একবার তাকাল শোয়ার জন্য নির্ধারিত খাটের দিকে। খাট না বলে এটাকে ছোটোখাটো একটা টেনিস কোর্ট বললে ভুল হবে না। এত সুন্দর খাট! বেডকাভার, বালিশ, মাথার দিকে ঝোলানো এত সুন্দর পর্দা! এর আগে দেখার সৌভাগ্য হয়নি রুস্তমের। মুহূর্তে চোখ ভরে নিল সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্রের প্রতিটি অণু। তারপর এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে।

সত্যি সত্যিই বাল্ব জ্বলছে না। নতুন বাল্ব লাগিয়েও জ্বালানো যায়নি।

কোথায় সমস্যা? সুইচবোর্ড খোলার জন্য বোর্ডের দিকে এগোতে গিয়ে নজরে এলো পুরো বাথরুমের দৃশ্য :

রুমের শাওয়ার জোন থেকে ড্রাই জোনের দূরত্ব কল্পনাতীত বেশি। ড্রাই জোনে দেয়ালজুড়ে বসানো রয়েছে বড়ো আয়না। ফলে শ্বাসবদ্ধ অনুভব থাকার সুযোগ নেই, স্পেসটি এমনিতে বড়ো। আয়নার কারণে আরও বেশি এক্সটেনডেড মনে হচ্ছে। এমন পরিবেশে ড্রেস চেঞ্জ করাও সুবিধাজনক, বুঝতে অসুবিধা হলো না। শাওয়ার জোন আলাদা করার জন্য সলিড ওয়াল পার্টিশন নেই। হিঞ্জডডোরে ফাইবার গ্লাস ব্যবহারের ফলে আভিজাত্যের উগ্রতা নেই, আছে শান্তসৌম্য মন সঁপে দেওয়ার মতো নির্মল ঘরোয়া আকর্ষণ।

বাথরুম দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলেও শঙ্কা কাটল না। ‘লাইট সংযোগ ঠিক করতে পারব তো?’ এমনি একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন গেঁথে আছে করোটিতে। প্রশ্ন ঠুকে থাকার কারণ হচ্ছে বৈদ্যুতিক ত্রুটি শর্ট সার্কিটের জন্য ঘটেনি, উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ সংযোগে গোলযোগ তৈরি করলে সেই ত্রুটি সারাতে অনেক বেশি সময় লাগার কথা। সমস্যা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকার কথা। ভাবনার চাকা ঘুরতে থাকার কারণে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যাচ্ছে না রুস্তমের চেহারায়। টের পেয়ে কলি বলল, ‘বাথরুমে কেউ নজরদারি করতে গোপনে ফাঁদ পেতে নেই। ইজি হন। কাজে ব্যর্থ হবেন না, নিশ্চিত থাকুন।’

‘ব্যর্থ হব না, কীভাবে বুঝলেন?’

‘কারণ, লাইনটি ডিসকানেক্ট করেছি আমি। সংযোগটাও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কানেক্ট করে দেবো আমিই। ব্যর্থতার সম্ভাবনা জিরো। আমার স্বার্থেই সফল হতে হবে। সফল দেখতে চাই আপনাকে।’

‘আমার সফলতা দেখে আপনার কী লাভ?’

‘কী লাভ, শোনার প্রয়োজন নেই। তবে শুনে রাখুন, আমি হচ্ছি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের মালিক। সুইসব্যাংকে প্রতিমাসে আমার নামে কত দিরহাম বা ডলার জমা হচ্ছে, জানি না। বিভিন্ন ব্যাবসা থেকে লাভের বিশাল অঙ্ক অটোমেটিক ঢুকে যায় ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে-এর পাসওয়ার্ড কেবল আমারই জানা। আমার সিগনেচারে পরিচালিত হয় অ্যাকাউন্ট। আমার ধনবান বাবা তার সব সন্তানের জন্য এই ব্যবস্থা করেছেন।’

‘এতসব শোনাচ্ছেন কেন? লোভ দেখাচ্ছেন? অসৎ কোনো কাজ করাতে প্ররোচিত করছেন আমাকে?’

‘সৎকাজের লোকের অভাব আছে?’

পালটা প্রশ্ন শুনে ভয় পেয়ে গেল রুস্তম। অসৎ কাজ করা মানে আইন লঙ্ঘন করা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এই দীক্ষায় বটবৃক্ষের বীজ রোপিত হয়ে গেছে বুকের মাটিতে। সেই বটগাছের ছায়া দখল করে আছে নববধূ কলি। দুবাই-কলির জায়গা কোথায় সৎ ছায়ায়? অসৎ ছায়া পড়ুক নিজ জীবনে, চায় না সে। তবে দেশের কলি যদি অসৎ হয়, শৌর্যের সঙ্গে যদি সত্যি সত্যি জড়িয়ে যায়, শূন্য ছায়ায় কি বসবে দুবাই-কলি? তেমন কোনো চিন্তা কি স্থান দেওয়া উচিত কল্পনায়?

উদিত চিন্তার উদ্গিরণে বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নিজেকে প্রশ্ন করল, ‘লোভী হয়ে যাচ্ছি আমি?’

মানুষকে ডোবায় লোভ, জানে রুস্তম। অপ্সরী কলির বেপরোয়া আচরণের মূল উদ্দেশ্য কী, এখনো খোলাসা হয়নি। রহস্যের ঘূর্ণি ক্রমশ বাড়ছে। আদিরস যে মূল বিষয় নয়, এখনো শিয়োর হতে পারছে না। এই মেয়ের আচরণের মূল শিকড় কোথায়? এত দুঃসাহসী হলো কেন সে? নানা প্রশ্নের ঝড় আবারও বেগবান হচ্ছে। ঝড় মাথায় নিয়ে শান্ত গলায় জানতে চাইল, ‘আর কতক্ষণ থাকতে হবে ? আর কী কী করতে হবে আমাকে?’

‘যতক্ষণ রাখব, ততক্ষণ থাকবেন, অসুবিধা আছে?’

‘আছে। আপনার ঘরে এতটা সময় কেন কাটালাম, জবাবদিহি করতে হবে না?’

‘কতক্ষণ কাটালেন, খোঁজ রাখবে না কেউ।’

‘কখন ঢুকলাম, কখন বের হলাম, নোট থাকবে না গেটে?’

‘থাকবে। থাকুক। ক্ষতি নেই। নিশ্চিত সন্দেহ করবে না—অবৈধ কিছু ঘটবে, কল্পনায়ও স্থান দেবে না কেউ।’

‘কল্পনায় স্থান দেবে না কেন? আপনার কাজিন তো বাংলাদেশের আরেক রুস্তমের সঙ্গে ভেগে গেছে, বলেছিলেন। আগের অভিজ্ঞতা দিয়ে কেউ সন্দেহ করবে না বর্তমান রুস্তমের অন্য কোনো সংযোগের কথা?’

যুক্তিটি ফেলে দেওয়ার মতো না। জানে দুবাই-কলি, তবু বলল, ‘অন্য কোনো সংযোগ কী হতে পারে, অনুমান করতে পারছেন? প্রশ্ন করে খিলখিল করে হাসতে হাসতে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে টুকটাক কাজ করে সুইচ টিপ দিলো। বাথরুমের বাল্ব জ্বলে উঠল। দুবাই-কলি বলল, ‘দেখলেন তো! আপনি সফল। বাল্ব জ্বালাতে পেরেছেন। পারেননি?’

‘এখন আমি জ্বালাইনি। আপনি জ্বালিয়েছেন।’

‘আমি যা জ্বালাতে পারি মেয়ে হয়ে, ছেলে হয়ে পারেন না আপনি?’

‘ডিসকানেক্টেড সুইচবোর্ড দেখান। চেষ্টা করে দেখি, পারি কি না।’

‘গুড। এই তো লাইনে এসেছেন। ধরুন আমার দেহে একটা সার্কিট ব্রেক হয়েছে। ঠিক করতে পারবেন না সার্কিটটা?’

প্রশ্নের গভীরতা অনুভব করে কেঁপে উঠল রুস্তম। অস্বাভাবিক প্রশ্নের ধার অনুভব করে নতুন প্রশ্নের উদয় হলো, মেয়েটি সুস্থ তো? দুর্গের জীর্ণ কেল্লার মতো চুরচুর করে ভেঙে যেতে লাগল নিজের অহংকার। সততার দেয়ালে ফাটল টের পেল। ভেতরে ঘূর্ণমান লোভী দানবটি চাপ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। জ্যান্ত আকাক্সক্ষার গোপন ঘরে মশাল জ্বলে উঠল দপ করে। হঠাৎ মনে হলো মরে গেছে সে—যেন শ্মশানেও জ্বলন্ত বাঁশের খোঁচা খাচ্ছে নিজের শবদেহে।

নীরবতা ভেঙে দুবাই-কলি বলল, ‘আমার তৃষিত বুকে লুকিয়ে আছে বিষণ্নতা। অপঘাতে নিভে যেতে পারে চারপাশের আলো। আমার শতভুজ সত্তার পাপড়ি ঝরে যেতে পারে বিকশিত হওয়ার আগেই। এমন পরিস্থিতি হলে খুলে দেখবেন না দেহের সার্কিট? আলোকিত করবেন না অন্ধকার ঘর? অবৈধ পথে নয়, বৈধ পথে জীবনবাজি রেখে দাঁড়াবেন না পাশে?’

কলির প্রশ্ন শুনে, সমস্যার গভীরতা না বুঝেও থেমে গেল মনোজগতে বইতে থাকা উচ্ছৃঙ্খল ঝড়। খরস্রোতা খালে ভাঙতে বসা সাঁকোটি আবার দাঁড়িয়ে গেল আগের অবস্থানে, ফুঁসে ওঠা জল রূপ নিল শান্ত পুকুরে। উড়ে গেল মনের উঠোনে জমতে থাকা নির্লজ্জ ক্লেদ, জঞ্জাল। পরিচ্ছন্ন মনে সাহস নিয়ে বলল, ‘দাঁড়াব। বৈধ পথে জীবনবাজি রেখে দাঁড়াব পাশে।’

‘ধন্যবাদ। দেখেই বুঝেছিলাম, পাশে দাঁড়াবেন। তাই আপনার পাসপোর্টটি প্রয়োজন আমার। আশা করি, আগামী সপ্তাহে আবার আসবেন, পাসপোর্ট নিয়ে আসবেন। আসবেন তো? কী বলেন ? দ্বিতীয় শর্তটিও পূরণ করবেন তো?’

রুস্তম জবাব দিলো, ‘আসব। পূরণ করব।’

সায় দেওয়ার পর টের পেল বুকের ঘরে বটগাছের শীতল ছায়া আচমকা ‘নেই’ হয়ে গেছে। খরখরে রোদ্দুর জেগে উঠছে। ওই রোদ্দুরে কেউ বসে জিরাতে পারবে না, আশ্রয় নিতে পারবে না—আশ্রয়হীন হয়ে যাবে কি নিজেও? প্রশ্ন নিয়ে তাকাল বাল্বের দিকে। আলো ছড়াচ্ছে বাল্ব। আলো-ঝলমলে বাথরুমের শুকনো জোনের দেয়াল-আয়নায় পাশাপাশি ফুটে আছে রুস্তম আর দুবাই-কলি। চোখ নামিয়ে নিল আয়না থেকে। মনের মধ্যে নতুন ভাবনার মোচড় টের পেল- তার স্ত্রী কলি তাহলে দাঁড়াবে কোথায়? কোন ছায়ায়? শৌর্যকে ঘিরে কি নতুন ছায়ার আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে সে?

আবারও বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। ভেঙে যাচ্ছে বুক। ভাঙা বুক উঁচিয়ে চোখ সামলে দাঁড়িয়ে রইল আয়নার সামনে।

পাশাপাশি দুজনের প্রতিবিম্ব দেখে হেসে উঠল দুবাই-কলি। হাসির দাপট থেকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল লক্ষ কলির হাসি…

রুমের ভেতরে কেউ আসার সংকেত হচ্ছে। কে এলো এখন! দুই নারী কেয়ারটেকার তো এখানে আসার কথা না অনুমতি ছাড়া। তবে কি এসেছেন আম্মিজান? প্রশ্নটি ধড়ফড়িয়ে উঠল বুকের ঘরে। বাথরুমের ভেতর থেকে বেরিয়ে বাইরের করিডরের দিকে তাকাল কলি। দেখল লম্বা কেয়ারটেকার মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সিগন্যাল-সুইচ অন করে। কাছে গিয়ে কলি প্রশ্ন করল, ‘কী ? কেন এসেছেন?’

‘আম্মিজান আসবেন আপনার রুমে। জানাতে এলাম।’

‘জানাতে, নাকি সতর্ক করতে এসেছেন?’

‘দুটোই।’

‘অসতর্ক হওয়ার মতো কোনো কাজ হচ্ছে না ঘরে। সতর্ক হওয়ারও প্রয়োজন নেই। আম্মিজানের হাউজ গভর্নেসদের জানিয়ে দেন কথাটা। বুঝেছেন?’

‘জি। বুঝেছি।’

‘জানিয়ে দেন কথাটা।’

‘জানিয়ে দেবো।’

ফিরে যাওয়ার আগে দুবাই-কলি বলল, ‘যত ধরনের ফল দিয়ে ধনাঢ্য মেহমানদের আতিথেয়তা করা হয়, সব অ্যারেঞ্জ করে আনুন। লিভিংরুমের টেবিলে পরিবেশন করুন। আর সবচেয়ে উন্নত মানের খোরমা খেজুর দিতে ভুলবেন না।’ কথা শেষ করে রুস্তমের কাছে ফিরে এলো কলি।

রুস্তমের মনে ঝড় বইছিল। মনে হয়েছিল, ক্রাইম সিকিউরিটি দল ঢুকে পড়েছে অন্দরমহলে। এখনই তাকে ধরে নিয়ে গর্দান কাটবে কিংবা মাটিতে পুঁতে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ পাথর ছুড়ে ছুড়ে রক্তাক্ত করবে। নিভিয়ে দেবে জীবনপ্রদীপ। ধোঁয়াশাচ্ছন্ন চোখে দেখতে পেল যেন ভূত হয়ে ফিরে আসছে আবার দুবাই-কলি! আবার কি সার্কিট ব্রেক হয়েছে ? কার ঘরের বাতি? নাকি দুবাই-কলির দেহের সার্কিট? চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। চক্কর খেয়ে মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল রুস্তম।

অন্ধকার ফুঁড়ে ঠিক এই সময় ভেসে এলো দুবাই-কলির কণ্ঠস্বর, ‘ভয়ের কিছু নেই। আম্মিজান আসছেন। সন্দেহের বশে নয়। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের বিষয়ে খোঁজ নিতে আসছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলবেন হয়তো-বা, আসুন। লিভিংরুমে বসুন।’

কলির কথা শুনে ভুল ভেঙে গেল। এক ঝটকায় দূর হয়ে গেল ভূতুড়ে আবহ। তবে এবার মনে ঢুকল এক অজানা ভয়। ভীতকণ্ঠে বলল, ‘আমাকে কি কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে?’

‘প্রয়োজন হলে হবেন। পরীক্ষা দিতে ভয় পাচ্ছেন কেন? কোনো অপরাধ করেছেন? কলির হাতের আঙুল স্পর্শ করেছেন?’

ঢোক গিলে রুস্তম বলল, ‘না।’

‘তাহলে পরীক্ষা দেন। ফেল করবেন না। পরীক্ষা দিলেই জিতবেন। আপনার জিত মানে আমারও জিত। এ গ্রেডে পাস করবেন আপনি। আর তালগাছটা আমারই থাকবে।’

এবার রুস্তমের মনে হলো কাঁধে বন্দুক তাক করে ট্রিগারে আঙুল রেখে দাঁড়িয়ে আছে কলি। আদিজলে ভাসা তার উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য আহত রুস্তমের চিৎকার শোনা, রুস্তমকে রক্তাক্ত করে বিজয়োল্লাস করা।

ফলের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে রুস্তম। খাচ্ছে না কিছুই। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে একটা খোরমা খেজুর। কলি হাতে তুলে নিয়েছে কাটা নাশপাতি, লেবু। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রুস্তম। মনে পড়ে গেল নিজেদের বাড়ির জঙ্গলে শরবতি লেবুর কথা। দেশের কলিও কি শরবতি লেবু হয়ে শৌর্যের মনোরঞ্জন করছে ? এত ছোটো ছেলে কি শুষে নিতে পারবে শরবতি লেবুর তাজা রস ? নাকি দুবাই-কলির মতো ঝড়ের তাণ্ডব বুকে নিয়ে শৌর্যও দেশের কলির দিকে তাক করেছে গুলিভরা পিস্তল ? বুলেটের আঘাতে কি তবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে নববধূ কলির দেহ?

চমকে বাস্তবে ফিরে রুস্তম দেখল, দুবাই-কলি দ্রুত হাতে মাথায় পরে নিয়েছে স্কার্ফ। অর্থাৎ মায়ের সামনে কমে যাবে তার দুরন্তপনা। বুঝল রুস্তম।

ক্যালিগ্রাফি ফ্যাশনের আবায়ার আড়ালে কলির আম্মিজানের চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমব্রয়ডারি করা উজ্জ্বল রঙের আবায়ার ঐতিহ্যে ফ্লোরাল ও জিয়োম্যাট্রিক মোটিফের বৈচিত্র্যপূর্ণ ঝলক দেখে চট করে বসা থেকে উঠে সালাম দিলো রুস্তম। কলিও সালাম জানাল মাকে।

মেয়ের পাশের চেয়ারে বসে রুস্তমকে ইশারা করে আম্মিজান বললেন, ‘বসুন।’

কণ্ঠে যেন মধুমাখা! শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল রুস্তম। বেজে উঠল বুকের ভেতরের দোতারা। থেমে গেছে শঙ্কার ঝড়। পরম তৃপ্তি বুকে নিয়ে চেয়ারে বসল রুস্তম।

‘সার্কিটের ত্রুটি ধরতে পেরেছেন?’

‘জি?’

প্রশ্ন করেছেন এ প্রাসাদের মালকিন। জবাবে ‘হ্যাঁ’ বললে মিথ্যা বলা হবে, ‘না’ বললেও মিথ্যা বলা হবে।

‘বাথরুমের বাল্ব জ্বালাতে পেরেছেন?’ আবার প্রশ্ন করলেন এ বাড়ির মলকিন।

‘জি। জ্বলেছে।’ এবারও মিথ্যা জবাব দিলো না রুস্তম।

‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ! কলির বাথরুমের লাইট জ্বলছে না, শুনে চিন্তিত হয়েছিলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।’

লজ্জায় মাথা নত করে রাখল রুস্তম।

‘আপনার বাড়ি কি বাংলাদেশে?’

প্রশ্ন শুনে শক খেলো। দুবাই-কলির মাও জানে তার বাড়ির খবর!

উত্তর দেওয়ার আগে একবার তাকাল কলির মুখের দিকে। হাসছে কলি। রহস্য কী? মা-মেয়ে পেছনে লেগেছে কেন? উদ্দেশ্য কী তাদের? ঘূর্ণিঝড়ের মতো বুকের কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন তেড়ে আসার পরও সহজ হয়ে জবাব দিলো, ‘জি। বাংলাদেশে।’

‘বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ কৌতূহল আছে আমার। একবার সেখানে বেড়াতে যেতে হবে। আপনাকে সঙ্গে যেতে হবে, রাজি আছেন?’

খুশি হয়ে রুস্তম বলল, ‘অবশ্যই যাব।’

‘ধন্যবাদ আপনাকে।’

‘ধন্যবাদ জানিয়ে লজ্জিত করবেন না।’

‘বিয়ে করেছেন আপনি?’

‘জি। করেছি।’

মায়ের প্রশ্নের জবাবে রুস্তমের স্বাভাবিক উত্তর শুনে যেন আকাশে উড়ন্ত ডানা-ভাঙা পাখির মতো দপ করে পড়ে গেল কলি।

‘আপনার বউয়ের নাম কী?’ আবার প্রশ্ন করলেন আম্মিজান।

‘কলি।’

‘কী বললেন?’ বেশ জোরেই জিজ্ঞেস করলেন আম্মিজান।

শান্ত গলায় আবারও জবাব দিলো রুস্তম, ‘কলি।’

প্রথমবার ভুল শুনেছিলেন ভেবে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করেছেন। নিশ্চিত হয়ে চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

দুবাই-কলির মুখে আলো নিভে গিয়ে কালো মেঘে ঢেকে গেল আবার।

আম্মিজানের উঠে দাঁড়ানোর ফলাফল ভয়াবহ, জানে কলি। এমন বোকামি করল কেন রুস্তম? আকস্মিক জেগে ওঠা প্রশ্ন নিয়ে ভাবার সময় পেল না।

উত্তর দেওয়ার পর রুস্তমও হতভম্ব। বাক্-রুদ্ধ হয়ে গেল। কী ঘটতে যাচ্ছে বোঝার সুযোগই পেল না।

আম্মিজান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রুমে ঢুকে গেল অস্ত্রধারী দুজন নারী সিকিউরিটি গার্ড। পিছমোড়া করে রুস্তমের দুহাত বেঁধে মুখে লাগিয়ে দিলো পুরু টেপ। একবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কলি। ফল হলো উলটো। আম্মিজানের চোখের ইশারায় একজন সিকিউরিটি দেখিয়ে দিলো বেডরুমের দরজা। রুমের ভেতরে ঢোকার আগে মাথা ঘুরিয়ে দুবাই-কলি দেখল, কেবল রুস্তমকেই নয়, তার জন্য নির্ধারিত কেয়ারটেকার দুজনকেও বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে আর্মড নারী সিকিউরিটি গার্ড।

চিৎকার করে একবারমাত্র বলার সুযোগ পেল কলি, ‘আম্মিজান! নিশ্চয়ই কোথাও গলদ হয়েছে! নিশ্চয়ই বাংলাদেশি এই ভদ্রলোকের মাথায় গোলযোগ দেখা দিয়েছে। উনি একজন দক্ষ ও সৎ শ্রমিক। উনার ওপর কোনো অবিচার যেন না হয়।’

বাতাসে কেবলই মিলিয়ে গেল না চিৎকারটি, কথাগুলো ঢুকেছে রুস্তমের কানেও। আম্মিজানও শুনেছেন কলির হৃদয়বিদারী চিৎকার। নিজের পেটের সন্তানের কথাগুলো মিথ্যা মনে হলো না। সত্যিই মনে হলো। কিন্তু পরিস্থিতি আর তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। অন্দরমহলে সিকিউরিটি সংস্থা এখন যা করবে, তার ওপর মতামত নেওয়া হবে না অন্দরমহলের নারীদের।

রুস্তমের কি শিরছেদ ঘটবে ? জেলে যেতে হবে তাকে? নাকি দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে? ভেবে আকুল হলো কলি। স্বাধীন মতামত জানানোর সুযোগ কি পাবে সে? বেপরোয়া চিন্তায় ওলটপালট কাণ্ড ঘটিয়ে দিলো—আর্মড সিকিউরিটিকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে একছুটে বেরিয়ে আবারও চিৎকার করে বলল, ‘উনার পাসপোর্ট দেখুন। পাসপোর্টে স্পাউসের নাম থাকতে পারে। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য পাসপোর্ট দেখুন আম্মিজান। উনি মুসলমান।’

অপরাধসংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির আলোকে নিজের মেয়েও অভিযুক্ত হয়ে গেছে। অভিযুক্তের কোনো কথা শোনা হবে না এখন। তবু মেয়ের কথাগুলো মাথায় রাখলেন তিনি।

কলিকে বেডরুমে ঢুকিয়ে দরজা লক করে দেওয়া হয়েছে। নিজের মহলের বাদশাহ নামদার নিজের পাতানো জালে জড়িয়ে গেছে। ছটফট করছে। উদ্ধার পাওয়ার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। নিজের দেহতরঙ্গে আলো নিভে গেছে; দেহে জেগে উঠছে বিশৃঙ্খল ঢেউ। অজানা ঢেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সীমাহীন অন্ধকারে, অথই সাগরে। প্রতিবাদ করতে চাইল। চিৎকার করল বদ্ধরুমের ভেতর। প্রতিধ্বনি উলটো আঘাত করল বিপুল শক্তিতে। বিছানায় ধরাশায়ী হলো কলি।

পরিস্থিতি যথাযথ বিচার না করে দোষীকে ধরার জন্য সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছেন মহলের আম্মিজান। মায়ের পাঠানো সংকেতের গুরুত্ব অনেক বেশি। যাচাই না-করেই সংকেত পাঠিয়েছেন- বুঝতে পারেননি তিনি।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আটউপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব দশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *