অদ্বৈত মারুত: কাব্যাভায় দীপ্যমান।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক অদ্বৈত মারুত, প্রকৃত নাম জাহাঙ্গীর আলম, বয়সে তরুণ হলেও তাঁর কাব্যে ভাবের
অন্তর্গত গাম্ভীর্য, বাক্য বিন্যাস, শব্দ চয়ন ও নতুন শব্দের সন্নিবেশ, দেশজ সংস্কৃতির আবেশে সৃষ্টি  গভীরে
প্রবেশ করলে তরুণ বলে আর ধারণা করার কোনো কারণ  থাকে না; মনে হবে পরিপক্ক কবি সত্তা তাঁর মধ্যে
বিরাজমান। তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় অনেক অপ্রচলিত শব্দ যেগুলো তাঁর লেখাপড়ার সুবাদেই মজ্জাগত
হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।

তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত সাহিত্যে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন এবং দীর্ঘকাল
সংস্কৃতচর্চার  কারণে তাঁর কবিতায় অনেক সংস্কৃত শব্দে জড়িয়ে যায়। কখনো পাঠকের কাছে সংস্কৃত শব্দের
ব্যাখ্যার জন্য কিছুটা দুর্জ্ঞেয় মনে হলেও কবিতা পাঠের সাবলীলতার বিধ্বংসী নয়; বরং কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি
করে।

এজন্য কবিতা বোঝার চেয়ে পাঠের আনন্দই তাঁর কিছু কবিতায় বিরাজমান। কবিতা যেমন সাধণার ফসল ঠিক
তেমনই স্বীকার করতে হবে যে, কবিতা হৃদয় ও ভাবাবেগ সঞ্জাত স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধির সৃষ্টির। কবি অদ্বৈত
মারুতের কবিতা পাঠে সেই কবিতার রস ও মায়াবী আকর্ষণীয় আবেশে পাঠক আটকে যায়।  কখনো খুব
সাধারণ মানের কবিতা মনে হলেও উলব্ধির ব্যাখ্যাতে কবিতার আস্বাদন গভীরতা পাওয়া যায়। ফেসবুক,
পত্রপত্রিকা, অনলাইন পোর্টালসহ একটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে দৃঢ় প্রত্যয়ের  সঙ্গে বলা যায কবি মারুত জোর
করে জোড়াতালির অর্থহীন উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় ভারি করে লোহার পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে সাঁকো নির্মাণের মতো
কবিতা নির্মাণ করেন না; তার কবিতা সৃষ্টি  হয় ভাবাবেগ ও বুকের ভেতর থেকে সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত  শব্দের
বিন্যাসে। কোনো কবিতা পাঠ করলে মনে হয় কবি হাঁটতে হাঁটতেই তার দৃষ্টিতে দৃশ্যমান বস্তুর চিত্রকল্প তৈরি
করে কবিতা লিখছেন—একজন কবির সার্থক স্বরূপ হয়তো এখানেই।

মারুতের শিশুতোষ গল্প লেখার হাতও নিপুণ ও কৌশলী। তাঁর  শিশুতোষ গল্পপাঠে মনে হয় যেন শিশুর মনের
ভাষাই গল্পে টেনে এনেছেন যা শিশুসাহিত্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গল্প রচনায় নিপুণ ও কৌশলী হলেও
তাঁর সমগ্র সত্তায় কাব্যের জৌলুশই অধিক উদ্ভাসিক।

শিশুতোষ ছড়ায় ও কবিতার যে সড়কে তিনি হাঁটছেন সেই সড়ক খুব দ্রুতই প্রসারিত হয়ে আপন মহিমায়
মহাসড়কে পরিণত হবে তা জোর দিয়েই বলা যায়। সাহিত্যের ঊষালগ্নেই কবি নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে
রাখার সংগ্রামে কৌশলী এবং বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মতো মঞ্চে আসার  আগেই জুতসই প্রপসও বাছাই করে
নিয়েছেন।

তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, মার্ক টোয়েনসহ আরও অনেক জগদ্বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক পৈতৃক নাম পরিবর্তন
করে যেমন নিজেদের পছন্দ মতো নাম ধারণ করেছেন কবি আদ্বৈত মারুতও ঠিক তেমনই একটি
ব্যতিক্রমধর্মী নাম নিয়ে লেখালেখির প্রাঙ্গণে এসেছেন। এই নাম থেকেই কবির প্রস্তুতি সম্পর্কে ধারণা
পাওয়া যায়।

সিরাজগঞ্জ জেলায় ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করে পনেরো বছর বয়স থেকে অর্থাৎ গত শতাব্দীর
নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে লেখালেখি শুরু করে নিরন্তর লিখে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা
চৈাদ্দটি যেগুলোর মধ্যে  কাব্যগ্রন্থ তিনটি ’নিস্তরঙ্গের বীতস্বরে’ ’স্বর ভাঙার গান’ সদ্য প্রকাশ হয়েছে
’জল মাতালের মুখ’  এবং বাকি এগারোটি বই শিশুতোষ ছড়া ও গল্পের।

দৈনিক আমাদের সময়ের সাহিত্য সাময়িকী ছাড়াও একাধিক  বিভাগ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করে আসছেন
দীর্ঘদিন যাবৎ। ছড়াসাহিত্যে তাঁর বিশেষ আকর্ষণ থাকায় ‘পাঁপড়’ নামে একটি  ছড়া বিষয়ক ছোট কাগজও
সম্পাদনা করেন।

কবি মারুতের অগ্রন্থিত অনেক কবিতা ও ছড়া ফেসবুকের সুবাদে পড়ার সুযোগ হওয়াতে তাঁর শাণিত
কাব্যপ্রতিভার উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে। তার প্রথম ‘নিস্তরঙ্গের বীতস্বরে’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ারও সুযোগ
হয়েছে। মোট আটত্রিশটি কবিতা নিয়ে ক্ষুদ্র কলেবরের কাব্যগ্রন্থটিতে কবিতার জৌলুশে দীপ্যমান।
এই কাব্যগ্রন্থের  আবহ তৈরি হয়েছে বিষাদ, সমকালীন বিরূপ বাস্তবতা এবং  মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন,
বিরহ, অপ্রাপ্তি, নিঃসঙ্গতা ও নষ্টালজিয়ার দীর্ঘশ্বাসে। ‘ব্যক্তিগত ধূলিঝড়’ প্রথম কবিতায় মনস্তাত্ত্বিক সংকট,
নিঃসঙ্গতা ও টানাপোড়েনের বেদনাহত কবিকে ঋজু থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকার অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে।

আমার গন্তব্য পথে তখনও কোনো পথিক ছিল না
আমার গন্তব্য পথে তখনও কোনো প্রেমিক ছিল না
আমার গন্তব্য পথে তখনও নদীর ধারণা ছিল না
তখনও আমি ছিলাম একা শুধু একা সজারুর কাঁটার মতো টান!

কাব্যের শিরোনামের অর্থাৎ ‘নিস্তরঙ্গে বীতস্বরে’ কবিতায় কবির মনস্তাপের
উত্তাপ পাওয়া গেলেও এখানেও কবির দৃঢ়তার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে শেষ বাক্যে।

আর সেসবের শোক প্রস্তাব এলে নীল বৃষ্টি থেকে
কারো কারো হাতে দেখি অহল্যার ঘুরির লাটাই!
ফেরারিই ধরো রক্ত মাংসে আমার দীর্ঘপথে…
একাকী নাকি কোনো সন্তাপে থাকতে নেই!

এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় ফুটে উঠেছে বিমূর্ত পোর্টেট এবং কোনো কবিতায় রয়েছে বিষন্নতার মায়াবী
জড়ির বুনন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে কবিতার আমেজে পাঠককে চুম্বকের মতো ধরে রাখে কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি
কবিতা। এখানেই হয়তো কবিতা শিল্পের সার্থকতা।

 ‘মার্চ ২০০৯’ শিরোনামের ছোট্ট কবিতায় কবিকে ঘুরে দাঁড়াবার মন্ত্র দেখা যায়। কবিতার প্রথম  তিন চার স্তবকে
বিরহ-দহনের আটপৌরে ক্ষোভ প্রকাশ পেলেও শেষ দুটি চরণে কবিমনের বিদ্রোহের তেজ বিস্ফোরিত:

কান্নার শহর আর নয়
কাঁদছে কাঁদুক যাদের কাঁদার কিন্তু আঁধার আর নয়
পুড়ছে পুড়–ক যাদের পোড়ার কিন্তু রাধার ছাড় নয়

অদ্বৈত মারুতের ছড়ার হাতও পাকা যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।  এখানে কয়েকটি নমুনা দেওয়া হলো:
এই ছড়াংশটিতে একটি চিত্রকল্পও দেখা যায় যেখানে মনে হচ্ছে শিশুর সঙ্গে মা-বাবার কথোপকথন চলছে।
ছোট ছোট শব্দের ক্রাফটিংয়ে পুরো ছড়াটিতে রয়েছে দারুণ রসবোধ।

বাবা, বাত্তি
না, না, হাত্তি!
দেখো মেষদ
খেলো বেশ জল!
ওমা, পালকি!
পাশে খাল কী?

এই ছড়াটিতেও বিমূর্ত ভাবনার চেয়ে একটি বৃষ্টির দিনের চিত্রকল্প দেখতে পাই।

বৃষ্টি এলে জানলা মনের─
দিই খুলে একাকী
ঝাঁপটিয়ে জল পড়লে ঘরে
চুপটি করে থাকি।

নিচের ছড়ার খন্ডংশে মামা-ভাগ্নির মিষ্টি-মধুর সম্পর্কে অনাবিল সম্পর্কে চিত্র ফুটে উঠেছে। এই ছড়া পড়ে
মনে হয় বিষয় বা ভাবের জন্য হন্যে হয়ে ছোটার প্রয়োজন নেই। আমাদের চারপাশের ঘটনাকেই শব্দের রং
চড়িয়ে সাহিত্যের ক্যানভাসে পোর্টেট নির্মাণ করা যায়।

কাগজ-কলম পেলে
আলতো করে মেলে
রঙ দেবে সব ঢেলে।
নাম খুকিটার শামা
হই আমি ওর মামা পেশাগত জীবনে দায়িত্বশীল, কঠোর পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী সাহিত্যিক অদ্বৈত মারুত
সাহিত্যের নিরলস স্রষ্টা। সৃষ্টি করে যাচ্ছেন প্রতিদিন। তাঁর এই কর্ম একদিন বিশাল যজ্ঞে পরিণত হবে সেই
বিশ্বাস আমাদের করতেই হবেই।

One thought on “অদ্বৈত মারুত: কাব্যাভায় দীপ্যমান।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

  • এপ্রিল ২৫, ২০২১ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    সুন্দর। গভীর পর্যবেক্ষণ ও পাঠে খুব সমৃদ্ধ লেখা। পড়ে মুগ্ধ আমিও।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *