উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব দশ
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// এক
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// দুই
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// তিন
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিলো, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব চার
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// পাঁচ পর্ব
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।।পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব পনরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। শেষ পর্ব
সে জন্য ওর সহপাঠীদের সহযোগিতা পাওয়া প্রয়োজন হবে, আর ওর শিক্ষকদের সহমর্মিতারও প্রয়োজন হবে।
আলেয়া, তুমি কি উপমাটা বুঝতে পেরেছো?
আসাদ ততক্ষণে লক্ষ্য করল আলেয়া কাঁদছে। সমস্ত ক্লাস নীরব। আসাদও আর কোনো কথা বলতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে না ওকে কীভাবে শান্ত করবে।
ঠিক আছে। আলেয়া তুমি হেড স্যারের রুমে যাও। আমি ক্লাস শেষে সেখানে আসছি।
আলেয়া বেরিয়ে গেল। ওর কান্ড দেখে পুরো ক্লাস অবাক হয়ে গেছে। ওরা বুঝতে পারল না কী এমন ঘটল যে সে ক্লাসে বসে এমন কান্না জুড়ে দিল? কিন্তু ওরা এটা বুঝল যে, কোনো কারণে আলেয়ার মন খুব খারাপ। সেটা দেখে ওদের কারো কারো মন খারাপ হয়ে গেল। আর কেউ কেউ গ্রাম্য মেয়ের উপমার সাথে আলেয়াকে সাঁতার কাটতে না দেয়ার একটা ছবি মনে মনে আঁকতে আঁকতে কবিতাটা বুঝতে চেষ্টা করল।
আসাদ প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গেল। প্রধান শিক্ষক তাঁর কক্ষে একাই বসে ছিলেন। তিনি যেন কিছু একটা চিন্তায় মগ্ন।
স্যার, একজন ছাত্রীর বিষয়ে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।
কে?
আলেয়াকে একটু বোঝানো দরকার।
কেন, আবার কী হয়েছে?
নতুন করে কিছুই হয় নি। আমি যতটুকু বুঝতে পারি ওর জন্য আমাদের সকলের সহযোগিতা দরকার। মেয়েটার উপর দিয়ে একটা ধকল গেছে। এটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে, যদি সে মানসিক সাপোর্ট না পায় তাহলে ওর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়া আরো বিলম্বিত হতে পারে।
আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কী ভাবে সেটা করবো, বলুন।
আপনি ওকে সাহস দিন। আপনি ওর সঙ্গে আছেন এটা ওকে বুঝতে দিন। দেখবেন সে সামলে উঠবে। আলেয়ার এই পরিণতির জন্য ও দায়ী নয়─ ওর বিয়ে হয়েছে সামাজিকভাবে, এরকম আগেও অনেকেরই হয়েছে। তখন লেখাপড়ার সুযোগ কম ছিল, এখন সেটা আছে। মনের জোর থাকলে এখনো লেখাপড়া করে জীবনটাকে সে পাল্টে দিতে পারবে। একথা ওকে বলা দরকার।
আলেয়া দরোজায় দাঁড়িয়ে শুনছিল। সে প্রবেশ করে সালাম দিল এবং ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে রইল। প্রধান শিক্ষক ওকে বসতে বললেন। ও কুণ্ঠিতভাবে একটা চেয়ারে বসল।
আলেয়া, তোমার নতুন করে কোনো সমস্যা হয়েছে?
স্যার, আমার জন্য আপনি যা করলেন, সে ঋণ আমি কোনোভাবে শোধ করতে পারব না। আমার জীবনে যা ঘটে গেছে সে নিয়ে আমার আর কোনো কষ্ট নেই। আজ বাংলার স্যার যখন এদেশের মেয়েদের অবস্থাটা কবিতার ভেতর দিয়ে আমাদের বোঝাচ্ছিলেন তখন আমার ক্লাসের আর স্কুলের মেয়েদের মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আমার মনে হচ্ছিল, যে কোনো সময় ওদের কারো আমার মতো হঠাৎ পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা যে ছোটোবেলা থেকে বন্দীদশায় বড় হই সেটা আমরা আগে থেকে বুঝতে পারি না। আমরা আদর-যত্নে বড় হতে হতে পিতামাতাকে আপন জানি, কিন্তু সেই তারাই যখন আমাদের ভবিষ্যত না ভেবে আমাদের জীবনটাকে বুঝে উঠবার আগেই আরেকটা জেলখানায় পাঠিয়ে দেয় তখন আমরা বুঝতে পারি─ মেয়েদের আসলে কোথাও নিজের বলে কিছু নেই। বুঝতে পেরে কান্নাকাটিও করি। আমাদের অবস্থাটা তখন কেউ বুঝতেও চায় না। আর আমাদের অজ্ঞ মা-বাপ মনে করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় তাদের মায়ায় আমরা কাঁদছি। বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে কাঁদছি। কিন্তু তারা কেউ আমাদের ভেতরটা বুঝতে পারে না। আমরা যে একটা আরামদায়ক জেলখানা থেকে কঠিন জেলখানায় যাচ্ছি সেটাও তারা ভাবতে পারে না। তারা তখন আমাদের বিয়ে দেয়ার আনন্দে নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকে। আমার যখন বিয়ের কথা হলো, আমি তখন জানলাম আমার বাপের বাড়ি আমার বাড়ি নয়। সকলেই বলল বাপের বাড়ি নাকি মেয়েদের আসল বাড়ি নয়, শ্বশুরবাড়িই আসল বাড়ি। তখন আমার কাছে বাড়িটাকে জেলখানা মনে হচ্ছিল। যখন সেখান থেকে আমাকে আরেক বাড়িতে নিয়ে গেল সেটা দেখলাম আরো কঠিন জেলখানা। সেখানে আমি কথাও বলতে পারতাম না। স্বামী কী জিনিস সেটাও আমি জানতাম না। আমি স্বামীর অর্থ ডিকশনারিতে দেখলাম। স্বামী শব্দের অর্থ প্রভু বা মনিব এ কথা জানার পর আমি খুব কান্না করলাম। স্বামী মানে যে প্রভু সেটা আগে আমি জানব কেমন করে? আমি জানলাম, শ্বশুরবাড়িও আমার বাড়ি নয়। আসলে মেয়েদের নিজের বলে কিছু নেই, নিজের কোনো ঠিকানা নেই। আমি ভেবে দেখলাম, আমার দাদীরও নেই, মায়েরও নেই, আমার চাচী বা কারোই নেই। সবাই শ্বশুর বাড়িতে থাকে, শ্বশুর মারা গেলে স্বামীর বাড়িতে আর স্বামী মারা গেলে ছেলের বাড়িতে থাকে। আমি মাত্র কয়েকটা দিনেই বুঝতে পারলাম, আমরা, মেয়েরা কেউ আমাদের পায়ের অদৃশ্য শেকলটা দেখতে পাই না। কেউ আমাদের সেই শেকলটা দেখতে দেয় না। যে শেকল দেখা যায় সেটা খুলবার কথা মাথায় আসে, কিন্তু যেটা দেখা যায় না সেটা তো থেকেই যায়।
স্যার, আমার অনুরোধ, আপনারা সেই শেকলটা আমাদের মেয়েদের ভালো করে দেখিয়ে দিন। আমি বলবার আগেই বাংলার স্যার এটা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন, আমি তখন চোখের পানি সামলে রাখতে পারি নি।
প্রধান শিক্ষক আর আসাদ হতবাক, তাঁরা আলেয়ার এমন বক্তব্য আশা করেন নি। এ যে তাদের চেনা আলেয়া নয়। প্রধান শিক্ষক ভাবতে লাগলেন, কী করে ওর এমন পরিবর্তন আর সাহস হলো?
স্যার, আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি এখন থেকে মন দিয়ে পড়ালেখা করব।
আলেয়া উঠে এসে প্রথমে প্রধান শিক্ষক তারপর আসাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তার পর যেন কিছুই ঘটে নি এমন করে ক্লাসের দিকে চলে গেল। প্রধান শিক্ষক আসাদ করিমের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন।
আসাদ সাহেব, আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ স্যার আপনারই প্রাপ্য। আপনাকে ছাড়া যদি আর কাউকে দিতে হয় সে কনকচাঁপা। সে সাহস করে এগিয়ে এসে আমাদের জন্য কাজটা সহজ করে দিয়েছে।
আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা মেয়েদের বিষয়গুলো ঠিক বুঝতে পারি না। আমরা চিন্তা করি মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি পার করতে পারলেই আমাদের দায়িত্বপালন করা হয়ে গেল। কত অল্প বয়সে আমরা তাদের ঘাড়ে সংসারের কঠিন জোয়াল তুলে দেই। তাঁরা কীভাবে সারাটা জীবন কাটায় সেটা ভাবি না। মেয়ে সুখী না হলে বলি তাঁর দোষ, বড়জোড় বলি কপাল। অথচ ছেলেদের বেলায় ঠিকই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি। তাকে মানুষ করার জন্য, স্বাবলম্বী করার জন্য কত চেষ্টাই না করি। একটা ছেলেকে নিয়ে আমরা যতখানি ভাবি তার সামান্য ভাবনাও যদি মেয়েদের নিয়ে ভাবতাম তাহলে মেয়েদের জীবন এত কষ্টের হতো না। আমরা মেয়েদের অবস্থান থেকে কখনো বিষয়টা দেখি না। আর মেয়েরা ভুক্তভোগী বলে তারা প্রকৃত সমস্যা তাদের মতো করে বুঝতে পারে।
আপনি স্যার, ঠিকই বলেছেন। পিতা যদি তার সন্তানদের একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় না করতে পারে তাহলে মেয়ে সন্তান তো স্বাবলম্বী হতে পারবে না। মেয়েদেরকে ছেলেদের সমান চোখে পিতারা দেখে না। আর সে দৃষ্টিভঙ্গিটা পিতার নিকট থেকে ছেলেও পায়। তাই সেও তার স্ত্রী বা মেয়েকে তাঁর বা তাঁর ছেলের সমান করে ভাবতে পারে না। কাল-পরম্পরায় এই দৃষ্টিভঙ্গিটা সমাজে স্থায়ী হয়ে আছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাজ এগোবে না, মেয়েদেরও মুক্তি আসবে না। এক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই সহযোগিতা করা দরকার। সমাজের সহযোগিতা ছাড়া এই সামাজিক সমস্যা দূর হবে না। আপনি যদি ভূমিকা না নিতেন তাহলে আলেয়ার সমস্যা আরো বেড়ে যেত বলে আমার ধারণা।
সেটা একটা দিক─ শিক্ষকেরও ভূমিকা রয়েছে। আপনি ওর সাহস কী ভাবে ফিরিয়ে আনলেন? আমি জানি না, কিন্তু সাহসই আসল জিনিস। আমরা অনেকেই অনেক কিছু বুঝি, কিন্তু সবসময় উচিত কথা বলি না। আমরা নিজেরা উচিত-অনুচিত বুঝলেও অন্যকে বোঝাতে পারি না। আসাদ সাহেব, আমার মনে হয় আপনি পারবেন। আমি আপনার সঙ্গে থাকবো, আমাদের দিন তো শেষ আপনি কাজ করে যান।
ধন্যবাদ, স্যার।
১০
‘ছোটো নদীটি ঈষৎ বেঁকে এইখানে একটুখানি কোণের মতো, একটু কোলের মতো তৈরী করেছে…।’ রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে এক চিঠিতে লিখেছেন। কবির দেখা সেই ছোটো নদটিা একশ বছর পরও আসাদ করিম চিনতে পারছে। এলাকার লোকজন বলে, এই নদী দেকেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছোটো নদী ছড়াটি লিখেছিলেন। নদটিার কত যে বাঁক!
আসাদ দেখছে, নদীটার দু’পাড়ে কোলঘেঁষে লোকালয়, গাছপালা। এপাড় থেকে ওপাড়ের গৃহস্থালির সবকিছুই দেখা যায়। উঠোনের ধান, লাউয়ের মাচা, ঘরের কোণের কাছে বেগুন কিংবা মরিচগাছ, হাঁস-মুরগির বিচরণ, গাভীর হাম্বা বাছুরের লাফ-ঝাফ সবই চোখে পড়ে। একই রকম ওপাড় থেকে এপাড়েও দেখা যায়। এপাড়ের মানুষের জমি যেমন ওপাড়ের মাঠে আছে তেমনি ওপাড়ের মানুষের জমিও এপারে আছে। আর এপাড়ে ওপাড়ে মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া। নদীটা যেন বড় আদরের, দু’কুলের মানুষ একে বড়ো ভালোবাসে। বিশেষ করে বর্ষার জন্য তারা প্রতীক্ষা করে। এ পাড়ের মানুষ ও পাড়ের মানুষে পাড়ে-পাড়ে গল্প হয়। নদীটা ছমাস শুকনো, বর্ষা এলে এর বুকে নানা রকম নৌকা দেখা যায়। ভরা ভাদরে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলে তারা যেন আনন্দে মেতে ওঠে। তখন এ নদী দূর-দূরান্তের মানুষের মিলন ঘটায়। নৌকা থেকে পাড়ায়-পাড়ায় ঘাটে-ঘাটে নাইওর নামে আবার নাইওর ওঠে। পাড়ার মা-ঝিরা ঘাটে বিদায় জানাতে হাজির হয়, নৌকাটা নদীর বাঁকে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। আবার যারা নাইওর আসে তাদের বরণ করতে এসে দাঁড়ায় ছেলে-মেয়ে নারী-পুরুষ। পাড়ার নারী-পুরুষ নদীর ঘাটে নাইতে আসে। আশ্বিন থেকেই পানি নামতে থাকে─ শীতের শেষে তলায় কোথাও কাদা, কোথাও কচুরিপানা আর কোথাও বা কলমির দাম। এই ছবিটা ছিন্নপত্রে অবিকল আঁকা রয়েছে।
আসাদ নতুন করে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী পড়ছে। পড়তে গিয়ে ওর মনে হচ্ছে, সে আগে আর ছিন্নপত্র পড়ে নি। অথচ রবীন্দ্রনাথের গল্পে পল্লীপ্রকৃতির উত্তর লিখতে গিয়ে ছিন্নপত্র থেকে উদৃতি দিয়েই পরীক্ষায় বেশী নম্বর পেয়েছিল। কী লিখেছিল আজ সে সবের কিছুই মনে নেই। অথচ এখন, আবার নতুন করে ছিন্নপত্রাবলী পড়তে পড়তে মনে মনে রবীন্দ্রনাথকে পতিসরে দেখতে পায়। সে কল্পনায় ১৮৯১ সালে চলে যেতে পারে। সে দেখতে পায়, জানুয়ারির ১৩ তারিখ একটা বজরা এসে পতিসর কাছারিবাড়ির ঘাটে ভিড়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। জমিদারের ম্যানেজার আর তহশিলদার সকাল থেকেই ঘাটে প্রতীক্ষা করছিল। অবশেষে তাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটি বজরা এসে ঘাটে ভিড়ল। সুদর্শন এক যুবা ধবধবে ধুতি আর পাঞ্জাবির উপর শাল জড়িয়ে নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চারিদিকের গ্রাম আর মাঠ দেখছেন। ঘাটে রাজকর্মচারীরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। বরং তিনি দূরে তাকিয়ে আছেন, যেখানে মাঠের শেষে, গ্রামের পেছনে নীল আকাশ নেমে এসে মিশে গেছে। তিনি এর আগে এতবড়, এমন উদার আকাশ আর বুঝি অবলোকন করেন নি!
এই অজপাড়ায় রবীন্দ্রনাথকে দেখে আসাদ রোমাঞ্চিত হচ্ছে। সে যুবক রবীন্দ্রনাথকে তেমন করে চেনে না, সফেদ শ্মশ্রুমন্ডিত প্রৌঢ়-ঋষি রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা চেনে। সে আধ্যাত্মিক রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা জানে। তাঁর বিপুল সৃষ্টির ভান্ডার থেকে কিছুটা মাত্র সে অধ্যয়ন করেছে। একটা মানুষ একজনমে এত পরিমাণ সৃষ্টি করতে পারেন? সেটা ওর কাছে একটা বিস্ময়, অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়।
ছিন্নপত্রের ছবিতে রবীন্দ্রনাথ পতিসরকে যেভাবে দেখেছেন এর আগে গ্রাম দেখলেও এমন অভিভূত হয়ে গ্রাম আর গ্রামের মানুষ দেখেন নি? ‘একটা ছোটো নদী আছে বটে, কিন্তু তাতে কানাকড়ির স্রোত নেই। সে যেন আপন শৈবালদামের মধ্যে জড়ীভূত হয়ে অঙ্গ বিস্তার করে পড়ে পড়ে ভাবছে, যদি না চললেও চলে তবে আর চলবার দরকার কী? জলের মাঝে মাঝে যে লম্বা ঘাস এবং জলজ উদ্ভিদ জন্মেছে, জেলেরা জাল ফেলতে না এলে সেগুলো সমস্ত দিনের মধ্যে একটু নাড়া পায় না। পাঁচটা-ছটা বড়ো নৌকো সারি সারি বাঁধা আছে, তার মধ্যে একটার ছাতের উপর একজন মাঝি আপাদমস্তক কাপড়ে মুড়ে রোদ্দুরে নিদ্রা দিচ্ছে─ আর একটার উপর একজন বসে বসে দড়ি পাকাচ্ছে এবং রোদ পোহাচ্ছে, দাঁড়ের কাছে একজন আধ-বৃদ্ধ লোক অনাবৃত গাত্রে বসে অকারণে আমাদের বোটের দিকে চেয়ে আছে। ডাঙার উপরে নানা রকমের নানান লোক অত্যন্ত মৃদুমন্দ অলস চালে কেন যে আসছে, কেন যে যাচ্ছে, কেন যে বুকের মধ্যে নিজের দুটো হাঁটুকে আলিঙ্গন করে ধরে উবু হয়ে বসে আছে, কেন যে অবাক হয়ে বিশেষ কোনো-কিছুর দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোনো অর্থ পাওয়া যায় না।’
আসাদ ভাবে এই ছবিটা কত জীবন্ত! ওর কাছে এই ছবিটাকে সত্যজিত রায়ের ক্যামেরার চোখের মতো মনে হচ্ছে। সত্যজিত রায় অপুর চোখ দিয়ে দেখছেন বাতাসে পুকুরের জল আর শাপলা পাতা কাঁপছে, জলের উপর ভেসে থাকা কীট খেলা করছে। আর রবীন্দ্রনাথ দেখছেন, ‘গোটাকতক পাতিহাঁস জলের মধ্যে মাথা ডুবোচ্ছে এবং তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে নিয়ে সবলে ঝাড়া দিচ্ছে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন তারা জলের নিচেকার নিগূঢ় রহস্য আবিষ্কার করবার জন্যে প্রতিক্ষণেই গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং তার পরে সবেগে মাথা নেড়ে বলছে, ‘কিচ্ছুই না কিচ্ছুই না!’…
এই ছবিটা শতবছরেও বদলায় নি। শশাঙ্ক বাবুকে আসাদ করিমের মনে পড়ছে। তিনি রবীন্দ্রনাথের পতিসর আর পতিসরে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রথম সাক্ষাতেই বেশ ভালো বলেছিলেন। ছিন্নপত্র আবার পড়তে বলেছিলেন। শশাঙ্ক বাবুর কথা মনে হতে ওর কনকচাঁপাকে মনে পড়ে। সে ভাবে, একবার গেলে হয়। কনকচাঁপা যে অভূতপূর্ব কাজটি দুদিন আগে করেছে তার জন্য সে অন্তত একটা ধন্যবাদ ওকে দিতে চায়। আসাদের গ্রামে তো দূরের কথা শহরেও কেউ এমন ভ‚মিকা নেবে কি না ওর সন্দেহ হয়। সে আবার ভাবে, শশাঙ্ক বাবু আর তো যেতে বলেন নি। কনকচাঁপার সঙ্গে সেদিন দেখা হলেও ওদের বাড়ি যেতে বলে নি। তবে কি যাওয়া ঠিক হবে? সে ভেতরে ভেতরে যেতে প্রস্তুত অথচ যেতে সঙ্কোচবোধ হচ্ছে, অথচ ঘরেও আর বসে থাকতে পারছিল না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে অবশেষে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকে। একসময় নিজেকে কনকচাঁপাদের বাড়ির পাশে দেখতে পেল। আর এটা বুঝতে পারে যখন শশাঙ্ক বাবু ওকে দেখে ডাকলেন।
আরে, আসাদ সাহেব! এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
জ্বী, যাচ্ছিলাম, মানে এমনিতেই হাঁটছিলাম।
গ্রামের ভেতর দিয়ে কী হাঁটবেন, হাঁটবেন নদীর পাড়ে। দেখবেন, নদীটা কত আঁকাবাঁকা। এটা দেখেই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন? ‘আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে। বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’ নাগর নদে তখনও হাঁটুজলের বেশী ছিল না।
আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন, কোনো কাজে?
না, না। আমি এমনিতেই বের হচ্ছিলাম। ভাবছিলাম আপনার ওখানে একবার যাবো। অনেকদিন কথাই হয় না। এত ক্লাস আপনাকে দিয়েছে। আপনি নিলেন কেন? ইতিহাস-ভূগোল-সমাজ এসব তো আপনার সাবজেক্ট না।
তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কেউ উপস্থিত না থাকলে প্রক্সি দিতে যাই। তা না হলে ক্লাসটা ফাঁকা পড়ে থাকে।
অনেকেই ফাঁকি দিয়ে জীবন কাটাতে চায়, ফাঁকি দিতেই তো এ কাজটি করে। আপনি নিতে থাকলে তারা আরো বেশী সুযোগ নেবে। সেই ফাঁকটা আপনাকেই নিয়মিত পূরণ করে যেতে হবে।
আমাকে দিয়ে যদি কিছুটা ফাঁক পূরণ হয়, ক্ষতি কী?
প্রক্সি দিয়ে কি ফাঁক পূরণ হবে আসাদ সাহেব?
আচ্ছা, বাদ দিন। সে দেখা যাবে। যে কথা বলতে চেয়েছিলাম, পতিসরে রবীন্দ্রনাথের বিষয় নিয়ে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
চলুন ঘরে বসি। চা খাবেন আর কথা বলব।
আজ আর চা খাবো না। আসুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
শশাঙ্ক বাবু আর আসাদ নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে। কথা বলতে বলতে আবার তারা কুঠিবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়িটার দেয়াল ঘেঁষে ইটের গাঁথুনি দিয়ে কেউ একজন দোকানঘর তৈরী করছে।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারি সম্পর্কে বলুন।
আমি আর তেমন কী জানি! এখানে রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কিছু চিহ্ন কি আছে? হয়ত ঘাঁটাঘাঁটি করলে কিছু পুরোনো দলিলদস্তাবেজ এখনো কালেকটরির রেকর্ডরুমে পাওয়া যেতে পারে। এখানে যে জিনিসপত্র ছিল সেগুলো পাকিস্তান হওয়ার পর কর্মচারিরা নিয়ে গেছে, কিছু চুরি হয়ে গেছে। কাগজপত্র তো কেউ নেয় নি, সেগুলো উঁইপোকা খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। আর জায়গা-জমি তো সব বে-দখল হয়ে গেছে। এখন বাড়িটাও দখলের পাঁয়তারা করছে। কুঠিবাড়ির আঙিনায় এখন হাট বসছে। এই হাট নদীর পাড়ে ছিল, রবীন্দ্রনাথ নিজেই বসিয়েছিলেন। বাড়িটাতে এখন তহশিল অফিস। কেউ কেউ শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ইজারা নেবার জন্য আবেদনও করেছে। আবেদন করে ঘর তুলতেও শুরু করেছে। সেসব বলে আর কী হবে! এখন তো অনেকের কথা শুনে মনে হয় দেশটা স্বাধীন হওয়ায় ভুল হয়ে গেছে, পাকিস্তান থাকলেই ভালো ছিল।
রবীন্দ্রনাথের জায়গা-জমি পাকিস্তান হওয়ার পরও ছিল?
রেকর্ডপত্রে এখনো আছে। এই যে চারপাশে যা দেখছেন সবই ঠাকুর জমিদারির সম্পত্তি। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর অনেক আগেই জমিদারির দায়িত্ব একমাত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। পতিসরের উন্নতির জন্য তাঁর অবদানও কম নয়। রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তখন তিনিই জমিদারির দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়ে আধুনিক কৃষিবিদের মতো কৃষকদের উন্নতির চিন্তা করলেন। রবীন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ১৯৫৬ সালে এদেশে জমিদারি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। আর জমিদারের কাছারি এবং সংলগ্ন ভূমি ও জনসাধারণের ব্যবহার্য ভূমি বলে তা সরকারেরই দখল নেওয়ার কথা। জমিদারের কাছারিবাড়ি জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের অধীন সরকারের খাস সম্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই সম্পত্তিও শত্রু সম্পত্তি।
শত্রু সম্পত্তি মানে?
১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যে সকল হিন্দু পরিবার এদেশে সম্পত্তি ফেলে রেখে ভারতে চলে গিয়েছিল, তখনকার সামরিক সরকার তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য এনিমি প্রপার্টিজ এ্যাক্ট করেছিল। সেই আইনে রবীন্দ্রনাথের ফেলে যাওয়া সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো ১৯৪১ সালেই মারা গেছেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান সরকার শত্রুই মনে করত। তা নাহলে তাঁর গান নিষিদ্ধ করত না।
পাকিস্তানীরা কবিগুরুকে শত্রু ভাবত একথা ঠিক। জমিদার হিসেবে সেটেলমেন্ট অফিসের কর্মকর্তাদের অধিগ্রহণের সময় তো কাগজপত্র দেখেই জমিদারের পরিত্যক্ত জমি খাস হিসেবে রেকর্ড করার কথা। এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে জরিপ হয়েছে তাতেও রবীন্দ্রনাথের এইসব সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। কেউ তো আপত্তি করে নি।
তার অনেক আগেই তো রবীন্দ্রপ্রয়াণ হয়েছে।
আপনিও বলছেন আগেই রবীন্দ্রনাথ স্বর্গে গেছেন। আমি বলছি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন এখনও যেমন বেঁচে আছেন। বেঁচে ছিলেন জেনেই সেটেলমেন্ট অফিস তাঁর নাম শত্রুর খাতায় লিখে রেখে গেছে। সেটেলমেন্ট জরিপের আইনে তো কোনো মৃত ব্যক্তির নাম রেকর্ড করার বিধানও নেই।
সত্যি বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে না থাকেলে তিনি শত্রু হবেন কেমন করে!
আসাদ আর কোনো প্রশ্ন করে না। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ মনের ভেতর সে টের পাচ্ছে। যেন এই সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করবার সময় সে উপস্থিত ছিল। কিন্তু কিছু করতে পারে নি। সে মুখ খুলে বলতে পারে নি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের শত্রু নন, আপনারা ভুল করছেন।
আসাদ ভাবে বিষয়টি যদি পত্রপত্রিকায় তুলে ধরা যেত! এখনও সরকারীভাবে উদ্যোগ নিলে এই স্মৃতিচিহ্ন, এই বাড়ি, রবীন্দ্রনাথের আরও যদি কিছু স্মৃতিচিহ্ন কারো কাছে থেকে থাকে সেগুলো সংগ্রহ করে রাখা যায়। ভগ্নদশা বাড়িটাকে সংস্কার করা যায়, হাজামজা দীঘি-পুকুরগুলো সংস্কার করা যায়। মানুষকে জানানো যায় রবীন্দ্রনাথের পদধুলি এই মাটিতে মিশে আছে। এদেশে কত অখ্যাতজনের কবর পর্যন্ত মার্বেল পাথরে বাঁধাই করে রাখা হয়। অথচ রবীন্দ্রনাথের এই বাড়িটি অরক্ষিত হয়ে আছে। ওর মনে পড়ছে সেই গানের কথা, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে…।’