উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// পাঁচ পর্ব
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// এক
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// দুই
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// তিন
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিলো, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব চার
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// পাঁচ পর্ব
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।।পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব পনরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। শেষ পর্ব
হয়।
কেন গর্ব হয়?
কোনো উত্তর নেই। ছাত্রছাত্রীসব চুপ করে আছে। আসাদ তখন বলতে লাগল, একটা কারণে আমরা
সবাই এই স্কুলটির জন্য গর্ব করতে পারি। তোমরা কি সে কারণটি বলতে পারো?
না, স্যার।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা তোমাদের জ্ঞান অর্জনের জন্য এই স্কুলটি
প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আমি জানি না, বাংলাদেশে এমন আর কোনো স্কুল আছে কি-না। আরো স্কুল থাকলেও
আমাদের এই স্কুলটার জন্য অবশ্যই আমরা গর্ব করতে পারি। কারণ, তিনি তোমাদের এই গ্রামে আসতেন।
তোমাদের জন্য আমার শুভ কামনা রইল। তোমাদের সঙ্গে আরো অনেক কথা হবে, প্রতিদিন। ছাত্রছাত্রীরা,
তোমরা সবাই লাইন ধরে শৃঙ্খলার সঙ্গে যার যার ক্লাসে যাও।
আসাদ সাহেব, আপনি আমার রুমে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা বলব।
আসাদ করিম প্রধান শিক্ষকের পেছন পেছন তাঁর কক্ষে এলো। প্রধান শিক্ষক টেবিলে রুটিনের উপর চোখ
বুলিয়ে বাংলা ক্লাসগুলো কলম দিয়ে আলাদা করে কাগজে তুলে নিয়ে আসাদের হাতে দিলেন।বাংলার
ক্লাসগুলোর কোনোটাই প্রথম পিরিয়ডে নেই। টিফিনের আগে মাত্র একটা। আর বাকী সবকটি টিফিনের পর,
এমন কি শেষ পিরিয়ডেও আছে। তৃতীয় পিরিয়ডে ক্লাস সেভেনে আছে। কী আছে বইতে, কী পড়া ছিল কিছুই
আসাদের জানা নেই। সে ভাবে মানসিক প্রস্তুতির জন্যও যা পড়াতে হবে সেটা দেখে নেওয়া দরকার। বই
কোথায় পাওয়া যায়? সে ভাবে লাইব্রেরীতে আছে হয়তো।
ক্লাসের বাংলা বোর্ডের বই দরকার। লাইব্রেরিতে আছে কি?
মনে হয় না। এখন তো বোর্ডের বই কোনো শিক্ষক পড়ান না।
ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন দিয়ে উত্তর শিখে আসতে বলেন। ছাত্রছাত্রীরা গাইড থেকে মুখস্থ করে এসে পরীক্ষা দেয়।
সব ক্লাসেরই গাইড বই পাবেন। গাইড বই-এর ব্যবসা ভালো বলে প্রকাশকরা সৌজন্য কপি পাঠায়। শিক্ষকদের
নেয়ার পর যা থাকে আমি লাইব্রেরিতে রাখতে বলি। সেগুলো হয়তো আছে। মূল বই তো কেউ দেয় না আর
শিক্ষকদেরও কেউ চান না। কেনাও হয় না। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখতে পারেন। লাইব্রেরিতেও অল্প কয়েকটা বই
আছে। একসময় অনেক বই ছিল। কবিগুরুর নিজের দেয়া বইও ছিল। সেসব বই আর নেই। একাত্তরে স্কুলে
রাজাকাররা ক্যাম্প করেছিল। আর কুঠিবাড়িটা সেনাদের জন্য গেস্ট হাউস বানিয়েছিল। একদিন একজন
মেজর কুঠিবাড়ি দেখতে দেখতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রহিমকে নাকি কী সব জিজ্ঞেস করেছিল। সেসব কথা
রহিমই ভালো জানে। এসব বই রবীন্দ্রনাথের ছিল এ কথা জানতে পেরে মেজর রাজাকারদের মাঠের মাঝখানে
সব বই নিয়ে আগুন লাগিয়ে দিতে বলেছিল। তখন ছিল বর্ষাকাল। আগুনে সব পুড়বার আগেই বৃষ্টি এলে কিছু
বই রক্ষা পেয়েছিল। যাক, দেখুন গিয়ে কোন বই পান কি-না। না পেলে ক্লাসের কোনো ছাত্রের থেকে আনিয়ে নেন।
প্রধান শিক্ষকের কথাই ঠিক, বইয়ের আলমারিতে তেমন কোনো বই নেই। দু’একটা ইংরেজিতে লেখা পুরোনো বই
ধুলাবালির নিচে চাপা পড়ে আছে। পশুপাখি নিয়ে লেখা অতি পুরোনো ইংরেজি জার্নালের একটি কপি আসাদের
চোখে পড়ল। কোনো কোনো পাতায় পেন্সিল দিয়ে দাগানো। পাতা উল্টাতে গেলে ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে।
তবুও সে আগ্রহ নিয়ে সাবধানে পাতা উল্টে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে একসময় এর পুরোনো পাতায় যুবক
রবীন্দ্রনাথের মুখ এবং তাঁর পর ছিন্নপত্র-এর সেই লেখা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সে কল্পনায় দেখতে পায়
অনেক বছর আগে একদিন সকাল বেলার প্রাতরাশ সেরে তরুণ রবীন্দ্রনাথ পতিসর কাচারিবাড়ির অদূরে নাগর
নদীতে বোটে বসে পশুপ্রীতির উপর বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঠানো একটা লেখা বই পড়ছেন। হঠাৎ হৈচৈ শুনে
তাঁর মনোযোগ ছুটে যায়। তিনি বোটের জানলা দিয়ে দেখতে পান একটা মুরগি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে
নদীর অপর পাড়ে গিয়ে উঠেছে। ওটাকে ধরবার জন্য বাবুর্চিও সাঁতরে ওপারে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন বাবুর্চি
দুপুরের রান্নার জন্য নদীর তীরে মুরগি কাটবার আয়োজন করছিল। আর ওটা জান বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করছে।
তিনি বাবুর্চিকে মুরগি রান্না করতে নিষেধ করে দিলেন।
আসাদ আন্দাজ করল, এই বইটি বলেন্দ্রনাথের পাঠানো সেই বই। কবির হাতের স্পর্শধন্য বইটির ধূলোবালি মুছে
আবার তাকে রেখে সে ক্লাস নিতে গেল। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে শিক্ষককে সম্মান দেখালে আসাদ যে
একজন শিক্ষক সেটা সে প্রথমবারের মতো অনুভব করল।
আসাদ কখনো স্কুলে কিংবা অন্য কোথাও পড়ায় নি। ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা নেই। এই প্রথম
সে পাঠদান করতে এসেছে। ওর মনে পড়ল, সে কোনো এক বইতে পড়েছিল, শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে
দূরত্ব থাকলে শিক্ষক সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারে না, শিক্ষকের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব থাকলে শিক্ষার্থীর পক্ষেও
যথার্থ শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয় না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুর মতো। শেখানোর সময়
শিক্ষার্থীর পরিবেশ আর সমাজের প্রভাবও মনে রাখতে হবে।
আসাদ ভাবে, আগে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবে। তাদের জানতে পারলে তাদের কাছাকাছি
পৌঁছানো যাবে। কী ভাবে শুরু করা যায় সে কথা ভাবতে ভাবতে আসাদ ছাত্রচাত্রীদের জিজ্ঞেস করল
তোমরা কেমন আছো?
ভালো। আপনি ভাল আছেন, স্যার?
আমিও ভালো আছি। তোমরা আমার নাম জানো?
না, স্যার। আপনার নাম কি?
আবু করিম আসাদ।
স্যার, আপনার ডাক নাম নাই?
আবু।
আবু মানে কি।
আমাদের গ্রামে ছোটো শিশুকে আবু বলে।
আপনি তো আর শিশু নন।
তাই তো। এখন তো আর আবু নাম চলে না। তাই আসাদ করিম। তোমরা আসাদ বলতে পারো। করিমও
বলতে পারো। তোমাদের সবার নাম আমার জানা দরকার। তোমরা একে একে দাঁড়িয়ে নাম বলো।
আমি আমিনা বেগম। আমার রোল নম্বর ১।
রোল নম্বর দরকার নেই। শুধু নাম বললেই চলবে।
আমার নাম আলতাফ হোসেন।
আমার নাম রশিদ। আব্দুর রশিদ।
আমার নাম আবুল কাসেম।
আমার নাম স্যার ফরিদ মিয়া।
আমার নাম নির্মল দাস।
আমার নাম…
তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ। সবার নাম জানলাম। আমি হয়তো সবার নাম মনে রাখতে পারব না। তবে
চেষ্টা করবো। ভুলে গেলে জেনে নেবো। তোমরা সবাই খুব ভালো।
কেন স্যার?
এই যে খুব হাসিখুশি তাই। যারা হাসিখুশি তারা খুব ভালো হয়।
আপনিও খুব ভালো।
তাই?
স্যার, আপনি ত বাংলা ক্লাস নিবেন।
ঠিক বলেছো।
এখন থেকে হুজুরের বদলে আপনি ক্লাস নিবেন?
হ্যা। তোমরা কী পড়ছিলে?
কবিতা, প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে দিছিলো।
কবিতার নাম কী?
আনন্দ।
কার লেখা?
সুকুমার রায়।
সুকুমার রায় সম্পর্কে জান?
তিনি কবি ছিলেন।
সেটা তো ঠিক। কেমন কবি ছিলেন, কাদের জন্য লিখেছেন, সেটা জান কি?
না, স্যার।
সুকুমার রায় ছিলেন, আনন্দের কবি, হাসিখুশির কবি। তিনি শিশুদের আনন্দের জন্য ছড়া, কবিতা, গল্প
লিখে গেছেন।
স্যার, তিনি কি মরে গেছেন?
হ্যা, অনেক বছর আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু, তাঁর মজার মজার গল্প, কবিতা-ছড়া পাঠ করে এখনো
আমরা অনেক আনন্দ পাই। তাঁর আর কোনো গল্প বা ছড়া-কবিতার বই পড়েছো?
না, স্যার।
সুকুমার রায়ের আর কী কী বই আছে?
আবোল-তাবোল, হ-য-ব-র-ল, পাগলা দাসু- আরো বেশ কিছু মজার লেখা তিনি লিখেছেন।
নামগুলো খুব সুন্দর।
ছড়াগুলোও খুব সুন্দর। যেমন, ‘রামগড়রের ছানা হাসতে তাদের মানা/হাসির কথা শুনলে
বলে হাসব না-না না না।’
স্যার, আরো বলেন।
আজ আর নয়। সুকুমার রায়ের মজার ছড়াই শুধু নয় গল্প পড়লেও হাসতে হাসতে তোমাদের পেটে খিল
ধরে যাবে।
তাহলে সুকুমার রায় আনন্দের কবি। তিনি সবখানেই আনন্দ দেখতে পান। তাই না?
কোথায় কোথায় আনন্দ দেখতে পান তোমরা জানো?
সবখানে।
বলো, সেসব বলো শুনি।
ফুলের গন্ধে, পাখির গানে, অরুণ আলোয়, শিশুর প্রাণে, বাতাসে, সাগরের জলে, ধুলিকণায়, তৃণের দলে।
আচ্ছা, তৃণের দলে তৃণ মানে কী,
স্যার? তৃণ মানে ঘাস, দুর্বা।
ঠিক বলেছো। তোমরা অনেক মেধাবী। তোমাদের মানে শিশুদের সব থেকে বেশী কী দরকার? বলতে
পারলে না? আমি বলছি আনন্দ আর খুশি দরকার, তাই না?
জী, স্যার।
স্যার, আবিরের মনে আনন্দ নাই।
কেন, আবিরের কী হয়েছে?
স্যার, ওর মা মারা গেছে।
আমরা ওর দুঃখ দূর করব। আমরা সবাই ওকে খুশি রাখতে চেষ্টা করব
স্যার, কী ভাবে ওকে খুশি করব?
ওর সাথে খেলা করব, গল্প করব।
জী, স্যার।
আবির, তোমার বাসা কোথায়?
কুঠিবাড়ির দীঘির পাড়ে।
আমারও বাসা ওখানে। আবির তুমি এসো, তোমাকে গল্প শোনাবো
কেমন?
আচ্ছা।
আমরাও আসবো, স্যার।
আচ্ছা, সবাই এসো। সবাই মিলে গল্প করবো।
স্যার, আপনি অনেক গল্প জানেন?
জানি। তোমরা জানো না?
কী গল্প জানো?
জানি। ভুতের গল্প। জ্বীন-পরীর গল্প।
ঘণ্টা পড়ে গেল। আসাদ ক্লাসটা বেশ উপভোগ করল। মনে হলো যেন এই শিশুরা ওর বহুদিনের
চেনাজানা। আর ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল- ওরা যেন কেবল জানতেই চায়।
আসাদ শিক্ষকরুমে গিয়ে দেখল কেউ নেই। সে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গেল। দেখতে পেল প্রধান
শিক্ষক বসে পত্রিকা পড়ছেন।
কেমন লাগল ক্লাস?
ভালো। বাংলা পড়বার জন্য ছাত্রছাত্রীদের খুব উৎসাহ আছে মনে হলো।