শিশুতোষগল্প।। শীতকাতুরে প্রজাপতি।। কমলেশ রায়

কারোর প্রজাপতি অপছন্দ!
এটা কী হয়? হতে পারে? কিভাবে?
প্রজাপতি বলে কথা। দেখতে দারুণ। অনেক সুন্দর। ডানাগুলো রঙিন। কী
চমৎকার ওড়ে! ইচ্ছে মতো উড়ে বেড়ায়। ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়ায়। এক গাছ
থেকে আরেক গাছে। ডাল থেকে ডালে। পাতা থেকে পাতায়। ফুল থেকে ফুলে।
উড়ে উড়ে যায়। একটু বসে। খানিক জিরিয়ে নেয়। আবার ওড়ে। নেচে নেচে ওড়ে।
উড়ে উড়ে নাচে। উড়তে, বসতে নাচে।

ঝলমলে রোদ। প্রজাপতি উড়ছে। ডানা মেলে। গাছে গাছে। ডালে ডালে। ফুলে
ফুলে। পাতায় পাতায়। হাওয়ায় হাওয়ায়। দলে দলে। তালে তালে।
আহ্! কী মধুর দৃশ্য।
আমার তো বেশ লাগে। মন ভরে যায়। মন ভাল হয়ে যায়।
প্রজাপতি কার না ভাল লাগে? সবার ভাল লাগে। সবাই ভাবে: কোথায় পেলে ভাই
এমন রঙিন পাখা?
ব্যতিক্রম আছে? আছে। অন্তত একজন। কে সে?
রিদিমা। তার প্রজাপতি ভাল লাগে না।
রিদিমার মত ভিন্ন। পাখা রঙিন, ঠিক আছে। কোথায় পেল, এটাও ভাল প্রশ্ন। তাই
বলে সবার ভাই? এটা কেমন কথা?

এটা কথার কথা। আমি বলি।

বাবা বাজে কথা বলো না। একদম বলো না। তোমারও ভাই আমারও ভাই, এটা হয়?
আর সব ভাই, একটিও বোন নেই? এটা হয় নাকি! রিদিমা বিরক্ত হয়।
বড় হলে বুঝবে, কথার কথা কি। আমি ইচ্ছে করেই ওকে রাগাতে থাকি।
রিদিমা বলে, আমি কী কম বড়? তুমি না আমাকে সোনামা ডাকো।
তোমাকে তো আমি বুড়ি মাও ডাকি। আমিও কথার পিঠে কথা সাজাই।
সেটা তো আমার দাঁত পড়েছে বলে। ফোকলা দাঁত বের করে দেখায় রিদিমা। ভেংচি
কাটে।
আমি হাসি। হাসতে থাকি।
রিদিমা রেগে যায়। বলে, খালি কথা ঘোরাও। আবার হাসো। যাও তোমার সঙ্গে কথা
বলব না।
চুপিচুপি একটা কথা বলে রাখি। একেবারে আসল কথা। রিদিমা ভয় পায়।
প্রজাপতিকে ভয় পায়।

পেছনে ঘটনা আছে। সেটাও চুপিচুপি বলতে হবে। শুনতে পেলে রিদিমা রেগে
যাবে। ভীষণ রেগে যাবে। তার চোখ ছলছল করবে। বলবে, বাবা তুমিও পারো।
একই কথা সবার কাছে বলো।

তাহলে ঘটনাটা বলি। বলেই ফেলি। তবে ওই যে বললাম, চুপিচুপি।

পরীক্ষা শেষ। রিদিমা গেল দাদার বাড়িতে। সঙ্গে আমি আর ওর মা।

শীতকাল। গ্রামে যাওয়ার মজাই আলাদা। সকালে চারদিকে ঘন কুয়াশা। সূর্য ওঠে
দেরিতে। ডুবে তাড়াতাড়ি। দিন ছোট। বিকাল হতেই সন্ধ্যার আনাগোনা। কুয়াশাও
ঘিরে ধরে। রাত নামে আগেভাগেই। কনকনে উত্তুরে হাওয়া। বেজায় দাপুটে।
ঠাণ্ডা বয়ে নিয়ে আসে। টিনের চালে শিশির পড়ে। টুপটাপ। টুপটাপ।

কী যে শীত ! হাড়কাঁপানো। রিদিমা মজার নাম দিয়েছে। দাঁতকাঁপানো শীত। শীতে
শরীর কাঁপে। কথা বললে মুখ থেকে ধোঁয়া বের হয়। দাঁতে দাঁত বাড়ি খায়। আওয়াজ
হয়। তাই এই নাম।

শীতের সঙ্গে লড়তে হয়। গরম পোশাক, চাদর, মাফলার, কান টুপি, হাত মোজা।
সারা শরীর ঢাকা। শুধু চোখ দুটো খোলা। কাউকে চিনতে হয় পোশাক দেখে।
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। লেপ, কম্বলের ওমে শুয়ে থাকা। বেলা করে ওঠা।
সকালে রোদ পোহানো। খেঁজুরের রস খাওয়া। অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

গরম গরম পিঠা খেতে বেশ লাগে। হাঁসের মাংস, চিতই পিঠা, পাটি সাপ্টা,
খেঁজুরের গুড়ের পায়েস। আহ্ ! কী স্বাদ। মুখে লেগে থাকে।
রিদিমা তো ছড়া বানিয়ে ফেলেছে। মজার ছড়া।
’তোমরা কী এটা জানো?
পিঠা এত মিঠা কেন?
পিঠা খেতে মজা কেন?
আরে এত কথা কেন?
মিষ্টি কথা মিঠা কেন?
নিম পাতা তিতা কেন?
গুড় এত মিঠা কেন?
দুধ খেতে মজা কেন?
পিঠা তাই সেরা জেনো।’
এবার আসল কথায় ফিরি। ঘটনাটা বলা দরকার। আমি সেটাই বলতে চাই। রিদিমা
হয়ত ঠিকই বলে। ওর অভিযোগ, আমি এক কথা বলতে গিয়ে অন্যকথায় চলে
যাই। না, এবার শুধু ঘটনাটাই বলব।

আমাদের বাড়িটা ছবির মতো। আধাপাকা ঘর। সামনে উঠান। উঠানের পরই
সবজি ক্ষেত। মূলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন। একদিকে সিম আর লাউয়ের
জাঙ্গলা। তার নিচে পালং ও লাল শাক। বাড়ির সামনে রাস্তা। যেটা যোগ হয়েছে বড়
রাস্তায়। বাড়ির রাস্তার দু’ধারে গাছ। খেঁজুর গাছও আছে। একটা নয়, চারটে।
রাস্তার দু’পাশে দুটো ক্ষেত। একপাশে সরষে ক্ষেত। হলুদ আর হলুদ। আরেক
পাশে মটর কলাই। চোখ জুড়ানো সবুজ।

একদিন দুপুরে ঘটে ঘটনাটা। হলুদ সরষে ক্ষেতে যায় রিদিমা। একা একা।
প্রজাপতিরা রোদ পোহাচ্ছিল। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে ব্যস্ত। রিদিমা যাওয়ায় বিরক্ত
হয় তারা। উড়তে শুরু করে। মৌমাছিরা গুনগুন আওয়াজ তোলে। প্রজাপতির দল
এলোমেলো ছোটে। দু’চারটে উড়ে যায় ওর প্রায় শরীর ছুঁয়ে। চোখ-মুখের পাশ
দিয়ে।

ঘাবড়ে যায় রিদিমা। দৌড়ে চলে আসে বাড়িতে।
সেই থেকে প্রজাপতিকে ভয়। প্রজাপতি দেখলেই ভয় পায় সে।

দুই.

আরও একটি ঘটনা। ঘটেছে কিছুদিন বাদে। আমাদের বাসায়। এটাও বলতে হবে।
তবে চুপিচুপি। রিদিমা যেন না শোনে। এ গল্প বলতে সে আমাকে মানা করেছে।

তবুও বলছি।

স্কুলে নতুন বই দিয়েছে। রিদিমা খুব খুশি। বই খুব ভাল লাগে তার। হাতে নিতে ভাল
লাগে। উল্টে পাল্টে দেখতে ভাল লাগে। নতুন বইয়ে আলাদা গন্ধ। সেটাও তার খুব
পছন্দ। টেবিলে বইগুলো সে গুছিয়ে রাখে। একটা বই বের করে। দেখে আবার
রেখে দেয়। খুব সাবধানে। যত্ন করে।

টেবিলে মন দিয়ে বই দেখছিল রিদিমা। হঠাৎ চোখ গেল টিউবলাইটের দিকে। কি
যেন উড়ছে। তাকিয়েই চিৎকার দিলো সে।

ছুটে গেলাম। দেখি প্রজাপতি।

রিদিমা ভয়ে কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে আছে।
চিৎকারে প্রজাপতিটাও যেন ভয় পেয়েছে। রুমের মধ্যে এদিক-ওদিক উড়ছে।
তারপরও আমি বললাম, কি হয়েছে সোনামা?
বাবা, প্রজাপতিটাকে বের করো। ঘর থেকে বের করো। রিদিমা জোর গলায় বলল।
আরে থাকুক না। কি হয়েছে?
আমার ভয় করে। রিদিমা বলল।
বেচারা বিপদে পড়ে এসেছে। ওকে বের করে দেওয়া ঠিক হবে না।
ওর আবার কিসের বিপদ?

আজ কি শীত পড়েছে দেখেছো। বাইরে তো আরও বেশি ঠাণ্ডা। ও তাই আমাদের
ঘরে ঢুকেছে। আমি বললাম।

কেন, ঘরে ঢুকেছে কেন? ইচ্ছে হলেই ঘরে ঢুকবে? রিদিমা বিরক্ত।

ওরা শীত সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া ওড়ার জন্য ওদের শরীরের তাপমাত্রা ঠিক
রাখতে হয়। তাপমাত্রা কমে গেলে ওরা ঠিকমতো উড়তে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে
প্রজাপতিটা ঘরে ঢুকেছে। ঝুঁকি আছে জেনেও এসেছে। বিষয়টা কী তুমি বুঝতে
পেরেছো?

পেরেছি। তা ওড়ার জন্য ওদের শরীরের তাপমাত্রা কত থাকতে হয়? রিদিমা প্রশ্ন
করল। মনে হলো সে একটু ধাতস্থ হয়েছে।

শরীরের তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রির বেশি হলেই কেবল প্রজাপতিরা উড়তে পারে।
এজন্য শরীর গরম রাখতে শীতের দিনে তারা রোদ পোহায়। ওরা কিন্তু নিরীহ প্রাণী।
ওদেরকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি শুধু শুধু ভয় পাও।

রিদিমা মন দিয়ে আমার কথা শুনল। ততক্ষণে প্রজাপতিটি টিউবলাইটের পাশে
চুপটি করে বসেছে।

বাবা দ্যাখো, প্রজাপতিটা টিউবলাইট পোহাচ্ছে। রিদিমা বলল। তার চোখ ওদিকে।
মন দিয়ে দেখছে।

ওর বলার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেললাম।

তিন.

চুপিচুপি আরেকটা ঘটনা বলব। এটাই শেষ। অন্তত আজকের জন্য। এবারের
গল্পটা একটু অন্যরকম। ভয়কে জয় করার। মন ভাল হয়ে যাওয়ার মতো।
শৈত্যপ্রবাহে কাবু সবাই। দীর্ঘ শীতল রাত। সবে সোয়া সাতটা বাজে। মনে হচ্ছে
অনেক রাত। নিরবতাও বেশি। সন্ধ্যার পরই রাস্তা প্রায় ফাঁকা। অকারণে কেউ
বাইরে নেই। ঘরে ফিরে গেছে।

আমিও বাইরে যাইনি। ছুটির দিন। লেপের নিচে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম। রিদিমা
এসে আমাকে ডাকল। বলল, বাবা দেখে যাও। তার গলায় চাপা উত্তেজনা।

ওঠলাম। ইশারায় সে বলল শব্দ না করতে।

ওর পড়ার ঘরে গেলাম। যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য। টিউবলাইটের আশপাশে সাত সাতটা
প্রজাপতি। উত্তাপ নিচ্ছে। নির্ভয়ে।

পা টিপে বেরিয়ে এলাম। ইশারায় রিদিমাকে বললাম আমার সঙ্গে আসতে। শোবার
ঘরে ফিরলাম। আমি আগে। ও আমার পিছুপিছু।

এত প্রজাপতি কিভাবে এলো ? আমি জিজ্ঞেস করলাম। এবার আমার গলায়
উত্তেজনা।
বিকালে বারান্দায় গেলাম। দেখি ওরা ঘোরাঘুরি করছে। বুঝলাম শীতে কাতর। আজ
তো সূর্যই ওঠেনি। মায়া হলো। থাই গ্লাসটা একটু ফাঁকা করে রাখলাম। যাতে ওরা
ঢুকতে পারে। রিদিমা বলল।

ভয় পাওনি?
না, পাইনি। প্রাণীগুলো শীতে কষ্ট পাচ্ছে। আর আমরা আরামে আছি। এটা হয়,
বলো বাবা?

আমি কিছু বললাম না। রিদিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হলো হঠাৎ
করেই সে বড় হয়ে গেছে। আকারে নয়, মনে। ভাবনায়।

কী হলো, কথা বলছো না কেন ? আজ কিন্তু আমি আরেকটা কাজ করব। পড়ার
ঘরের লাইট বন্ধ করব না। সারারাত জ্বলবে। প্রজাপতিরা একটু আরামে থাকুক। কী
বলো?

আমি আর কি বলব। আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। রিদিমার নাকটা টিপে দিয়ে
বললাম, তোমার যা ইচ্ছে করো।

তুমি তাহলে মাকে বুঝিয়ে বলো। শোবার আগে মা সব ঘরের লাইট বন্ধ করে। আজ
ও ঘরের লাইট যেন বন্ধ না করে।
মাথা নেড়ে বললাম, আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার মা আজ লাইট বন্ধ করবে না।
রিদিমার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। শীতের রাতেও সেই উত্তাপ আমাকে ছুঁয়ে গেল।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *