উপন্যাস

উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিলো, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব চার

তরুণ কবিই এখানে এসেছিলেন। অজপাড়াগাঁয়ের মানুষকে প্রথম দেখাতেই অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তিনি
যখন এসেছিলেন তখন এই এলাকাটা কেমন ছিল আপনি আন্দাজ করতে পারবেন না।

একশ বছর আগের কথা আন্দাজ করা সত্যি সহজ নয়।
তখন পতিসর আসার জন্য জলপথই একমাত্র পথ ছিল। বর্ষাকালে নৌকা আর শুকনো মৌসুমে পালকি ছাড়া কোনো
উপায় ছিল না। যারা এখানকার লোক তাদের তো আশেপাশের গ্রাম ছাড়া কোথাও যাবার দরকার পড়ত না। বছরে দু’মাস
বাদে সিংড়া আর আহসানগঞ্জ হাটে নৌকায় যাওয়া যেতো। সেই এক-দু’মাসে হয়তো কারো হাটে যাওয়ার দরকারই পড়ত
না। একেবারে লবণ আর কেরোসিনের মতো দ্রব্যের জন্য ঠেকে গেলে কাদামাটি মাড়িয়েই যেত। আর এখনও অনেকটা
সেরকমই অবস্থা। বর্ষা নামলে আর পথঘাট চলার মতো থাকে না। জেলা পরিষদ পতিসর আসার রাস্তাটা না করলে হাঁটা ছাড়া
উপায় ছিল না। তবে রাতবিরাতে কোনো যানবাহন মেলে না। আপনার ভাগ্য ভালো যে কাল রাতে একটা ভটভটি পেয়েছিলেন।
আমিও ট্রেন থেকে নেমে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভেবেছিলাম আহসানগঞ্জ একটা প্রসিদ্ধ জায়গা হবে। গঞ্জ বলে কথা— কিন্তু
স্টেশনে নেমে হতাশই হয়েছিলাম।

একসময় আহসানগঞ্জ প্রসিদ্ধই ছিল। ব্রিটিশ আমলে এখানে রমরমা পাটের ব্যবসা ছিল। আত্রাই নদীও তখন জীবন্ত আর
খরস্রোতা ছিল, এরকম মরা আত্রাই ছিল না। সেই নদীও নেই, বন্দরও নেই। দেশ ভাগ হয়েছে, নদীর মৃত্যু হয়েছে, নদীর
মতোই বন্দরও মরে গেছে। আহসানগঞ্জ থেকে বড় বড় নৌকায় পাটের চালান যেত কলকাতার পাটকলে। আসাম মেল
এখানে থামত। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে কখনো কখনো আসাম মেলে এখানে এসেই নামতেন। আত্রাই ঘাটে তাঁর জন্য
বজরা অপেক্ষা করত। বজরায় কবি পতিসর আসতেন। বর্ষাকালেই যাতায়াত বেশ সুবিধার ছিল। বজরায় সব ব্যবস্থা করা
থাকত-কবির জন্য বিশ্রামকক্ষ, আলাদা রান্নাঘর, আরও যতসব সুবিধা। কবি পতিসর এলে নাওয়া-খাওয়া বজরাতেই
করতেন।। নাগরে তো তেমন কোনো স্রোত কোনোকালেই ছিল না, আত্রাই আর গুড় নদী যেমন আঁকা-বাঁকা, তেমনি স্রোত
ছিল। কবি পথ চলতেন ধীরে ধীরে। চলতে চলতে নদীতীরের গ্রাম দেখতেন। নদীর ঘাটের জন-জীবন দেখতেন। মাঝিরা
স্রোতের টানে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে হাল ধরে আরাম করে বসে থাকত। দু’পারের মানুষ, ঘাটে স্নানরত বউ-ঝিরা মুখে
আঁচলচাপা দিয়ে আড়াল থেকে জমিদার দেখতো। আর প্রজারা দূর থেকেই জমিদারকে জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার
জানাত। কবি তাদের এই সম্মান জানানোর বিষয়টা বেশ উপভোগ করতেন।
আর শুকনো মৌসুমে কী করে আসতেন?
শুকনো মৌসুমে পালকী থাকতো। পালকীতে স্টেশন পর্যন্ত আসা-যাওয়া করতেন। আত্রাই থেকে পতিসর আসতে বজরা
কিংবা পালকি যা-ই হোক-কমসে কম ছয় ঘণ্টা সময় লাগত।
এত সময় লাগত!
কালীগ্রাম পরগণার বেশীরভাগই ছিল বিল আর জলাভমি। পথঘাট যা ছিল বছরের ছ’মাস জলের তলেই ডুবে থাকত।
জনবসতির ধার ঘেঁষে ঘুরপথে আসতে হতো। বেহারাদের পথ চলতে হতো সাবধানে।
এমন অজগাঁয়ে রবীন্দ্রনাথ আসতেন এটা এখনও বিশ্বাস করা কঠিন।
আপনি ছিন্নপত্র পড়েন নি?
পড়েছি, ছাত্রজীবনে।
তাহলে তো রবীন্দ্রনাথের সংগে পতিসরের সম্পর্ক আপনার জানাই আছে।
আসলে রবীন্দ্রসাহিত্যে নিসর্গের চিত্রায়ণ বোঝার জন্য ছাত্রজীবনে আমাদের ছিন্নপত্রাবলী পড়তে হয়েছিল।
ছিন্নপত্রাবলীতে বাংলার প্রকৃতির রূপ ও সৌন্দর্য অবলোকন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের
সম্পর্কের বিষয় ভেবে আমরা তখন ছিন্নপত্র পড়িনি। আর সত্যিকথা বলতে কি, রবীন্দ্রনাথের মানব উন্নয়ন ভাবনার চাইতে
প্রকৃতি ভাবনার বিষয়টাই আমাদের পাঠক্রমে এখনো গুরুত্ব দেয়া হয়।
রবীন্দ্রনাথ গ্রাম-বাংলায় ভ্রমণকালে প্রকৃতি আর ঋতুবৈচিত্র্য যেমন অবলোকন করেছেন তেমনি বাংলাদেশের গ্রামের
সাধারণ মানুষের জীবনযাপনও অবলোকন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মানুষগুলোকে না জানলে রবীন্দ্রনাথকে কেমন করে বোঝা
যাবে?
পূর্ববাংলায় রবীন্দ্রনাথের আসা-যাওয়া ছিল সেকথা তাঁর কোনো কোনো কবিতার নিচে টীকা হিসেবে আছে। কিন্তু
আমরা তো পতিসরের নাম তেমন করে শুনি না।
স্মৃতি সংরক্ষণ করতেও হয় আবার চর্চাও করতে হয়। জানেন, এখনও যদি আপনি গ্রামকে ভালো করে জানতে চেষ্টা
করেন হয়তো আপনার জানা থাকতেও পারে দেখতে পাবেন, সাধারণ মানুষ আগের মতোই সহজ-সরল আর কষ্টে
জীবন কাটাচ্ছে। এখনো ‘দুইবিঘা জমি’র সেই মহাজনদের গ্রামে দেখা যাবে। গ্রামে আজো সেই উপেন আছে। পাঁচুপুরের
মহাজন বাবুরা দেশভাগের পর কলকাতা চলে গেলে তাদের স্থান দখল করেছে এদেশের মুসলিম জোতদার মহাজন।
রবীন্দ্রনাথ সেকালে যেমন দেখেছিলেন, সাধারণ মানুষ একালেও আসলে সেই একই রকম জীবনযাপন করে।
কী রকম জীবনযাপন করে?
রবীন্দ্রনাথ যে রকম বলে গেছেন—
‘স্ফীতকায় অপমান
অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান
লক্ষ মুখ দিয়া; বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার;’
আসাদ বুঝতে পারছে, শশাঙ্ক বাবু রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভালোই পড়েছেন। তিনি রবীন্দ্রপল্লীভাবনার সঙ্গে কবিতা
মিলিয়ে পড়তে চান। পল্লীর মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি উদার ছিল। বিশেষ করে, দরিদ্র কৃষকদের প্রতি কবির
সহানুভূতির কথাই শশাঙ্কবাবু তুলে ধরতে চান। আসাদ এ বিষয়ে তেমন কিছু জানে না, তাই প্রসঙ্গটাকে একটু ঘুরিয়ে দিতে
চাইল।
এই সুন্দর বাড়িটা কি রবীন্দ্রনাথই বানিয়ে ছিলেন?
না। বাড়িটা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিনেছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা সংস্কার করিয়ে নিয়েছিলেন।
এখানে রবীন্দ্রনাথ কী কী লেখা লিখেছিলেন,
সেসব কি আপনার জানা গেছে? সে সব কি আর আমি বলতে পারব? আমি তো আর সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা করি নি। তবে কিছু কিছু লেখার কথা
সকলেই জানে। যেমন, ‘সন্ধ্যা’, ‘এবার ফিরাও মোরে’, ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ ছাড়াও চিত্রা ও চৈতালির কিছু কবিতা যে এখানে
লেখা তা কবিতার নীচেই লেখা রয়েছে। আর কোনো কোনো কবিতার খসড়া এখানে লেখা হলেও শিলাইদহ বা করকাতায়
গিয়ে শেষ করেন। কোনো কোনোটার খসড়া অন্যখানে রচিত হলেও এখানে এসে কবি চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন। চৈতালি ও
চিত্রার বেশ কিছু কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। আপনি পড়লে দেখবেন এখানকার গ্রাম, প্রকতি কত মূর্তিমান। অথচ
লেখার নিচে লেখা রয়েছে কলকাতা। কোথায় বসে লিখলেন সেটা বড় কথা নয়, কী লিখলেন আর কী ফুটিয়ে তুললেন
সেটাই আসল কথা। এই গাঁয়ের ছবি কবির অনেক কবিতাতেই পাওয়া যায়।

আসাদ এ বিষয়ে কিছু কিছু জানে। রবীন্দ্রনাথ তো নজরুলের মতো ছিলেন না, তাঁর ভেতর থেকে ঝড়ের মতো কবিতা
বেরিয়ে আসত না। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় একই সঙ্গে ভাবনা, চিন্তা আর বোধের পরিশীলিত সমন্বয় দেখা যায়। তিনি একটি
কবিতা লিখে বহুবার পরিশুদ্ধ করেছেন। যতক্ষণ না একটি কবিতার অবয়ব তাঁর মনে পূর্ণরূপ নিয়ে ধরা না দিয়েছে ততক্ষণ
পর্যন্ত তিনি এর শুদ্ধতার জন্য প্রতীক্ষা করেছেন, কাটাকুটি করেছেন। কাটাকুটির এসব খসড়া তো অনুপম কলমচিত্র হয়ে
সমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে গেছে। কিন্তু নজরুল তেমনটি করেন নি। তিনি অশান্ত ঝড়ের মতো ক্ষিপ্র গতিতে লিখেছেন। তাঁর
ভেতরে সবসময় যেন ঝড় বয়ে যেত। আসাদ শশাঙ্ক বাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভাবছিল, কিন্তু এ নিয়ে কথা বলল না।
সে শশাঙ্কবাবুর কথা শুনতে লাগল।
ররীন্দ্রনাথ মানবতা আর একেশ্বরবাদী কবি। কোনো ধর্মের সঙ্গেই তো তাঁর কাব্যাদর্শের বিরোধ নেই। তবে পতিসরে
রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার চাইতে আর্ত-মানবতার সাধনাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আপনার যদি এখানে থাকা হয়, ধীরে ধীরে
আপনিও এসব গ্রাম, গ্রামের মানুষ দেখতে পাবেন, মন দিয়ে দেখলে অনেক কিছু বুঝতেও পারবেন।
থাকবো না কেন?
থাকবেন কিনা সময় বলে দেবে। ভালো চাকুরি পেলে এরকম হতশ্রী পল্লীতে থাকবেন কেন? কবিগুরু ছিলেন। তার কথা
অবশ্য আলাদা। যদিও প্রথমবার এখানে এসে তিনি বলেছিলেন, আর কখনো এখানে আসবেন না।
কেন?
তাঁর মনে হয়েছিল, এটা কোনো থাকার মতো জায়গা নয়। এমন অজপাড়াগাঁ-পথ নেই, ঘাট নেই। কলকাতার সংগে
কোনো সম্পর্ক নেই। কেমন করে থাকবেন? কিন্তু দু’দিনেই এই হতশ্রী পল্লীকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন।
তার পর?
প্রতিবছর একাধিকবার কবি এখানে আসতেন। এসে বেশ কিছুদিন থাকতেন। কালীগ্রাম-পতিসরের সবখানে তাঁর
পদচিহ্ন পাওয়া যাবে। তাঁর পবিত্র পায়ের ছাপ এ মাটির সবখানে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু, খুঁজবে কে?
বুঝতে পারছি, রবীন্দ্রনাথ এখনো আপনার প্রাণে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন।
ঠিক বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সঙ্গে আছেন বলেই এখনো আমরা বেঁচে আছি। আর ভবিষ্যতেও আমাদের
রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই বাঁচতে হবে।


আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ। পথের দু’পাশে লাগোয়া ঘরবাড়ি ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে। অধিকাংশেরই মাটির দেয়াল। টিনের
চাল লাজুক বধুর মতো দেয়ালের অর্ধেক খানি ঢেকে রেখেছে। বৃষ্টি আর ঝড় থেকে বাঁচানোর জন্যই হয়তো এই আড়াল।
একটা-দুটা পাকা দালান অযাচিতভাবে চোখের সামনে এসে পড়ছে। গলিটা কোনো রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে স্কুলের ফটকের
সামনে থেমেছে। ফটকের মাথায় সিমেন্টের অক্ষরে লেখা-পতিসর কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউশন। প্রতিষ্ঠাতা: কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রতিষ্ঠা: ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ।
একটা ছোটো সবুজ মাঠ ঘিরে স্কুলঘর। সবকটি ঘর একরকমও নয়, আবার একই সময়ে তৈরীও হয় নি। ঘরগুলো
সময়ের চিহ্ন ধারণ করে আছে। নির্মাণও একই রকম নয়। পুরোনো ঘরটির ছাদ টালিতে ছাওয়া, দু’একটি টালি ভেঙেও
গেছে, মাটির দেয়ালে চিড় ধরেছে। দক্ষিণপাশে একটা নতুন দালান দেয়ালের ইটে পলেস্তরা এখনো লাগে নি; পূর্বপাশে
‘পতিসর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’, আর উত্তর পাশের ভবনটির দিকেই শশাঙ্ক বাবু হাঁটছেন। আসাদ তাকে অনুসরণ
করছে। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের চারপাশে গাছপালাও চোখে পড়ছে। মাঠে একটা গাইগরু ঘাস খাচ্ছে।
‘প্রধান শিক্ষক’
লেখা কক্ষে শশাঙ্ক বাবু প্রবেশ করলেন। সঙ্গে আসাদ করিম।
আদাব।
আসুন।
ইনি আবু করিম আসাদ।
আসাদ?
আমি ঢাকা থেকে এসেছি। আমাকে আশরাফ কবির পাঠিয়েছেন।
আশরাফ কবির, মানে আমাদের কবির?
জ্বী।
আপনি বাংলায় এমএ, লেখালেখি করেন?
জ্বী, একটু-আধটু লিখি।
কবির তো বলল, আপনি খুব ভালো গল্প লেখেন। আপনার লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তা আপনি মফঃস্বলে
এসেছেন কেন? এই অজ-পাড়াগাঁয়ে থাকতে পারবেন কি?
কেন পারব না?
অবশ্য লেখকদের বিচার-বিবেচনা আলাদা হয়। তারা কখন কী করেন, কোন অজপাড়া তাঁদের কখন ভালো লেগে যাবে
সেটা বলা মুশকিল। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ কলকাতা শহর ফেলে এই পতিসর-শাহজাদপুর এসে থাকবেন কেন।
রবীন্দ্রনাথ তো জমিদারি দেখাশুনা করতেই এখানে এসেছিলেন।
সেটা একটা অছিলা মাত্র। আসলে আসতেন মাটি আর মানুষের কাছে।
এতদূরে, এমন অজপাড়ায়?
তা অবশ্য ভেবে দেখার বিষয়। কী মায়ায় এই অখ্যাত জনপদে বারবার আসতেন সেটা কেউ ভেবে দেখেনি। একমাত্র
কবিই জানেন কেন আসতেন।
প্রধান শিক্ষকের কক্ষের দেয়ালে সাঁটানো রবীন্দ্রনাথের ছবিটা আসাদ দেখতে থাকে। ওর মনে পড়ছে শশাঙ্ক বাবু কবির
মর্ত্যভূমিতে নেমে আসার কথা বলেছিলেন। প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটির চরণগুলো আসাদের
পুনর্বার মনে পড়ল- ‘এইসব মুখে দিতে হবে ভাষা জাগিয়ে তুলিতে হবে আশা।’
দীর্ঘদিন যাবত বাংলার শিক্ষক নেই। বিজ্ঞপ্তি দিয়েও নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয় নি, কাউকে পাওয়া যায় নি। মফস্বলে কেউ
আসতেও চায় না। আপনি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি।
প্রধান শিক্ষক জানতে চাইলেন, শশাঙ্কবাবু, আসাদ সাহেবকে কোথায় থাকতে দিয়েছেন?
ছাত্রাবাসের একটা রুমে।
ঘরটা থাকার মতো অবস্থায় আছে কি?
পায়রাদের আস্তানা। আজ ঠিকঠাক করে দেব।
আসাদ সাহেব, এমন অজপাড়া গাঁয় একা থাকতে পারবেন তো? অবশ্য আপনি লেখক মানুষ নিভৃতে নির্জনে থাকতে
আপনার ভালো লাগতেও পারে। কী বলেন?
কোনো অসুবিধা হবে বলে মনে হচ্ছে না।
অসুবিধা মনে করলে বলবেন। কোনো বাড়িতে লজিং দিয়ে দেয়া যাবে। অনেকেই লজিং মাস্টার চায়। অবশ্য ইয়াং
মানুষের লজিং না থাকাই ভালো।
যেখানে থাকতে দিয়েছেন সেখানে কোনো অসুবিধা হবে বলে মনে করছি না। তবে রান্না করে খাওয়া আমার
জন্য সমস্যা হবে। এই কাজটা আমি কখনো করি নি।
এই সমস্যার সমাধান করা তো তাৎক্ষণিক সম্ভব নয়-মেয়ে দেখেটেখে তারপর। বুঝলেন, না জানিয়ে তাড়াহুড়ো করে
কিছু করবেন না। মনের মিল আছে কিনা জেনে টেনে নিলে ভালো করবেন। বুঝলেন। অনেকেই এই ভুলটা করে শেষে
পস্তায়। শেষে রান্নাও ভালো হয় না, বাদও দেয়া যায় না। বুঝলেন?
আসাদ কোনো মন্তব্য করল না। প্রধান শিক্ষক আর শশাঙ্ক বাবু দু’জনই রসিক মানুষ বোঝা যাচ্ছে। আসাদ অবাক হচ্ছে
প্রথম দিনই তারা আন্তরিক আর খোলামেলা কথা বলছেন। এখানেই কি শহরের সাথে গ্রামের তফাৎ? শহরে প্রথম পরিচয়ে
কেউ এমন করে কথা বলবে না। নিজে থেকে অন্যের সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসবে না। বরং উল্টোটাই করবে।
রহিমকে বলে দেব আপনার ভাত-তরকারি রান্না করে দিতে। সে সামান্য বেতনের দপ্তরি, তেমন ভালো কিছু রান্না
হয়তো হবে না। কিন্তু খারাপও না। আমি কখনো কখনো খেয়েছি। তার বাপদাদা সকলেই বাবুর্চি ছিল, সে নিজেও ভালো
রান্না করে। স্কুলে কোনো রান্নার দরকার হলে, মানে ইন্সপেকশন হলে তখন রান্নার দায়িত্ব নেয়। বাবুর্চিগিরিতে ওর
পূর্বপুরুষের একটা ঐতিহ্য আছে। যাক, ওর নাতিটা আপনার ছাত্র, সিক্সে পড়ে। ওকে বলে দেব টিফিন বাটিতে খাবার
প্রতিদিন সময় মতো দিয়ে যাবে।
সেরকম হলে আমার জন্য কিন্তু বেশ হবে। কিন্তু এতে তাদের ঝামেলা হবে।
শিক্ষকের জন্য এতটুকু সকলেই করবে।
আমি কিছু টাকা না হয় অগ্রিম দিয়ে রাখব।
সেটা দিলে তো বেশ ভালো হয়।
বাইরে ছাত্র-ছাত্রীরা ছুটাছুটি খেলছে। তাদের চীৎকার হৈচৈ কানে আসছে। পরিবেশটা আসাদের ভালো লাগছে। ওর
মনে হচ্ছে পুরো মাঠজুড়ে একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
যাক, আপনাকে পেয়ে ভালো হয়েছে। এখন থেকে আর মৌলবিকে দিয়ে বাংলা পড়াতে হবে না।
মৌলবি বাংলা পড়ান?
জ্বী। আর কেউ পড়াতে চান না। অবশ্য শশাঙ্ক বাবু পড়াতে চান। কিন্তু তিনি অঙ্কের ক্লাস নিতে গিয়ে আর বাংলা
পড়ানোর সময় পান না।
আর কেউ পড়াতে চান না কেন?
যেখানে মানি, সেখানেই হানি।
বাংলায় মধু নেই?
আমি সাহিত্যমধুর কথা বলছি না। শশাঙ্ক বাবুরা ভালো বুঝতে পারেন। ঠিক আছে তাহলে এই কথাই রইল। চলুন,
শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।
প্রধান শিক্ষক আসাদ করিমকে শিক্ষকদের বসার কক্ষে নিয়ে গেলেন। মাঝখানে লম্বা একটি টেবিল। দু’পাশে
বেশীরভাগ চেয়ারই শূন্য। প্রধান শিক্ষক ও শশাঙ্ক বাবু আসাদকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করলে সালাম বিনিময় হলো।
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
সবাই এখনো আসেন নি? বিজ্ঞানের রহিম সাহেব, ইংরেজির মাসুদ সাহেব এখনও আসেন নি? তারা ক্লাসের আগে চলে আসবেন।
যাক গে, ইনি আসাদ আহাম্মদ সরি, আবু করিম আসাদ। আমাদের বাংলার নতুন শিক্ষক।বাংলার শিক্ষক!
কী বললেন, বুঝলাম না, স্যার।
মৌলবির কথায় প্রধান শিক্ষক বিব্রত। কেউ কেউ তার মুখের দিকে আর কেউ কেউ আসাদ করিমের মুখের দিকে
তাকিয়ে যেন কিছু পরখ করছেন। শশাঙ্ক বাবু তাঁদের উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন।
আসাদ সাহেবকে আশরাফ, মানে আপনাদের কবির পাঠিয়েছে। তিনি বাংলায় অনার্সসহ এম. এ। তিনি এসেছেন
কবিরের অনুরোধে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিরের ছাত্র ছিলেন।
কখন নিয়োগ দিলেন, স্যার? আমরা তো কিছুই জানতে পারলাম না।
নিয়োগ হয়নি, হবে। আপাতত স্কুল ফান্ড থেকে বেতন হবে। আমরা পরে নিয়োগ রেগুলার করে নিতে পারব।
তাহলে আর কেউ আবেদন করতে পারবে না?
পারবে না কেন?
তখন যদি এর চাইতে ভালো কাউকে পাওয়া যায়?
পাওয়া গেলে নেবেন। আসাদ সাহেব তখন চলে যাবেন। আপাতত মৌলবি সাহেব বাংলা পড়াবার দায় থেকে রক্ষা
পাবেন। আপনাদেরও প্রক্সি ক্লাসের ঝামেলা পোহাতে হবে না।
আসাদ দেখছিল দেয়ালে দুটো ছবি একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আরেকটা পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। পিতা-পুত্রের
চেহারায় মিলের চাইতে অমিলই বেশী। এটাই যেন স্বাভাবিক ছিল। রথীন্দ্রনাথ যে কবিতা লিখতেন না সেটাও বোধহয়
মঙ্গলজনকই হয়েছে।
আসাদ সাহেব লেখালেখিও করেন।
আপনি কবিতা লেখেন?
না। গল্প।
গল্প?
আপনার গল্পের বই বাজারে পাওয়া যায়?
না। বই পাওয়া যায় না,
আপনি কেমন লেখক?
কেন, বই না থাকলে লেখক হয় না?
বই না থাকলে কী করে লেখক হয়?
কখনো কখনো পত্র-পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়।
পত্রিকা পড়ে আপনাকে লেখক বলে চিনব?
মওলানা সাহেব মনে হয় ইদানিং বেশ সাহিত্যটাহিত্য পড়েন। কবে থেকে এমন সুমতি হলো আপনার?
শশাঙ্ক বাবু, আপনার সঙ্গে কথা বলছি না। আপনাদের রবীন্দ্রনাথের বই ছাপা না হলে তাকে কে চিনত? তিনি কি বিশ্ব
কবি হতে পারতেন?
তা ভালো বলেছেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথ!
মওলানার কথার ধরনটা আসাদ খেয়াল করল। সে বুঝতে পারছে, এ যুগের মওলানারাও রবীন্দ্রনাথকে মেনে নিতে
পারেন না। সে ভাবছে, যে কবির কবিতা এদেশের জাতীয় সঙ্গীত সে কবিকে এখনো কেউ কেউ মেনে নিতে রাজি নন, কিন্তু
কেন? মওলানা তার কথা শেষ করেন নি। আসাদকে মওলানা প্রশ্ন করলেন,
তাহলে, আপনার বই কবে বের হচ্ছে?
ঠিক বলতে পারছি না আমি তো তেমন কোনো বিখ্যাত লেখক নই।
তাই বলেন! বই ছাপার মতো লেখা আপনি এখনো লিখতে পারেন নি!
আসাদ কোনো মন্তব্য করল না। সে বাইরে তাকিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ছুটাছুটি খেলা দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে ওর
শৈশবকালের দিনগুলো চোখে ভেসে উঠছিল। ওর মনে হচ্ছে, শৈশবের চাইতে সুন্দর সময় আর হয় না। ভাবনা শেষ না
হতেই ঘণ্টা পড়ে যায়।
ঘণ্টা পড়ে গেলে আসাদ শৈশব থেকে বর্তমানে ফিরে আসে। স্কুল মাঠে ছাত্রছাত্রীদের হৈচৈ থেমে গেছে। শশাঙ্কবাবু
ছাড়া অন্যান্য শিক্ষক যে যার মতো বেরিয়ে গেছেন। প্রধান শিক্ষক সবার শেষে উঠে দাঁড়ালেন।
আসাদ সাহেব, কিছু মনে করবেন না। মৌলবি সাহেবের কথার ধরণ এরকমই।
আমি কিছু মনে করিনি।
চলুন, এসেম্বিলিতে দাঁড়ালে ছাত্রছাত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে।
আচ্ছা, চলুন।
মাঠে ছাত্র আর ছাত্রী আলাদা সারিতে দাঁড়িয়েছে। ‘সোজা হও, আরামে দাঁড়াও’ বলে তাদের আরো শৃঙ্খলার মধ্যে আনা
হলো। শিক্ষকরা পতাকার কাছে এসে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছেন। দু’জন ছাত্র আর দু’জন ছাত্রী সামনে এসে দাঁড়িয়ে জাতীয়
সঙ্গীত গাওয়ার জন্য তৈরী।
জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো।
ছাত্র-ছাত্রীরা একসঙ্গে সেলুট করল। আসাদ ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে পতাকার প্রতি সম্মান দেখাল। অন্য কেউ হাত
না তোলায় বিব্রত বোধ করল। জাতীয় সঙ্গীত শুরু হলো। যদিও সুর-তাল কিছুই সঠিক নেই তবু ওর ভাবতে ভালো লাগল
একারণে যে প্রতিদিন এখানে কাজের শুরুটা জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে হয়। জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে কাজ শুরু করায়
একটি ভিন্নমাত্রা যোগ হয় বলে ওর মনে হচ্ছে। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলে প্রধান শিক্ষক কথা বললেন।
ছাত্রছাত্রীরা, তোমরা সকলেই পাঁচ মিনিট দাঁড়াও। আমি তোমাদের নতুন শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব। আসাদ
সাহেব, সামনে আসুন।
প্রধান শিক্ষক ডাকলে আসাদ সামনে এগিয়ে এলো। সব ছাত্র-ছাত্রী ওর দিকে হাসি হাসি মুখ আর চোখ নিয়ে তাকিয়ে
আছে। নিজেকে প্রথমবার ওর বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।
আসাদ সাহেব তোমাদের বাংলার নতুন শিক্ষক। তিনি তোমাদের বাংলা পড়াবেন। তিনি একজন লেখকও। তিনি বাংলা
সাহিত্যে অনার্সসহ এমএ। তিনি নিশ্চয় তোমাদের খুব সুন্দর করে বাংলা শেখাবেন।
প্রধান শিক্ষক কথা থামিয়ে আসাদের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন,
আসাদ সাহেব, আপনি আপনার ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
আমি আবু করিম আসাদ। এই তোমাদের দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।
আমাদের এতদিন বাংলার স্যার ছিল না। স্যার, আমরাও আপনাকে পেয়ে খুশি হয়েছি।
ধন্যবাদ। তোমাদের সঙ্গে আরো কয়েকটি কথা বলতে চাই। হেড স্যার কি আমাকে দু’মিনিট অনুমতি দেবেন?
বলুন, বলুন। অসুবিধা নেই।
আমরা প্রতিদিন স্কুলের কাজ কী ভাবে শুরু করি তোমরা বলতে পারো?
সকলেই চুপ করে থাকে। কেউ কেউ উসখুশ করতে থাকে। কিন্তু আসাদ যেন কথাগুলো না বলে পারবে না।
আমরা জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে স্কুল শুরু করি, তাই না?
জী, স্যার।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কে রচনা করেছেন তা তো তোমরা জানো।
জী, স্যার, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তাঁর কবিতা তো তোমরা পড়েছো?
জী, স্যার।
আচ্ছা, তোমাদের স্কুলের জন্য তোমাদের গর্ববোধ হয়?

Series Navigation<< উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// তিনউপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// পাঁচ পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *