ছোটগল্প।। যখন সমান্তরাল।। রফিকুর রশীদ

গওহারডাঙ্গা মাদ্রাসার সুপারের হাত থেকে রেডিওটা মেঝেতে পড়ে খানখান হয়ে ভেঙেচুরে যায়। চীন থেকে
আসা সস্তা রেডিও। প্লাসিকের হালকা বডি। প্যাগোডার মতো গোলাকৃতি দেখতে। মাঝখানে তার ক্রমান্বয়ে উঁচু
হওয়া গম্বুজ। আকৃতিটা পছন্দ না হলেও অল্প দামের এই রেডিওতে শব্দ হয় গম্গম্ করে। বাংলাদেশ বেতার,
আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা, এমন কি রেডিও পিকিং পর্যন্ত অনায়াসে শোনা যায়। খবর শোনার নেশাটা
হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। দূরের এক মাদ্রাসায় তখন সে উঁচুক্লাসের ছাত্র। তার বয়সী অধিকাংশ যুবক
যুদ্ধে গেছে, তার যাওয়া হয়নি নানাবিধ কারণে। বিশেষত বিছানায় পড়ে থাকা পক্ষাঘাতগ্রস্থ বাবাকে ফেলে রেখে
যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া তার হয়ে ওঠেনি। অতি শৈশবে বাবার কাছ থেকেই দেশাত্মবোধের শিক্ষা সে পেয়েছে। তবু
সেই যুদ্ধের সময়ে জন্মাদাতা বাবার চেয়ে দেশকে বড় করে দেখতে পারেনি এটাই সত্যি। সারা দেশের যুদ্ধ
পরিস্থিতির খবর শোনার জন্যে বুকের ভেতরে ভয়ানক ছটফট করত বলে এখানে সেখানে লুকিয়ে-চুরিয়ে
রেডিও শুনত, স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনে এসে বাবাকে তার সারমর্ম শোনালে পাণ্ডুর মুখে রোদের
ঝিলিক খেলা করত। বাবা তাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিয়েছে, তবু যাওয়া হয়নি। অথচ যুদ্ধের শেষের দিকে
স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার অপরাধে তারাইলের কুদ্দুছ গাজী তাকে জোর করে রাজাকারে ভর্তি করানোর
উদ্যোগ নিলে অসুস্থ বাবাকে ফেলে এক সময় তাকে পালাতেই হয়। সেই থেকে রেডিও শোনার অভ্যাস তার।

স্বাধীন দেশে মাদ্রাসার চাকরিতে ঢোকার পর নিজের উপার্জিত অর্থে এই সস্তা রেডিও কেনা হয়। ফজরের
নামাজ শেষে মিনিট বিশেক কোরান তেলোয়াত করে মনোযোগ দিয়ে। নিজের কণ্ঠ নিজে থেকেই বেশ
কয়েকভাবে ভেঙেচুরে ছহি উচ্চারণে আবৃত্তির চেষ্টা চালায়। কোনো একদিন রেডিওতে কোরান তেলোয়াতের
গোপন ইচ্ছে অনেকদিন থেকে পুষে রাখে বুকের মধ্যে। এই জন্যে অতি যত্নে তার কান খাড়া করে রেডিও
শোনার অভ্যেস। এরপর বুকের উপরে প্যাগোডা চাপিয়ে নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিছানায় শুয়ে চলে খবর শোনার
পালা। খবর শুনতে শুনতে এক সময় আলস্য আসে, চোখের পাতা মুদে আসে; কতদিন গোলাকৃতি রেডিও
বুকের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ে যায়। প্লাস্টিক বডির এখানে ওখানে একটু-আধটু ভেঙেচুরেও যায়।
তবু রেডিও তাকে শুনতেই হবে।

সেদিন ভোরবেলা রেডিওর নব ঘুরাতেই যেনবা তার সারা দেহ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। কোনো এক খুনি মেজর
সদর্পে নিজের নাম ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পৈশাচিক ও নৃশংসতম খবরটি পরিবেশন
করছে। বাংলাদেশ বেতারের পরিবর্তে রেডিও বাংলাদেশ বলছে। কোরান তেলোয়াতের ফাঁকে ফাঁকে কার্ফ্যু
ঘোষণা করছে। ঘরের বাইরে বেরুনোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে। গওহরডাঙা মাদ্রাসার সুপার চট
জল্দি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। আর তক্ষুনি রেডিওটা মেঝেতে আছড়ে পড়ে খোলামকুচির মতো
ছড়িয়ে যায়। নাকি ভয়ানক ক্ষোভে-দুঃখে-রাগে ভঙ্গুর এই বস্তুটি সে আছড়ে ভেঙে ফেলে কিনা তাই বা
কে জানে সঠিকভাবে।

মাদ্রাসা-সুপার বলতে যেমন গরুগম্ভীর বয়স্ক মুরুব্বিজনের ছবি ভেসে ওঠে, এই গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার
সুপার কিন্তু মোটেই তেমন নয়। শুধু বয়সে নবীনই নয় দৃষ্টিভঙ্গিতেও সে অনেক আধুনিক। তার
শিক্ষকতা-জীবন শুরু হয় অন্য এক মাদ্রাসায়। বাড়ি থেকে অনেক দূরে, নদীপার হয়ে
যেতে হয়, অসুস্থ বাবার নিয়মিত খোঁজখবর রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। অল্প কিছুদিন আগে এই গওহরডাঙ্গা
মাদ্রাসার অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার হিসেবে যোগদানের সুযোগ হয়। মাখরাজসহ চমৎকার সুললিত কণ্ঠের
কোরান তেলোয়াতের ব্যাপারটা ছিল তার বাড়তি যোগ্যতা। গওহরডাঙ্গাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয়
ঘোপেরডাঙ্গা, এ গ্রামে তার নানাবাড়ি মামাবাড়ি। তাদের প্রভাবও হয়তো কিছু কাজ করে থাকবে।
মাদ্রাসার এ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার হলেও লিল্লাহ্ বোর্ডিংয়ের পূর্ণ সুপার হিসেবেই তাকে দায়িত্ব নিতে হয়।
ভালোই লাগে ঘোপেরডাঙ্গার কর্মজীবন। বাড়ি থেকে বিশেষ দূরে নয় বলে প্রতিদিনই শয্যাশায়ী বাবাসহ
পরিবারের সবার খবরাখবর নেয়া যায়, ইচ্ছে হলে সন্ধেনাগাদ ঘুরেও আসা যায় বাবা-মাকে দেখে। বড়
হুজুর- মানে মাদ্রাসার বয়োবৃদ্ধ সুপার কিছুদিন আগে হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যাবার ফলে সব দায়িত্ব
এসে পড়েছে এ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারের উপরে। সব দিক তাকেই সামলাতে হয়। কাগজ-কলমে পরিবর্তন না
হলেও তাকেই সবাই সুপার বলে জানে এবং মানেও।

ভোরবেলা আকাশ কাঁপানো শোকসংবাদটি শোনার পর গওহারডাঙ্গা মাদ্রাসার সুপার এমনই স্তম্ভিত হয়ে
পড়ে যে এখন তার কী যে করণীয়, বেশ কিছুক্ষণ তা বুঝতেই পারে না। ঘরের মেঝেতে চৌচির হয়ে ছড়িয়ে
পড়ে থাকা রেডিওর দিকে তাকিয়ে থাকে আনমনে। শতেক চেষ্টায় জোড়াতালি দিয়েও রেডিওটির গোলাকার
অবয়ব আর ফিরে আসবে না এ কথা ভাবতেই রোগজর্জর বাবার মুখ মনে পড়ে যায়। এ সময়ে কেন মনে
পড়ে মৃতপ্রায় মানুষটিকে! একদা তার মুখটাও ভারি গোলগাল ছিল, দিনে দিনে সেই চেহারা ভেঙে-চুরে কী যে
হাল হয়েছে! চোখ তুলে তাকানো যায় না সেই মুখের দিকে। নাহ্, রেডিওর ভগ্নাংশ কুড়াতে মোটেই তৎপর হয়
না। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লিল্লাহ্ বোর্ডিংয়ের ছেলেপিলেকে ডেকে সে একত্রিত করে, ইচ্ছে হয় সবাইকে
ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলিতে দাঁড় করিয়ে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে উঠতে। কিন্তু সে পারে না। তার সারা
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এমন কি যেনবা মৃদু কাঁপুনিও অনুভূত হয় শরীরে। তখন নিজেকে কোনোমতে সম্বরণ
করে ছেলেদের কোরান তেলোয়াতের আদেশ দেয়। ছেলেরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে হুজুরের দিকে- এ
আর নতুন কী! প্রতিদিন সকালে কোরান তেলোয়াত করা তো নৈমিত্তিক ঘটনা,
এভাবে হঠাৎ জোর দিয়ে বলার মানে কী!

শোকসংবাদটি নিজে মুখে ঘোষণা করতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে সুপারের। তবু তা করতে হয়। বেশ কয়েকটি বালক
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। সুপার তাদের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়। তারপর কোরান তেলোয়াতের সঙ্গে দোয়া-দরুদও
পাঠ করতে বলে। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়-বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহিদের আত্মার শান্তি কামনা করে সুপার নিজেই
বিশেষ মুনাজাত পরিচালনা করবে।

সকল শহিদ মানে কী!
সকল শহিদের আত্মার শান্তি কামনার কথা মনে আসতেই সহসা নিভৃতে প্রশ্ন জাগে- কজন শহিদ হয়েছে? রেডিওর
ঘোষণায় কি সে কথা বুঝার উপায় আছে? স্বেচ্ছাচারী এক মেজরের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান
নিহত হয়েছেন। কীভাবে নিহত হয়েছেন, অঘটনটি যদি তাঁর বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডির নিজস্ব বাড়িতে ঘটে থাকে, তাহলে
পরিবারের অন্যান্য সদস্যের অবস্থা কী, কেমন আছেন তারা, নিহত মুজিবের নশ্বর মরদেহ কোথায় আছে, কোথায় বা
সমাহিত হবে- কিছুই জানার উপায় নেই। রেডিওতে এ-সবের কোনো আভাস নেই। হামদ-নাত-কোরান তোলোয়াতের
ফাঁকে ফাঁকে মুজিব হত্যার খবরটিই বারংবার প্রচারিত হচ্ছে নিজের রেডিও ভেঙে যাবার পূর্ব পর্যন্ত এটুকুই শুনতে
পেয়েছে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার সুপার। এটুকু তথ্যে কার তৃষ্ণা মেটে! বরং ওই তথ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থাকা
আরো অনেক অনিবার্য প্রশ্ন মাথার মধ্যে কিলবিল করে, মগজে আঘাত হানে, হৃদয়ে ঝড় তোলে তোলপাড়।
কিন্তু জবাব কোথায় এসব প্রশ্নের? মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে সুপার। তার ইচ্ছে করে গিমাডাঙ্গা, বালাডাঙ্গা,
সোনাখালি, পাটগাতি, কলাতলা, মিত্রডাঙ্গা, তারাইল, পাথরঘাটা-মধুমতির আঁচল ছোঁয়া প্রতিটি জনপদে ঘুরে ঘুরে
জিজ্ঞেস করতে; তোমরা কি শুনেছ কী সর্বনাশ হয়ে গেছে গতরাতে? মাডগার্ড খোলা একটি সাইকেল আছে তার,
সেটার হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই বিরক্তিতে মন বিষিয়ে যায়। ছেলেমানুষের মতো অকারণে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়
সাইকেল। নদীবেষ্টিত এ অঞ্চলে শ্রাবণের এই কাদাজলের মধ্যে যানবাহনটিকে বড়ই তুচ্ছ মনে হয়। তখন সেহাঁটতে
শুরু করে।
দুটো পায়ের উপরে ভর দিয়েই তার ইচ্ছে করে খুলনা-বরিশাল চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-রাজশাহী-রংপুর-দিনাজপুর-যশোরসহ
সারাদেশ ঘুরে আসতে। ইচ্ছে করে ঢাকার কথা শুধাতে- তোমরা কি জানো ঢাকার আকাশ থেকে কেমন করে খসে
পড়েছে জ্যোতির্ময় নক্ষত্র? উদ্বান্ত সুপার সারাটা দিন পথে পথে টো টো করে ঘোরে। বুকের মধ্যে ফাঁকা লাগে,
হাহাকার গুমড়ে ওঠে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে সেই কারণও নির্ণয় করতে পারে না। তার তো কোনো রাজনীতি
সম্পৃক্ততা নেই, তাহলে? শ্রাবণ-আকাশ নুয়ে আছে, বৃষ্টিধারায় যদি চরাচর ভাসিয়ে নিয়ে যেত, তাহলে কেমন হতো
কে জানে! গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার সুপার বয়সে নবীন হলেও এলাকার মানুষের কাছে তার বিশেষ গ্রহণযাগ্যতা আছে।
ফলে পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে যখনই যার সঙ্গে দেখা হয়েছে, প্রায় সবাই তার পথ আগ্লেছে, কেউ কেউ চোখে চোখ
রেখে শুধিয়েছে- যাচ্ছেন কোথায় হুজুর? ঢাকার খবর শোনেন নি?

এ খবর না-শোনার তো কোনো উপায় নেই। সারা দেশে ঘরে ঘরে দোকানে-বাজারে অসংখ্য রেডিও ঘ্যানর ঘ্যানর করে
একই তথ্য ক্লান্তিহীন ভাবে প্রচার করে চলেছে। নতুন তথ্য যোগ হয়েছে অনেক পরে, জুম্মার নামাজ গড়িয়ে গেলে
তারপর শোনা গেল, খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর প্রধানেরা
আনুগত্য অভিনন্দন জানিয়েছেন নতুন সরকারের প্রতি: এমন কি পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনী-প্রধানও পিছিয়ে থাকেন নি।
সন্ধ্যা নাগাদ নতুন প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন রেডিওতে। কোথায় জয়বাংলা! ভাষণ শেষে আবার সেই
পাকিস্তানি জামানার জিন্দাবাদ। কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই। মুক্তিযুদ্ধে পোড় খাওয়া দেশের মানুষ প্রতিবাদ করবে
কোন সাহসে! স্থানীয় বাজারের এক ব্যবসায়ী খুব বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছে- ঢাকার রাজপথ দাবড়ে বেড়াচ্ছে
সেনাবাহিনীর ট্যাংক-বহর, সৈনিকদের কাঁধে কাঁধে খোলা স্টেনগান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাণ্ডব নয় তবু আমি জিপ
কিংবা ট্যাংক বহরের সামনে বাঙালি সৈনিকের বদরাগী চেহারা দেখে আতংকিত মানুষজনের চোখে একাত্তরের
বিভীষিকার ছবিই হয়তোবা ফুটে ওঠে। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ‘বালিতে মুখ গোঁজ উটপাখি’ হয়ে ওঠা মোটেই
অস্বাভাবিক নয়।

সারাটা দিনের শেষে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার সুপারের আবার মনে পড়ে যায় জন্মাদাতা বাবার কথা। দুনিয়া কাঁপানো এত
বড় খবর তাকে কেউ শুনিয়েছে কিনা, যদি কোনোভাবে শুনেও থাকেন, এমন কুৎসিত সংবাদের ধাক্কা কী ভাবে
সামলাবেন ওই শয্যাশায়ী রোগজর্জর মানুষটি, তাই নিয়ে খুব ভাবনা হয়। তার মনে হয় এ সময়ে সন্তানকে চোখের
সামনে দেখে মৃতপ্রায় মানুষটি যদি একটুখানিও বুকে বল পায়। মাত্র তিনদিন আগে সে বাবাকে দেখে এসেছে।
শরীর তার ভালো নেই। বিছানায় পড়ে থেকে থেকে পিঠে ঘা হয়ে গেছে। এদিকে বুকে তার শ্লেষ্মা। আকাশে মেঘ
জমলে শ্বাসকষ্ট বাড়ে। অর্জুন গাছের ছালবাকল বেঁটে বুকে লাগিয়ে দিয়েছে মা। নাহ্, আর দেরি করা চলে না,
লিল্লাহ্ বোর্ডিংয়ের ছেলেদের কানের কাছে মুখ নামিয়ে কী যেন বলে মাদ্রাসা-সুপার, তারপর হনহন করে বেরিয়ে পড়ে
বাড়ির উদ্দেশে। এমন উৎকণ্ঠাপূর্ণ একটা দিন কাটানোর পর তার মনও যেন একটুখানি ছায়াঘন আশ্রয় খোঁজে।
বাড়ি সে যাবেই। পরদিন দুপুর গড়িয়ে যাবার পর এ দিগরে যখন শ্রাবণ মেঘের ছায়া নেমে আসে, তখনই টুঙ্গিপাড়ার
আকাশে উড়ে আসে এক দুর্বিনীত সামরিক হেলিকপ্টার। থমকে দাঁড়িয়ে থাকা গুমোট বাতাস চিরে হেলিকপ্টারের
পাখা যে ভয়ঙ্কর শব্দ ছড়ায়, তা এ জনপদের নির্বিবাদী মানুষের মনে তীব্র আতংকের হল্কা ছড়ায়। মাথার উপরে
খানিকটা বেলা বাড়তে বাড়তে এলাকার উৎকণ্ঠিত মানুষজন সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে দেখতে পায়- শত শত পুলিশ এসে বঙ্গবন্ধুর
পৈত্রিক বাড়ি ঘিরে ফেলছে। কেন এ ঘেরাও, মানুষ বুঝতে পারে না। যাকে নিয়ে সারা দুনিয়ার মাথাব্যথা, তাকে তো
ঢাকার বাড়িতেই হত্যা করা হয়েছে সপরিবারে, তারপরও এই আজ পাড়াগাঁয়ে সশস্ত্র পুলিশের এই ঘেরাও কমসূর্চির কী
যে মানে! দুপুর নাগাদ সেই ঘেরাও-এর বৃত্ত আরো সমপ্রসারিত হয়। গ্রামের মানুষ ভয়-তড়াশে দূরে সরে যায়।
টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে হেলিকপ্টার অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে বিপজ্জনক সাইরেন বাজিয়ে অতিদ্রুত আতংকের হল্কা ছড়িয়ে
দেয়া হয়। তারপর হেলিকপ্টার থেকে গটমট করে নেমে আসে সশস্ত্র দেবদূতেরা। তাদের চোখেমুখে কী যে অগ্নিজ্যোতি-
কেউ সামনে পড়লে ভস্ম হয়ে যাবার সম্ভাবনা। তারা এসেছে টুঙ্গিপাড়ার খোকা, শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র
শেখ মুজিবুর রহমানের বুলেট ঝাঁঝরা মরদেহ টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে ফিরিয়ে দিতে।

শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু রাসেল এমন কি তাদের মা-জননীর নিথর দেহ বনানীতে সমাহিত করা হলেও
শেখ মুজিবের প্রাণহীন দেহ ঢাকায় রাখতে সাহস হয়নি, আবার যদি সাতই মার্চের মতো আঙুল উঁচিয়ে বাঙালি জাতিকে
কোনো আদেশ দেয়! এদিকে মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে আসার পরও ভয়ানক তাড়াহুড়ো তাদের- যদিবা মধুমতি-বাইগার
নদী রুষে ওঠে, ঘিরে ধরে অক্টোপাসের মতো। পিতার কবরের পাশে পুত্রের জন্যে গোর খনন হয়েছে, অতি দ্রুত অতি
সংক্ষেপে গোসল, দাফন, জানাজা শেষে মরদেহ মাটির বিছানায় শুইয়ে দিতে পারলেই তাদের দায় সারা হয়। না না,
হাজার হাজার লোকজনের দরকার নেই, সেনা-অফিসার, জানিয়ে দেয়- ৮/১০ জন লোক হলেই চলবে। কুইক।
জলদি কর।
বাপরে বাপ! এ কি সিভিল হুকুম! আর্মি-আদেশ বলে কথা! মুর্দা গোসলের জন্যে এলো ৫৭০ কাপড় কাচা
সাবান, রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে রিলিফের সস্তা কাপড় এলো কাফনের জন্যে। মরা হাতির দাম লাখ টাকা হতে
পারে, বীর(!) সেনাদের গুলিতে নিহত প্রেসিডেন্টের মরদেহের কীবা দাম, কীবা ইজ্জত! জানাজা? ওই ৮/১২০ জনেই
হবে। আর যা-ই হোক, এ দেশে তো মোল্লা-মৌলোভীর অভাব হবার কথা নয়, একজনের মাথায় টুপি চাপিয়ে দাঁড়
করিয়ে দিলেই হবে; জলদি লাগাও।
জলদি। টুঙ্গিপাড়ায় যখন এই সব ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ব্যাপারটা কাকতালীয় হলেও সত্যি- গওহরডাঙ্গা
মাদ্রাসার সুপার তখন তার বাবার জানাজায় ইমামতী করতে দাঁড়িয়েছে। গত রাতে নয়, অঘটনটা ঘটেছে সকালে। বাবা
বঙ্গবন্ধুভক্ত মানুষ বলেই পুত্র এত বড় ট্রাজিক ঘটনার বিবরণ আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে। গতকাল থেকে
কেউ তাকে বলে নি। বলবে কী, চলৎশক্তিরহিত এই মানুষটিরও যে সামান্য পরিমাণে বোধবুদ্ধি আছে, সে-কথাই তো
কারো মনে পড়ে না।! কে বলবে এই পাথর-প্রতিম ভারি কথা! পুত্রের মুখে সব শুনে চোখ দুটো তার বিস্ময়ে বিস্ফারিত
হয়ে ওঠে। তারপর মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ে। এ ঘটনার পর পুত্র নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং নিজেকে মনে হয়
পিতৃহন্তারক। জাতির জনককে পরিকল্পিতভাবে যারা হত্যা করেছে, নিজেকে তাদের মতোই অপরাধী মনে হয়।
আত্মীয়স্বজন এসে তাকে সান্ত্বনা দেয়- অসুস্থ মানুষটি প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে এ-মৃত্যু অনেকটা
প্রত্যাশিতই বলা চলে। জানাজায় দাঁড়িয়েও প্রবল কান্নাস্রোত আছড়ে পড়ে তার বুকে, আপন মনে হাহাকার করে ওঠে-
আমি কি এই জন্যে গওহরডাঙ্গা থেকে ছুটে এসেছিলাম…।
এরপর আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়াশি সবাই জানাজা ও মুনাজাত পরিচালনার দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় তার উপরেই। পিতার
জন্যে পুত্রের দোওয়া সব চেয়ে উত্তম, পুত্রের হাত আল্লাহ কিছুতেই ফিরিয়ে দেন না। এখানে আলেম পুত্রই সর্বাপেক্ষা
উপযুক্ত ব্যক্তি। সবার পরামর্শে মুনাজাতের জন্যে হাত তোলার পর আবার তার কান্না আসে, বাঁধ-ভাঙা কান্না।
সেই কান্নার শরীর পেঁচিয়ে কিছু কিছু বাক্য স্ফূট হয়। শৈশব কৈশোরের পিতৃস্মৃতির কথা আসে, পিতৃস্নেহের কথা আসে,
পিতার ব্যক্তিত্বের নানা দিক উঠে আসে, নিজের অযোগ্যতার কথা বারবার উচ্চারিত হয়; এমনই সুললিত ভঙ্গিতে
মুনাজাত চলতে থাকে যে উপস্থিত সবারই দু’চোখের তটিনি উপচে কান্না পায়। ফুঁপিয়ে ওঠে।
কান্নার সংক্রমণ-ক্ষমতা এমনই প্রবল যে অনেক সময় প্রতিরোধ-অযোগ্য হয়ে ওঠে। ইমামের সব কথা তখন সবার কানেও
ঢোকে না, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কেবল আমিন আমিন বলতেই থাকে। কেউ টের পায় না সেদিনের মুনাজাতের
মধ্যে কখন আলগোছে বঙ্গবন্ধু ঢুকে পড়েন। ইমাম সাহেব আল্লাহর কাছে আকুল ফরিয়াদ জানিয়ে বলে- শুনেছি পিতার
জন্যে পুত্রের দোয়া তুমি কবুল কর, যার তিন পুত্র থেকেও নেই, তিনজনকেই খুন করা হয়েছে, তার জন্যে কে চাইবে দোয়া!
তিনি তো জাতির পিতা, আমি এক অধম সন্তান হয়ে তার জন্যে দোয়া চাইছি মাবুদ, তুমি কবুল কর।
উপস্থিত সকলে সমস্বরে উচ্চারণ করে- আমিন! সুম্মা আমিন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *